বাংলা অ্যাকাডেমি ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সাহিত্য পুরস্কার-২০২০’ ঘোষণা করেছে। এবার পেয়েছেন, নিউইয়র্ক অভিবাসী লেখক হাসান ফেরদৌস। এই পুরস্কার ঘোষিত হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বেশ সরগরম হয়ে উঠেছে। কথা উঠেছে ‘প্রবাসী ক্যাটাগরি’ লেখক বলে আদৌ কিছু আছে কি না। কিংবা এ রকম তকমা দিয়ে দেশের বাইরে থাকা বাংলাদেশি লেখকদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হচ্ছে কি না!
এই প্রসঙ্গে আরও পেছন থেকে কিছু কথা বলা দরকার মনে করি। বাংলাদেশের বাইরে বাংলা অ্যাকাডেমি আরও একটি বইমেলার আয়োজন করতো দুই দিনব্যাপী। এই মেলাটি ইংল্যান্ডের শহর, লন্ডনে অনুষ্ঠিত হতো। ২০১০ সাল থেকে এই বইমেলা আয়োজিত হয়ে আসছিল। ২০০৯ থেকে বাংলা অ্যাকাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন দেশের বিশিষ্ট সাহিত্যিক শামসুজ্জামান খান। মূলত তার উদ্যোগেই বিদেশে এই দুই দিনের বইমেলাটির আয়োজন করা হতো।
বহির্বিশ্বে এমন একটি নান্দনিক কর্মযজ্ঞ অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার ছিল। বাংলা অ্যাকাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক, বর্তমান সভাপতি শামসুজ্জামান খানের উদ্যোগে ও ‘সম্মিলিত সাংস্কৃতিক পরিষদ, যুক্তরাজ্য’-এর আয়োজনে ২০১০ সাল থেকে ২০১৬ পর্যন্ত লন্ডনে মোট সাতটি ‘বাংলা অ্যাকাডেমির বইমেলা’ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এই মেলাকে কেন্দ্র করেই ২০১১ সাল থেকে বাংলা অ্যাকাডেমি প্রবর্তন করে ‘প্রবাসী লেখক পুরস্কার’। ২০১৪ সালে এর নামকরণ করা হয়, ‘বাংলা অ্যাকাডেমি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সাহিত্য পুরস্কার’। পরবর্তী সময়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় অনুষ্ঠিত এই অনুষ্ঠানের নামকরণ করা হয়েছিল, ‘বাংলাদেশ বইমেলা সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক উৎসব’।
কবি শহীদ কাদরী গভীর আপ্লুত হয়ে বলেন, ‘কবিতা লিখে এমন বিরল সম্মান পাবো, তা কোনোদিন ভাবিনি।’ তিনি প্রজন্মকে বাংলা ভাষা, সংস্কৃতিচর্চায় গভীর অনুরাগী হওয়ার আহ্বান জানান।
বাংলা অ্যাকাডেমি ২০১১ সালে যে ‘প্রবাসী লেখক পুরস্কার’প্রবর্তন করে, তা প্রথমবারের মতো পান ইংল্যান্ড অভিবাসী কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক কাদের মাহমুদ। এর পরের বছর কথাশিল্পী সালেহা চৌধুরী এবং ডা. মাসুদ আহমেদকে সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য ‘প্রবাসী লেখক পুরস্কার-২০১২’ দেওয়া হয়। তারা দুই জনই গ্রেট ব্রিটেনপ্রবাসী।
২০১৩ সালে প্রবাসে বাংলা অ্যাকাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান যুক্তরাজ্যবাসী দুই জন। তারা হলেন, লেখক ও সাংবাদিক ইসহাক কাজল ও লেখক-গবেষক ফারুক আহমদ। এছাড়া পেয়েছেন জার্মানপ্রবাসী লেখক ও বিজ্ঞান-গবেষক ড. মোহাম্মদ জাকারিয়া।
