মেলা। মেলা মানে আনন্দ। মেলা মানে জটলা। মেলা মানে হৈ-হল্লা। মেলা মানে বর্ণিল আয়োজন। আনন্দ আড্ডা। বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় জাতীয় মেলা হচ্ছে পহেলা বৈশাখ। অন্যদিকে, যদি হয় বই নিয়ে মেলা হয়? তাহলে তো আর কথাই নেই! যেখানে বইপোকা, জ্ঞানভুক থেকে শুরু করে শিল্পমেজাজের নানামুখী মানুষের ভিড় বা জটলা দেখা যায়; যে জটলা অন্যরকম জটলা। যে আড্ডা অন্যরকম আড্ডা। এমন জটলা বা আড্ডায়, কত কৌতূহলী জন কত প্রশ্নের উত্তর পেয়েছে। কত মনকে দিয়েছে কাঙ্ক্ষিত বই বা সুলুক সন্ধান। এরকম আড্ডা থেকেও পৃথিবীতে ঘটে গেছে যুগান্তকারী কত শত বিপ্লব!
বর্ষার কাদাপানিতে একসময় গ্রাম-বাংলার বিল-ঝিল হাঁট-মাঠ-ঘাট ভেসে থাকতো। তখন মানুষ ঘরে বসে সৃজনশীলতার আরেক চাষ শুরু করতো। কেউ জালবোনা। কেউ কাঁথায় ফুল গাঁথা। বালিশ রুমাল থেকে শুরু করে কত নান্দনিক জিনিস; বউ ঝি কন্যা, অশীতিপর বৃদ্ধটি পর্যন্ত পুঁথি হঁলা গান বাঁধা থেকে শুরু করে কত ধরনের বিচিত্র নির্মাণ!
কালিদাসের ‘মেঘদূত’ কাব্য, এই কাব্যে বর্ষার সমস্ত আবেগ-বিরহের অনুরণন অনবদ্য উপস্থাপনায় আমাদের হৃদয়কে উদ্দীপিত করে আছে; ফলে এটি ‘বর্ষাকাব্য’ অথবা ‘বিরহকাব্য’ নামেও সমাদৃত। এছাড়া, পঞ্চদশ শতকের মধ্যযুগের বিখ্যাত কবি বিদ্যাপতি, বর্ষাস্নাত-প্রেম বিরহের অনন্য বার্তা দিয়েছেন যেভাবে, ‘এ সখি হামারি দুঃখের নাহি ওর/ এ ভরা বাদর মাহি ভাদ্র শূন্য মন্দির মোর।’ ঠিক তার বিপরীতে করোনাকালীন পৃথিবীও মানুষের ধোঁয়াচ্ছন্ন কষ্টমেঘ বিচিত্র শঙ্কা ও দুঃখবোধ নিয়ে হৃদয়কে ছারখার করছে। এখনো চলমান।
রবীন্দ্রনাথ তার ‘বিচিত্র প্রবন্ধ’ গ্রন্থের ‘লাইব্রেরি’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘হিমালয়ের মাথার উপরে কঠিন বরফের মধ্যে যেমন কত কত বন্যা বাঁধা আছে, তেমনি এই লাইব্রেরির মধ্যে মানবহৃদয়ের বন্যা কে বাঁধিয়া রাখিয়াছে!’ বছর শেষে এমন বইমেলাকেও আমরা একটি বৃহৎ লাইব্রেরির সঙ্গে চিন্তা করতে পারি। যে লাইব্রেরিতে বাঁধা আছে কত জ্ঞান, কত প্রাণ, কত আশা, কত আকাঙ্ক্ষা, অপেক্ষা বা প্রতিক্ষার প্রহর!
