শিল্প-সাহিত্যশ্লিষ্টদের যত তীর্থস্থান আছে, তার মধ্যে সম্ভবত একনম্বরে রয়েছে ফ্রান্সের রাজধানীর প্যারিস। আর এই প্যারিসের সবচেয়ে বড় পর্যটন কেন্দ্র হলো আইফেল টাওয়ার। সম্পূর্ণ লোহা দিয়ে ১৮৮৭ সালে প্যারিসের শ্যেইন নদীর কাছে এই টাওয়ার তৈরির কাজ শুরু হয়।
১৮৮৭ সালে এই টাওয়ার নির্মাণের বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল। ওই সময় ফরাসি বিপ্লবের শর্তবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে দেশটির সরকার বহুমুখী উদ্যোগ নেই। এর একটি হলো ফরাসি বিপ্লবের শতবর্ষকে স্মরণীয় করে রাখতে একটি প্রতীকী টাওয়ার তৈরির সিদ্ধান্ত। সরকার এই কাজের জন্য নির্বাচন করে প্রকৌশলী আলেকজান্ডার গুস্তাভ আইফেলকে। আর তার নামানুসারেই ৯৮৪ ফুট উঁচু এই টাওয়ারের নামকরণ করা হয় ‘আইফেল টাওয়ার’। গুস্তাভ আইফেলের নামে এই টাওয়ারের নামকরণ হলেও এটির ডিজাইন করেছিলেন প্রকৌশলী মরিস কোয়েচিন ও এমিল নউগুইয়ার।
শুরুতে প্যারিবাসীর সমালোচনা
ফরাসি স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন এই আইফেল টাওয়ারকে প্রথমদিকে প্যারিবাসীরাই পছন্দ করেনি। এই টাওয়ার তৈরির প্যারিবাসীর মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তারা টাওয়ারটিকে শহরের অন্যান্য স্থাপনার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ বলেও পত্র-পত্রিকায় অভিমত প্রকাশ করতে লাগলেন।
তৈরি করতে সময় লেগেছিল ২ বছর ২ মাস ৫ দিন
১৮৮৭ সালের ২৮ জানুয়ারি আইফেল টাওয়ার তৈরির কাজ শুরু। কাজ শেষ হয় ১৮৮৯ সালের ৩১ মার্চ। এই হিসাবে মোট সময় লেগেছিল ২ বছর ২ মাস ৫ দিন। ৩০০ শ্রমিকের কঠোর পরিশ্রমে দুই একর জমির ভিত্তির ওপর এটি তৈরি হয়। এর চূড়া থেকে ৭৫ কিলোমিটার পর্যন্ত এক নজরে দেখে নেওয়া যায়।
বেতার তরঙ্গ হিসেবে ব্যবহার
আইফেল টাওয়ারের উচ্চতাকে কাজে লাগানোর নতুন নতুন পরিকল্পনা করে ফরাসি সরকার। এরই অংশ হিসেবে ১৯০৯ সালে এর চূড়ায় বসানো হয় একটি বেতার অ্যান্টেনা। এর মাধ্যমে টাওয়ারটি বেতার তরঙ্গ পাঠানোর কাজেও ব্যবহৃত হচ্ছে। এই অ্যান্টেনা বসানোর পর এর উচ্চতা বাড়ে আরও ৬৬ ফুট। টাওয়ারের চূড়ায় ওঠার জন্য ১ হাজার ৬৬৫টি ধাপ রয়েছে। রয়েছে লিফটও। তবে, যখন ১৮৮৯ সালের ৬ মে দর্শনার্থীদের আইফেল টাওয়ারে প্রবেশের অনুমতি দেয় ফরাসি সরকার, তখন এতে কোনো লিফট ছিল না। ফলে ওই সময় ৩০ হাজার দর্শনার্থীকে টাওয়ারটির ১ হাজার ৬৬৫টি ধাপ বেয়ে চূড়ায় উঠতে হয়।
নির্দিষ্ট কোনো রঙ ব্যবহার করা হয়নি
টাওয়ারটিতে কোনো নির্দিষ্ট রঙ ব্যবহার করা হয়নি। তবে, আবহাওয়ার সঙ্গে খাপা খাওয়ানোর জন্য ওপরের অংশে কিছুটা গাঢ় রঙ ব্যবহার করা হয়েছে। নিচের দিকে হালকা রঙ। প্রতি সাত বছর পর পর রঙ করা হয়। পুরো টাওয়ার রঙ করতে সময় লাগে ১৮ মাস। আর এতে রঙ লাগে প্রায় ৬০ মেট্রিক টন।
সবচেয়ে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠার সময়
আইফেল টাওয়ার, প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত প্রতি ঘন্টায় ৫ মিনিটের জন্য ঝলমল করে ওঠে। টাওয়ারটির আলোকসজ্জায় প্রায় ৩৩৬টি প্রজেক্টর এবং ২০,০০০টি বাল্ব ব্যবহার করা হয়েছিল।
ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যপূর্ণ স্থানের তালিকায়
১৯৯১ সালে আইফেল টাওয়ারকে বিশ্ব ঐতিহ্যপূর্ণ স্থানের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে ইউনেস্কো।
বছরে প্রায় ১০ লাখ দর্শনার্থী জমায়েত হয় টাওয়ারে
প্রতি বছর প্রায় ৭০ লাখ দর্শনার্থী এই টাওয়ার দেখতে জমায়েত হয়। এর ভেতরে দুটি রেস্তোঁরা রয়েছে। রয়েছে একটি সংবাদপত্র অফিসও। এছাড়া রয়েছে পোস্ট অফিস, বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার ও থিয়েটার।
একনজরে আইফেল টাওয়ার
