ইয়াসিন শেখ আরো কিছুদিন অন্তত শান্তিতে বাঁচতে চায়। আকাশের দিকে তাকিয়ে সে পাখিদের উড়ে যাওয়া দেখতে চায়। পাখা মেলে শঙ্খচিলের প্লেনের মতো রাজকীয় ভঙ্গিমায় উড়তে থাকা কিংবা বাড়ির আঙিনার পাশে অথবা উঠোনের কোনে ঝোপের মতো দাঁড়িয়ে থাকা ফুলের বাগানে, রোদ-হাওয়া শরীরে মাখিয়ে ফুলে ফুলে দাপাদাপি করে উড়ে বেড়ানো কিংবা ফুলের পাপড়িতে বসে দক্ষিণা বাতাসে দোল খাওয়া চিত্রল প্রজাপতিদের কানামাছি খেলা দেখতে চায়।
অথবা আঁড়িয়াল খা কিংবা কুমার নদের পাড়ে শেষ বিকেলের আলোয় আছড়ে পড়া ঢেউ এবং স্রোতের সৌন্দর্য অথবা কুয়াশার চাদরে মোড়া নিস্তেজ স্বচ্ছ জলের ভেতরে চিংড়ি/ঢাউস সাইজের বেঁলে মাছের মাটি আঁকড়ে থাকা জীবনের গতিবিধি এখনো সে নিবির ভাবে দেখতে চায়।
সে সন্ধ্যার পরে নেমে আসা নিস্তব্ধ অন্ধকারে কোথাও বসে ঝোপ ঝাড়ের পাতার ফাঁক গলে গলে জোনাকির মিটিমিটি করে জ্বলে ওঠা আলোয় নিবিড় মনে মুগ্ধ হতে চায়। কিংবা সে জীবনের ফেলে আসা পথে ফিরে যেতে চায়। যেখানে আবারো সে দল বেঁধে তার বন্ধুদের নিয়ে বংশীবাদক হওয়ার তুমুল প্রতিযোগিতার আনন্দে মেতে উঠতে চায়। তার মনে পড়ে, ছেলেবেলায় পেঁপে গাছের ডাল কেটে কেটে বাঁশের বাঁশির মতই ছিদ্র করে পেঁপে ডালের/ডগার এক প্রান্তে নকশি কাঁথা সেলাই করার, রং-বেরংয়ের লাল, নীল, কালো, সাদা কিংবা হলুদ সুতা দিয়ে পলিথিন বেঁধে, বাঁশি বানিয়ে বাজিয়ে বাজিয়ে তার বন্ধুদের কতই না মুগ্ধ করেছে।
প্যারপ্যার করে বিশ্রি রকমের আওয়াজ তুলে এক মনে বন্ধুদের সে বাঁশির সুর শুনিয়ে যেত। সেই বাঁশির প্যারপ্যারে আওয়াজে আসলে কোন সুর ছিল নাকি ছিল না, সে ব্যাপারে কারো কোন মাথা ব্যথা ছিল না। তখন সে বাঁশির সুর শুনে সবাই মানে তার বন্ধুরা মুগ্ধ হয়ে যেত। পেছনের সেই সব দিনগুলোকে মনে করে, সে আরো কিছু বছর শান্তিতে থাকতে চায় কিন্তু এখন সে বন্দী না থাকলে, তার বেঁচে থাকা পুরোটাই ঝুঁকিপূর্ণ।
তার বেঁচে থাকার সকল সৌন্দর্যময় শখগুলোকে জ্যান্ত কবর দিতে হয়েছে। অন্তত এই বয়সে এসে সেটাই সে এখন উপলব্ধি করছে। ফলে এখন সে নিয়তিকে দায়ী করে মূলত এই দরজা বন্ধ ঘরে বসে ফেলে আসা সুখ-দুঃখময় জীবনের দৃশ্যই এখন তার চোখে মুখে ভেসে উঠছে।
তার মনে পড়ে। তার মানে ইয়াসিন শেখ। যখন সে একুশ বছরের যুবক ছিল। তখন তার বুকের পাঁজরটা জুড়ে কী সাহসই না ছিল। ঠিক রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মতো ছিল হিংস্র আবার পিতৃত্বের মতই স্নেহপূর্ণ, অতি কোমল। সে যে কোন অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলতে পারত। তখন তার চোখে ছিল দিন বদলের স্বপ্ন, রাতের বিছানার সঙ্গী তাকে দিতো অফুরন্ত প্রাণ চাঞ্চল্যর শক্তি। সারা দিনের কর্ম তৎপরতার অমৃত পানীয়। যা দিন ভর তাকে এক স্বপ্নঘোর গ্রস্থ পৃথিবীর বুকে ভাসিয়ে বেড়াত।
তার মনে পড়ে, কমলা খাতুনকে যখন সে বিয়ে করে ঘরে তোলে তখন তার হাতে দুটি গরু ছাড়া আর কিছুই ছিল না। ভাগ্যের চাকা পাল্টে ফেলার সে কী তীব্র প্রচেষ্টা। খড়ে বোনা দুই চালা ঘরে, হোগলা পাতার বেড়ায় সে কী শীতল সুখ ছিল। বাহির থেকে কাজ শেষে ঘরে ফিরে যখন সে তার মাটির খাটালে গামছা পেতে কিংবা কখনো কখনো পাটের ছালা বিছিয়ে অথবা কখনো কখনো খুব গরম পড়লে খালি মাটির উপরে আস্ত করে শুয়ে পড়ত, তখন সেই শীতল মাটির স্পর্শে সে খুঁজে পেত অফুরন্ত সুখের অনুভূতি। তখন তার রঙিন দিন যাপনের সময় ছিল। ঘরে-বাইরে সে আর তার স্ত্রী কমলা খাতুন। শীতল মাটিতে গড়াগড়ি খেতে খেতে সে কখন যেন কমলা খাতুন কে প্রাণ খুলে ডেকে ডেকে বলত, ‘বউ হুনছো। কই তুমি?’