ফেব্রুয়ারির এই সময়টায় বইমেলা করার বিবেচনা বাদ দিয়ে মার্চ-এপ্রিলের দিকে (বিদ্যমান পরিস্থিতি বিবেচনায়) করার একটি প্রস্তাবনা রাখা যেতে পারে। করলেও লোক সমাগম কমিয়ে সবার উপস্থিতি যাতে নিশ্চিত করা যায়; তার একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও বিবেচনা মাথায় রাখতে হবে।
এই শীতের মাসে বৃষ্টিভেজা ভারি বর্ষা হয়তো নেই। কিন্তু আবেগের ছলাৎ-বর্ষাকে আপনি কিভাবে থামিয়ে রাখবেন? সে যদি হয় নিজ বইয়ের লেখক। একজন কাঙ্ক্ষিত বই পাগল পাঠক। অথবা একজন প্রকাশক। বইমেলায় এই তিন স্রোতের মানুষের প্রয়োজন আর আবেগকে আপনি ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন না।
তাই বলা যায়, করোনাক্লান্ত এই সময়—বর্তমান বইমেলা না হওয়া সত্যি একটা দুঃখজনক ব্যাপার। অনেক সময় পরিস্থিতির বৈপরীত্যকেও আমাদের আমলে নিতে হবে। সেই পরিস্থিতি যদি হয় মানুষ সংহারক, তাহলে? এজন্য সচেতনতা, বিবেচনাবোধ ও দূরদর্শিতা এখানে কাম্য। বইমেলার বিষয়টিও তাই।
মহামারীর কারণে পুরো বিশ্ব এখন শারীরিক ও মানসিক ক্রান্তিলগ্ন পার করছে। কেউ হারিয়েছে জাতীয় সম্পদ; জাতীয় মানুষ। রক্ত সম্পর্কের স্বজন। কাছের প্রিয় মানুষ। বন্ধু বা শুভাকাঙ্ক্ষী। অন্যদিকে কেউ হারিয়েছে জীবন ও জীবিকার একমাত্র সম্বল সোনার হরিণ ধরা চাকরি। কারও ব্যবসা বাণিজ্য একেবারে শেষ। কারও লস কারও ধস। কারও চাকরির বেতন নেমে এসেছে অর্ধেকে। কেউ বা সহায় সম্বলহীন হয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে নগর ছেড়ে চলে গেছে গ্রামে।
বিদ্যমান এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু। দ্রুত এই মৃ্ত্যুর মিছিল—যা একেবারে সংখ্যার বিবেচনায় চলে গেছে! উপর্যুপরি একেক জন একেক কিছু হারিয়ে সমবেদনার (ন্যূনতম চিন্তার) জায়গাটুকু পর্যন্ত অবশিষ্ট নেই! এই বিষয়গুলো বিবেচনা রেখে বইমেলার ঢলকে আপনি বা আমরা কিভাবে মোকাবিলা করবো, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। তাই প্রশাসনিকভাবে একটি সুনির্দিষ্ট প্রটোকল মেনটেইন না করলে এটি সুস্থভাবে সম্পন্ন করা সত্যি ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপজ্জনক হতে পারে। বইমেলার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও সচেতন বোদ্ধা মহলের বিশেষ বিবেচনাও এখানে জরুরি। মেলায় ঢুকার প্রবেশ পথের শৃঙ্খলা ও পরিচ্ছন্নতা কেমন; আবার বইমেলার ভেতর-মাঠে শারীরিক দূরত্ব বা জটলা নিয়ন্ত্রণে রাখা, দু’টাই বড় চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। তাই ফেব্রুয়ারির এই সময়টায় বইমেলা করার বিবেচনা বাদ দিয়ে মার্চ-এপ্রিলের দিকে (বিদ্যমান পরিস্থিতি বিবেচনায়) করার একটি প্রস্তাবনা রাখা যেতে পারে। করলেও লোক সমাগম কমিয়ে সবার উপস্থিতি যাতে নিশ্চিত করা যায়; তার একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও বিবেচনা মাথায় রাখতে হবে।