২০১৪ সালে ‘বাংলা অ্যাকাডেমি প্রবাসী সাহিত্য পুরস্কার’-এর নাম পরিবর্তন করে ‘সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ সাহিত্য পুরস্কার’ করা হয়। সেই বছর এই পুরস্কার পান কানাডাপ্রবাসী ইকবাল হাসান ও সৈয়দ ইকবাল এবং যুক্তরাজ্যের ব্রিটিশ লেখক-অনুবাদক-গবেষক উইলিয়াম রাদিচি।
২০১৫ সালে বাংলা অ্যাকাডেমি প্রবর্তিত এই ‘সৈয়দ ওয়ালি উল্লাহ সাহিত্য পুরস্কার’ পান যুক্তরাজ্যপ্রবাসী লেখক মঞ্জু ইসলাম ও ফ্রান্স প্রবাসী ফ্রান্স ভট্টাচার্য।
২০১৬ সালে পান যুক্তরাজ্য প্রবাসী কবি শামীম আজাদ এবং জার্মানপ্রবাসী লেখক ও কথিত গবেষক নাজমুন নেসা পিয়ারি। বাংলা অ্যাকাডেমি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ পুরস্কার ২০১৭ পেয়েছিলেন ইংল্যান্ড অভিবাসী কবি মুজিব ইরম ও কানাডা অভিবাসী কবি মাসুদ খান।
২০১৮ সালে এই পুরস্কার নিয়ে কোনো মাতামাতি করতে দেখা যায়নি বাংলা অ্যাকাডেমিকে। ২০১৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর হঠাৎ ঘোষণা দেওয়া হয় ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সাহিত্য পুরস্কার ২০১৮’-এর জন্য মনোনীত হয়েছেন কানাডা অভিবাসী লেখক সালমা বাণী ও ইংল্যান্ড অভিবাসী সাগুফতা শারমীন তানিয়া। ১৯ জানুয়ারি ২০২১ বাংলা অ্যাকাডেমি যে নোটিশে হাসান ফেরদৌসকে মনোনীত করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, এই পুরস্কারটি এখন ‘দ্বি-বার্ষিক সাহিত্য পুরস্কারে’ রূপ লাভ করেছে। কোন প্রজ্ঞাপণের মাধ্যমে কেন এমনটা করা হয়েছে, তাও অনেকের অজানা।
বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশের বাইরে এখন গড়ে উঠেছে একটি অনেক বড় অভিবাসী সমাজ। স্মরণ করছি, ১৯৯২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর, ‘বাংলা সাহিত্য পরিষদ-যুক্তরাজ্য’ লন্ডনের ম্যানিং হলে একটি বড় সাহিত্য উৎসব করে। সেই উৎসবে বাংলাদেশ থেকে অতিথি হয়ে আসেন কবি বেগম সুফিয়া কামাল এবং পশ্চিমবঙ্গ থেকে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। ‘দেশবিকাশ’-এর মোনায়েম আহমেদ মায়েনীনের আমন্ত্রণে আমি সেই উৎসবে অংশ নেই। সেমিনারেও যোগ দেই।
১৯৯২-১৯৯৫ সময়ে বেশ কয়েকদফা ইংল্যান্ডে দীর্ঘবকাল অবস্থান করি। ওই সময়ে অনেক সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আমার অংশ নেওয়ার সুযোগ হয়েছে। চলতি সময়ে এর প্রসার অনেক বেড়েছে। একইসঙ্গে ইউরোপ-আমেরিকার অন্যান্য দেশেও বেড়েছে এর বিস্তৃতি। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি বড় আয়োজনের বইমেলা হচ্ছে বিগত ২৯ বছর থেকে। ‘বাঙালির চেতনা মঞ্চ ও মুক্তধারা’র আয়োজনে নিউইয়র্কে ১৯৯২ সালে প্রথম বইমেলাটির উদ্বোধক ছিলেন ড. জ্যোতি প্রকাশ দত্ত।
এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রে আমেরিকা-বাংলাদেশ-কানাডা (এবিসি সম্মেলন) সম্মেলনও আয়োজিত হয়েছে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। ২০০৯ সালের ১১, ১২ জুলাই নিউইয়র্কে অনুষ্টিত হয় এই আমেরিকা-বাংলাদেশ-কানাডা সম্মেলন। সেমিনারগুলোর আলোচনার বিভিন্নপর্বে অংশ নেন অধ্যাপক আলী আনোয়ার, দিলারা হাশেম, সমরেশ মজুমদার ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
২০১০ সালের দ্বিতীয় এবিসি সম্মেলনে নিউইয়র্কে ম্যারি লুইস অ্যাকাডেমির সুবিশাল চত্বরে এই সম্মেলন ছিল অভিবাসী বাঙালির প্রাণের মেলা। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য তো বটেই, কানাডা, ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রেলিয়া থেকেও শিকড়সন্ধানী বাঙালি অভিবাসীরা ছুটে এসেছিলেন এই সম্মেলনে। এই সম্মেলনে কবি শহীদ কাদরীর হাতে ‘এবিসি সম্মেলন সম্মাননা পদক’ তুলে দেন সাবেক রাষ্ট্রদূত ড. ওসমান সিদ্দিক। কবি শহীদ কাদরী গভীর আপ্লুত হয়ে বলেন, ‘কবিতা লিখে এমন বিরল সম্মান পাবো, তা কোনোদিন ভাবিনি।’ তিনি প্রজন্মকে বাংলা ভাষা, সংস্কৃতিচর্চায় গভীর অনুরাগী হওয়ার আহ্বান জানান।
২০১২ সালের জুন মাসের ২৩ ও ২৪ তারিখে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশের বিশিষ্ট বাঙালিরা অংশ নেন তৃতীয় এবিসি সম্মেলনে। নিউইয়র্কের বিশ্ববিখ্যাত ‘এস্টোরিয়া ওয়ার্ল্ড ম্যানর’ সেজেছিল বর্ণাঢ্য সাজে। এই সম্মেলনে অতিথি ছিলেন শাহীদ কাদরী, সৈয়দ শামসুল হক ও ফরহাদ মজহার।
এই ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সাহিত্য পুরস্কার’কে ‘সান্ত্বনা পুরস্কার’ বা ‘বি ক্যাটাগরি পুরস্কার’ বলতে শুনেছি অনেকের কাছে। পরে তাদের অনেকেই এই পুরস্কার পেয়ে উল্লাসও করেছেন।
মার্কিন মুলুকের বাঙালিদের অনেক বড় বড় সম্মেলন করার অভিজ্ঞতা ইতোমধ্যে অর্জিত হয়েছে। ২০১৫ সালের ৫ ও ৬ সেপ্টেম্বর বিশ্বের বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে খ্যাত নিউইয়র্কে অভিজাত পেনসিলভেনিয়া হোটেলের দ্য প্যান প্লাজা অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত হয় নর্থআমেরিকা বাংলাদেশ কনভেনশন। ‘এনএবিসি’ খ্যাত এই সম্মেলন উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. ওয়াকিল আহমেদ। অতিথি হিসেবে ছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক শফিক রেহমান, কথাসাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সতিনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।
কনভেনশনের শেষ সেমিনারটি ছিল ‘বাংলা সাহিত্যচর্চার গুণগত মান: অতীত ও বর্তমান’ এটি উপস্থাপনার দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। এতে মূল প্রবন্ধ পড়েন ড. সালাহউদ্দিন আইয়ুব।
স্বপ্নময় চক্রবর্তী বলেন, লেখক তার মতো করেই লিখবেন। গুণগত মান নির্ণয় করবে মহাকাল। অতীতে কী ছিল, আর ভবিষ্যতে কী হবে, তা বলা কঠিন। এরপরও আমাদের আশাবাদ সাহিত্য মানুষের জন্য পুষ্পবর্ষণ করে যাবে পথে পথে।