- ১৮৮৭ সালে শুরু হয়ে ১৮৮৯ সালে আইফেল টাওয়ার নির্মাণ কাজ শেষ হয়।
- প্রকৌশলী গুস্তাভ আইফেলের নামানুসারেই এই টাওয়ারের নামকরণ করা হয়। টাওয়ারটির প্রধান স্থপতিও তিনি।
- প্রায় ১৮ হাজার বিভিন্ন আকৃতির লোহার কাঠামো জোড়া লাগিয়ে টাওয়ারটি নির্মাণ করা হয়।
- আইফেল টাওয়ারের ওজন প্রায় দশ হাজার টন।
- আইফেল টাওয়ারে প্রতি সাত বছর পর পর প্রায় ৬০ মেট্রিক টন রঙের প্রলেপ দেওয়া হয়।
- এই টাওয়ারে রয়েছে তিনটি প্ল্যাটফর্ম। প্রথম প্ল্যাটফর্ম মাটি থেকে ১৯০ ফুট উঁচুতে। দ্বিতীয় প্ল্যাটফর্ম ৩৭৬ ফুট ওপরে। আর তৃতীয়টির ৯০০ ফুট ওপরে।
- পুরোপুরি আলোকিত করতে এই টাওয়ারে বিশ হাজার বাল্ব ব্যবহার করা হয়।
- আইফেল টাওয়ারকে স্থানীয়রা চেনে অন্য নামে। তাদের ভাষায় এটি ‘লা দামে দ্য ফার’। বাংলায় ‘লোহার নারী’।
- ১৮৮৯ সালের ১০ সেপ্টেম্বর টমাস এডিসন এই টাওয়ার পরিদর্শন করেন। তিনি পরিদর্শন লিখেছেন, ‘শ্রদ্ধা জানাই সেই সাহসী প্রতিষ্ঠাতা ও প্রকৌশলী এম আইফেলের প্রতি, যিনি আধুনিক প্রকৌশলের নিদর্শনস্বরূপ এই বিশাল ও মৌলিক সৃষ্টির জন্য টমাস এডিসন, বন ডিউ-এর মতো বিশ্ববিখ্যাত প্রকৌশলীসহ সব প্রকৌশলীর জন্য গর্বের ও মর্যাদার।’
- ১৯১০ সালে ফাদার থিওডর উলফ টাওয়ারের পাদদেশ ও চূড়ার বিকিরিত শক্তি পরিমাপ করেন, যা প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি ছিল। কসমিক রশ্মি তখনই আবিষ্কৃত হয়।
- ১৯১২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ফরাসি দর্জি ফ্রাঞ্জ রেইচেল্ট নিজের তৈরি প্যারাস্যুট নিয়ে আইফেল টাওয়ারের ৬০ মিটার ওপর থেকে লাফিয়ে পড়েন। এতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
- ১৯২৫ সালে ভিক্টর লাস্টিগ নামে একজন শিল্পী টুকরো ধাতব হিসেবে টাওয়ারটি বিক্রি করেন।
- ১৯৩০ সাল পর্যন্ত আইফেল টাওয়ার ছিল বিশ্বের সবচেয়ে উঁচ স্থাপনরা। ওই বছর যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরে ক্রাইসলার ভবন তৈরি হলে আইফেল টাওয়ারের সেই গৌরব হারিয়ে যায়।
- ১৯২৫-১৯৩৪ সময়ের মধ্যে টাওয়ারের তিন দিকে মোটর গাড়ির জন্য আলোকসজ্জিত করা হয়। যা ওই সময় বিশ্বের সর্বোচ্চ উচ্চতায় স্থাপিত বিজ্ঞাপন চিত্র ছিল।
- ১৯৪০-১৯৪৪ সালে জার্মানির অধিন ছিল প্যারিস। ১৯৪০ সালে ফরাসিরা টাওয়ারের লিফটের তার কেটে ফেলে। এর ফলে এডলফ হিটলারকে সিঁড়ি বেয়েই চূড়ায় উঠতে হয়।
- ১৯৫৬ সালের ৩ জানুয়ারি টাওয়ারের চূড়া আগুনে পুড়ে বিনষ্ট হয়।
- ১৯৫৭ সালে বর্তমান রেডিও অ্যান্টেনাটি টাওয়ারের চূড়ায় বসানো হয়।
- ১৯৯৫ সালের ১৪ জুলাই জিন মাইকেল জার ‘Concert For Tolerance’ নামে একটি কনসার্টের আয়োজন করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল ইউনেস্কোকে (UNESCO) সহায়তা করা। অনুষ্ঠানে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ উপস্থিত ছিল।
- ১৯৯৯ সালে আইফেল টাওয়ারে প্যারিসের সহস্র বর্ষ উদযাপিত হয়। এই উপলক্ষে সম্পূর্ণ টাওয়ারটি আলোকোজ্জ্বল করা হয়।
- ২০০৩ সালের ২ জুলাই টাওয়ারের সম্প্রচার কক্ষে আগুন ধরে যায়। ৪০ মিনিট পর সম্পূর্ণ আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
- ২০০৪ সালে টাওয়ারের প্রথম স্তরে স্কেটিং খেলার আয়োজন শুরু করা হয়।
- ২০০৮ সালে ফ্রান্স দ্বিতীয়বারের মতো ইউরোপীয় ইউনিয়নের সভাপতিত্ব পাওয়ায় আইফেল টাওয়ারে ১২টি দেশের পতাকা লাগানো হয়। একইসঙ্গে সম্পূর্ণ টাওয়ার নীল আলোয় আলোকিত করা হয়।
- ২০১০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর বোমা হামলার আশঙ্কায় আইফেল টাওয়ার দর্শকদের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে, শেষপর্যন্ত কোন বোমা না পাওয়ায় পরদিনই খুলে দেওয়া হয়।
তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট