চিন্তাসূত্র: এবারের বইমেলায় আপনার কী কী বই আসছে? প্রকাশক কে? প্রচ্ছদ কে করেছেন? প্রকাশিত বই সম্পর্কে কিছু বলুন।
রাকিবুল রকি: এবার বইমেলায় আমার সাতটি বই আসবে। অবসর প্রকাশনী ‘দুর্দান্ত দুই সিরিজ’ চারটি কিশোর উপন্যাস আসবে। নাম ‘চাঁদবনের জাদুর বাড়ি’, ‘গুপ্তধন আবারো গুপ্তধন’, ‘বিপদ ভয়ংকর’, ‘চাঁদের বুকে এলিয়েন’। এগুলো ফ্যান্টাসি অ্যাডভেঞ্চার জনরার বই। মূল চরিত্র ইহাম ও আরিয়া নামের দুই ভাই-বোন। তাদের নিয়েই গল্প। ফ্যান্টাসি এডভেঞ্চার জনরার হলেও পুরাণ, বিজ্ঞান, ভূগোলের প্রসঙ্গ কাহিনির প্রয়োজনে চলে এসেছে। এই চারটি বইয়ের প্রচ্ছদ করেছেন মোস্তাফিজ কারিগর।
চিলেকোঠা প্রকাশনী থেকে আসবে প্রবন্ধের বই ‘হুমায়ূন আহমেদ ও অন্যান্য গদ্য’। এই বইতে মূলত কথা সাহিত্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের সংক্ষিপ্ত রূপরেখা এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। এছাড়া দুটো অনূদিত মোটিভেশনাল বই আসবে। চর্চা গ্রন্থ প্রকাশ থেকে ‘গেট টু দ্য টপ’ এবং অন্যধারা প্রকাশনী থেকে ‘সেলস সাকসেস’ প্রকাশিত হবে।
বইদুটোর মূল লেখক যথাক্রমে সোহেল শেঠ এবং ব্রায়ান ট্রেসি। ‘গেট টু দ্য টপ’ বইয়ের প্রচ্ছদ করেছেন অমর্ত্য আতিক এবং ‘সেলস সাকসেস’ বইয়ের প্রচ্ছদ করেছেন মোবারক হোসেন।
চিন্তাসূত্র: সারাবছর লেখক-প্রকাশক বই প্রকাশ না করে এই একুশে বইমেলা এলেই বই প্রকাশের প্রতিযোগিতায় নামেন। মেলাকেন্দ্রিক বই প্রকাশকে আপনি কিভাবে দেখেন?
রাকিবুল রকি: সবকিছুরই দুটো দিক থাকে। ভালো-মন্দ। মেলাকেন্দ্রিক বই প্রকাশের ভালো দিক বা অন্যতম কারণ হলো এই সময়ে মিডিয়ার কভারেজ সহজেই পাওয়া যায়। তাছাড়া পাঠকও অপেক্ষায় থাকে মেলা থেকে নতুন বইকেনার। বইমেলা আমাদের সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীর কোথাও এত দীর্ঘদিন ধরে মেলা হয় না। বুঝতে হবে আমাদের আবেগই এর নেপথ্য কারণ। খারাপ দিক বলতে বলা যায়, এই অল্প সময়ে এত বই প্রকাশিত হওয়ায় সব বই সমানভাবে প্রচার পায় না। ফলে অনেক ভালো বইও কিছুদিনের জন্য আড়ালে পড়ে যেতে পারে।
চিন্তাসূত্র: একুশে বইমেলা বাংলাদেশের সাহিত্যে কী ধরনের প্রভাব ফেলছে?
রাকিবুল রকি: সাহিত্যের বাহন বই। আর আমাদের দেশের অধিকাংশ বইই প্রকাশিত হয় এই মেলাকে কেন্দ্র করে। অনেক লেখক আছে এই মেলাকে লক্ষ রেখে লেখালেখি করেন। ফলে একটা প্রভাব তো পড়েই। যদিও লেখালেখি একটি শিল্প, যেখানে নিরন্তর চর্চার কোনো বিকল্প নেই। তবে বই যেহেতু মেলাকে কেন্দ্র করেই বেশিরভাগ প্রকাশিত হয়, তাই এর প্রভাবকে অস্বীকার করার উপায় নেই। এতে খুব বেশি দোষের কিছুও দেখি না। কলকাতায় পুজোর সংখ্যাকে টার্গেট রেখে লেখকেরা লেখেন, আমরা একুশে বইমেলাকে কেন্দ্র করে।
চিন্তাসূত্র: একুশে বইমেলা প্রকাশনা শিল্পে তরুণদের উৎসাহিত করার ব্যাপারে কী ধরনের ভূমিকা রাখছে বলে আপনি মনে করেন?
