চিন্তাসূত্র: এবারের বইমেলায় আপনার কী কী বই আসছে? প্রকাশক কে? প্রচ্ছদ কে করেছেন? প্রকাশিত বই সম্পর্কে কিছু বলুন।
ফকির ইলিয়াস: আমার তিনটি বই এ পর্যন্ত কনফার্ম হয়েছে। দুটি প্রবন্ধের। একটি গল্পের। আরও একটি কবিটার বই আসতে পারে! প্রবন্ধের বই ‘বঙ্গবন্ধুর জ্যোতিরেখায় শেখ হাসিনা’ ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশ করেছে আগামী প্রকাশনী। প্রচ্ছদ করেছেন মোস্তাফিজ কারিগর। এই বইয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ থেকে শেখ হাসিনার আজকের উন্নয়ন ও কর্মযজ্ঞ নিয়ে প্রবন্ধগুলো রয়েছে। রয়েছে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চেতনা,সবুজ বিপ্লবের ভাবনা, দুর্নীতি নিরোধে তার হুঙ্কার; ইত্যাদির মূল্যায়ন। একইসঙ্গে আজকের বিশ্বে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার বিশ্লেষণ। দ্বিতীয়টি, ‘শেখ মুজিব আজও অনিবার্য কেন’, প্রবন্ধের বই। গেলো বছর বের হওয়ার কথা ছিল। হয়নি। এ বছর হচ্ছে। প্রকাশক বইপুস্তক প্রকাশন । প্রচ্ছদ করেছেন মমিনুল ইসলাম। কী কথা হয়েছিল সেদিন জেরাল্ড ফোর্ডের সাথে বঙ্গবন্ধুর! জাতির পিতা হত্যাকাণ্ডে কী ছিল সি আই এ’র ভূমিকা! ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডে জড়িত সাধারণ সৈনিকেরা এখন কোথায়! এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছি এই বইয়ে লেখা প্রবন্ধগুলোতে।
আমার তৃতীয় বইটি গল্পের। ‘চৈতন্যের চাষকথা’; প্রথম সংস্করণ বেরিয়েছিল ২০১০ সালে। বইটি প্রিন্ট আউট। ব্যাপক পাঠকনন্দিত হয়েছিল গল্পগুলো। মহান মুক্তিযুদ্ধ ও জীবনবাদী আখ্যান নিয়ে লেখা এই গল্পের বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ বের করছে বুনন প্রকাশন। প্রচ্ছদ এঁকেছেন আল নোমান।
চিন্তাসূত্র: সারাবছর লেখক-প্রকাশক বই প্রকাশ না করে এই একুশে বইমেলা এলেই বই প্রকাশের প্রতিযোগিতায় নামেন। মেলাকেন্দ্রিক বই প্রকাশকে আপনি কিভাবে দেখেন?
ফকির ইলিয়াস: এই প্রবণতা এখন কমছে বলে মনে হয়। ঢাকার বেশ কিছু প্রকাশক এখন পুরো বছর ধরে বই বের করছে। আমি আগামী প্রকাশনী, অনুপ্রাণন প্রকাশন, অনিন্দ্য প্রকাশ, বুনন প্রকাশন এমন অনেক নাম করতে পারি। সমস্যা আরও আছে। বাংলাদেশের সিংহভাগ কবি-লেখক খুবই অগোছালো। তারা বইমেলাকে ‘ঈদ-পুজো-পার্বণ’ মনে করেন! ফলে বইমেলা এলেই তাড়াহুড়ো লাগিয়ে দেন। প্রকাশককে চাপ দেন। একুশে বইমেলায় সত্যিকারের প্রকাশনার স্টল কয়টা ? আমাদের তা ভেবে দেখতে হবে। শতকরা ৭৫ ভাগ মৌসুমী। কী না পাওয়া যায় বইমেলায়! এটা কি বিশ্বের বড় বড় বইমেলায় দেখা যায় ? যায় না। অনেকে মনে করেন, তারা মেলাকেন্দ্রিক বই বের করে মাত করে দেবেন! পাঠক এখন বছরজুড়ে নতুন বই চান। সময় লাগবে হয়তো। তবে এই প্রবণতা বদলে যাবে বলেই আমার বিশ্বাস।
চিন্তাসূত্র: একুশে বইমেলা বাংলাদেশের সাহিত্যে কী ধরনের প্রভাব ফেলছে?
