সময়-সুযোগ পেলে যারা নিজেকে ধরে রাখতে পারে অথবা ঠিক থাকতে পারে, তারা নিশ্চিত ভালো মানুষ। এ সংজ্ঞার কাঁচের প্লেটে বসে মানুষ বের করা বড়ই দূরূহ কাজ। একজন মানুষ নিজেকে সঁপে দিতে ভালোবাসে বেশি। সঁপে দেওয়ার ক্লাসটা নির্ভর করে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার ওপর। দুই পথে তা সম্ভব। এক পথে নিজের আস্থা। অন্যপথে বায়ুবীয় বা অস্বাভাবিক আস্থায়।
মানুষ প্রাকৃতিক নিয়মের একটা অংশ। বেড়ে ওঠার ক্রিয়াকলাপে নির্ভর করে বেঁচে থাকা, সুস্থ থাকা ও সুস্থ থাকা। মানুষ যতই নিয়মের মাঝে আসুক না কেন, হয়তো অনিয়মেই মানুষের আয়ু বাড়ে! যদি তা না হয়, তাহলে মানুষ কিভাবে অপখাদ্য খেয়ে বাংলাদেশে গড় আয়ু বাড়াচ্ছে? হয়তো কোনো সমীকরণই গা-ঘেঁষে বসে না। মানুষ ধর্মের কর্মহীনতা ও বাস্তবতার বিপরীত মেরুকরুণে বসেও নিরাপদ ও সুস্থ থাকতে পেরেছে বলে অনেক কিছু এখন আর নিয়মের ধর্তব্যে ধরা দিতে বাধ্য নয় বা দেয়ও না!
আজকের এই সময়ে দুটো বিষয় নিয়ে ভাবতে বসেছি। দেশ জাতি সব সময় সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, কল্যাণ-অকল্যাণ নিয়ে ভাবতে বাধ্য হওয়া বাঞ্চনীয়। যদিও দেশ আজ বৈশ্বিক এক অপলীলার কোলে বসে বাসর রাতের নতুন স্ত্রীর কাছে গীত গাওয়ার মতো আমাদের প্রেমলীলার হরফ বসেছে। করোনা মানুষের বানানো এক নতুন উৎপাদনপ্রক্রিয়াও বটে! যোগিক প্রক্রিয়ায় মানুষ মানুষের প্রয়োজনে যেমন কল্যাণের কাজ বের করে, তেমনি দেশ, জাতিও মানুষের অকল্যাণের সূত্র বের করতে পারে। করেও আসছে যুগ যুগ ধরে। হয়তো ধরন তার ব্যতিক্রম।
আজকের এই সময়ে সারা বিশ্বে করোনা একবছর অতিক্রান্ত করেছে। আর মানবজাতিও তার প্রায় আটশো কোটি সদস্য থেকে মাত্র ২০ লাখকে হারিয়েছে। সমীকরণ নিত্যমৃত্যু ঘটনার চেয়ে অনেক কম। তারপরও মানুষের বেঁচে থাকা যে নিশ্চিত, তার গ্যারান্টি আজও অথবা কখনো কেউ দিতে পারেনি। হয়তো পারবেও না। অথচ সারা বিশ্বময় সতর্কতার সব ব্যবস্থা, যোগ্যতা ও সামর্থ্য অনুযায়ী গ্রহণ করা হলেও অনেক দেশ জাতি হীনসার্থের বেড়াজালে আটকা পড়ে অথবা দৈন্যের ভদ্রখোলসে গেঁথে গিয়ে কিছুটা পিছিয়ে আছে। থাকবেও! এটাই স্বাভাবিক। তবে নিয়ত সত্যের কাছে মিথ্যার সব বদমাইশরা ধরা খায়। খাবেও।
সব ধরনের সভা-সমাবেশ, নির্বাচনি প্রচারণা, মিছিল-মিটিং, পথসভা কোনোটাতে কোনো ধরনের বাধাবিপত্তি চোখে পড়েনি। অথচ, এই জাতির আত্মপরিচয়ের ভাষা আন্দোলন ও ভাষার মাসে বইমেলা নিয়েই যত সমস্যা?
