হারুন পাশা—তরুণ কথাসাহিত্যিক। তার কথাসাহিত্যে উঠে এসেছে সমকাল ও সমাজ-মানুষ-রাজনৈতিক সংকটের নানামাত্রিক চিত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয়বর্ষের ছাত্র থাকাকালীন তার প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়। কিন্তু সাহিত্যের পাঠ নেন প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময় থেকেই। জন্মের পর থেকে তিনি এক রকম নিঃসঙ্গ। এই নিঃসঙ্গতাকে সঙ্গ দিয়েছে গল্পের বই। তিনি পাননি দাদা-দাদি-নানা-নানির সান্নিধ্য। তারা পাশার জন্মের আগেই বিদায় নিয়েছেন পৃথিবী থেকে। আবার পাননি বাবা-মায়েরও তেমন সান্নিধ্য। তারা চাকরি ও সংসারের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন। ফলে তার সঙ্গী হয়ে ওঠে বিভিন্ন ধরনের গল্পের বই। রূপকথার গল্পসহ অন্যান্য গল্প কারো কাছ থেকে শুনতে পাননি বলে সেগুলো পড়ে জেনেছেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশের জীবন ও মানুষের পাঠ নেওয়া ছাড়াও পড়েন প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রকাশিত সাহিত্য-দর্শনসহ বিভিন্ন ধরনের বই। লেখালেখি শুরুর আগে যে প্রস্তুতি প্রয়োজন তা ভালোভাবেই সম্পন্ন করেছেন। শৈশব-কৈশোরে গল্প শুনতে না পারার আক্ষেপ হয়তো তিনি কাটাতে পারেননি পুরোপুরি। কেননা, তার সাহিত্য পড়লে পাওয়া যায় এক চরিত্র আরেকজনকে গল্প বলছে।
তিনি সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদকও। নাম ‘পাতাদের সংসার। এ পত্রিকায় তিনি জীবিত সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের নিয়ে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। প্রকাশিত গ্রন্থ চারটি। সম্প্রতি ‘অনিন্দ্য প্রকাশ’ থেকে বেরিয়েছে তাঁর ‘তিস্তা’ উপন্যাস। আমাদের কিংবদন্তীতুল্য সাহিত্যিকগণ পাঠ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ‘তিস্তা’ নিয়ে। লিখেছেন হাসান আজিজুল হক, আহমদ রফিক, যতীন সরকার, হায়াৎ মামুদ, হরিশংকর জলদাস। পাঠকও গ্রহণ করেছে এবং করছে ‘তিস্তা’। এ কথাসাহিত্যিকের মুখোমুখি হয়েছেন নাজিয়া ফেরদৌস।
চিন্তাসূত্র: জেনেছি বইমেলায় আপনার উপন্যাস ‘তিস্তা থাকছে, এ প্রসঙ্গেই গল্প আগানো যাক। পাঠক এবং সমালোচকদের প্রতিক্রিয়া কেমন পেলেন?