‘ক্যান? কী অইছে? কও?’
‘আমারে তুমি এক মগ পানি খাওয়াবা। চাপকলের তোন এক্কেবারে শীতকালের পুহুরের মধ্যের পানির মতো এক মগ ঠান্ডা পানি খাওয়াও। ম্যালা পানির তিরিস্না লাগছে।’
‘হ। তয় তুমি খাডালে এমনেই হুইয়া থাহো। আমি পানি নিয়া আইতেছি।’
কমলা খাতুন চাপকল থেকে জগ ভর্তি পানি নিয়ে এসে কাঁসার একটি গ্লাসে এক গ্লাস পানি ভরে তার হাতে তুলে দেয়। বাহিরে খা খা রোদ্দুর থেকে ফেরা ইয়াসিনের তৃষ্ণার্ত গলা ঢকঢক শব্দ তুলে ভিজিয়ে নেয়। ঠান্ডা পানি যখন সে গিলছিল, তখন পানির ঠান্ডা কোমল স্পর্শ মুখের ভেতর থেকে যাত্রা শুরু করে খাদ্যনালী দিয়ে গরগড়িয়ে নেমে পেটের ভেতরে জমা হওয়ার পুরো প্রক্রিয়াটুকুই সে অনুভব করতে থাকে। এ যেন দীর্ঘ পিপাসার চির প্রশান্তির পরিসমাপ্তি।
পানি খাওয়া শেষে তার মনে এক ঝলক সুখের প্রতিক্রিয়া ঢেউ খেলতে খেলতে শরীরের আরো অঙ্গ প্রত্যঙ্গ হঠাৎ করে জেগে ওঠে। এই ভর দুপুরে নির্জন বাড়িতে সে বউয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে এক হেচকা টানে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা তার বুকের উপরে বউকে এনে জড়িয়ে ধরে দুই ঠোঁটে চুমো খেতে থাকে তো খেতেই থাকে। ধীরে ধীরে তাদের শরীর তপ্ত আগুনে মাখা উনুনের কড়াই হয়ে উঠে আবার ধীরে ধীরে সে চাপকল থেকে আনা পানির মতই ঠান্ডা হয়ে যায়। এভাবেই তারা সময়ে অসময়ে সুখের ছড়াছড়িতে থাকে।
যেদিন দেশ ভাগ হয়েছে, সেদিনই কমলা খাতুনের সাথে কবুল করানো হয়েছিল। বিয়ের বছর থেকেই তাদের খড়কুটোর ঘর ফুঁড়ে এক এক করে টুকরো টুকরো চাঁদের কনা আসতে থাকে। একটানা দশ বছর শেষে তিন ছেলে দুই মেয়ের হৈ-হুল্লোরে তাদের ঘর ভরে যায়। তার মনে পড়ে, যে বছর তার বড় ছেলে আফাজ উদ্দিন জন্মালো, সে বছরই প্রথম সে অন্যের জমিতে বদলা দেওয়ার কাজ ছেড়ে দেয়।
তখন থেকেই সে চিন্তা করতে থাকে, আমাকে নিজেই নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে হবে। শিশু আফাজ উদ্দিনের মুখ সে যখন প্রথম দেখল, তখন থেকেই তার ভেতরে আফাজের নিরাপদ পৃথিবীর কথা চিন্তা শুরু করে। তখন তার মনে হয়, নিজের জন্য না হলেও, তার পোনাপুনিদের জন্য তো কিছু একটা করতে হবে। যাতে তারা এই সুন্দর পৃথিবীর নির্মল আনন্দটুকু গ্রহণ করতে পারে। তাদের জীবনে যেন কোন দুঃখের ছায়া না আসে ।
সেই চিন্তা থেকেই সে পরের জমিতে কাজ করা ছেড়ে দিল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে কিছু একটা করবে, কিছু একটা করবে এমন চিন্তা করতে করতেই তার মাথায় হঠাৎ করে এক ঝলক বুদ্ধি এসে দোল খেল। সে সিন্ধান্ত নিলো, সে গাড়ি চালানোর ব্যবসা শুরু করবে। যেই চিন্তা সেই কাজ। একদিন ভর দুপুরে ঘরের খাটালে বেঁতের বোনা ছোট্ট পাটিতে বসে, যখন সে বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলা সরু খালে মাছ ধরার বাঁশের চাই বসিয়ে ধরা টেংরা, পুঁটি, বেঁলে কিংবা কই মাছের ঝোল অথবা শালুক দিয়ে লাল শাকে ভাত খেতে খেতে কমলা খাতুনকে বলতে লাগলো, ‘বুঝলা বউ। তোমার হাতের মাছ রান্দা খুব জুইত হয়। মুহের মধ্যে দিলেই কেমন জানি সু-স্বাদুতে মুখ ভইরা যায়।’কথাগুলো যখন সে বলছিল, তখন কমলা খাতুনের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। যেন সে খুশিতে, আহ্লাদে কিংবা শরমে মুখ যে কোথায় লুকাবে, খুঁজে পাচ্ছিলো না। তবুও কমলা খাতুন মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে শরম ও খুশি জড়ানো কন্ঠে বলে ওঠে-‘এইডা আবার কী রহম কতা। আমি কী আইজক্যা থাইক্কা রান্দা বাড়ার কাজ করি।’
‘হ,বউ। তোমার হাতের রান্দা খাইলে আমার পরানডা জুড়ায় যায়। বিয়ার পর থেইক্কা তোমার হাতের রান্দা ছাড়া আমার মুহে কোন খাওন ভাল্লাগে না।’—কথাগুলো যখন সে বলছিল, তখন দুই জনের মুখ থেকে উচ্ছ্বল প্রাণের বাঁধ ভাঙ্গা চাপা হাসি অঝরে ঝড়ে পড়ছিল, সে দৃশ্য দুজনেই মুগ্ধ হয়ে একে অপরের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখছিল। সে এক অন্যরকম মাত্রাতিরিক্ত সুখের ছোঁয়া। ‘হোনো বউ, ছোডবেলা আম্মার হাতের ছাতু মাহা খাইতে কী যে মজা লাগতো, সেই কতা তোমারে আর কী কমু। হেইরহম ছাতু মাহা কতকাল ধইরা যে খাই না। আহারে।’
‘ক্যান? আম্মায় কী জাদু দিয়া ছাতু মাহাইত?’
