হাবীবাহ্ নাসরীন কবি ও ঔপন্যাসিক। তিনি ১৯৯৭ সাল থেকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লিখছেন। ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতা আমার মেয়ে’। এবারের বইমেলায় প্রকাশিত হয় প্রথম উপন্যাস ‘তুমি আছো, তুমি নেই’ এবং শিশুতোষ গল্পগ্রন্থ ‘টুম্পা ও তার বিড়ালছানা’। সম্প্রতি সাহিত্যচর্চা ও সমকালীন সাহিত্যের বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: আপনার প্রথম উপন্যাস সম্পর্কে কিছু বলুন।
হাবীবাহ্ নাসরীন: এটি আমার কাছে এখনো অবাক লাগছে যে, আমি সত্যিই একটি উপন্যাস লিখে ফেলেছি! একটি দীর্ঘ সময় পাঠককে আমার লেখা দিয়ে ধরে রাখতে পারছি এটিও কম আশ্চর্যের নয়! মানুষ তাদের টাকা এবং সময় খরচ করে আমার লেখা পড়ছেন এটিও বেশ আনন্দের। উপন্যাসটি আমি লিখতে শুরু করি গত বছরের শুরুর দিকে। প্রায় নয় মাসের মতো সময় লেগেছে এটি লিখতে। সময়টা যে ইচ্ছা করেই খরচ করেছি এমন নয়। উপন্যাসটি খুব একটা বড় নয়, তবে এটি নিয়ে আমাকে প্রচুর ভাবতে হয়েছে। কিভাবে লিখলে তা বাস্তবসম্মত ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে, তা করে দেখানো আমার কাছে একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। লিখতে শুরু করা, কাহিনি গড়িয়ে নিয়ে যাওয়া এবং একটি সফল পরিসমাপ্তি দেওয়া বেশ কষ্টকর। এটি লিখতে গিয়ে তাই দীর্ঘ নয় মাস কাটিয়ে দিয়েছি। ভালো লাগছে যে পাঠক এই উপন্যাসটি ভালোভাবে গ্রহণ করেছেন। অনেকেই বইটি পড়ে তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তাদের সেই প্রতিক্রিয়াই আমাকে পরবর্তী লেখাটি লিখতে উৎসাহ দিচ্ছে নিঃসন্দেহে।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: সাহিত্যের কাছে আপনার প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির পার্থক্য কেমন?
হাবীবাহ্ নাসরীন: যেহেতু আমি কবিতা লেখি, অনেকেই আমার কাছে এটা জানতে চান যে এদেশে নারী কবির সংখ্যা এত কম কেন অথবা নারীর রূপের বর্ণনা দিয়ে পুরুষ কবিরা অনেক কবিতা লিখেছেন, পুরুষের বর্ণনা দিয়ে কবিতা সেভাবে চোখে পড়ে না কেন? আমার মনে হয় আমাদের সাহিত্যের অনেকটা জুড়েই কেবল নারী। স্রষ্টা হিসেবে না থাকলেও নারী আছে সৃষ্টি হিসেবে। দেশে বা দেশের বাইরের সাহিত্যে অনেক নারী চরিত্রই বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বাস্তবে হয়তো এদের অস্তিত্ব নেই, তবে পাঠকের হৃদয়জুড়ে বেশ শক্তপোক্ত অবস্থান। যারা সাহিত্যের রচয়িতা, আমার প্রত্যাশা মূলত তাদের কাছেই। তারা যেভাবে লিখবেন, পাঠক সে রকমটাই জানতে পারবেন। তাই নারীকে ভোগ্য পণ্য বা শুধু উপমা হিসেবে উপস্থাপন না করে যেন নারীর মূল পরিচয়টি তুলে ধরা হয়। নারীর ত্যাগ, নারীর ভালোবাসা, নারীর সংগ্রাম এগুলোও যেন লেখার মাধ্যমে উঠে আসে। কারণ পাঠকের মনটি হচ্ছে কাদামাটির মতো। লেখক তার লেখার মাধ্যমে এটির আকার দিতে পারেন। একজন লেখক যখন তার লেখায় এই দায়বদ্ধতার কথা স্বীকার করবেন, তখন আর নারী হিসেবে সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির পার্থক্য থাকবে না।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: সমকালীন কথাসাহিত্য নিয়ে আপনার ভাবনা কেমন?
হাবীবাহ্ নাসরীন: আসলে এত ভারী ভারী বিষয় নিয়ে বলতে আমার ভয় লাগে। আমি নিজেকে এতটা যোগ্য মনেও করি না। লেখকের বাইরে আমি যে পরিচয়টি দিতে বেশি পছন্দ করি তা হলো, আমি একজন ভালো পাঠক। সামনে যা পাই, তাই পড়ি। তবে সে লেখাটি অবশ্যই আমার ভালোলাগতে হবে। আমাদের হাতে সময় খুব অল্প। আর পৃথিবীভরা প্রচুর বই। বাজে লেখা পড়ে সময় নষ্ট করার পক্ষপাতী আমি নই। তাই যে লেখাটি পড়তে শুরু করার পর আমাকে টানে না, সেটি আমি পড়ি না। পড়ি কেবল ভালোলাগার লেখাটিই। আর এভাবে পড়তে পড়তে কিছু ভালোলাগার লেখা তৈরি হয়েছে। তবে প্রিয় কোনো লেখকের কথা আমি বলতে পারব না। এই সময়ে আমাদের দেশে যারা সাহিত্যচর্চার সঙ্গে যুক্ত, তাদের বেশিরভাগই খ্যাতির কাঙাল। কিছুটা অধৈর্য। এই বিষয়টি আমাকে কষ্ট দেয়। আমাদের উচিত নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে সেরা লেখাটি লেখার চেষ্টা করা। নাম, খ্যাতি এসব একদিনে হয় না। যদি লেখার মান ভালো না হয়, তবে কোনোদিনও হয় না। আমার মনে হয় আমাদের কবি-লেখকরা যতদিন পর্যন্ত ব্যক্তিত্ববান না হবেন, ততদিন পর্যন্ত সমৃদ্ধ সাহিত্য সৃষ্টি হবে না।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতা আমার মেয়ে’র পর উপন্যাস প্রকাশের অনুভূতি কেমন?
