খেই হারিয়ে ফেলেছি বলে
যেদিকে হেঁটে যাচ্ছ হে বিষণ্ন বংশীবাদক
আমি ঠিক পিছু পিছু ছুটছি
. ছুটছি তো ছুটছিই
দেখি কতদূর নিয়ে যাও
কতদূর গিয়ে থামাও তোমার অভিযাত্রা
তারপর সেখানে কী আছে?
আসলে এসব নাটকের শেষদৃশ্যটা
আগে থেকে জানা থাকে না কারও
এমনকী হে বংশীবাদক তুমিও জানো না
ঝরনা আর জঙ্গলের পথ পাড়ি দিলে যে
দুরূহ পাহাড়
. তার আসল নাম কী?
দেখি কতদূর নিয়ে যাও
কতদূর গিয়ে তুমি থামো
আর আমি ঠিক এভাবেই চলি এলোমেলো হেঁটে
বিচ্ছেদ
আমরা হয়তো সুখী হতে পারতাম
দুর্বিনীত এ জলোচ্ছ্বাস না এলে
উল্টে নাগেলে জীবনের যাবতীয়;
আমাদের মাঝে সেতুবন্ধন হতো
তখন গভীর নয়ন দু’জনে মেলে
অনন্তকাল মুখোমুখি থাকতাম
আমাদের পাশে আলোর শিশুরা এসে
খেলা করে যেত—কত কথা বলে যেত
হাসনাহেনার ঘ্রাণ জোছনায় ভেসে
আসতো এ ঘরে, আমরা তখন লীন—
দূর কোনো বনে হারিয়ে গিয়েছি একা
একঝাঁক পাখি ডানার শব্দ তুলে
অদূরে নদীর জল ঘেঁষে উড়ে যেত
শান্ত, উদাস—হাতে হাত রেখে বসে
আমরা পেতাম শান্তি, প্রেমের খোঁজ
এত চোরাবালি যদি না থাকতো পথে
আমরা হয়তো সুখী হতে পারতাম
কিছুটা স্বপ্ন জীবিত থাকতো যদি
কিছুটা দরদ যেন কোনো উপশম
মাঝখানে যদি কাচের দেয়াল এসে
না দাঁড়াতো, যদি দূরের আয়না ছুঁয়ে
ফিরে না আসতো আমাদের কথামালা
তাহলে হয়তো সুখী হতে পারতাম
হয়তো তখন আমাদের পাশ দিয়ে
একঝাঁক শাদা রাজহাস চলে যেত
পাশের পুকুরে, যেন শাপলার ফুল
সময়টা ঠিক দুরন্ত এক মৃগ
চোখের পলকে বনের ভেতরে লীন
এভাবেই যায় অনেক কিছুই মিটে
এগিয়েও আসে ঘোর অমানিশা দিন
নারী কি তাহলে পাহাড়ের পাদদেশে
যেকোনো বাতাসে নড়ে ওঠা কাশফুল
কখনো দখিন কখনো পূর্বে দোলে?
মাঝে মাঝে তবু হিসাব মেলাতে বসি
এমন না-হলে হয়তো অমন হতো
সম্পর্কের নানান হিসাব কষি
মাঝে মাঝে বুকে জমা হয় গাঢ় ক্ষত
কিছু দোষ তুমি আমাকেও দিয়ে রেখো
কিছু দোষ আমি তোমাকেও দেই বটে
দূর থেকে চেয়ে আড়চোখে সব দেখো
আমিও ভাবব, কেন যে এসব ঘটে?
আমরা হয়তো সুখী হতে পারতাম
যদি সবকিছু না যেতো বানের জলে
যদি হাতে হাত রেখে হেঁটে চলতাম
সব ভালোবাসা না হারাতো রসাতলে
‘হয়তো’, ‘যদি’তে এখন কী লাভ আর
সবকিছু ভেঙে হয়ে গেছে চুরমার।
আশাবাদ
সবকিছু এককালে ঠিক হয়ে যায়
অন্ধও নিজের পথ নিজে করে নেয়—নিজের লাঠিতে
ভর করে চলে; খাবার চাইতে হয়
কিভাবে এ কথা বোবারাও জেনে যায়—আর
বধিরও শুনতে পায় প্রিয় শব্দমালা
কষ্টের মুকুট জানি ক্যাকটাসে গড়া
তবু দেখো এ মুকুট মাথায় জড়িয়ে
কেউ কেউ চলে যায় গন্তব্যের পথে
থমকে দাঁড়িয়ে আছে—এ বিষয় মানুষের ইতিহাসে নেই
যাতনার সোপান পেরিয়ে অবরুদ্ধ উপত্যকা বেয়ে
মানুষ ঠিকই পায় আলোর ঠিকানা
দুর্নিবার ইচ্ছা পারে পথ খুলে দিতে—
সবকিছু এককালে ঠিক হয়ে যায়
নাপাম গার্ল
পেছনে বোমায় বিধ্বস্ত জনপদে আগুন জ্বলছে—
ধোঁয়ার কুণ্ডুলী চারপাশে, আর পিচ-রাস্তা ধরে
বস্ত্রহীন শিশুরা পালিয়ে যায় নগ্ন পায়ে
. অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে—
তাদের কান্নার ঠিক পেছনেই
সামরিক বাহিনীর বন্দুকের নল
সামনে কোথাও নেই সহায়ের হাত, সান্ত্বনার বুক
হে যুদ্ধ—আকাশ ছেড়ে নেমে আসা আগুনের গোলা
ট্যাংক-কামান, বলো—এরা এখন কোথায় যাবে
. কার কাছে যাবে
এদের ঘর পুড়ে গেছে, খেলার মাঠের ঘাস মরে
হয়ে গেছে ফ্যাকাশে, বিবর্ণ—এরা এখন কোথায় যাবে?
