সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: এবারের নতুন বই সম্পর্কে কিছু বলুন।
কাজী নাসির মামুন: এবারের বইটি আমার প্রথম কবিতার বই ‘লখিন্দরের গান’ ও দ্বিতীয় কবিতার বই ‘অশ্রুপার্বণ’ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। অনার্স ও মাস্টার্স করার সময় আমি ঢাকায় বসবাস করেছি। আবার কয়েক বছর আগে সহকারী পরিচালক পদে ঢাকার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে প্রেষণে নিযুক্ত ছিলাম। এই দুই নাগরিক অভিজ্ঞতার নির্যাস হচ্ছে এবারের কাব্য ‘কাক তার ভোরের কোকিল’। প্রকাশ করেছে প্লাটফর্ম। প্রচ্ছদ এঁকেছেন রাজীব দত্ত। এই গ্রন্থে আমি যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতাকে সত্য ও সংবেদনার নান্দনিক সমন্বয় হিসেবে তুলে ধরেছি। ফলে আমার দৃষ্টকোণ মধ্যবিত্তের নাগালের ভেতর গভীরতর হওয়ার চেষ্টা করেছে। মেকি নাগরিকতার আস্ফালনে অভিজাত হওয়ার বৃথা প্রবণতা দেখায়নি। ফলে এই গ্রন্থে নাগরিকতার বোধ সময়ের বিশ্বস্ত সাক্ষ্য বহন করছে বলে আমার মনে হয়।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:বইমেলা সম্পর্কে আপনার প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা…
কাজী নাসির মামুন: মাসব্যাপী বইমেলা হওয়ার কারণে কিছু সুবিধা আছে। ঢাকার বাইরে যারা থাকেন, তারা সুবিধামতো সময়ে বইমেলায় ঢুঁ মেরে যেতে পারেন। লেখক-কবিদের মধ্যে আন্তঃযোগাযোগের উপলক্ষ হচ্ছে বইমেলা। তা ছাড়া বইমেলাকে কেন্দ্র করেই বই প্রকাশের হিড়িক পড়ে যায়। এটি একইসঙ্গে ব্যবসায়িক সুবিধা ও সৃষ্টিশীল প্রকাশের সুযোগ এনে দেয়। ফলে পাঠবিমুখ জাতিকে পাঠে উদ্বুদ্ধ করতে কিছুটা হলেও বইমেলার অবদানকে স্বীকার করতেই হবে। তবে আমার প্রত্যাশা হলো ঈদ, পূজা ও বৈশাখী উৎসব যেমন সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে,তেমনি বইমেলাকে কেন্দ্র করে গ্রন্থপাঠের প্রতিযোগিতা বাংলাদেশের স্কুল কলেজগুলোতে ছড়িয়ে পড়ুক। যেন গ্রামে-গঞ্জেও বইমেলার ব্যাপক প্রভাব পড়ে। আর বইমেলার সময়টাতে মফস্বলের শহরগুলোতেও সরকারি উদ্যোগে ছোট পরিসরে বইমেলার আয়োজন করলে গ্রন্থপাঠের অনুপ্রেরণা পাবে অনেকেই। এবারের বইমেলা অন্যান্য বারের চেয়ে সুশৃঙ্খল মনে হয়েছে। আর আমার কবিতার বই ‘কাক তার ভোরের কোকিল’মোটামুটি ভালো কাটতি হওয়ার কারণে আমার ভালো লাগাও এবার একটু বেশি।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: সমকালীন সাহিত্য নিয়ে আপনার চিন্তা ভাবনা কেমন?
কাজী নাসির মামুন: ‘অস্তিত্বের অসহনীয় লঘুতা’র যুগে বাস করছি আমরা। সাহিত্যও এই ধারণার বাইরে নয়। ফেসবুকের কল্যাণে যে কেউ কবি হয়ে উঠছে। সামান্য গ্রন্থও অসামান্য প্রচার পাচ্ছে। গল্প উপন্যাসের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। আর সব কথার ব্যতিক্রম তো থাকেই। সে ক্ষেত্রে কিছু পরিশ্রমী কবি লেখক প্রচারের বাইরেও নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের সম্ভাবনাকে বেশি দেখি। আমি যখন ‘মেইনরোড’ সম্পাদনা করি, তখন দ্বিতীয় সংখ্যা নিয়ে শামসুর রাহমানের সঙ্গে দেখা করতে যাই। তিনি আড্ডার এক পর্যায়ে বললেন, এখন তো অনেক কবি। অনেক কবি থাকলে সুবিধা হলো অনেক রকম কবিতার স্বাদ পাওয়া যায়। আবার অসুবিধাও আছে। অনেক বেশি আগাছাও জন্মায়। ভালোদের আলাদা করা যায় না। শামসুর রাহমানের এ কথা সমসাময়িক লেখকদের ক্ষেত্রেও খাটে। লেখা নয়, সম্পর্ক বিচার বা গোষ্ঠী বিচার বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে এখন।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:বর্তমান লেখকদের মধ্যে কাদের লেখা ভালো লাগে?
কাজী নাসির মামুন: প্রায় সব লেখকের কিছু লেখা ভালো লাগে। আবার কিছু ভালো লেখক আছেন, যাদের প্রায় সব লেখাই ভালো লাগে। অবশ্য এ মুহূর্তে নাম মেনশন করা সম্ভব নয়।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: সাহিত্য নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
কাজী নাসির মামুন: প্রথমত মহাকাব্যের মতো কিছু লেখা এবং আরেকটি পরিকল্পনা হলো: একই উপন্যাস বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা। আর কবিতা তো নিরন্তর পরিকল্পনারই অংশ।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: সাহিত্যের কোন শাখা আপনাকে বেশি টানে?
কাজী নাসির মামুন: লিখতে গেলে বেশি টানে কবিতা। পড়তে গেলে বেশি টানে উপন্যাস ও ছোটগল্প।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: লেখালেখির ক্ষেত্রে আপনার অনুপ্রেরণা?
কাজী নাসির মামুন: আমার প্রেরণা মূলত লেখালেখির অন্তর্গত প্রেষণা। এটা ভেতর থেকেই আসে। এছাড়া পরিপার্শ্ব, প্রকৃতি, মানুষের ভালোবাসা, ঘৃণা, ঈর্ষা- সব আমাকে অনুপ্রাণিত করে। এইতো সেদিন আমার মা বললেন, দেওতো দেখি তোমার বইটা, একটু পইড়া দেখি। আমার মনে হলো আমার কবিতার শ্রেষ্ঠ পাঠক আমি পেয়ে গেছি।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: প্রচার বিমুখ থেকে সাহিত্য চর্চার সার্থকতা কতটুকু?
কাজী নাসির মামুন: প্রচার বিমুখ ব্যাপারটাই আমার কাছে ফেইক মনে হয়। আবার প্রচারের নামে ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে হ্যাংলামো করাটাও খুবই বিরক্তিকর ঠেকে।
তবে নিভৃতে কাজ করাটা আমার ভালো লাগে। নিভৃতি আর প্রচারবিমুখতা এক কথা নয়। প্রচার প্রকাশেরই অংশ। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, প্রকাশই কবিত্ব। আবার ভিড়ের মধ্যে হট্টগোল তোলার চেয়ে নিভৃতে কাজ করে সেই কাজকে সামনে তুলে ধরা ভালো। কাজের শক্তিই প্রচারে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: আপনার বই আপনাকে কেমন পুলকিত করে?
কাজী নাসির মামুন: অনেক, অনেক। বই হাতে নিয়ে কতবার তাকিয়ে থাকি! এইখানে আমি আবেগে গদগদ। এই আবেগ আমাকে গতিশীল রাখে। ভাবি, কিছু হোক আর না হোক, একটা ভাবনার রেশতো রয়ে গেলো। অবশ্য এটা-যে মানসিক বিনয় সেটাও বুঝি। মনে মনে কনফিডেন্সটাও কিন্তু কম না। সৃষ্টি নিয়ে এই আত্মবিশ্বাসও খুব জরুরি মনে হয় আমার কাছে।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: আপনার লেখালেখির সাফল্যে অন্যের ঈর্ষা আপনাকে বিব্রত করে?
কাজী নাসির মামুন: কেউ ঈর্ষা করে কি না, আমি জানি না। তবে অনেকের নীরবতাও আমার কাছে ঈর্ষাই মনে হয়। ওটা আমি বুঝি। তবে বিব্রত হই না। শক্তি সঞ্চয় করি। তবে আমি অনেক লেখককে ঈর্ষা করি। এটা নিশ্চিত জানি। মজার ব্যাপার হলো আমার ঈর্ষাও আমাকে শক্তি দেয়।