হারুন পাশা: হ্যাঁ, ঠিকই জেনেছেন। অনিন্দ্য প্রকাশ থেকে আমার ‘তিস্তা’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছে। বইমেলায় তাদের প্যাভিলিয়ন নম্বর ১৩। উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছে ডিসেম্বর ২০১৭-তে। যখন থেকে ‘তিস্তা’ লিখছিলাম এবং ফেসবুকে ছোট ছোট পোস্ট দিচ্ছিলাম এ সম্পর্কে, তখন থেকেই পাঠকদের সচেতনতা খেয়াল করেছি। এটা কেবল বাংলাদেশ নয়, পশ্চিমবঙ্গ থেকেও কেউ কেউ তাদের আগ্রহের কথা জানিয়েছেন পোস্টের কমেন্ট এবং ইনবক্সে। এখন পর্যন্ত বইটি যাদের হাতে পৌঁছেছে এবং যারা পড়েছে তারা ইতিবাচক কথাই বলেছেন। কেউ কেউ প্রত্যাশায় ছিল বইটি থেকে তিস্তাপারের সংকট বিষয়ে জানবে এবং সে অনুযায়ি নদীকে ঘিরে যে সংকট চলছে তা কিছুটা কমানো যায় কি না, সে বিষয়ে কাজ আগাবে এবং ‘তিস্তা’ পাঠ শেষে তারা এ বিষয়ে উপকৃত হয়েছেন। সাধারণরাও পাঠ শেষে জেনেছে এবং জানছে উপন্যাসটি তাদের নানা পথে জ্ঞানসীমা বিস্তৃতিতে সহযোগিতা করছে, আনন্দ পাচ্ছে। তিস্তা নদী, ব্যারেজের ইতিহাস, তিস্তাচুক্তির অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ, প্রেম, সমাজ প্রভৃতি জানছে। কেউ কেউ বলছে বেশ কিছু শব্দ অনেক ভালো লেগেছে। কথাসাহিত্যিক হরিশংকর জলদাস তো বলেছেন ‘তিস্তা’ উপন্যাসের নতুন একটা ধরন আছে, বিচিত্র একটা গড়ন আছে।’ কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক উপন্যাসটির ভাষা প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘তিস্তা’ উপন্যাসে ব্যবহৃত ভাষা জীবন্ত’। প্রাবন্ধিক-গবেষক আহমদ রফিক এবং যতীন সরকার তো দীর্ঘ প্রবন্ধই লিখেছেন ‘তিস্তা’ উপন্যাস নিয়ে। যতীন সরকার বলেন, ‘তিস্তা’ পাঠ করে আঞ্চলিক ভাষার বহুমাত্রিক প্রকাশ শক্তি সম্পর্কে অনেক নতুন ভাবনায় ভাবিত হলাম।’ অধ্যাপক ও গবেষক হায়াৎ মামুদও লিখেছেন আমার উপন্যাস নিয়ে।
চিন্তাসূত্র: একজন নবীনের জন্য তো এ অনেক বড় পাওয়া।
হারুন পাশা: অবশ্যই, এটি বড় পাওয়া।
চিন্তাসূত্র: আপনি তো মূলত গল্পকার, উপন্যাসের প্রতি মনোনিবেশের কারণ সম্পর্কে কিছু বলবেন?
হারুন পাশা: আমি গল্প লিখছি ২০১২ সাল থেকে। আর উপন্যাস লেখার চেষ্টা শুরু করেছিলাম ২০১৪ সালে। সে উপন্যাসটি এখনো লিখছি, কিন্তু শেষ করতে পারছি না। ১৯টি গল্প লেখার পর মনে হলো বড় পরিসরে, মানে উপন্যাস নিয়ে কাজ করা যায় কি না, ভাবা দরকার। তারপর বিষয় খুঁজতে থাকি। খুঁজতে খুঁজতে মন চলে গেল তিস্তাপারে। মনে হলো এটা নিয়ে লেখা যেতে পারে। কারণ তিস্তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক জন্মের পর থেকেই। সেই পরিবেশ, মানুষ, তাদের জীবন নিয়ে দীর্ঘ এক স্মৃতি, জানাশোনা, উপলব্ধি আছে। যে বিষয়ে আমি জানি না তা লেখায় আনলে, সেই লেখা অক্সিজেনের অভাবে ভুগবে। এজন্য তিস্তা নদী ও তার মানুষদের বেছে নিলাম। লিখলাম ‘তিস্তা’ নামের উপন্যাসটি। শুরু হলো ঔপন্যাসিক সত্তার প্রকাশ। তাছাড়া গল্প ও উপন্যাস লিখে আনন্দ পাই।
চিন্তাসূত্র: উপন্যাস হিসেবে নদীকেই কেন বিষয় হিসেবে বেছে নিলেন?
হারুন পাশা: ওই যে বললাম, নদীর সঙ্গে আমার পরিচয় বহুদিনের। স্কুল-কলেজ জীবন তো তিস্তার আশেপাশেই কেটেছে। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার জন্য যখন ঢাকায় আসি তখন বাড়িতে গেলে আমাদের আড্ডা, সময় কাটানোর বড় একটা জায়গা ছিল তিস্তা ব্রিজ। এখনো যখন গ্রামে ফিরি পরেরদিনই চলে যাই তিস্তায়। বিকেল-সন্ধ্যা কাটে সূর্যাস্ত দেখে, ঝালমুড়ি খেয়ে। নদীর সঙ্গে স্মৃতি তো দীর্ঘ, খুবই দীর্ঘ।
এই নদীই যখন পানিহীন দশায় মরতে বসেছে তখন ভেতরে কষ্ট চাগার দিয়ে উঠে। ২০১৪ সালে যখন তিস্তা সবচেয়ে বেশি পানিশূন্যতায় ভোগে এবং যা এখনো বর্তমান তখন আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থবর্ষে পড়ি। আমি টেলিভিশন এবং দৈনিকের পাতায় পানিশূন্য তিস্তার কথা জানতে পাই এবং ব্যথা, যন্ত্রণায় আক্রান্ত হই। অল্প কদিনের ভেতর আমি গ্রামে ফিরি। যাই তিস্তায়, ব্যারেজে। ছবি তুলি, এমন বেদনার্ত আখ্যানের কথা ফেসবুকে লিখি। ‘তিস্তা ব্যারেজ’ শিরোনামে একটি গল্পও লিখেছিলাম।
দেখি নদীতে পানি না থাকায় তিস্তাকে আশ্রয় করে বেঁচে থাকা মানুষ ঠিক মতো আবাদ করতে পারছে না, মাছ ধরতে পারছে না। দেখি তাদের ক্ষয়, হতাশা, না খেয়ে থাকা, পেশা বদলের মিছিল। তিস্তার পাড় দিয়ে হাঁটি, ব্যথা বড় হতে থাকে। তাদের ভাগ্যবদল তো আমি করতে পারবো না, কারণ সেই ক্ষমতা আমার নেই। তাদের বর্তমান জীবন নিয়ে লেখার চেষ্টায় নিজেকে যুক্ত করি। বিষয় হিসেবে বেছে নেই ‘নদী’। লিখি ‘তিস্তা’ উপন্যাস।
চিন্তাসূত্র: বুড়িগঙ্গা বা অন্য কোনো বিপর্যস্ত নদীকে বাদ দিয়ে তিস্তাকে নির্বাচন করার পেছনে কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য আছে কী?
হারুন পাশা: ‘তিস্তা’র জীবনের সঙ্গে আমার পরিচয় যে দীর্ঘ। তিস্তা যে সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশের অন্য নদীগুলোতেও কম-বেশি সে সংকট আছে।
চিন্তাসূত্র: তিস্তার গঠনরীতির ভিন্নতা সম্পর্কে কিছু বলুন।
হারুন পাশা: ‘তিস্তা’ উপন্যাসে আমি নিরীক্ষা করেছি। বাংলা উপন্যাসের প্রচলিত বর্ণনারীতি এখানে পাবেন না। আমাদের প্রচলিত রীতি হলো লেখকই বর্ণনা করেন উপন্যাস। আর ‘তিস্তা’ উপন্যাসে লেখক হিসেবে আমার কোনো উপস্থিতি নেই। এখানে চরিত্ররাই যাপিত জীবনের ব্যাখ্যাকারক। তারাই বলেছে তাদের কথা এবং তাদের কথনেই উপন্যাসটি এগিয়ে গেছে শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত।
চিন্তাসূত্র: আমাদের সাহিত্যে সংলাপধর্মী উপন্যাস কী ধরনের প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন?
হারুন পাশা: আমার প্রিয় কথাসাহিত্যিক শহীদুল জহির বলেছিলেন, [হুবহু মনে নেই, স্মৃতি থেকে বলছি] অনেকেই আছেন যারা কেবল সংলাপ পড়েন, বর্ণনা কম পড়েন। তিনি আশির দশকে এটি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। এজন্য তাঁর গল্পে একসময় সংলাপ বেশি পাওয়া যায়। একবিংশ শতকের প্রথম দশকে এসে আমি লিখলাম পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস, যেখানে লেখকের বর্ণনা বা উপস্থিতি নেই, চরিত্ররাই যাপিত জীবনের ব্যাখ্যাকারক। প্রভাব ফেলুক আর না ফেলুক, আমাদের প্রচলিত ধারা ভাঙা উচিত। একটা ধাঁচ বা রীতি তো চললই এবং চলছে। এখন নতুন কিছুও পাঠক গ্রহণ করুক। এবং যারা যারা ‘তিস্তা’ ইতোমধ্যে পড়েছে তারা ইতিবাচকভাবেই গ্রহণ করেছে নতুন ফর্ম।
চিন্তাসূত্র: আপনি উপন্যাসটিতে সম্পূর্ণ আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করেছেন। বিষয়টি পাঠক কিভাবে দেখবে বলে মনে করছেন?
হারুন পাশা: পাঠক নিজের মতো করে পড়বে, পড়বে বুঝে বুঝে এবং পড়ার মধ্য দিয়ে আনন্দরস গ্রহণ করবে। আমরা তো সিলেটের ভাষায়, চট্টগ্রামের ভাষায় রচিত সাহিত্য পড়ি। তাহলে রংপুরের ভাষা কিংবা ময়মনসিংহের ভাষায় রচিত ‘তিস্তা’ কেনই বা পাঠকের ভালোলাগা তৈরি করবে না? পড়বে না? এ ভাষায় তো কোটি কোটি মানুষ তাদের আনন্দ-বেদনার প্রকাশ করছে, ভাব বিনিময় করছে, কেনই বা তারা বুঝতে এবং জানতে চাইবে না? পাঠক ভালোভাবেই গ্রহণ করছে এবং করবে এটাই মনে করি।
চিন্তাসূত্র: উপন্যাসটিতে অনেক তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে, এসব সংগ্রহে কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখিন হয়েছিলেন কী?
হারুন পাশা: না, প্রতিবন্ধকতা আসেনি।
চিন্তাসূত্র: সাক্ষাৎকারটি শেষ করতে চাই গল্প বিষয়ে প্রশ্ন রেখে। আপনার গল্পে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দিক, যেমন, অবরোধ, পেট্টোল বোম নিক্ষেপ করে মানুষ হত্যা এসেছে, এসেছে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি-ঘর পোড়ানো, জমি থেকে উচ্ছেদ, এসেছে বেকার জীবন, এ বিষয়গুলো নিয়ে জানতে চাই।
হারুন পাশা: আমি গল্পগুলো যখন লিখি তখন দেশ খুবই অস্থির। এ অস্থিরতা রাজনৈতিক দুই দলের ক্ষমতায় থাকা এবং ক্ষমতায় আসতে চাওয়ার কারণে। ক্ষামতাহীন দল দিনের পর দিন অবরুদ্ধ করে রাখে দেশ। পেট্টোল বোমায় মানুষ পুড়ে চিকেন ফ্রাইয়ের মতো হয়ে গেছে। ক্ষমতার লড়াই চলছে দুদলের মধ্যে, আর ক্ষতি যা হবার তা হচ্ছে সাধারণ মানুষের। গল্পে এই মানুষগুলোর ক্ষতি এবং সেই সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতির ভয়াবহতা দেখিয়েছি। অবরুদ্ধ অবস্থায় দূরে কোথাও যাওয়ার উপায় ছিল না। আর আমাদের দেশে সংখ্যালঘুরা সব সময়ই নির্যাতিত। যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন সংখ্যালঘুদের নির্যাতনের হাত থেকে মুক্তি নেই। গত নির্বাচনের পর বিভিন্ন জায়গায় হিন্দুরা নানা ভাবে আক্রান্ত হয়। ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং উচ্ছেদ করা হয় ভিটেমাটি থেকে। এ অবস্থাগুলোর উপর ভিত্তি করেই লিখেছি ‘সীমান্ত পাড়ের গল্প’, ‘কবিকে ঘুমাতে দাও’, ‘কর্ণাইয়ের আকাশে বিষাদের ছায়া’, ‘অবরুদ্ধ স্বদেশ’ প্রভৃতি গল্প।
আমি যেহেতু সমাজ-রাজনীতি ও ব্যক্তির সংকটের নানা জায়গা নিয়ে লিখি গল্প, সেহেতু ‘বেকারত্ব’ তো সমাজ-মানুষের এমনকি রাষ্ট্রের বড় সংকটের জায়গা। প্রথম যে গল্পটি লিখেছিলাম ‘বেকারদের আর্তনাদ’ শিরোনামে সেখানে ছিল বেকারত্বের প্রসঙ্গ। সর্বশেষ যে গল্পটি লিখেছি ‘এক চিলতে রোদের খোঁজ’ শিরোনামে, এটিও বেকারত্ব প্রসঙ্গে। এ সংকট থেকে মুক্তির জন্য রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ নেওয়া দরকারি।