‘হ। আমার আম্মার হাতে হাচা হাচাই জাদু আছিলো। সে নিজের আতে চাউল ভাইজ্জা ছাতু বানাইত। হেই ছাতুর লগে, পাকা খেঁজুর দিয়া কচলাইয়া কচলাইয়া ছাতু মাহাইয়া আমাগো খাইতে দিতো। বুজলা বউ, ছোডকালে কত দিন যে আমাগো ছাতু খাইয়া থাকতে অইত। ভাত তো খাইতে পারতাম না, ভাতের বদলে আমরা ছাতু খাইয়াতাম।’ —কমলা খাতুন তার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখে তার চোখ দুটো হঠাৎ ছলছল করে ভিজে উঠল।
তাদের মুখে সেই চাপা হাসি হুমুর্তেই উড়ে যায়। কিছুক্ষণের জন্য ঘরে কোন শব্দ নেই। পুরো ঘরটিই নিঃশব্দ হয়ে যায়। হঠাৎ দক্ষিনমুখী ঘরের দরজা দিয়ে শো শো করে কিছু বাতাস এসে কমলার চুলগুলোকে উড়িয়ে নিতে লাগলো, এমন সময় সে কমলাকে বলে উঠলো, ‘বউ। আমরা এ্যাহন নতুন এট্টা দেশ পাইছি। পাকিস্তান। আমি এহোন আর মাইনষের জমিতে কাজ করুম না। পাকিস্তানের মাটিতে নিজেই গাড়ি চালামু। নিজের পায়ে খাড়ামু।’
‘তাই নাকি?! সত্যিই এ্যাহন আমাগো মুসলমানগো লাইগ্যা এট্টা আলাদা দেশ হইছে। জিন্নাহ সাহেবরা ইংরেজগো ধাওয়াই দিছে। এহন আমরা পাকিস্তানের মানুষ। পাকিস্তান এ্যাহন আমাগো নিজেগো দেশ। নিজেগো দেশে নিজের পায়ে খাড়া অওনের লাইগ্যা কিছু এট্টা আমার করতেই হবে।’
‘তয়, তুমি কী কাজ করবা?’
‘হ, বউ। আমি গাড়ি চালামু। পোলাপানগো মুহের দিকে চাইয়াও তো আমার একটা কিছু করতেই হবে। এই ভাবে খড়ের চালের ঘরে কত বছর থাকমু। ভাগ্যের চাকা তো আমারই ঘুরাইতে হইবে।’
‘তয়, গাড়ি পাবা কই? আমাগো দ্যাশে তো গাড়ি নাইকা।’
‘পামু। পামু। গোয়ালে যে গরু দুইডা আছে। তার থেইক্কা গাই গরুডা বেইচ্চ্যা দিমু। হেই টাকা দিয়া একখান গাড়ি বানাইয়া গোয়ালের বাকী ষাড়ডারে নিয়া আমি গরুর গাড়ি চালামু। কও তো তাইলে ক্যামুন অইবে?’
‘আমার মেলা ডর লাগে?’
‘ক্যান ডর লাগবো ক্যান?’
‘হ। রাস্তা ঘাডে কত মাইনষের লগে মেলামেশা করতে হইবে। তাগো লগে গাড়ির ভাড়া টারা নিয়া ঝড়গা-ঝাডি ক্যাচাল-ম্যাচাল অইবো। থাউক গা, আমাগো গাড়ি চালাইন্যার কাম নাই। আরো কত মাইনষে গাড়ি চালায়, হেগো লগে ঝামেলা লাগবো। থাউক, অন্য কোন কাম হইলে ভাল। যেই কামে কোন গ্যাঞ্জাম-গোঞ্জাম অইবো না।’
‘আরে ডরাও ক্যা, বউ। আমি অইলাম গিয়া ইঁন্দুর।’
‘নাউজুবিল্লাহ। নাউজুবিল্লাহ। এইয়া কী কতা? মাইনষে এই রহম কতা মুহে লয়। ছিঃ ছিঃ ছিঃ’।
বউয়ের কথা শুনে সে কেবলই হাসে আর হাসে।—‘হুনো বউ, ইঁন্দুর কী মেলা খারাপ কোন প্রাণী তোমার কাছে মনে অয়?’