এসব কথা এজন্য লিখলাম, যুক্তরাষ্ট্রে এখন গড়ে উঠেছে বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির একটি বড় কাফেলা। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলা অ্যাকাডেমি কি সেই খবর রাখছে না? যদি রাখতো, তাহলে বাংলা অ্যাকাডেমি আয়োজিত একটি বইমেলাও যুক্তরাষ্ট্রে আয়োজিত হয়নি কেন? পর-পর সাত বছর ইংল্যান্ডে তা আয়োজিত হয়েছে।
এই বিষয়ে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই এক নিবন্ধে লিখিতভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করেছিলাম। মন্তব্য জানতে চেয়েছিলাম অনেকের কাছে। বিশিষ্ট লেখক-সাহিত্যিক হাসান ফেরদৌসের কাছে জানতে চাইলে তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘বহির্বিশ্বে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ব্যাপক প্রসারের লক্ষ্যে বাংলা অ্যাকাডেমি লন্ডনে বার্ষিক বাংলা বইমেলা আয়োজনের যে উদ্যোগ নিয়েছে, আমি তাকে স্বাগত জানাই। লন্ডনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলা ভাষাভাষীর বসবাস, এই বইমেলা তাদের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সাম্প্রতিক সেরা কাজ গুলির সঙ্গে পরিচিত করাতে সহায়ক হবে। কিন্তু শুধু লন্ডন নয়, এই মেলা বিশ্বের অন্যান্য শহরে, যেখানে বড় সংখ্যায় বাংলা ভাষাভাষীদের বসবাস, সেখানেই এই মেলা বসুক, সেটাই আমরা চাই। যেমন, নিউইয়র্ক শহরে ও তার আশেপাশে তিন লক্ষ বা তার চেয়ে বেশি বাঙালির বাস। বাংলা অ্যাকাডেমি যদি এখানেও তাদের বইমেলা নিয়ে আসে, আমরা সবাই তাকে স্বাগত জানাবো। হয়তো একাধিক শহরে প্রতি বছর এই মেলার আয়োজন বাংলা অ্যাকাডেমির পক্ষে সম্ভব হবে না। সেক্ষেত্রে বহির্বিশ্বের প্রধান শহরগুলোতে এই মেলা আবর্তিত হতে পারে।’
হাসান ফেরদৌস যোগ করেন, ‘এক বছর লন্ডন তো পরের বছর নিউইয়র্ক বা প্যারিস। বাংলা অ্যাকাডেমি একা এই মেলা সফলভাবে আয়োজনে সক্ষম হবে না, এজন্য প্রয়োজন পড়বে স্থানীয় আয়োজকদের। এই অংশীদারিত্বের ভিত্তিতেই লন্ডনের মেলাটি গত কয়েক বছর ধরে আয়োজিত হচ্ছে। নিউইয়র্কে গত ২৫ বছর ধরে একটি বইমেলা আয়োজিত হচ্ছে, ফলে সফল মেলা আয়োজনের ব্যাপারে এই শহরের সাহিত্যামোদিদের বিস্তর অভিজ্ঞতা আছে। বাংলা অ্যাকাডেমি এই রকম একটি বইমেলা আয়োজনে আগ্রহী হলে আমি ব্যক্তিগতভাবে তা সফল করতে সব রকম সম্ভাব্য সহযোগিতার আগাম আশ্বাস দিচ্ছি।’
না। যে-কোনো অজ্ঞাত কারণেই হোক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলা অ্যাকাডেমি কোনো বইমেলা করেনি। এরমাঝে বিশ্বে করোনা মহামারী শুরু হয়েছে। ২০২০ সালে নিউইয়র্কে মুক্তধারা অয়োজিত বইমেলা ভার্চুয়ালি আয়োজিত হয়েছে খুব হযবরল অবস্থার মধ্য দিয়ে। যার কোনো আর্কাইভই যথার্থভাবে সংরক্ষিত হয়নি। এরমাঝেও বিশ্ব থেমে নেই। জীবন চলছে। সেই নিরিখেই বাংলা অ্যাকাডেমি ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সাহিত্য পুরস্কার-২০২০’ ঘোষণা করেছে। যেটি পেয়েছেন হাসান ফেরদৌস।
