মামুন রশীদ—একাধারে কবি, কথাশিল্পী, প্রাবন্ধিক ও সংবাদকর্মী। এবারের তাঁর প্রকাশিত বই ‘মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস : বগুড়া জেলা’। বইমেলা, সাহিত্যভাবনা নিয়ে তার মুখোমুখি হয়েছেন কথাশিল্পী সালাহ উদ্দিন মাহমুদ।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: এবারের নতুন বই সম্পর্কে কিছু বলুন।
মামুন রশীদ: এবারের নতুন বই? আমার না অন্যদের? আমার দু’টি বই বেরিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস : বগুড়া জেলা। বইটি তাম্রলিপি প্রকাশনীর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ৬৪টি জেলা ভিত্তিক সিরিজের অন্তর্ভুক্ত। বগুড়া জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কিশোরদের উপযোগী করে লেখা। এছাড়া আমার সম্পাদনায় একটি বই এসেছে মেলার আগেই। ভাষা সৈনিক এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, সিরাজগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোতাহার হোসেন তালুকদার নিজের রাজনৈতিক জীবনের নানা ঘটনা অনুলিখিত হয়ে তিনি বেঁচে থাকতেই বই আকারে প্রকাশিত হয়—‘আমার রাজনৈতিক জীবনের ৫৫ বছর’ শিরোনামে। বইটি আবার নতুন করে আমার সম্পাদনা ও ভূমিকাসমেত প্রকাশ করেছে উত্তরাধিকার ’৭১ প্রকাশনী। বইটির পরিবেশক বেহুলাবাংলা।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: বইমেলা সম্পর্কে আপনার প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা?
মামুন রশীদ: বছরের অন্য মাসগুলোতে আমাদের অধিকাংশ প্রকাশক বই প্রকাশে ততটা আগ্রহী নন। ফলে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করেই অধিকাংশ বই প্রকাশিত হয়। সেই স্রোতে ভেসে যাওয়ার সুযোগ আমিও পেয়েছি। বইমেলাকে উপলক্ষ করেই আমার প্রথম বই প্রকাশিত হয়। এখনো আমার বেশিরভাগ বই-ই মেলাকেন্দ্রিক।
বইমেলা থেকে আমার প্রাপ্তি অনেক। আমার লেখা সারাবছরের, কিন্তু অধিকাংশ বই যেহেতু মেলাকেন্দ্রিক, তাই মেলায় অনেক পাঠকের সঙ্গে সরাসরি দেখা হওয়ার সুযোগ মেলে। সরাসরি পাঠকের প্রতিক্রিয়া তো পাওয়া যায় না, কিন্তু এই মেলা উপলক্ষেই পাঠকের সঙ্গে সেতু তৈরি হয়। মেলায় প্রচুর পাঠক, প্রচুর ক্রেতা—সরাসরি তাদের রুচি সম্পর্কে জানা-বোঝা যায়। নিজের রুচি ও জানা-বোঝাকে মিলিয়ে নেওয়ার সুযোগ মেলে। এটাই বড় প্রাপ্তি। তবে বইমেলা নিয়ে আমার আলাদা কোনও প্রত্যাশা নেই।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: সমকালীন সাহিত্য নিয়ে আপনার চিন্তা–ভাবনা কেমন?
মামুন রশীদ: ভিড় এড়িয়ে চলি আমি। সমকালীন মানে তো ভিড়। আর ভিড় মানেই তাতে হৈ হট্টোগোল বেশি। লেখার চেয়ে পড়তে আমার ভালো লাগে। পুরনো লেখা পড়তে যেমন আমার আগ্রহ, ভালোবাসা—তা নতুনের ক্ষেত্রেও আসে। আমার সঙ্গের যারা, আমার পরের যারা, তারা কী লিখছেন, কী ভাবছেন—একজন লেখকের জন্য এটা জানা-বোঝা জরুরি। সেই জরুরি কাজটুকুও আমি করি ভিড়ের হৃদয় এড়িয়ে। খোঁজ-খবর রাখি। এখন তো প্রকাশের মাধ্যম অনেক। নানাভাবে একজন লেখকের লেখা, ভাবনা সামনে চলে আসে। ফলে কাউকেই এড়িয়ে থাকার সুযোগ নেই। ভিড়ের বাইরে এসে, সমকালীনতার মধ্য থেকেও যারা আমাকে নাড়া দিয়ে যায়, তাদের লেখাও আমি গুপ্তপুঁথির মতো দরদের সঙ্গে পাঠ করি। বুঝে নিতে চাই তাদের ভাবনার জগৎ।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: বর্তমান লেখকদের মধ্যে কাদের লেখা ভালো লাগে?