ই-হি-হি- ইঁন্দুরের নাম হুনলেই আমার গা শিউরে ওডে। ঘিনে আমার মুখে ছ্যাপ আইয়া পড়ছে। ওয়াক, ওয়াক করে কমলা খাতুন ঘরের খাটালে বসা থেকে উঠে দরজার কাছে এসে ঘরের বাহিরে মুখ এনে, একদলা ছ্যাপ মুখ থেকে বের থু-থু শব্দ করে ফেলে আবারো তার দিকে ফিরে বলতে থাকে, ‘আমি কিন্তু বইল্লা দিলাম, আর একবারের লাইগ্যাও আমার মুহের সামনে বইসা ইন্দুরের গল্প আর কওন যাবে না। আমি হুনতেও পারমু না।’
‘আরে হোনো বউ। গরুর গাড়ি চালাইলে আমার লগে কারো লগে কোন কাইজ্জ্যা লাগবো না। ওই যে তোমারে কইছি না, আমি হইলাম ইঁন্দুরের জাত। ইঁন্দুর নিজেগো মধ্যে ঝগড়া ঝাডি করে না। অন্য কারো লগে মারামারি, ঝগড়াও করে না। সব পশু প্রাণীর মধ্যে দ্যাহো না, ইঁন্দুরই সবার চাইতে বেশি সহনশীল। সে যে কোন পরিবেশেই নিজেরে খাপ খাওয়ায় বাঁচতে পারে। তুমি এট্টু ভালো কইরা খেয়াল করলেই দ্যাখতে পাবা, ইঁন্দুরের আত্ম-সম্মান বোধ, লজ্জা শরমের মাত্রা অন্য প্রাণীগো লগে কোন রহমেই মিলবো না। তারা সহজে রাগও করে না, আবার অভিমানও করে না।’
আচ্ছা বউ, ইঁন্দুরের লজ্জা শরম নিয়া তোমারে একখান কতা হোনো, তোমার এতোগুলা বছর বয়স অইয়া গেল। তুমি কী কোনদিন দেখছো, ইঁন্দুর তার পোলাপান বিয়ানোর লাইগ্যা তার বউর লগে অকাম হরছে, হেইয়া কী কেউ কোনদিন দ্যাখছে।
তার বউ, মাথা দুলিয়ে না সাড়া দেয়। সে তখন বউকে বলে ওঠে, হ। তুহি হেইয়া দ্যাহো নাই। খালি তুমি ক্যান, ইন্দুরের আকাম কেউ দ্যাখবেও না।’
‘ইস। মুহে কিছু আটাকায়ও না।’
তবুও সে বলতে থাকে—ইন্দুরে যেমন লজ্জা শরম, তেমনই আত্ম-সম্মানবোধ। তুমি কোন চিন্তা কইরো না বউ। আমিও গাড়ি চালাইতে পারমু। তুমি এই নিয়া এট্টুও ডরাইও না।’
‘হুম। এই কতাগুলা আমি তো বিশ্বাস করি না। আমার ইন্দুর দেখলেই ঘিনে শরীর শিরশির কইরা ওডে।’
সে কথাগুলো বলতে বলতে, ভাতের থালায় থাকা টেংরা, পুঁটি, বেঁলে কিংবা কই মাছের মাথা ও কাটা মচমচ করে চিবিয়ে রসটুকু খেয়ে ভাতের থালার পাশে ফেলছে। আর পাশে থাকা সাদাকালো রঙের ছোট্ট বিড়ালটি তার চিবিয়ে ফেলা মাছের মাথা ও কাটা বার বার তার মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে গ্রোগ্রাসে গিলছে আর গিলছে। কমলা খাতুন আর কোন কথা বলে না। সে চুপচাপ বিড়ালের মাছের কাটা খাওয়ার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
শুধু কী রান্না বান্নার কাজ করতে হয়। বিষয়টি মোটেও তেমন নয়। সংসারে যে দিন দিন কত কাজ এসে জড়ো হয়েছে, সে সব তো কমলা খাতুনকে করতে হয়। সেই ফজরের আযানের আগে ঘুম থেকে উঠে, নামাজ পড়ে ঘর মোছার কাজ থেকে শুরু হয়। তারপর হাঁস-মুরগীর খোয়ার খুলে দিয়ে প্রতিদিন পাঁচটি-ছয়টি করে সাদা কিংবা কিছুটা হালকা নীল রংয়ের ডিমগুলোকে হাঁস-মুরগীর গু-মুত থেকে তুলে নিয়ে আসা, আবার তা জমিয়ে রেখে সপ্তাহে সপ্তাহে বেপারীবাড়ি কিংবা সুলতানবাড়ির হাটে বিক্রি করতে পাঠানোর কাজটাও তাকেই দেখতে হয়। তারপর গোয়াল ঘরের গরুগুলোকে খাবার দেওয়া থেকে শুরু করে গোয়াল পরিস্কার করার পরে, আবার রান্না-বান্নার সব আয়োজন তাকেই করতে হয়। স্বামী ও স্ত্রী সংসারটিকে সামনের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের সে কী প্রাণান্তকর চেষ্টা। মাঝে মাঝে কমলা খাতুন নিজের উপরে রাগে খিটমিট খিটমিট করে বলতে থাকেন-‘ইস। কী কপাল লইয়া যে জন্মাইলাম। হালার পোড়া কপালডা লইয়া কই যামু। যে হানেই যামু এই পোড়া কপালডা তো লগে লগে যাবে। উডানে একগোছ খড়-কুডা পড়লেও কেউ নাই যে হেইডা কুড়াইয়া হালাবে। সব এই পোড়া কপালীরই করতে হবে।’—একথা সত্যিই। এই সংসারের সব কাজ তো কমলাকেই করতে হয়, তার তো মূলত ঘরের সংসারি কাজগুলো করার আর কেউ নেই। তাকেই করতে হয়।