এখানে যে কথাটি না বললেই নয়, তা হলো, হাসান ফেরদৌস প্রতিষ্ঠিত লেখক। প্রায় পাঁচ দশকের কাছাকাছি সময় ধরে লেখালেখি করেন। তিনি নিউইয়র্কে বসবাস করলেও মূলত তার সব শব্দ আয়োজন বাংলাদেশকে ঘিরে। বাঙালি জাতিসত্তা ঘিরে। অনেকের মতো আমিও মনে করি, প্রবন্ধে বাংলা অ্যাকাডেমি পুরস্কারটি হাসান ফেরদৌস পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন। কিন্তু এখনো পাননি। কেন পাননি, পান না; এর কারণ অজানা।
বলে রাখা দরকার ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সাহিত্য পুরস্কার’ এর আগে অনেক অযোগ্য লোকের হাতে উঠেছে। অনেকে বাগিয়েও নিয়েছেন। আবার একজন অভিবাসী কবি তা নিতে অস্বীকারও করেছেন। বাংলাদেশ এমন একটি দেশ,যে দেশে রাজাকারের পাণ্ডারাও স্বাধীনতা পুরস্কার পায়। ‘জিয়া’ কে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করা ‘স্তাবক’ও কবিতায় বাংলা অ্যাকাডেমি পায়। আবার বিদেশে থেকে বাংলাদেশের পতাকার রঙ বিক্রি করে পলিটিক্যাল এসাইলাম নেওয়া লেখকও বাংলা অ্যাকাডেমি পায়।
চোরাকারবারিকে পার করে দেওয়া কাস্টমস কর্মকর্তাও বাংলা অ্যাকাডেমি পায়! একই দেশে, আবিদ আজাদ, আবু কায়সার, খোন্দকার আশরাফ হোসেন, ড. সফি উদ্দিন আহমদরা বাংলা অ্যাকাডেমি পান না। এর চেয়ে অবিবেচনা, নির্মমতা আর কী হতে পারে! এই ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সাহিত্য পুরস্কার’কে ‘সান্ত্বনা পুরস্কার’ বা ‘বি ক্যাটাগরি পুরস্কার’ বলতে শুনেছি অনেকের কাছে। পরে তাদের অনেকেই এই পুরস্কার পেয়ে উল্লাসও করেছেন।
সম্মান সব সময় আনন্দের। হাসান ফেরদৌসের আনন্দে আমরাও আনন্দিত। উল্লেখ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কোনো লেখক এই সম্মান পেলেন। যদিও এর আগে মার্কিন মুলুকেরই কেউ কেউ একুশে পদক, বাংলা অ্যাকাডেমি পুরস্কার অযোগ্য হয়েও বাগিয়ে নিয়েছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছিল।
হাসান ফেরদৌসের এই পুরস্কার প্রাপ্তির সংবাদ প্রচারিত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র অভিবাসী আরেকজন লেখক, চিন্তক আবেদীন কাদের একটি দরকারি স্ট্যাটাস দিয়েছেন ফেসবুকে। খুবই প্রাসঙ্গিক বিধায় এই স্ট্যাটাসটি এখানে যুক্ত করতে চাই। তিনি লিখেছেন,
‘‘আজ আমার শ্রদ্ধেয় অগ্রজপ্রতিম বন্ধু হাসান ফেরদৌসকে ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ পুরস্কার’-এ ভূষিত করেছে বাংলা অ্যাকাডেমি। এজন্য হাসান ভাইকে অভিনন্দন! হাসান ভাইয়ের বয়স কিছুদিনের মধ্যেই সত্তর বছর হবে। আজ পঞ্চাশ বছর যাবৎ সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ লিখছেন এবং গবেষণা করছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তিনি একাধিক গবেষণা গ্রন্থ রচনা করেছেন, যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য কাজ বলে অনেকে মনে করেন। অনুবাদ করেছেন। আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে বই লিখেছেন। প্যালেসটাইন সমস্যা নিয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন যা বাংলা অ্যাকাডেমি প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের ছাত্রজীবনে মেধা তালিকায় গোড়ার দিকে থেকে তিনি ছাত্র হিসেবে উজ্জ্বল মেধার পরিচয় দিয়েছেন একাধিক বার। বাংলা অ্যাকাডেমি সাহিত্য ছাড়া অন্য বিষয়েও তার প্রবন্ধগ্রন্থ প্রকাশ করেছে। সেদিক থেকে তিনি অনেকদিন ধরেই প্রবন্ধ সাহিত্যে বাংলা অ্যাকাডেমি পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য নিঃসন্দেহে। তা লিখিতভাবে লিখেছেনও একাধিক লেখক।
রাষ্ট্রীয় এই মর্যাদাপূর্ণ বাংলা অ্যাকাডেমি যেন এমন কিছু না করে, যাতে সাহিত্যের পাঠকদের মনে অ্যাকাডেমির প্রতি অশ্রদ্ধা জন্মায়
বাংলা অ্যাকাডেমি সাহিত্যে একাধিক পুরস্কার দিয়ে থাকে, ওয়ালীউল্লাহ পুরস্কার তার মধ্যে একটি। কিন্তু বাংলা অ্যাকাডেমি কখনো জাতিকে জানায়নি, এসব পুরস্কারের মধ্যে পার্থক্য কী? কোন মানদণ্ড ধরে একেকজনকে একেক পুরস্কার দেওয়া হয়, তা মনে হয় আমাদের সাহিত্যের পাঠকরা জানেন না। বাংলা অ্যাকাডেমির একজন মহাপরিচালকের নিজস্ব উদ্যোগে এই পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়েছে বলে শোনা যায়, আগে কোনোদিনই এ ধরনের পুরস্কার ছিল না। তাহলে এর হঠাৎ কেন প্রয়োজন হলো, তার ব্যাখ্যাও অ্যাকাডেমি দেয়নি। এতে নাকি যে মহাপরিচালকের মস্তিষ্ক থেকে এই পুরস্কার জন্ম নিয়েছে, তার নিজস্ব কিছু ‘পরিকল্পনা’ ছিল। সবই শোনা কথা, সত্যি নাও হতে পারে। কিন্তু কেন বিভিন্ন ধরনের সাহিত্য পুরস্কার, তার ব্যাখ্যা দেওয়া বাংলা অ্যাকাডেমির জন্য জরুরি। কারণ সাহিত্য কোনো শ্রেণী-বৈষম্য বা বর্ণবাদের স্থান নয়, বিষয়ও নয়। কোনো লেখক বাংলা অ্যাকাডেমির কাছে ব্রাহ্মণ, কেউ নমশূদ্র, এটা কি অমানবিক নয়? কেউ যদি ন্যূন বা গৌণ লেখক হন, তাকে তো পুরস্কার দেওয়ার প্রয়োজন নেই। পুরস্কার পাবেন যোগ্য লেখকরা। তাহলে এই বিচার কেন করছেন আমাদের সাহিত্যের মোড়লরা?
আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, ওয়ালীউল্লাহ পুরস্কার যাদের দেওয়া হয়েছে তারা অনেকেই প্রবাসী। ঢাকায় এদের বলা হয় ‘প্রবাসী লেখক’। আর ঢাকায় যারা বিখ্যাত প্রবন্ধ লেখক, তাদের কেউ কেউ বাংলা অ্যাকাডেমির মহাপরিচালকও হয়েছেন। এদের প্রবন্ধের মান সত্যিকার অর্থে কেমন? সব লেখা বিচারই তুলনামূলক, অন্য ভালো লেখার সঙ্গে তুলনা দিয়েই বিচার করা হয়। এই সব মহাপরিচালকদের লেখা বাংলা সাহিত্যে বড় প্রবন্ধকারদের সঙ্গে তুলনা করলে কোথায় দাঁড়ায়! দুই বঙ্গের প্রবন্ধ সাহিত্যের বিচারে এদের মান কেমন কেউ কি তা লিখে বুঝিয়ে দিয়েছেন পাঠকদের? যদিও এরা শুধু বাংলা অ্যাকাডেমি পুরস্কার নয়, একুশে বা স্বাধীনতা পুরস্কার ধরনের অনেক পুরস্কারই বাগিয়ে নিয়েছেন রাজনীতিকদের তোষামোদ করে। আমাদের সাহিত্যের বিচার এত বেশি দুর্নীতিপরায়ণ কবে থেকে হলো এবং এর সাংস্কৃতিক বা সাহিত্যিক কারণ কী, তা আমাদের লেখকদের ভেবে দেখা প্রয়োজন।
এর আগে, কবি ওমর শামস ও কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালকে এই পুরস্কার দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তারা দুজনেই নিজেদের আত্মমর্যাদায় আঘাত মনে করে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন বলে কাগজে এসেছে। আসলে ওয়ালীউল্লাহ পুরস্কারটি প্রবাসে বসবাসরত লেখকদের সান্ত্বনা হিসেবে দিয়ে সাহিত্যের মোড়লদের লন্ডন, নিউইয়র্ক বা টরোনটোতে ভ্রমণের পথ সুগম করে কারও কারও বাড়িতে মুরগির ঝোলের সঙ্গে রবীন্দ্রসংগীত শোনা বা সাহিত্যসভা আয়োজকদের কল্যাণে দুয়েক সন্ধ্যা আটলান্টিক সিটিতে বিনোদন নিশ্চিত করার প্রতারণাপূর্ণ বাহানা নয়তো? কারণ ঢাকার সাহিত্যের মোড়লরা নিউইয়র্ক লন্ডনে সাহিত্য অনুষ্ঠানের পাটাতনে দাপাদাপি করতে আবার খুব ভালোবাসেন। তাই সাহিত্যের যে মূল কাজ রুচি নির্মাণ, মানুষের মনকে সংস্কৃত করা, সেটা এইসব মোড়লের একটু মনে রাখা প্রয়োজন। রাষ্ট্রীয় এই মর্যাদাপূর্ণ বাংলা অ্যাকাডেমি যেন এমন কিছু না করে, যাতে সাহিত্যের পাঠকদের মনে অ্যাকাডেমির প্রতি অশ্রদ্ধা জন্মায়!’’
আরেকটি জরুরি কথা এখানে যুক্ত করতে চাই। বাংলাদেশকে যদি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মূল চারণভূমি বিবেচনা করা হয়, তাহলে সেই বাংলাদেশে প্রতি সপ্তাহে তিন-চারটি মানসম্মত লেখা ছাপা হয়; এমন লেখকও বিদেশে থাকেন। আজকাল বিদেশে থেকে দেশের সঙ্গে যুক্ত থাকাটা খুব কষ্টকর কিছু নয়। কারণ দেশের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কাঠখড় পুড়িয়ে ঢাকায় আসতে যদি ১৬/১৭ ঘণ্টা লাগে, তাহলে লন্ডন থেকে নয় ঘণ্টায় আর নিউইয়র্ক থেকে ১৯ ঘণ্টায় কেউ পৌঁছে যেতে পারেন ঢাকায়! অতএব ‘প্রবাসী’ বিভাজনটা খুবই ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে না?
না, ‘প্রবাসী লেখক’ আগেও ছিলেন না, এখনো নেই। সবাই বাংলা ভাষার লেখক। তাই এই দেয়াল সরিয়ে ফেলা উচিত। ‘শুধু প্রবাসীরাই পাবেন’ বলে দ্বিবার্ষিক এই সাইনবোর্ড নামিয়ে ফেলা হোক। সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহর জীবন ও সাহিত্য নিয়ে ব্যাপক চর্চার সুযোগ দিয়ে দেশি-প্রবাসী সব লেখককে তা পাওয়ার সুযোগ দেওয়া হোক। একইসঙ্গে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে যারা মেধা, মনন, প্রজ্ঞা ও স্বাতন্ত্র্য নিয়ে শিকড়মুখী কাজ করছেন, তাদের সেই আলোকেই বাংলা অ্যাকাডেমি সাহিত্য পুরস্কার দেওয়া হোক।
নাগিব মাহফুজ বলছেন, ‘আমি ডাক দিয়ে যাচ্ছি। কোথা থেকে ডাক দিচ্ছি, সেটা বিষয় নয়। তুমি যদি সৃজনের পথে আমার সারথী হও, তবে হাত বাড়িয়ে দাও।’
হ্যাঁ। একজন লেখক কোথায় থাকেন, সেটা এখন আর বিষয় নয়। আগেও ছিল না। এই বিবেচনাবোধ উজ্জ্বল না হলে প্রকৃত মেধাবীরা আঁধারেই থেকে যাবেন।