রাকিবুল রকি: একুশে বইমেলা আমাদের প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়েছে। মাসব্যাপী এই মেলায় প্রতিদিনই অসংখ্য লোকের সমাগম ঘটে। তাছাড়া বন্ধের দিনগুলোতে তিলধারণের ঠাঁই থাকে না। এই মেলার বেচাকেনার মাধ্যমে অনেক প্রকাশক সারা বছরের সিংহভাগ খরচ পুষিয়ে নেন। তাছাড়া বড় বড় প্রকাশকদের মতো বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা তরুণদের নেই। তাই বলা যায়, একুশের বইমেলা প্রকাশনা শিল্পে তরুণদের উৎসাহিত করার পেছনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।
চিন্তাসূত্র: প্রকাশনা উপকরণের সহজলভ্যতার কারণে যে কেউ ইচ্ছা করলেই বই প্রকাশ করতে পারেন। এতে বছর বছর বাড়ছে বইয়ের সংখ্যা। বইয়ের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মান বৃদ্ধি ঘটছে না বলে অনেকেরই অভিযোগ; বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন। বই প্রকাশের ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালা প্রয়োজন আছে কি?
রাকিবুল রকি: আমাদের দেশে বইকে অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখা হয়। বইয়ের সঙ্গে পায়ের স্পর্শ হলে বইকে সেলাম করতে শেখানো হয়। বইকে আমরা এতটাই শ্রদ্ধার চোখে দেখি। দ্বিতীয় কথা, বই প্রকাশ করা লাভবান হওয়া সহজ নয়। আমাদের দেশে জনপ্রিয় লেখক আছেন, তবে আঠারো কোটি মানুষের দেশে প্রকৃত অর্থে জনপ্রিয় লেখকের সংখ্যা দশকের ঘরও ছোঁবে না। তাহলে এত মানুষ কেন বই করছে? বই করছে সম্মানের জন্য। অমরত্বের জন্য। মানুষ সৃষ্টিশীল প্রাণী। আয়ু দ্বারা সে মৃত্যুকে জয় করতে পারে না। তাই সৃষ্টি দিয়েই মৃত্যুকে জয় করতে চায়। এবার আসি মানহীন বইয়ের প্রসঙ্গে। ভালো জিনিস কম বলেই তার কদর। আর ভালো জিনিস যত আড়ালেই থাকুক, সেটা প্রকাশিত হবেই। এই যে মানহীন বই প্রকাশ হচ্ছে, এইসব বইয়ের বিনিয়োগকারী কিন্তু গ্রন্থকার নিজে। সে তো চাইলে এই টাকা দিয়েই আরও অনেক কিছু করতে পারতো, সোনালি পানি পান করে নষ্ট করতে পারতো, বই না লিখে আরও অনেক কাজ করতে পারতো, সেগুলো না করে সে বই লেখার চেষ্টা করছে। প্রকাশ করছে। তাই তাকে নিরুৎসাহিত করার কোনো কারণ নেই।আমাদের দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজে এমন ব্যর্থ লেখক আরও বেশি বের হওয়া দরকার। হয়তো তারা সার্থক শিল্প তৈরি করতে পারছে না কিন্তু ভালো চিন্তা তো করছে। সুন্দরের সাধনা তো করছে। আমাদের সমাজের জন্য এই ভালো চিন্তাটুকুই দরকার। শত শত বই পৃথিবীকে পরিবর্তন করে না, করে দুয়েকটা বই। কিন্তু এই দুয়েকটা যুগান্তকারী বইয়ের জন্য শত শত বাজে বই প্রকাশ হওয়া জরুরি। তাছাড়া বাজে বই ঠেকানোর জন্য তৈরি নীতিমালা ভবিষ্যতে ভালো বই ঠেকানোর কাজে ব্যবহৃত হবে না, তার নিশ্চয়তা কে দেবে?