প্রথম প্রথম ইয়াসিনের গাড়ি চালাতে তার একটু একটু লজ্জা লাগত। তবে সে লজ্জা বেশি দিন থাকেনি, যখন দিন শেষে এক আনা, দুই আনা, তিন আনা কিংবা চার আনা করে ষোল আনা কিংবা তারও বেশি পয়সার মুখ সে তার চোখের সামনে দুই হাতের তালু ভর্তি দেখতে থাকে। তখন তার মনে আর কোন লজ্জা-শরম বলতে কিছু থাকে না। তখন তার বুকের ভেতরে প্রতিদিনই শুধু টাকা-পয়সা আয় করার নেশা পেয়ে বসে।
বাড়ির পাশের বেপারীরহাট থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরের সুলতানমিয়ার হাট পর্যন্ত সে মাটির রাস্তা ধরে গরুর গাড়ি চালানো শুরু করে। তখন এই রুটের জন প্রতি ভাড়া ছিল চার আনা। দিন শেষে যখন সে গাড়ি চালানোর আয়ের টাকা-পয়সা গুনতে শুরু করে, তখনই তার চোখের সামনে আফাজ উদ্দিনের লাল টুকটুকে কোমল স্নিগ্ধময় মুখখানা গোলাপের পাপড়ির মতো চোখ মেলে ভেসে ওঠে। প্রতিদিনের মতই সে তার ছেলে আফাজের জন্য নির্মল, অভাবহীন, সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতে থাকে।
এভাবেই দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এবং বছরের পর বছর ধরে সে বেপারীরহাট থেকে সুলতানমিয়ার হাট পর্যন্ত গরুর গাড়ি চালাতে থাকে। তার ঘরে শুধু আফাজই নয়, এক এক করে আসতে থাকে—ময়েজ উদ্দিন, ফয়েজ উদ্দিন। তিন ছেলেই নয়, ঘর ভরে মেয়েরাও আসতে থাকে—মিনা আক্তার এবং রুনা আক্তার।
গত দশ বছরে দেড় জোড়া ছেলে এক জোড়া মেয়ে পেয়ে সে এবং কমলা খাতুন তাদের স্বপ্নের ডালপালাগুলো মেলে চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। বড় ছেলে আফাজ উদ্দিনের জন্মের পরে বড় মেয়ে মিনা জন্মেছে। এইভাবে এক বছরে কমলা খাতুন ছেলে জন্ম দিছে তো অন্য বছরে মেয়ে জন্ম দিয়েছে।
তার খুব মনে আছে, বড় মেয়ে মিনা যে রাতে জন্ম নিলো, সে রাতে সে কী ভীষণ ঝড়। অন্ধকার রাতে ঘরের বাইরে শো শো করে গাছের ডালপালা গুলো যেন আছড়ে আছড়ে উঠোনে পড়তে চায়। তার খড়ের চাল যেন উড়ে যেতে চায়। অথচ যখন তার স্ত্রী বড় মেয়েকে জন্ম দিলো—তখনই হুমুর্তের মধ্যে কোথায় যে ঝড় তুফান হারিয়ে গেল। সেই থেকে মেয়ের প্রতিই তার বেশি মায়া জুড়ে গেল। মেয়েদের মুখের দিকে সে তাকালে পৃথিবীর সব সুখ যেন তার পায়ের কছে এসে দুলে পড়ে।
বাইশ বছর ধরে সে গাড়ি চালায়। আইয়ুব খানের যে বছর পতন ঘটল, সেই বছর সে গাড়ির ব্যবসা পুরোটা গুটিয়ে নিয়েছে। তার মনে পড়ে, প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের পতনের জন্য ঢাকার রাজপথে সে কী ভীষণ আন্দোলন। স্কুল ছাত্র মতিউর, ছাত্রনেতা আসাদ পুলিশের গুলিতে নিহত হলে, আন্দোলন ঢেউ তার নিজের গ্রামেও এসে পৌছে যায়। যাই হোক এই গাড়িই তাকে সুখের পথে নিয়ে এসেছে। এখন শুধু নিজেই গাড়ি চালায় না, শওকত বেপারীর গরুর গাড়ি,মতলেব চৌকিদারের গোয়ালের ষাড়টিও কিনে তার সাথে একটি নতুন গাড়িও রাস্তায় নামিয়েছে। সে এখন দেখে, গ্রামের মানুষগুলো তাকে দেখলেই কেমন জানি সমীহ করে। বাইশ বছর আগে গ্রামের এই সব রাস্তা দিয়ে যখন সে হেঁটে যেত, তখন যারা কখনো কোন ধরনের কথা বলতে চাইত না, কিংবা এমনিতেই কথা বলত না, কিন্তু এখন তাদের সাথে দেখা হলেই গল্প জুড়ে দেয়। এই তো সেদিন গ্রামের মাদবরের সাথে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল। কাছে ডেকে, জব্বারের চা-পানের দোকানে বসিয়ে দুধ ছাড়া লাল চা খাওয়ালো। সে তো কিছুতেই খাবে না, তবুও বার দুয়েক বলার পরে আর না করতে পারে নি। চা খেতে খেতে মাদবর বলতে লাগলো, ‘ইয়াসিন, তোমার বাড়ির পাশের আবুল বেপারীর পাঁচ বিঘা ধানি জমি নাকি কিনছো?’