মামুন রশীদ: এই প্রশ্নটি আমি এড়িয়ে যেতে চাই। যদিও এতে করে আগের প্রশ্নের উত্তরটির অপব্যাখ্যা হতে পারে। তবু আমি এড়িয়ে যেতে চাই।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: সাহিত্য নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
মামুন রশীদ: মুক্তিযুদ্ধ আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পড়ালেখা করছি কয়েক বছর ধরে। মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক কিছু কাজের পরিকল্পনা আছে। আর নিজের গদ্যের হাতটাকে আরও সমৃদ্ধ করতে চাই।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: সাহিত্যের কোন শাখা আপনাকে বেশি টানে?
মামুন রশীদ : আমাকে প্রচুর গদ্য লিখতে হয়—নানা বিষয়ে। তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার পেশা। তবে আমার আনন্দ আমার তৃপ্তির জায়গা কবিতা। যদিও আপাতত কবিতা আমি লিখছি না। তবুও কবিতার ঘোর আমাকে আবিষ্ট করে রাখে।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: লেখালেখির ক্ষেত্রে আপনার অনুপ্রেরণা।
মামুন রশীদ: লেখালেখিতে অনুপ্রেরণা? আমার পরিবার। আমার লেখার প্রথম পাঠক ছিলেন আমার মা। এখন তো জীবিকার প্রয়োজনে দূরে থাকি। তবু মাকে জানাই নতুন লেখা সম্পর্কে। লিখতে শুরু করেছিলাম কলেজে পড়ার সময়ে। তখনো গদ্যের প্রতিই ছিল আকর্ষণ। তবে অনার্স পড়তে এসে কবিতার দিকে মনোযোগী হই। আর আমার লেখার যে দুই-একজন পাঠক আছেন, যাদের উপস্থিতি হঠাৎ করে টের পাওয়া যায়, তাদের আগ্রহই আমাকে ধরে রেখেছে সাহিত্যের ভুবনে।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: প্রচারবিমুখ থেকে সাহিত্যচর্চার সার্থকতা কতটুকু?
মামুন রশীদ: প্রচারবিমুখ শব্দটাতে আমার সায় নেই। প্রচার সবাই চায়। কোনো না কোনোবে সবাই প্রচারের আলোতে। কারও দিকে আলো বেশি, কারও দিকে কম। সেখানে যদিও কারসাজি রয়েছে, তবে তাকেও আমি মূল্য দিতে চাই। যত ভালো লিখুন, যত ভালো লিখি প্রচারের আলোয় না এলে তা পাঠকের কাছে যাবে যাবে। পাঠক হাতে তুলে নেবে না। সাহিত্যচর্চায় তাই প্রচারের প্রয়োজন আছে। তবে যত প্রচারই হোক সাহিত্যমূল্য না থাকলে তা ধোপে টেকে না—এটাও কিন্তু আমি মনে রাখছি।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: আপনার বই আপনাকে কেমন পুলকিত করে?
মামুন রশীদ: নতুন বই হাতে নিলে ভালো লাগে। তবে প্রথম দুই-একদিন। তারপরই নিজের সীমাবদ্ধতা, নিজের মূর্খতা ধরা পড়তে থাকে আমার কাছে। লজ্জা লাগে—ভালো কিছু করার সুযোগ ছেড়ে দিয়েছে বুঝে। প্রতিবার প্রকাশিত হওয়ার পর আমি ধরতে পারি আমার সীমাবদ্ধতা। নিজের সীমাবদ্ধতা জানার আগ্রহই আমাকে প্রকাশিত করে।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: আপনার লেখালেখির সাফল্যে অন্যের ঈর্ষা আপনাকে বিব্রত করে?
মামুন রশীদ: আমার কোনো সাফল্য আছে কি না, তাই তো জানি না। সাফল্য থাকলে তো কেউ ঈর্ষা করবে। তবেই না বিব্রত হব!