ফকির ইলিয়াস: আনন্দ দিচ্ছে। মানুষকে মিলিত হওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে। বইও বিক্রি হচ্ছে। তা তো বইমেলা শেষে ঘোষিত হিসেব দেখলেই আমরা বুঝি। একটি বইমেলায় যদি ২০টি ভালো উপন্যাস-গল্প, ১৫টি ভালো কবিতার বই, সেরা-সেরা, ২০টি প্রবন্ধ-গবেষণার বই, ৫টি আত্মজৈবনিক, ৫টি জর্নাল,৫টি রম্য বই বের হয়- সেটাই যথেষ্ট মনে করি। দেখা যায়, ইউরোপ আমেরিকায়ও প্রতিবছর হাজার হাজার বই বের হয়। কিন্তু লাইমলাইটে,আলোচনায় আসে মাত্র ১০/১৫টি। এটাই বাস্তবতা। আমি চাই বই বেচাকেনা,বই পঠন-পাঠন পুরো বছরব্যাপী চলুক।
চিন্তাসূত্র: একুশে বইমেলা প্রকাশনা শিল্পে তরুণদের উৎসাহিত করার ব্যাপারে কী ধরনের ভূমিকা রাখছে বলে আপনি মনে করেন?
ফকির ইলিয়াস: লেখার প্রস্তুতি লাগে। লেখককে নিজেই তৈরি হতে হয়। ইঁচড়েপাকা সেজে লেখক হওয়া যায় না। লেখায় ‘পাঠসঙ্গ’ জরুরি। আমাদের অনেক তরুণ কবি পড়েন না। পড়তে চান না। ফেসবুক তাদের সাধনার জায়গা। কবিতা পোস্ট দিয়ে লাইক-কমেন্ট গণনা করেন! দেখা যায়, একজন তরুণের নতুন বইয়ের পোস্টে ৫২৬টি অভিনন্দন বার্তা এসেছে। এই পাচশ জন কি তার বই কেনেন? না। কেনেন না। খামোখা অভিনন্দনের হেতু কী? কী আসে যায়, এই লাইক-কমেন্টে! কিচ্ছু না। আগে লেখকরা সাধনা করে মাঠে আসতেন। এখন অধিকাংশই আসেন গায়ের জোরে। বন্ধুর পিঠ চাপড়ানোকে সম্বল করে। অথচ সেই বন্ধুটিও ফ্রি বই চায় তার কাছে। আমি বলি, সাধনা করে লেখালেখিতে আসুন। আপনার স্থান হবেই। হতেই হবে।
চিন্তাসূত্র: প্রকাশনা উপকরণের সহজলভ্যতার কারণে যে কেউ ইচ্ছা করলেই বই প্রকাশ করতে পারেন। এতে বছর বছর বাড়ছে বইয়ের সংখ্যা। বইয়ের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মান বৃদ্ধি ঘটছে না বলে অনেকেরই অভিযোগ; বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন। বই প্রকাশের ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালা প্রয়োজন আছে কি?
ফকির ইলিয়াস: আপনারা মত-প্রকাশের স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতার কথা বলবেন, আবার বই প্রকাশে ‘নীতিমালা’ চাইবেন, এটা তো হতে পারে না। বের করা সহজ হলেই, তা পাঠক গ্রহণ করবেন এই ধারণা সত্য নয়। প্রতিবছরই প্রচুর আবর্জনা তৈরি হচ্ছে । দ্য ক্লাটার অব দ্য লিটারেচার। আমি চাই, সাহিত্য হবে রাষ্ট্র মানবের কল্যাণ ও সঠিক ইতিহাসের আলোকে। আমাদের সাহিত্যের বড় পরিমাপযন্ত্র হচ্ছে, মহান মুক্তিযুদ্ধ। একাত্তরের চেতনা। এই চেতনা থেকে বেরিয়ে গিয়ে যারা ‘ফ্রিডম অব স্পিচ, ফ্রিডম অব থিংকিং’ খুঁজবে, তাদের মনে করিয়ে দিতে চাই, তারা কি নাৎসিবাদ নিয়ে সাহিত্য করতে পারবেন? লিখতে পারবেন ? ভাবতে পারবেন ? না পারবেন না। তাহলে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদী, মৌলবাদী, একাত্তরের চেতনাবিরোধী লেখা কেন লিখিত হবে? আর কিছু প্রকাশক তা ছাপবেনই বা কেন? এদের রুখে দেওয়া সকলের দায়িত্ব। ছিঁচকেমি করে প্রকাশনার কর্ণধার হওয়া যায় না। তাহলে ধরে নেওয়াই যায়, এরা উদ্দেশ্য নিয়েই এই মাঠে এসেছেন। কী উদ্দেশ্য তাদের? দেশদ্রোহিতা? ৩০ লাখ শহিদ সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলা? এদের পরিত্যাগ করবেই আজকের প্রজন্ম। না করতে পারলে, আমাদের মৌলিক সাহিত্যেরই ক্ষতি হবে সবচেয়ে বেশি। সাহিত্য হোক সত্যনির্ভর। মিথ্যা ও কলুষমুক্ত হোক বাংলা ভাষার প্রকাশনা।