হে ধ্বংস, বলো—সব কিছু হারিয়ে এখন
. এরা কেন নিখিলের যাত্রী?
(বি. দ্র. পুলিৎজার পুরস্কারজয়ী আলোকচিত্র ‘নাপাম গার্ল’ অবলম্বনে। ১৯৭২ সালের ৮ জুন ভিয়েতনামের ট্যাং ব্যাং শহরে নাপাম বোমা হামলার পর আট-দশ বছরের একদল শিশু আতঙ্কে পালায়। এ দৃশ্যটি ক্যামেরায় ধারণ করেন এপির আলোকচিত্রী নিক উট। এটি এখনো ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতীক হয়ে আছে। )
ছাইরঙা নাই ট্রেন
৩.
না চাইলেও এই ট্রেন নিয়ে যায় দূরের স্টেশনে
যেখানে সন্ধ্যার কালো পর্দা পড়েছে
অন্ধকার বনে বসে একটি বিরল পাখি
অক্লান্ত ডাকছে, না চাইলেও দূরের বনের ঠিক মাঝখানে
অচিনপুর স্টেশনে নিয়ে যাবে অবাধ্য ট্রেনটি
. হুইসেল বাজায় কেবল, তার
যাওয়ার শব্দ কেউ শুনতে পায় না, কেবল বধির ছাড়া
তাকে দেখেও না কেউ, কেবল জন্মান্ধ ছাড়া
ট্রেন চলে যায় দূর স্টেশনের দিকে
মধ্যরাতে যখন সমুদ্রে ঢেউ নিয়ে মেতে ওঠে জ্যোৎস্না
নৃত্যরত সাপের শরীরে চিকচিক ঘাস
স্থির পায়ে বনের ভেতরে শিকারসন্ধানী বাঘ
আর খুব নরম একটি ঘ্রাণ মৃত্যুর মতোই রহস্যের
তখন সে এক শান্ত কোলাহলহীন লোকালয় দিয়ে
চলে যায়; দেখি অলীক, মোহন ট্রেন
ভেতরে দেখতে পাই মহাফেজখানা পোড়াভস্ম, আর
ফারাও এখনাটনের মমি করা দেহ
৭.
কোনো এক চন্দনীর রাতে ট্রেন ছাড়ে জঙ্গলের দিকে
তখন হয়তো কুয়াশায় ঢেকে গেছে মাঠ, নদীটির ত্বকে
ছুঁয়ে ছুঁয়ে তারা চলে যাচ্ছে দূরে
স্থির চিত্র হয়ে আছে লোকালয়—
কোথাও শব্দ নেই, সাড়া নেই
সেই রাতে
রাহুচণ্ডালের হাড় না পেয়ে বেদের দল
দূরের একলা মাঠে বিলাপ করছে বসে একসঙ্গে
ক্লান্ত এই ট্রেন রওয়ানা করবে, যখন আলোর পাখি
রাস্তায়, গোরস্তানে, ঝোপেঝাড়ে ছড়িয়ে দিয়েছে আগুনের কণা—আর
হাসনাহেনার ঘ্রাণে মাতাল হয়েছে রাত
তখনই এ ট্রেন দুর্গম বনের দিকে চলে যাবে নিয়ে
যেখানে একটি পেঁচা চোখ বড় করে
. বাশের পাতার ফাঁকে তাকিয়ে রয়েছে
১৫.
এ এক আজব স্টেশন, এখানে স্পার্টান
যোদ্ধাদের ঢাল ও তলোয়াড়, খুলি
পড়ে আছে সংগ্রহশালায়—পিরামিডের পাথরে
লুকিয়ে রয়েছে খুফু, বেবিলন এশিরিয়া
এখনো বালুর পিঠে স্মৃতি হয়ে আছে
কেবল তারাই নেই, যারা একদিন ইউফ্রেটিস তীরে
শস্যবীজ বুনেছিল, ঘাসের পাহাড়ে
ঘোড়া ও ভেড়ার পাল
চিহ্ন রয়ে গেছে সেই সুদৃশ্য বাগানের
সিন্ধু নদের তীরে মহেঞ্জোদারোর প্রশস্ত রাস্তায়
মাটির প্রগাঢ় স্তর, চিহ্ন রয়ে গেছে
মানুষের পদচিহ্ন নিয়ে কবে মহাস্থানগড়
পুণ্ড্রনগরী বিরাণ হয়েছে, অথচ এ ট্রেন
পেয়েছে কি নিরলস গতি!