‘হ, মাদবর সাব। তয় পুরা টাকা দিতে পারি নাই। অর্ধেক দিছি। বাকী টাকা ছয় মাসের মধ্যে যোগাড় করে দিতে অবে।’
‘হুম। খুব ভালো করছো ব্যাডা। পোলাপানগুলার মুহের দিকে চাইয়া জমিডা কিইন্না খুবই ভালো করছো। বছর গেলেই তো জমিতে ধান, চাউল অইয়া যাবে। ঘরের গোলা ভইরা ধান-চাউল উঠলেই দেখবা তুমি তরতর কইরা আরো উন্নতির দিকে যাইতে থাকবা নে। কেউ তোমারে ফিরাইতে পারবে না।’
‘হ, মাদবর সাব। আমিও পোলাপানগুলার মুহের দিকে চাইয়া জমিডা কিনলাম। যাতে বছর শ্যাষে ঘরের গোলায় কিছু ধান চাউল ভরতে পারি।’
‘ইয়াসিন, তোমারে দেখলেই আমার পরানডার মধ্যে খুউব ভাল্লাগে। বুহের মইধ্যে খুউব বল পাই আর ভাবতে থাহি— বিশ-বাইশ বছরের আগের হেই তুমি, আর এহন এই বিশ-বাইশ বছর পরের তুমি। কী দিন রাইত পার্থক্য। এই আইয়ুব খানের আমলেই তুমি জমি-জমা কিনে ফেলছো। কত কম সময়ের মইদ্যে তুমি কত উন্নতি কইরা ফেলাইলা। আবার দুই তিনডা গাড়ির মালিক অইয়া গেছ। আবার জমি-জমাও কিইন্না ফেলাইতেছ।
‘হ। মাদবর সাব। সব আপনাগো দোয়া। আপনে গো দোয়া না থাকলে কী এইগুলান করতে পারতাম। কোনদিনই পারতাম না।’
‘হ। মাইনষের দোয়া না থাকলে কিছুতেই এমনে তাড়াতাড়ি উন্নতি করা যায় না। এক সময় লাল হাকের লগে হাপলার হালুক তুইল্লা কত রাইন্দা খাইছো। এট্টু আগুনের অভাবে মাইনষের চুলার মইদ্যে আটার গোল্লা পোড়া দিয়া খাইছো। হেই সময়ের দিনগুলান তুমি কত কষ্টে কাডাইছো। আইজ তুমি কত ভালো আছো। তোমার মতো যদি বেয়াক্কে (সবাই) দিন পাল্ডাইন্নার চেষ্টা করত, তাইলে বাঙালিরা আর এমনে বেয়াক (সব) কিছুতেই পিছাইয়া থাকতো না। তুহি অইলাম এই দ্যাশের এট্টা সোনার পোলা, বুজলা ব্যাডা। তুমি অইলাম আমাগো এক্কেবারে এট্টা খাঁটি সোনার পোলা।’
‘আপনে তো হাচা (সত্য) কতাই কইছেন। লাল হাকের মধ্যে হাপলার হালুক (শাপলার শালুক) দিয়া রাইন্দা খাইতে খুউব মজা। লাল হাক দিয়া ভাত মাহাইলে ভাতের মইদ্যের তোন লাল হাকের ঘ্রাণের লগে লগে যদি কুট্টি কুট্টি হালুক মুহের মধ্যে চাবান পড়ে, হেইলে কী যে মজা লাগে। হেই কতা আর কী কমু। আমার বউতো তো এহনো মনে আউস অইলে, লাল হাকের লগে শালুক দিয়া রাইন্দা আমারে খাওয়ায়। আমি এহনো খুব মজা কইরা খাই।
আমরা সবাই খুব ভাল থাকমু। আল্লাহর কাছে শেখ মুজিবের জন্য দোয়া চাও। এবারের নির্বাচনে শেখ মুজিব জিতে গেলে তো পুরা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে যাবে। তখন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের সোনালী দিন শুরু হয়ে যাবে।’
‘তাই নাকি। ইয়াহিয়া খান তো লোক সুবিধার না, বঙ্গবন্ধু নির্বাচনে জিতলেও তার হাতে ক্ষমতা দিতে চাইবে না। ওদের কথা বিশ্বাস করা যায় না।
‘আরে তোমার মাতায় তো মেলা বুদ্ধিা। শোন। ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর হাতে পাকিস্তানের ক্ষমতা দিতে না চাইলে আমরা বাঙালিরা সবাই মিলে নিজেদের জন্য একটা স্বাধীন বাংলাদেশ বানাইয়া ফেলামু। বুঝলা মিয়া।’
‘হ। শেখ মুজিব চাইলে জানটাও বুহের মধ্যের তোন বাইর কইরা দিতে পারি। আর তার জন্য দোয়া তো সব সময় করি।’
এই কথা বলার সময়ে দুজনের মুখেই আকাশে ঝুলে থাকা বাঁকা চাঁদের মতোন এক টুকরো উজ্জ্বল হাসি ফুটে ওঠে।
আইচ্ছা মাদবর সাব, আইজ আমি যাই। আমার মেলা কাম-কাইচ বাড়িতে পইড়া রইছে।’
কথাগুলো বলতে বলতে সে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে। তার বাড়িতে আসার মাটির পথের দুই পাশে কিছুটা দূরে দূরেই ছোট ছোট ঝোপের মত আকন্দ ফুলের গাছ দাঁড়িয়ে আছে। পুরো গাছ জুড়ে ছোট ছোট ফুলে ফুলে ভরে আছে। যখন সে আকন্দের ঝোপগুলোর পাশ দিয়ে পায়ে হেঁটে যাচ্ছে, ফুলগুলো যেন তার দিকে ঢ্যাপ ঢ্যাপ করে তাকিয়ে আছে।
শুকনো টনটনে মাটির রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ তার বুকের মধ্যে মোচর দিয়ে ওঠে— কমলা খাতুনের মুখখানা বুকের মধ্যে ভেসে উঠতেই সে বলে ওঠে, ‘ব্যাপার কী? বউর চিক্কুর হুনলাম ক্যান? সে কী কোন বিপদে পড়লো।’—কথাগুলো ভাবতে ভাবতে সে খুব দ্রুত পায়ে হাঁটতে শুরু করে।
মনে হচ্ছে যেন সে প্রতি সেকেন্ডে তিন/চার অথবা কখনো কখনো পাঁচ কদম করে পা ফেলতে শুরু করে। এখন আর তার চোখে পড়ে না রাস্তার দুই পাশে ফুটে থাকা আকন্দ, দুর্বাফুল কিংবা মাথা ছুঁই ছুঁই করে বকের গলা উঁচিয়ে থাকা মাথার মতো করে ডালের মাথায় মাইকের মতো হালকা বাতাসে দুলতে থাকা কলমি ফুল।
