মানুষ মাত্রই তার কাজের স্বীকৃতি আশা করে। কেউ তার কাজকে ভালো বলুক, প্রশংসা করুক, এটা সৃষ্টিশীল সব মানুষেরই আশা। যে শ্রমিক হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেন, তিনি দিন শেষে মজুরির দাবির পরও আশা থাকে কাজের প্রশংসা শোনার। প্রশংসা শোনার এই আশাই সৃষ্টিশীল মানুষের প্রেরণা। প্রশংসা যখন আনুষ্ঠানিক হয়ে ওঠে, তা যখন পোশাকী মোড়কে বাঁধা পড়ে, তাই হয়ে ওঠে পুরস্কার। ব্যক্তির কাজের মূল্যায়ন, তার প্রতিভার মূল্যায়নই পুরস্কার। সেই মূল্যায়ন ব্যক্তি কর্তৃক হতে পারে, আবার গোষ্ঠী বা সংগঠন কর্তৃকও হতে পারে। এমনকী রাষ্ট্রও ব্যক্তির প্রতিভা ও কাজের মূল্যায়নে পুরস্কার ঘোষণা করে।
পুরস্কার অর্থমূল্যসহ হতে পারে আবার অর্থমূল্য ছাড়াও হতে পারে। কিন্তু যেকোনো ধরনের বা পর্যায়ের মূল্যায়নই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাজের স্বীকৃতি। এই স্বীকৃতি একজন মানুষের সামনে চলার প্রেরণা। তার কাজের উদ্যোম বাড়িয়ে দেয়। আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি কাজের সম্মান। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে, সাদা চোখে—বস্তুগত সাফল্যের পরিমাপ করা গেলেও, শিল্প-সাহিত্যের বস্তুগত পরিমাপ করা যায় না। সে অর্জন দৃশ্যমান নয়, যা শুধু অনুমান-অনুভব করা যায়। ব্যক্তির মনে যার অবস্থান, তার মূল্যায়ন বা স্বীকৃতি তুলনামূলকভাবেই শিল্পের কঠিন পথের মতোই।
এরপরও এই কঠিন পথে হেঁটেই বিভিন্ন পর্যায়ের শিল্প-সাহিত্য ক্ষেত্রে শিল্পী-সাহিত্যিকের মূল্যায়ন করা হয়। তাদের কাজের জন্য পুরস্কৃত করা হয়। যদিও অনেক সময় এই পুরস্কার বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠতে পারে না। তার কারণ সম্ভবত শিল্পের কঠিন পথের মতোই কঠিন। কারণ, যার অবস্থান ব্যক্তির মনে, যা মানুষের মনকে নাড়া দেয়, যে অর্জন কোনো বস্তুগত জিনিস দিয়ে পরিমাপ করা যায় না, যা শুধু অনুভব-অনুভূতির বিষয়, যার মূল্যায়ন শুধু ব্যক্তির মনেই হয়, তাকে অন্যান্য দৃশ্যমান বিষয়ের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলা অসঙ্গত। এজন্যই হয়তো শিল্প-সাহিত্যে মূল্যায়ন অনেক সময়েই বিতর্কের ঝড় তোলে। যার কাজ একজনের ভালো লাগছে, অন্য একজনের তা নাও ভালো লাগতে পারে। ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির রুচির পার্থক্যই শিল্প-সাহিত্যের পছন্দে ভিন্নতা তৈরি করে।
আমাদের দেশেও নানাভাবে শিল্প-সাহিত্যক্ষেত্রে অবদান রাখায় ব্যক্তিকে সম্মানিত করার উদ্যোগ চোখে পড়ে। তবে সেসব উদ্যোগের অধিকাংশই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারে না। স্বাধীনতার আগে সাহিত্যে প্রভাবশালী ও মর্যাদাবান পুরস্কার ছিল ‘আদমজী পুরস্কার’। এর বাইরেও ব্যক্তি ও সংগঠন পর্যায়ে সাহিত্যিকদের সম্মানিত করতে নানা পুরস্কার-সম্মাননার চল ছিল। কিন্তু তার কোনোটিই সেই পথে সচল থাকতে পারেনি। স্বাধীনতার পরেও বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি পর্যায় থেকে পুরস্কার-সম্মাননা দেওয়া হতো। রাষ্ট্রীয় ও অ্যাকাডেমিক পুরস্কারের বাইরে অনেক পুরস্কারই সুধীসমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। মর্যদা ও নিরপেক্ষ বিচারের ক্ষেত্রে এমনও দেখা যেতো, ব্যক্তি বা সংগঠনের পক্ষে দেওয়া অনেক মর্যাদাবান পুরস্কারে ভূষিত ব্যক্তি কয়েক বছরের মধ্যেই বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হতেন। রাষ্ট্রীয় একুশে ও স্বাধীনতা পদকের জন্যও তারা মনোনীত হতেন। কিন্তু ধারাবাহিকতা না থাকায় এবং নানা কারণে অনেক ব্যক্তি ও সংগঠনের পক্ষে দেওয়া পদক নিয়মিত প্রদান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেসব পদক ও পুরস্কার আর সেই মান ও মর্যাদা ধরে রাখতে পারেনি। এখনো প্রতিবছরই সারাদেশের নানান সাহিত্য সংগঠনসহ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সাহিত্যিকদের পুরস্কৃত করা হয়। এইসব পুরস্কারের বাইরে-সাহিত্যিকদের জন্য দেশের সবচেয়ে মর্যাদাবান পুরস্কার ‘বাংলা একাডেমী’ পুরস্কার, একুশে পদক ও স্বাধনীতা পদক।
বাংলা একাডেমীর পক্ষে দেওয়া পদকের বাইরে দেশের রাষ্ট্রীয় পদক দুইটি। সর্বোচ্চ বেসামরিক এই দুটি পদক শুধু সাহিত্য ক্ষেত্রে নয়, সমাজ ও দেশের ভেতরে ও বাইরে নানা ক্ষেত্রে অবদানের জন্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়। এরমধ্যে একুশে পদক বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসরকারি পুরস্কার। ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’ ১৯৭৬ সাল থেকে এই পদকটি ভাষা আন্দোলন ও ভাষা শহীদদের স্মরণে প্রচলন করে। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, শিক্ষা, গবেষণা, ভাষা ও সাহিত্য, শিল্পকলা, সাংবাদিকতা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, সমাজসেবা এবং অর্থনীতি—এই দশটি বিষয়ে সরকার প্রতিবছর একুশে পদক প্রদান করে। পদক চালু হওয়ার পর প্রথমবার একুশে পদকে ভূষিত হন কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
উল্লিখিত এই লেখকদের মাঝে অথবা আলোচনার বাইরে থাকা যোগ্যতম কারও হাতে উঠবে একুশে পদক।
একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রত্যেকে ১৮ ক্যারেটের সোনা দিয়ে তৈরি ৩৫ গ্রাম ওজনের একটি পদক, একটি সম্মাননা সনদ, একটি রেপ্লিকা ও পুরস্কারের অর্থমূল্য প্রদান করা হয়। শুরুতে এই পুরস্কারের অর্থমূল্য ছিল পঁচিশ হাজার টাকা। পরবর্তী সময়ে বাড়তে বাড়তে এখন পুরস্কারের অর্থমূল্য দুই লাখ টাকায় উন্নীত হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে এই পুরস্কার পাওয়ার যোগ্যদের তালিকা তৈরি হয় সরকারের সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দেশের সব জেলা প্রশাসক ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন সব অধিদপ্তর, দপ্তর, সংস্থা ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠানো প্রস্তাব অনুযায়ী। এছাড়া একুশে পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তিও নির্ধারিত ছকে তার মনোনয়ন প্রস্তাব জমা দিতে পারেন। প্রাপ্ত তালিকা থেকে যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যম জাতীয় পুরস্কার সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাব-কমিটি উপযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচন করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠায়। প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দেওয়ার পরই পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম প্রকাশ করা হয়।
দশটি বিষয়ে একুশে পদক প্রদান করা হলেও, বরবারই শিল্পমোদী মানুষের আগ্রহ থাকে সাহিত্যের দিকে। অন্যান্য শাখা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা না থাকলেও শিল্প-সাহিত্যে কে বা কারা এই পদকে ভূষিত হবেন, তা নিয়ে বরাবরই কৌতূহল থাকে। এ নিয়ে আলাপ-আলোচনাও হয় প্রচুর। এমনকী পুরস্কার ঘোষণার পরও চলতে থাকে আলোচনার ঝড়। পছন্দের ব্যক্তির নাম তালিকায় না দেখে অনেকেই হতাশ হন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বহুল ব্যবহার হওয়ায় পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণার পর আনন্দ ও হতাশা দুই-ই টের পাওয়া যায়। কখনো কখনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাহিত্য বিষয়ে পুরস্কার নিয়ে এতটাই আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে যে, সম্মিলিত প্রতিক্রিয়ার ফলে সিদ্ধান্ত পাল্টানোর মতো ঘটনাও ঘটেছে। এবারও এগিয়ে আসছে একুশে পদক ঘোষণার সময়। স্বাভাবিকভাবেই শিল্প-সাহিত্যমোদীদের মাঝে পুরস্কার বিষয়ে আগ্রহ-কৌতূহলও বাড়ছে। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন আলোচনায় ঘুরে ফিরে আসছে—রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ (মরনোত্তর), আবিদ আনোয়ার, মাহবুব সাদিক, কাজী রোজী, কামাল চৌধুরীর নাম।
একুশ শতকের সত্তর দশকের কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। জন্ম ১৯৫৬ সালের ১৬ অক্টোবর, বাবার কর্মস্থল বরিশালে। বেড়ে ওঠা, পড়ালেখা ঢাকায়। স্বৈরাচারবিরোধী প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কবিতা মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম ও অসাম্প্রদায়িকতার উদাহরণ। সাতটি কবিতার বইয়ের বাইরেও রয়েছে তার লেখা গল্প, কাব্যনাট্য ও গান। মাত্র চৌত্রিশ বছর বয়সে ১৯৯১ সালের ২১ জুন তিনি মারা যান। স্বল্পায়ু রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ রচনা করেছেন অসংখ্য স্মরণীয় পঙ্ক্তি। তার লেখা ‘ভালো আছি ভালো থেকো’ গানটি এখনো সংগীতপ্রেমীদের কণ্ঠে কণ্ঠে ফেরে।
আলোচনায় থাকা আরেকজন হলেন কবি, প্রাবন্ধিক, গল্পকার ও গীতিকার আবিদ আনোয়ার।জন্ম ১৯৫০ সালের ২৪ জুন, কিশোরগঞ্জে। অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নেওয়া আবিদ আনোয়ার দশক বিচারে সত্তর দশকের কবি।
একইসময়ে আভির্ভূত আরেক কবি কামাল চৌধুরী। জন্ম ১৯৫৭ সালের ২৮ জানুয়ারি। প্রেম ও দ্রোহের কবি কামাল চৌধুরীর কবিতায় রয়েছে সমাজ ও সময়চেতনা। সংবদেনশীল এই কবি নির্মাণ করেছেন প্রেম ও দ্রোহের ভাষা। কামাল চৌধুরীর রচিত গানেও রয়েছে ভিন্নমাত্রা।
আলোচনায় থাকা আরও দুজন হলেন, মাহবুব সাদিক ও কাজী রোজী। দুজনই দশক বিচারে ষাটের দশকের। মাহবুব সাদিকের জন্ম ১৯৪৭ সালের ২৫ অক্টোবর। অংশ নিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে। গদ্য ও কবিতা দুই মাধ্যমেই সচল। শিল্পের শুদ্ধ চর্চায় বিশ্বাসী মাহবুব সাদিক কবিতা রচনা করেছেন ছন্দ-মাত্রার নিখুঁত ব্যবহারে। যুক্তি ও মননে ঋদ্ধ তার কবিতা।
কাজী রোজীর জন্ম ১৯৪৯ সালের ১ জানুয়ারি। স্পষ্ট উচ্চারণের মধ্য দিয়ে ষাটের দশকের এই কবি নির্মাণ করেছেন তার নিজস্ব স্বর।
এছাড়া, সাহিত্যমোদীদের মধ্যে আলোচনা চলছে, ইসহাক খান, তপন বাগচী, মলয় ভৌমিক ও সুজন বড়ুয়াকে নিয়েও। এই চারজনের কাজের পরিমাণও কম নয়।
আলোচিত এই লেখকদের মাঝে অথবা আলোচনার বাইরে থাকা যোগ্যতম কারও হাতে উঠবে একুশে পদক। প্রত্যাশা করি, যোগ্যতম ব্যক্তির হাতেই উঠুক-যোগ্যতম পদক। সম্মানিত ব্যক্তির কর্ম নিদর্শনে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে আনুষ্ঠানিকতা।