হাবীবাহ্ নাসরীন: ‘কবিতা আমার মেয়ে’ আমাকে কিছুটা পরিচিত করেছিল। এরপর এবারই প্রথম উপন্যাস ‘তুমি আছো, তুমি নেই’ দিয়ে আবারও কিছু পরিচিত হলাম। আমার মনে হয়, লেখা আসলে মানুষের কাছে পৌঁছানোর একটি মাধ্যম। একটি বইয়ের মাধ্যমে পাঠক-লেখকের একটি সম্পর্ক তৈরি হয়। অনেক পাঠক আছেন, যারা আমাকে চেনেন, আমার লেখা পড়েন, কিন্তু আমি তাদের চিনি না, কখনো কথাও হয় না, আমার হয়ে আমার লেখাই তাদের সঙ্গে কথা বলে। আমি তাদের কথা বলতে পারি বলেই হয়তো তারা আমাকে গ্রহণ করেন। এটি নিঃসন্দেহে ভালোলাগার। এই উপন্যাসটির মাধ্যমে আমি প্রচুর ভালোবাসা পেয়েছি। এত মানুষ যে আমাকে ভালোবাসে তা মেলায় গিয়ে বইটিতে অটোগ্রাফ দিতে গিয়ে টের পেয়েছি। কেউ কেউ আমার জন্য উপহার নিয়ে এসেছেন। কেউ ফুলের মুকুট, কেউ চকোলেট, কেউবা কলম! আমার বইটি কিনে আমাকেই উপহার দিয়েছেন একজন পাঠক! উপন্যাসটি না লিখলে তো এত ভালোবাসা পেতাম না। আমার মনে হয়, এত ভালোবাসার দশ ভাগের একভাগও হয়তো আমি ফেরত দিতে পারবো না। মজার বিষয় হলো, ভালোবাসা কখনো প্রতিদানের ধার ধারে না!
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: সাহিত্য নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
হাবীবাহ্ নাসরীন: আমার লক্ষ্য হচ্ছে নিরন্তর লিখে যাওয়া। হোক তা অল্প, তবে তা যেন পাঠকের সঙ্গে প্রতারণা না হয়। আমি ভালো কিছু লেখা লিখে যেতে চাই।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: শিল্প-সাহিত্যের এ কণ্টকাকীর্ণ পথচলায় আপনার অনুপ্রেরণা।
হাবীবাহ্ নাসরীন: অনুপ্রেরণা আমার নিঃসঙ্গতা। আমার যদি একজনও বন্ধু থাকতো, যে আমার মতো করে আমাকে ভাবতে বা বুঝতে পারছে, তাহলে আমি কখনোই লেখক হতাম না। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মানুষ যে জন্ম থেকেই নিঃসঙ্গ এই ব্যাপারটি আমি খুব ছোটবেলায়ই টের পেয়েছিলাম!
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: প্রচারবিমুখ থেকে সাহিত্যচর্চার সার্থকতা কতটুকু?
হাবীবাহ্ নাসরীন: আমি ভালো লেখার পক্ষে। হোক তা যেভাবেই। তবে প্রচারবিমুখ হওয়ার প্রয়োজন দেখি না। কেউ যদি নিজের মতো আড়ালে থেকে লিখতে চায়, তবে তাকে সেভাবেই লিখতে দেয়া উচিত। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি ভালো জিনিস প্রচারে অলসতা না করাই ভালো। আপনি ভালো একটি লেখা লিখলেন, সেটি যত বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায় ততই মঙ্গল। তবে প্রচারণা যেন নগ্ন না হয়, নিজেকে জাহির করার নির্লজ্জ আচরণ না হয়। আমি বিশ্বাস করি, আল্লাহ কাউকে বঞ্চিত করেন না। ভালো লিখলে আজ হোক, কাল হোক পাঠক তা গ্রহণ করবেই।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: আপনার লেখালেখির সাফল্যে অন্যের ঈর্ষা আপনাকে বিব্রত করে?
হাবীবাহ্ নাসরীন: যদিও আমি তেমন কেউ এখনো হইনি তবু কেউ কেউ যে ঈর্ষা করেন না, এমন নয়। ঈর্ষা করে যদি তারা আমার থেকেও ভালো একটি লেখা লিখতে পারেন, সেটি অবশ্যই ইতিবাচক। আমার চাওয়া হচ্ছে, ভালো লেখা উঠে আসুক। সেটি যে-ই লিখুক না কেন। হতে পারে তা আমি অথবা অন্য কেউ। কে লিখেছে এর থেকেও বড় কথা হচ্ছে কী লিখেছে। সাহিত্যের উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্য, সর্বোপরি মানুষের জন্য কল্যাণকর কিছু করা। সেটি যেকোনো লেখকই করতে পারেন। ঈর্ষার ফলাফল যদি হয় শুধু জ্বলেপুড়ে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া তবে সেইসব ঈর্ষাকারীর জন্য আমি সমবেদনা অনুভব করি।