সে প্রায় দম বন্ধ করে বাড়ির দিকে হাঁটছে। খুব কাছাকাছি আসতেই ছেলে মেয়েদের চিৎকার করা শোকার্ত কান্নার শব্দ তার কানে ভেসে আসতে থাকে। সন্তানদের চিৎকারে তার পা ওখানেই আটকে যায়। সে যেন আর পা ফেলতে পারে না। সে অনুভব করতে থাকে—তার পা দুটো কয়েক মণ ওজন বেড়ে যেন চির অসার হয়ে পড়েছে।
তবুও সে মনের জোরে হেঁটে হেঁটে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ে। ছেলেমেয়েদের ভারী কান্নায় যেন পুরো বাড়িটা জুড়ে শোকের বাতাস বইছে। সে কান্নার শব্দেই বুঝে ফেলে বাড়িতে বড় কোন ধরনের অঘটন ঘটে গেছে। তার বুকের ভেতরে ভয়, সংশয় এবং শোকের আতঙ্কে পুরো শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে। তা সে টের পায় না।
ঘরের ভেতরে ঢুকে সে দেখতে পায়, ঘরের খাটালে কমলা খাতুনকে ঘিরে তার ছেলে মেয়েরাই শুধু নয়, আশে পাশের বাড়িরও কয়েক জন মহিলা এসেছে। তারা সবাই কমলা খাতুনের চারপাশে জড়ো হয়ে বসে আছে। সবাই যখন তাকে দেখতে পেল, তখন তার ছেলেমেয়েসহ জড়ো হওয়া সকলেই বেদনার শোকে মোড়ানো বিষন্ন বিলাপে কাঁদতে শুরু করে। তাকে দেখতে পেয়ে যেন, কান্নার গতি আরো বেড়ে যায়।
কান্নার শব্দে দূর দূরান্ত থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে কাক এসে বাড়ির উঠানের পশ্চিম কোনের শিরিষ গাছের ডগায় বসে তারাও যেন বিষন্ন কর্কশ স্বরে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল। ইয়াসিন শেখও তখন, কমলার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে কাঁদতে শুরু করে।
আফাজ উদ্দিন চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকেন—‘আব্বা রে, আব্বা। আম্মায় তো এট্টু আগেও কী রহম কইরা হাসতে ছিল, আব্বা। ওই যে ফুলবানু খালারে জিগাই দ্যাহেন (হাত দিয়ে এক মহিলাকে ইশারা করে) আম্মায় কতা কইতে কইতে এমনে মইরা গেল..রে..রে..আব্বা। কোনদিন ভাবতেও পারি নাই, আমাগো আম্মার বুহের মধ্যে এমন কইরা ব্যাতা উইডা দাপাইতে দাপাইতে সে মইরা যাবে..রে..আল্লাহ। কোনদিন ভাবতেও পারি নাই। কোনদিন ভাবতেও পারি নাই..আল্লাহ।’আফাজ উদ্দিন বিলাপ করে এভাবেই কাঁদতে থাকেন।
শুধু আফাজউদ্দিনই নয়, তার সাথে সাথে ময়েজ উদ্দিন, ফয়েজ উদ্দিন, মিনা, রুনাও অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে। তাদের ঘর ভরতি মানুষজন আর ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আম, জাম, নারিকেল কিংবা শিরিষ গাছের মগডালে উড়ে উড়ে এক ঝাঁক কাকের কান্নায় চারপাশের বাতাস শোকে আরো ভারী হয়ে ওঠে। ইয়াসিনও শোকে কাতর হয়ে পড়েন।—ইয়াসিনের মনে পড়ে, কমলা খাতুনকে সে কতই না ভালোবাসত। সেই যে বিশ বছর আগে এই বাড়িতে তার ছোট্ট একটি খড়কুটোর চাল ও হোগলা পাতার বেড়ার ঘওে সে বউ হয়ে এসেছিল। তারপর থেকে দু’জনের যে সংগ্রাম শুরু, তা শেষ না করেই মাঝ পথে এভাবে সে চলে গেল। ইয়াসিন শেখ তা মানতেই পারছেন না।
স্ত্রীর রেখে যাওয়া কত স্মৃতিই না তার চোখে কাছে পড়ে রইল। স্ত্রীর মৃত্যুর পরে চারপাশের কত জনেই ইয়াসিনকে বলেছে, ‘নে-নে ইয়াসিন। বউরে হারাইয়া মেলা দিন তো একলা একলাা কাটাইলি। এহন নতুন কইরা একখান বিয়া কর।’শুধু চারপাশের বন্ধু-বান্ধবই নয়। এক মধ্য রাতে সে স্বপ্নে দেখে, কমলা খাতুন আর সে ঘরের খাটালে খেজুর গাছের পাতা দিয়ে বোনা পাটিতে বসে দুজনে চুন, সুপারি আর জদ্দা দিয়ে পান চিবাতে চিবাতে বলছে, ‘আমি তো এহন আর বাইচ্যা নাই। সংসারডা যাতে এক্কেবারে এলোমেলা অইয়া যেন না যায়। এহন আমার তোন সোন্দর দেইখা এট্টা মাইয়ারে বিয়া কইরা আনলেই তো সংসারডা এট্টু ভালোমত চলতে পারে।’
‘হায় রে-রে, এইয়া তুমি কী কও, বউ?’
‘ক্যান? হাচা কতাই তো কইতেছি। এট্টা সোন্দর দেইখা মাইয়া এহন বিয়া কইরা আনলেই তো অয়। নইলে সামনের পৌষ-মাঘ মাসের কত বড় বড় রাইত আইবে, একলা একলা ক্যামনে কইরা হেই বড় বড় রাইতগুলা কাটবে আনে। রাইত কাডাইন্নার যন্ত্রর যদি লগে থাহে,তাইলে রাইত খুব ছোড অইয়া যাবে নে। লেপ কাতাও তাড়াতাড়ি কইরা গরম অবে।’একটু থেকে সে আমার বলতে থাকে ‘ক্যান? আমার এই কতাগুলান কী মিছা কতা মনে অইতেছে?’
দু’জনে খিল খিল করে হাসতে হাসতে সে বলে ওঠে—‘বউ তুমি কী সোন্দর কইরা শীতের রসের মতন কইরা মিডা মিডা কতা কইতেও জানো। আল্লাহ তোমার মুহে হাড়ি ভরা রসের মতন কতা দিয়া পাডাইছে,বুঝলা বউ’।
‘আমি তো এহন আর বাইচা নাই। তয় আমার মাতায় কিন্তু মেলা চিন্তা আইয়া পড়তেছে।’
‘ক্যান? তোমার মাতার মধ্যে কীহের চিন্তা বউ?’
‘ক্যান? বড় মাইয়াডা তো বিয়ার লাহান অইয়া গেছে। কয় দিনের মধ্যে লকলকাইয়া ডাঙ্গর অইয়া গেল। হেদিকে কী খেয়াল আছে? এট্টু খেয়াল রাকতে অবে। এট্টা ভালো পোলা দেইখা মাইয়াডারে বিয়া দেওনের কথা চিন্তা করন তো লাগবে। নইলে মাইনষে তো নানান কতা কইতে থাকবে।’
‘হ-বউ। তুমি হাচা কতাই কইছো। আমি তো তোমার মতন কইরা ভাবি নাই।’
এরপরই হঠাৎ তার ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভেঙে সে দেখে যে, কমলাকে আসলে সে স্বপ্নে দেখছে। স্বপ্নে তাকে, সে বিয়ে করার কথা বলছে। মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার কথা বলেছে। কিন্তু ইয়াসিন সিদ্ধান্ত নেয়—সে আর কোন দিন বিয়ে সাদি করবে না। কমলা ঘর ভরতি করে যাদের রেখে গেছে, তাদেরকেই নিয়েই সে জীবনের বাকী দীর্ঘ পথটি হেঁটে হেঁটে শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকবে। এমন সিদ্ধান্তেই চলছে তার রাত, চলছে তার দিন।
হঠাৎ একদিন আফাজ বাড়ি এসে ইয়াসিন শেখকে বলতে থাকে— আব্বা, খবর শুনেছেন?
‘কী খবর?’
‘রেসকোর্সের ময়দানে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দেওয়ার পর থেকেই ঢাকা থমথমে ছিল। গতকাল রাতে নাকি ঢাকায় গন্ডগোল শুরু হয়ে গেছে। মেলেটারিরা ঢাকায় রাস্তায় যারে পাচ্ছে তারেই মেরে ফেলছে। ওরা গ্রামের দিকেও ছুটে আসছে। সবাইকে মেরে ফেলে বাংলাদেশ দখল করে ফেলতে চায়। আমরা এখন কী করবো আব্বা?’
সে তার নিজের হাতে গড়া বাড়ির চারপাশে তাকিয়ে ভাবতে থাকে—এই নারিকেল গাছ, আম গাছ, জাম গাছ, খেজুরগাছ, শিরিষের গাছ, বাতাসে দোল খাওয়া সোনালী ধানের শীষের ঝলমলে ফসলি ক্ষেত সব কিছুই কী ওরা অন্যের হাতে তুলে দিতে হবে। সে কিছুতেই ভাবতে পারে না তার এইসব ঘরবাড়ি জমি-জমা অন্য কেউ এসে দখল করে নেবে। সে এসব কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার মেম্বারের সাথে সেদিনের কথাগুলো মনে পড়ে হুঙ্কার দিয়ে বলেন—চল আমরা সবাই যুদ্ধে যাবো। এই নারিকেল গাছ, আম গাছ, জাম গাছ, খেঁজুরগাছ, শিরিষের গাছ, বাতাসে দোল খাওয়া সোনালী ধানের শীষের ঝলমলে ফসলি ক্ষেত কিছুতেই কাউকে দখল করতে দেবো না। তারা শুনতে পেল—তাদের বাড়ির পাশের রাস্তা ধরে গ্রামের একদল যুবক মিছিল করতে করতে যাচ্ছে—
তোমার আমার ঠিকানা
পদ্মা মেঘনা যমুনা।
পদ্মা মেঘনা যমুনা
তোমার আমার ঠিকানা।
তোমার নেতা, আমার নেতা
শেখ মুজিব, শেখ মুজিব।।
এক সময় তারা নিজেদের আবিষ্কার করে গ্রামের য্কুদের মিছিলের অগ্রভাগে তারাও আগুনের মত ঝলসে ঝলসে গর্জে ওঠে চিৎকার করে শ্লোগান দিচ্ছে—তোমার আমার ঠিকানা/পদ্মা মেঘনা যমুনা/পদ্মা মেঘনা যমুনা/তোমার আমার ঠিকানা/তোমার নেতা, আমার নেতা/শেখ মুজিব, শেখ মুজিব।
যেন তারা এখন আগুনের পুত্র, তাদের শরীর জুড়ে আগুনের ক্রোধ দাউ দাউ করে জ্বলছে। বাংলাদেশে বহিরাগত শাসক শত্রুদের পুড়িয়ে ছাই করে মানুষের মুক্তি এনে দেবে। তখন শেষ বিকেলে ক্লান্ত শরীরের মানুষ, রং-বেরংয়ের পাখি ও প্রজাপতিরা ঘরে ফিরে আসছে। সে দেখতে থাকে সারা দিনের খাঁ খাঁ রোদ্দুর নিয়ে আসা সূর্যটাও কেমন যেন নেতিয়ে পড়ে রূপসী বাংলার নতুন ভোরের জন্য টুপ করে ডুবে গেল।
বানানরীতি ও সম্পাদনা: লেখকের নিজস্ব