প্রবাদে আছে, যত মত তত পথ। আবারও ধর্ষণ। এবার বিকৃত যৌনাচারে কিশোরীর মৃত্যু। অভিযোগ কিন্তু ওই বাবা-মায়ের দিকে, সন্তানকে সঠিক শিক্ষা দেয়নি। আসলেই তাই, সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে, সেদিকে খেয়াল নেই আমাদের। বিত্তশালী পরিবারের সন্তানেরা আধুনিকতার নামে অবাধ যৌনতাকে নিজের স্বাধীনতার একটা অংশ মনে করে। শরীরের মুক্তি চেয়ে হয়তো অনেক নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে নারী-স্বাধীনতার রূপকল্পে বিশ্বাসী হয়ে ওঠে। এতে স্বভাবসূলভ কিছু পোড়খাওয়া মানুষ সমর্থন করে। এতে লাভের খাতা শূন্য থেকেই যাচ্ছে। বাবা-মায়ের শাসনব্যবস্থাকে হয়তো নির্যাতনের শামিল ভেবে সবাই এভয়েড করে, কিন্তু বিষয়টি আসলে তা নয়। টিনএজ ছেলেমেয়ের গণ্ডি যতই বিস্তৃত হোক, সেখানে বাবা-মায়ের খোঁজ রাখা জরুরি।
পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ যদি না থাকে, সেখানে শাসন নির্যাতনের শামিল হয়। বাবা-মা চাকরি করলেই যত জ্বালা, এতে সন্তান লালন-পালনে সমস্যা। একদল লোক মায়ের চাকরিকে মোটেই সমর্থন করে না। তারা ভেবে দেখে না, উন্নত দেশের প্রত্যেক মানুষই কর্মজীবী। তারা কেমন করে সামলায় সব? তাদের সন্তানেরা তো আমাদের সন্তানের মতো এমন পুতুপুতু করে না। গলদ আসলে অন্য জায়গায়। নিজেরাও যেমন মানুষকে সন্মান করতে জানি না, অন্যেরর সমস্যা-সুবিধার কথা ভাবি না, তেমনি বাচ্চাদেরও এই শিক্ষা দেই না। টাকা থাকলেই কেল্লাফতে। পায়কে আমাদের।
দামি বাড়ি, আসবাব, জীবনযাপন আমাদের কিন্তু সুখী করতে পারছে না। কারণ আমরা রোবট হয়ে যাচ্ছি, আমরা নিজেকে নিজেরাই তো সময় দেই না, সেখানে সন্তানকে সময় দেওয়ার কথা হাস্যকর বটে। টাকা থাকলে প্রেম হয়, সেক্স হয়, আসলে আমাদের মন-শরীর নিজেরাই নিজেদের পণ্য ভাবি। আমি বারবার বলি, জীবনের জন্য বিশাল টাকা-পয়সার প্রয়োজন নেই। সততা দিয়ে কখনো কাড়ি কাড়ি টাকার মালিক হওয়া যায় না। গাড়ি বাড়ি দালানকোঠা এসব ফোবিয়ার মতো মানুষকে আছন্ন করে রাখে। নারীর যেমন উপার্জন করার প্রয়োজন আছে, তেমনি বিয়ে, সন্তান লালন-পালন এসবেরও প্রয়োজন আছে। প্রয়োজন আছে একে অন্যকে সময় দেওয়ারও।
যুদ্ধ করি স্বামীর সঙ্গে নয়, তথাকথিত পুরুষতান্ত্রিক সিস্টেমের সঙ্গে। মনোমালিন্য হলে, মতের অমিল হলে ডির্ভোস দেওয়ার পক্ষে আমি নই।
আমিও চাকরি করি। আমার মেয়েরা আমার কাছে থাকে, নানা বাড়ি থাকে, বাবার কাছেও থাকে। আমি বড় মেয়েকে শরীর সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়ে দিয়েছি। ওদের স্পর্শকাতর বিষয়গুলোকে পাট টু পাট খোলামেলা আলোচনা করি। বিয়ের প্রয়োজনীয়তা, বন্ধুত্বের প্রয়োজনীয়তা, পারিবারিক সম্পর্ক, বয়স্কদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার ধাপগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করি। এতে সহজ বিষয়গুলো ওর জটিল মনে না হোক। বইয়ের দোকানে গেলে মেয়েদের জন্য একটা গল্পের বই আমি কিনি। ছোট থেকে বই পড়ার অভ্যাস তৈরি হলে, আর যাহোক একাকিত্ব বোধ, নষ্টাচারের প্রতি মনোযোগ যাবে না।
সেদিন ফোন করে স্বামী আমাকে জানালো যে, বড় মেয়ে তার এন্ড্রয়েড ফোনটা ওর বাবাকে দিয়ে দিসে। নতুন ক্লাসে, নতুন বই নিয়ে ব্যস্ত। বললাম, স্কুল খোলা না পর্যন্ত আমার কাছে থেকে যেতে, ওরা বাবার কাছেই রয়ে গেছে। অথচ আমাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দ্বন্দ্ব লেগেই থাকে। আমিও শ্বশুর বাড়ি যাই সপ্তাহে একবার। পাড়াপ্রতিবেশী সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চেষ্টা করি। এর পেছনে কারণ হলো, আমার বাচ্চারা যেন হীনন্মন্যতায় বড় না হয়। আমি কার সঙ্গে মিশি, কী লিখি, কোথায় যাই, কার সঙ্গে ইনটিমেট, সব আমার বড় মেয়ে জানে।
গত সপ্তাহে বাড়ি গেলে, বিকেল বেলা দেখি মেয়ে বাজারে ওর বাবার দোকানে গেছে, বাবাকে নিয়ে কেক, বেলুন, মোমবাতি কিনেছে। কেকের ওপরে লিখেছে হ্যাপি এনভার্সারি, ওর বাবার নাম ও আমার নাম। বাড়ির বাচ্চাদের নিয়ে, দাদি-চাচিকে সঙ্গে নিয়ে হৈ-হুল্লোড় করে কেক আমাকে দিয়ে কাটিয়ে আনন্দ করেছে। বারো বছরের ছোট্ট মেয়েটি বাবা-মায়ের সম্পর্কে জোড়া লাগানোর চেষ্টা আমাকে মোহিত করে দিলো। আপনারা বলবেন, ধান বাধতে শিবের গীত গাইছি। যুদ্ধ করি স্বামীর সঙ্গে নয়, তথাকথিত পুরুষতান্ত্রিক সিস্টেমের সঙ্গে। মনোমালিন্য হলে, মতের অমিল হলে ডির্ভোস দেওয়ার পক্ষে আমি নই। একজন মানুষের দরকার আছে জীবনে। সন্তানের জন্য দরকার আছে বাবা, কাকা, ফুপু সবার। সংগ্রাম সবাই করে। কেউ বেশি করে, কেউ কম করে কিন্তু করে তো! মানিয়ে নেওয়ার নামই ম্যাচুউরিটি, যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকার নামই ম্যাচুউরিটি। আমি নিজেই আপসহীন। ধৈর্য শেষ পরীক্ষা পর্যন্ত আমি দিতে পারি। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এসে আমিও শান্তি খুঁজে নেই। নিজেকে নিজে বোঝাই।
আমি বলতে চাই আমাদের সন্তানরা অভাব, দারিদ্র্য, ক্ষুধা ও না-পাওয়ার যন্ত্রণা কিছুটা হলেও বুঝুক।