অঘোরি তান্ত্রিক? শব্দটা কারও মুখে শুনলে বা কোথাও পড়লেই গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে। অঘোরিদের বেশভূষা আচরণ ও কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষের কাছে ভয়ের কারণ। মাথায় লম্বা জট বাঁধানো চুল, মুখমণ্ডল থেকে শুরু করে শরীরে শবভষ্ম মাখানো। নগ্নদেহে গলায় হাতে শবদেহের হাড়গোড় পরিধান করা অঘোরি সাধুদের অভ্যাস। এছাড়া চাউর আছে, তারা কালা জাদু করেন, নরবলি দেন। পচা নোংরা খাবার, মৃতদেহের মাংসভক্ষণ এবং মৃতদেহের সঙ্গে রতিক্রিয়ায় লিপ্ত হওয়া নাকি তাদের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এসব কারণে অঘোরিদের প্রতি সাধারণ মানুষের কৌতূহল থাকলেও তাদের কাছে যাওয়ার কথা চিন্তা করতেও যে-কারও প্লীহা চমকে ওঠে।
এরপরেও অনেকেই আছে, তাদের কাছে আশীর্বাদ নিতে অঘোরিদের কাছে যায়। অঘোরিদের সম্পর্কে জানা যায়, সনাতম ধর্মের অনুসারী এসব সাধুর বসবাস সাধারণত শশ্মান ও শশ্মানের আশপাশের জঙ্গলে। এরা সাধারণত শিবের ভক্ত। পাশাপাশি কালী ও কাল ভৈরবের সাধনাও করেন।
অঘোরিদের প্রধান আখড়া কাশিতে। এখানেই তাদের নিয়মিত দেখা যায়। সেখান থেকেই তারা বিভিন্ন তীর্থে গমণ করেন। পশ্চিমবঙ্গের কালিঘাট ও দক্ষিণেশ্বর মন্দির তাদের কাছে পবিত্র তীর্থ। এছাড়া কোলকাতার তারাপিঠ মন্দিরে সারা বছরই এই অঘোরিদের দেখা যায়। এছাড়া ভারতের কুম্ভ মেলায় বহু অঘোরি সন্ন্যাসীর দেখা মেলে। গভীর রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে, তখন অঘোরিরা একে একে এসে জমায়েত হয় সমাধি ক্ষেত্রে। উত্তর ভারতে কেবল পুরুষরাই অঘোরি সম্প্রদায়ভুক্ত হতে পারে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে নারী অঘোরিও দেখা যায়। অঘোরিরা কোনো কিছুকেই ভয় পান না। তাদের জীবনের প্রধান লক্ষ্য সরল হয়ে বেঁচে থাকা। যে কারণে তারা যত কম উপকরণে জীবন ধারণ করা যায়, তার অভ্যাস করেন। মূলত এ কারণেই তারা অধিকাংশ সময়ই নগ্ন থাকেন।
তাদের অনেক সময় কালো রঙের পোশাকেও দেখা যায়। তারা বিশ্বাস করে এই রঙের কারণে তাদের মধ্যে কোনো শোক, আফসোস প্রবেশ করতে পারে না। এছাড়া তারা মনে করে কালো রঙের পর আর কোনো রঙ নেই। যেকোনো কিছুকে পোড়ালে কালো রঙ হয়ে যায়। যেমন মানুষকে পোড়ালে ছাই হয়। ছাইয়ের রঙটিও কালো। যে কারণে মানুষ পোড়ানোর পর ছাই ভষ্ম তারা তাদের পুরো শরীরে মেখে থাকে।
সাধারণ মানুষের কোনো ক্ষতি করেন না। তবে কেউ আগ বাড়িয়ে তাদের সমস্যা সৃষ্টি করতে গেলে অঘোরিরা তাদের ক্ষতির কারণ হতে পারেন।
তারা পবিত্র ও অপবিত্র বিশ্বাস করেন না। এরা জবাই করা পশুর মাংস এবং মৃত নরমাংসের সঙ্গে কোনো পার্থক্য করেন না। যে কারণে তারা অনায়াসে মৃত মানুষের মাংস খেয়ে ফেলেন। পচা নোংরা খাবারও খাওয়া তাদের কাছে মামুলি ব্যাপার। অঘোরিরা পানির পাশাপাশি নিজেদের পেশাব এবং জীবজন্তুর তাজা রক্ত পান করেন। তারা খাদ্যগ্রহণের পাত্র হিসেবে ব্যবহার করেন নর কঙ্কালের মাথার খুলি। ভিক্ষাগ্রহণের জন্যও তারা মানুষের সামনে নরকঙ্কালের মাথার খুলি এগিয়ে ধরেন। তাদের কাছে খুব প্রয়োজনীয় এই নরকঙ্কালের মাথার খুলি। গাঁজা সেবন করার জন্য তারা ব্যবহার করেন গরু বা মহিষের শিং। অঘোরিরা মৃত শরীর থেকে হাড়গোড় খুলে নিয়ে নিজেদের শরীরের সঙ্গে রাখতে পছন্দ করেন। মৃতের হাড় ও মাথার খুলি দিয়ে তারা পূজা করেন। অমাবস্যার পূজায় বিভিন্ন পশুর পাশাপাশি নরবলিও দেন, এমন কথাও শোনা যায়।
এছাড়া অঘোরিরা চিতায় জ্বলন্ত লাশের পাশেই মৃতদেহের সঙ্গে সঙ্গমে মেতে ওঠে। মৃতদেহের সঙ্গে সঙ্গমের পাশাপাশি তারা যৌনকর্মীদের কাছে গিয়ে তাদের রীতি অনুযায়ী যৌনক্ষুধা মিটিয়ে থাকেন। তবে অঘোরিদের নিজেদের মাঝে কেউ মারা গেলে তাদের শরীরকে তারা সমাধিস্থ করেন অথবা চিতায় পোড়ানো হয়। তারা নিজেদের কারও মৃতদেহের মাংস খান না বা যৌনসঙ্গমে মিলিত হন না। এদিকে, অনেক সনাতন ধর্মাবলম্বী আছেন, যারা এসব অঘোরি তান্ত্রিকে কাছে যান, আশীর্বাদ নেওয়ার জন্য। বিশেষ করে যারা নিঃসন্তান এবং তাদের ধন সম্পদ কম, তারাই যান। বিনিময়ে এই মানুষগুলো অঘোরিদের টাকা পয়সাও দিয়ে আসেন। কিন্তু অঘোরিরা সবার মঙ্গলের জন্যই শিবের কাছে চান।
যতুটুক জানা গেছে, কোনো খারাপ কাজ বা কারও ক্ষতি করা অঘোরিদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নয়। তাদের মূল লক্ষ্য মোক্ষ লাভ। তারা জীবন এবং মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তিলাভের আশায় জীবন পার করে দেন। সাধারণ মানুষের কোনো ক্ষতি করেন না। তবে কেউ আগ বাড়িয়ে তাদের সমস্যা সৃষ্টি করতে গেলে অঘোরিরা তাদের ক্ষতির কারণ হতে পারেন।
তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট।