চিন্তাসূত্র: এবার আপনার কী বই বের হচ্ছে, প্রকাশক কে? প্রচ্ছদ কে করেছেন? প্রকাশিতব্য বই সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু বলুন।
কুমার দীপ: এবার আমার নতুন কোনো বই নেই। ‘অপরূপ শহীদুল জহির ও অন্যান্য অভিজ্ঞান’ শিরোনামে আমার ৫ম প্রবন্ধের এবং ‘বুকের ভেতর বাংলাদেশ’ শিরোনামে ১ম ছড়ার পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেছিলাম, কিন্তু মফঃস্বলের মানুষ, রাজধানীর লেখক-প্রকাশক মহলে তেমন কোনো চেনা-জানা নেই, অধিকন্তু কবিতা ও প্রবন্ধের লেখক (যদিও গল্পের বইও আছে); সুতরাং কোনোটাই এবারে আলোর মুখ দেখলো না। আমার মতো অন্তর্মুখী স্বভাবের মানুষের জন্য বই প্রকাশ সবসময়ই কঠিন ব্যাপার।
যদিও এমুহূর্তে প্রকাশের নিশ্চয়তা নেই, তবু যদি পাণ্ডুলিপি সম্পর্কে সামান্য ধারণা দিতেই বলি: ‘অপরূপ শহীদুল জহির ও অন্যান্য অভিজ্ঞান’ নামের বইটিতে ‘অপরূপ শহীদুল জহির’, ‘কমল কুমার মজুমদারের অন্তর্জলী যাত্রা: ভয়ঙ্করের ভাষাসৌকর্য’, ‘শহীদুল্লা কায়সারের উপন্যাসে সুস্থ জীবনাকাঙ্ক্ষা: সময়ের আয়নায়’, ‘হাসান আজিজুল হকের আগুনপাখি: উপদ্রুত নারীকথন’, ‘শওকত আলীর দলিল: মানুষ ও তার সময়ের চারিত্র্য’, ‘সেলিনা হোসেনের দীপান্বিতা: নারীত্বের অরূপকথা’, ‘জাকির তালুকদারের পিতৃগণ: আত্মানুসন্ধানের ইতিবৃত্ত’, ‘গল্প নিয়ে অল্পকথা’, এবং ‘‘রিজিয়া রহমানের ‘অগ্নিস্বাক্ষরা’: কথাশিল্পীর শুভযাত্রা,’’- এই ৯টি প্রবন্ধ আছে। ‘বুকের ভেতর বাংলাদেশ’ নামের শিশু-কিশোরদের উপযোগী বইটি ‘বাংলাদেশের ছেলে’, ‘ফুলের মতো জীবন গড়ি’, ‘বাংলাদেশের পাখি’, ‘বাংলাদেশের নদী’, ‘গ্রীষ্মদিনের গান’, ‘বৃষ্টি এলে’, ‘শরৎ তারে কয়’, ‘হেমন্ত রানির হাত’, ‘শীত আছে বলে’, ‘বসন্ত না হলে’, ‘আমরা পেয়েছি স্বাধীন স্বদেশ’, ‘মায়ের ভাষায় কথা’, ‘একুশের প্রথম প্রহর’, ‘তারিখটা মার্চের সাত’, ‘ষোলোই ডিসেম্বর’, ‘বোকা ছেলেটি’, এবং ‘বুকের ভেতর বাংলাদেশ’, নামের ১৭টি ছড়ার সমাহার।
উল্লেখ্য, ২০১৭’র ‘রটে যাচ্ছে আাঁধার’সহ পূর্ব-প্রকাশিত ৩টি কাব্য, ৪টি প্রবন্ধ ও ১টি গল্পগ্রন্থের দু-একটি বাদে বাকিগুলো থাকতে পারে ওইসব প্রকাশনীর স্টলে।
চিন্তাসূত্র: সারা বছর লেখক-প্রকাশক বই প্রকাশ না করে, এই একুশের বইমেলা এলেই বই প্রকাশের প্রতিযোগিতায় নামেন। বইমেলাকেন্দ্রিক বই প্রকাশকে আপনি কিভাবে দেখেন?
কুমার দীপ: সারাবছর প্রকাশকেরা বই বের করেন না, এই কথাটি অনেকটাই সত্য, তবে পূর্ণসত্য নয়। বেঙ্গল, প্রথমা বা এরকম দু-একটি প্রকাশনী আছে, যাদের বই বছরের অন্য সময়েও প্রকাশিত হয়। কিন্তু সর্বোপরি এই কথাটি এখন সবাই জানেন যে, বই মেলাকে কেন্দ্র করে বর্তমান বাংলাদেশে প্রায় নির্বিচারে বই প্রকাশিত হয়। কোনো কোনো লেখকের যেমন ৭-৮টি বই প্রকাশ পায়, তেমনি কোনো কোনো প্রকাশকও শতাধিক প্রকাশ করে থাকেন। এটার ভালো-মন্দ দুটো দিকই আছে। মন্দ হলো, কোনো কোনো প্রকাশক কোনো রকমের বাছবিচার ছাড়াই, লেখকের নিকট থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে একের পর এক বই প্রকাশ করে থাকেন। ফলে, অনেকক্ষেত্রেই যেমন প্রচুর মানহীন বই বাজারে ছড়িয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে তেমনি অসংখ্য মানহীন বইয়ের ভিড়ে অল্পসংখ্যক মানসম্মত বই পাঠকচোখের অন্তরালে থেকে যায়। এমন লেখকও এখন হামেশাই বই বের করে থাকেন, যারা নাকি ঠিকমতো বাক্য গঠন করতে পারেন না, আধুনিক বাংলা বানান সম্পর্কেও যাদের তেমন কোনো ধারণা নেই। আর ভালো দিকটি হলো, যেভাবেই হোক, যে কারণেই হোক, প্রচুর বই প্রকাশিত হচ্ছে, যারা প্রকাশের সুযোগ পাচ্ছেন, তাদের অনেকেই যদি যোগ্য না-ও হয়ে থাকেন, তবু অন্য কোনো মন্দ কাজে সময় ব্যয় না করে অন্তত লেখালেখির মতো মানবিক উৎকর্ষের দিকটি বেছে নিতে পারছেন। আর হ্যাঁ, এই অ-বাছাইকৃতদের ভেতরে যারা কিছুটা যোগ্য, যাদের সম্ভাবনা আছে, তারা কিন্তু টিকে থাকার সুযোগ পাচ্ছেন। যারা একেবারেই অনুপযুক্ত, তারা কিছুদিন বাদে ঠিকই হারিয়ে যাবেন।
চিন্তাসূত্র: একুশের বইমেলা বাংলাদেশের সাহিত্যে কী ধরনের প্রভাব ফেলছে বলে মনে করেন?
কুমার দীপ: একুশে বইমেলা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য, বাঙালি সংস্কৃতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। একসময় যে মেলাটি দেশের অল্পসংখ্যক মানুষের কাছে পরিচিত ছিল, তা আজ অধিকাংশ শিক্ষিত বাঙালির নিকটেই সমাদর লাভ করেছে। এর পেছনে অবশ্য গণমাধ্যম, বিশেষত ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমের ভূমিকা খুব ইতিবাচক। বেসরকারি স্যাটেলাইট টিভিগুলো যেভাবে একমাস ধরে বইমেলা কাভার করে, সত্যি প্রশংসনীয়। তবে সমস্যা হলো, এত যে ব্যাপক প্রচারণা, তবু নতুন প্রজন্ম কিন্তু বইমুখী নয়, বিনোদনমুখী। ফেসবুক-ইউটিউব ইত্যাদি অন্তর্জালিক পৃথিবীটাই তাদের যেভাবে মোহমুগ্ধ করে রাখছে, তাতে বইপাঠের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
চিন্তাসূত্র: একুশে বইমেলা প্রকাশনা শিল্পে তরুণদের উৎসাহিত করার ব্যাপারে কী ধরনের ভূমিকা রাখছে বলে আপনি মনে করেন?
কুমার দীপ: ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে বলেই অনুমান করি। না হলে গত কয়েক বছরের মধ্যে এতগুলো প্রকাশনী বাড়তো না। এই সময়ের বেশ কয়েকজন তরুণ কবি-লেখক নিজেরাই প্রকাশকরূপে অবতীর্ণ হয়েছেন। তারা যে সফলতার সঙ্গেই এগোচ্ছেন, তা বলাই বাহুল্য।
চিন্তাসূত্র: প্রকাশনা উপকরণের সহজলভ্যতার কারণে যে কেউ ইচ্ছা করলেই বই করতে পারেন। এতে বছর বছর বাড়ছে বইয়ের সংখ্যা। বইয়ের সংখ্যাবৃদ্ধির সঙ্গে-সঙ্গে মান বৃদ্ধি ঘটছে না বলে অনেকেরই অভিযোগ। বিষয়টাকে আপনি কিভাবে দেখেন। বইপ্রকাশের ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালার প্রয়োজন আছে কি না?
কুমার দীপ: এই প্রশ্নের উত্তর কিছুটা আগেই দিয়েছি। সত্যিই এখন অনেক লেখক, অনেক তাদের বই; পাঠক থাক বা না থাক লেখক থাকছেন, তাদের বই থাকছে। পাঠক না বাড়লেও বই বাড়ছে প্রতি বছর, হাজার হাজার। কিন্তু এটাকে আমি পুরোটাই নেতিবচকভাবে দেখতে চাই না, এর যথেষ্ট ভালো দিকও আছে। সমাজে প্রচুর নেতিবাচক কাজ তথা অপরাধমূলক কাজ আছে, এবং সেসব অপকর্মগুলো ক্রমশ বর্ধমান। তবু কিছু তরুণ অন্তত বইয়ের সঙ্গে থাকতে চাইছে, লেখালেখির সঙ্গে থাকতে চাইছে, এটাকে খারাপভাবে না নিয়ে বরং তারা যেন সঠিক পন্থায় কাজগুলো করতে পারে, যোগ্য হয়ে উঠতে পারে অথবা নিজের অক্ষমতা বুঝে সরে যেতে পারে, সেরকম ভাবনা থাকাই উত্তম বলে মনে হয়।