বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চা, গবেষণা ও প্রচারের লক্ষ্যে ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩ ডিসেম্বর বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা হয়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন-পরবর্তীকালের প্রেক্ষাপটে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার দাবি ওঠে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন ‘বর্ধমান হাউজ’-এ এই প্রতিষ্ঠানের সদর দপ্তর স্থাপন করা হয়।
বাংলা একাডেমির প্রধান ভবন বর্ধমান হাউজ
বাংলা একাডেমি স্থাপন ও সংগঠনের চিন্তা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ প্রথম করেন। ১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর ‘পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে’ ভাষা-সংক্রান্ত একটি একাডেমি প্রতিষ্ঠার দাবি করেন তিনি। এছাড়া দৈনিক আজাদ পত্রিকা বাংলা একাডেমি গঠনে জনমত সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। ১৯৫২ সালের ২৯ এপ্রিল পত্রিকাটি ‘বাংলা একাডেমী’ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা জানিয়ে এই প্রসঙ্গে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। এই ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ওই সময় কিছু প্রচেষ্টা নেয়। ১৯৫৪ সালে এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রস্তাবও গ্রহণ করা হয়। কিন্তু অর্থাভাবে প্রস্তাবটি বাস্তবায়িত হয়নি। এরপর ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হলে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী সৈয়দ আজিজুল হক।
অবশেষে ১৯৫৫ সালে ৩ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার উদ্বোধন করেন ‘বাংলা একাডেমি’। বাংলা একাডেমির প্রথম সচিব হন মুহম্মদ বরকতুল্লাহ। ১৯৫৬ সালে একাডেমির প্রথম পরিচালক নিযুক্ত হন অধ্যাপক ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক। বাংলা একাডেমির প্রথম প্রকাশিত বই আহমদ শরীফ সম্পাদিত দৌলত উজির বাহরাম খান রচিত ‘লায়লী-মজনু’। স্বাধীনতার পর থেকে একাডেমি চত্বরে স্বল্প পরিসরে বইমেলা শুরু হয় এবং ১৯৭৪ সাল থেকে বড় আকার ধারণ করে।
২০০৯-২০১১ খ্রিষ্টাব্দে একাডেমির বর্ধমান হাউজ ভবনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় ভাষা আন্দোলন জাদুঘর স্থাপিত হয়েছে।
সাংগঠনিক কাঠামো
বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বাংলা একাডেমি একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। একাডেমির কার্যনির্বাহী প্রধান হলেন মহাপরিচালক। প্রথম মহাপরিচালক ছিলেন প্রফেসর মযহারুল ইসলাম। বর্তমান মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী।
বাংলা একাডেমির বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পাদনের জন্য ৪টি বিভাগ রয়েছে। বিভাগগুলো হচ্ছে: (ক) গবেষণা, সংকলন ও ফোকলোর বিভাগ (খ) ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও পত্রিকা বিভাগ (গ) পাঠ্যপুস্তক বিভাগ (ঘ) প্রাতিষ্ঠানিক পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণ বিভাগ।
গ্রন্থমেলা
উইকিপিডিয়া বলছে, গ্রন্থমেলায় আগ্রহী কথাসাহিত্যিক ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সাবেক পরিচালক সরদার জয়েনউদ্দীন আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ উপলক্ষে ১৯৭২ সালে ডিসেম্বরে একাডেমি প্রাঙ্গণে একটি আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলার আয়োজন করেন। সেই থেকেই বাংলা একাডেমিতে বইমেলার সূচনা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলা একাডেমির একুশের অনুষ্ঠানে কোনো বইমেলা হয়নি। তবে বাংলা একাডেমির দেয়ালের বাইরে স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্সের রুহুল আমিন নিজামী সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রগতি প্রকাশনের কিছু বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসেন। তার দেখাদেখি মুক্তধারা প্রকাশনীর চিত্তরঞ্জন সাহা ও বর্ণমিছিলের তাজুল ইসলামও তাদের বই নিয়ে বসে যান। ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে একটি বিশাল জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই মেলার উদ্বোধন করেন। এই উপলক্ষে নিজামী, চিত্তরঞ্জন ও বর্ণমিছিলসহ সাত-আটটি প্রকাশনীর কর্ণধার একাডেমির ভেতরে পূর্ব দিকের দেয়ালঘেঁষে বই সাজিয়ে বসে যান। ওই বছরই প্রথম বাংলা একাডেমির বইয়েরও বিক্রয়কেন্দ্রের বাইরে একটি স্টলে বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়।
অমর একুশে গ্রন্থমেলা
প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে বাংলা একাডেমি একটি জাতীয় বই মেলার আয়োজন করে যা অমর একুশে গ্রন্থমেলা নামে আখ্যায়িত হয়। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের ২১ তারিখ বাংলা ভাষার জন্য আত্মোৎসর্গের যে করুণ ঘটনা ঘটে, সেই স্মৃতিকে অম্লান রাখতেই এই মাসে আয়োজিত এই বইমেলার নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। ১৯৮৪ সাল থেকে বাংলা একাডেমি আয়োজিত বইমেলাকে অমর একুশে গ্রন্থমেলা নামকরণ করা হয়।
পত্রিকা প্রকাশনা
বাংলা একাডেমির প্রথম প্রকাশনা ‘বাংলা একাডেমি পত্রিকা’ প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৯৫৭-র জানুয়ারি মাসে। ‘উত্তরাধিকার’ সৃজনশীল মাসিক সাহিত্য পত্রিকা। এটি ১৯৭৩ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। বাংলা একাডেমি বার্তা, বাংলা একাডেমির ত্রৈমাসিক মুখপত্র লেখা ২০০৯ সালের আগস্ট থেকে ‘বাংলা একাডেমি বার্তা’ নামে প্রকাশ করা হচ্ছে। ধানশালিকের দেশ, কিশোরদের জন্য প্রকাশিত ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা।
পুরস্কার
বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার বাংলা ভাষার অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ সাহিত্য পুরস্কার। এছাড়া, বাংলা একাডেমি কয়েকটি পুরস্কার দেয়। এগুলো হলো: রবীন্দ্র পুরস্কার, চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার, সরদার জয়েনউদ্দীন স্মৃতি পুরস্কার, পলান সরকার স্মৃতি পুরস্কার, মোহাম্মদ নুরুল হক গ্রন্থ–সুহৃদ পুরস্কার।