আজ সারা দেশ তথা আমার সবুজ ভূমি যখন করোনা মোকাবিলার সব প্রস্তুতি শেষ করেছে, তখন আমার ঝোলার নিচে ফুটো হয়ে সব অর্জন হাতছাড়া হতে চলেছে। এরপরও আমরা স্বপ্নের দেশে স্বপ্নের চাষ করতে দোষ দেখি না। তবে, কিছু অচিন্তক বা অলসদেহের কল্যাণে বার বার ভালো কিছু প্রস্তুতি বা সিদ্ধান্তও ভেস্তে যেতে চলেছে।
আজ সারা দেশব্যাপী সরকারের দৃশ্যমান উন্নয়নের পাশাপাশি করোনা মোকাবিলার সব আয়োজন চোখে পড়ার মতো হলেও পরিপালন আইনে জাতিগতভাবে আমরা পরাস্ত। কিন্তু আজকের এই সময়ে রাস্তাঘাটে, হাঁটে-বাজারে, বিয়ে-শাদি, মেজবানে, বাস-ট্রেনে কোথাও মানুষের মাঝে করোনা নিয়ে কোনো ধরনের আতঙ্ক যেমন নেই, তেমনি নেই কোনো সতর্ক পরিপালনও। কোনো কিছুই থেমে নেই।
এদিকে ১৬ জানুয়ারি দেশব্যাপী প্রথম ধাপের কিছু পৌরসভা নির্বাচন চিত্র আমাদের সবার কাছে দেদীপ্যমান। সব ধরনের সভা-সমাবেশ, নির্বাচনি প্রচারণা, মিছিল-মিটিং, পথসভা কোনোটাতে কোনো ধরনের বাধাবিপত্তি চোখে পড়েনি। অথচ, এই জাতির আত্মপরিচয়ের ভাষা আন্দোলন ও ভাষার মাসে বইমেলা নিয়েই যত সমস্যা?
এই মেলার সঙ্গে পুরো জাতির দেশপ্রেম জড়িয়ে আছে বহুবছর ধরে। অথচ এই সময়ে এসে কিছু অপরিণামদর্শীর সিদ্ধান্তে একুশে বই মেলা না করার একটা পরিকল্পনা এঁটেই চলেছে। যারা এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরিকল্পনা করছেন, নিশ্চিত তারা সংস্কৃতির অবক্ষয়ের দিকে এগুচ্ছেন। যে দেশে সব হচ্ছে, সে দেশে বই মেলা না করতে মনস্থির করা মানে এ দেশের বইপ্রেমীদের সঙ্গে এক ধরনের মশকারাও বটে।
আমি মনে করি, সব নিয়ম মেনে বইমেলা করাটা তেমন কোনো কঠিন কাজ নয়। শুধু চিন্তার বিকাশ ঘটাতে পারলেই সব সম্ভব। জাতির জনকের শতবর্ষ উদযাপন করতেও এবারের বইমেলাকে ভিন্ন প্যাটার্নে নিয়ে করা যেতে পারে। যেমন একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করে জাতির জনকের জন্মতারিখ ১৭ মার্চ আয়োজন করা। এতে একদিকে জাতির জনকের প্রতি সম্মান দেখানো হবে, অন্যদিকে বইপ্রেমীদের প্রতিও ভালোবাসা প্রকাশিত হবে। তবে, এরজন্য দরকার সঠিক পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত। তাহলে কেবল বাংলা অ্যাকাডেমি প্রাঙ্গণ বা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নয়, দেশের প্রতিটি থানায় বছরের ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বই মেলার আয়োজন করা সম্ভব।