শেয়ালের ভূগোলের সাথে রইসুদ্দীনের ভূগোরের কানামাছি খেলা
কবরটি মিথ্যে কথা বলেছিল
যুবক শেয়ালটা ক্ষুধা প্রকাশ হতে পারে অথবা ক্ষুধার্ত থাকলে যে ধরনের আওয়াজ হতে পারে তেমন একটা আওয়াজ করে আর ঝোঁপটির ভেতরেই শুয়ে থাকে নির্জীবের মতো। ধুকধুক করতে থাকে তার পেট আর বুক। চোখ দুটো বুঁজে থাকে। কিছুক্ষণ চোখ বুঁজে থাকার পর আবার ক্ষুধামাখা দৃষ্টি নিয়ে কিছুক্ষণ তাকায় যেদিকে যেভাবে মুখ আছে সেদিকে সেভাবেই। চোখ বোঁজা আর চোখ খোলা ব্যাপারটা চলছে। কিছুক্ষণ জীব আর কিছুক্ষণ নির্জীব খেলার ভেতর রয়েছে শেয়ালটা। প্রচুর গরম রয়েছে চারদিকে। এই গোরস্থানটিই যা একটু ছায়াঘন আর শুনশান শান্তির আবাসের মতো। যে গোরস্থানটি সে ছেড়ে এসেছে অথবা যে গোরস্থান থেকে তার জ্ঞাতিরা তাকে তাড়িয়ে দিয়েছে সে গোরস্থানটিও ভালো ছিল।
যুবক শেয়ালটি লেজ নাড়ল আলতোভাবে, মাছি বা পিঁপড়া তাড়াতে অথবা নিজের অস্তিত্ব নিজেকে জানান দিতে। যখন বুঝল, সে তার ভূগোলে আছে তখন যুবক শেয়ালটি আসন পরিবর্তন করে লম্বা হয়ে শোয়। সামনের পা দুটো সামনে সোজা করে—অনেকটা রেললাইনের মতো। পায়ের রেললাইনের মাঝের মাটিতে থুতনি ঠেঁকিয়ে মাথাটিকে সোজা করে শুইয়ে রাখে। একটা মাছি তার মাথার কাছে বা মগজের কাছে বা মগজের ভেতর গুনগুন করছে। মাছিটিকে তাড়ানোর মতো শক্তি তার নেই। নির্লিপ্তভাবে সে মাছির উপদেশ শুনছে। মাছিটা কী কী জানি বলতেই আছে। ভনভন করতে করতে মাছিটা নাকের সামনে এলে জোরে একটা শ্বাসের তীর ছুড়ে তাড়াতে চাইল মাছিকে। শ্বাসের তীর মাছিকে বিদ্ধ করল না। শ্বাস-তীর মাছিটার গায়ে আলতো সুড়সুড়ি তৈরি করলে মাছিটা বুঝে নেয় শেয়ালটার ভূগোলে একটা মৃত্যুশিশু জন্ম নিয়েছে। মৃত্যুশিশুটি বড় হচ্ছে। মৃত্যুশিশুটি কিছুক্ষণের মধ্যেই যুবক হয়ে গেলে যুবক শেয়ালটির সাথে আয়ু নিয়ে ফুটবল খেলা শুরু করবে। শেয়ালটির নিজের শরীরও মৃত্যুর কাছে হেরে যাবার জন্য শেয়ালের বিরুদ্ধে শক্তি সঞ্চয় করছে। মাছিটা যুবক শেয়ালের কানের কাছে বলতে থাকে—‘তুমি মরে যাচ্ছ না কি হে? ভালো ভালো, মর, মরে যাওয়াই ভালো, তুমি মরে গেলেই তোমার উপর ডিম পাড়ব, আমার বাচ্চা হবে, তখন আমি মরে যাব।’
ক্ষুধাক্লান্ত শেয়াল তার মনোযোগের স্টিয়ারিং মাছির দিক থেকে অন্যদিকে ফেরানোর উদ্যোগ করে। আগের গোরস্থান, যে গোরস্থানটি সে ছেড়ে এসেছে তার স্মৃতিসিনেমা দেখার চেষ্টা করে। ঐ লাশস্থানের পাশ দিয়েই রেললাইন গেছে দূরের দিকে। মানুষ কাটা পড়ত না তেমন কারণ সেখানে কোনো স্টেশন ছিল না। তবে মাঝে মাঝে কেউ কেউ আত্মহত্যা করতে আসত শেষরাতের দিকে। আত্মহত্যা সমাপ্ত হবার পর, শেয়ালেরা বুঝে উঠতে উঠতেই ভোর হয়ে যেত, লোকজন চলে আসত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক-আধ কামড় মাংস বা রক্ত চেটে নেওয়া যেত আত্মত্যাগীর আত্মীয়গণ চলে আসার আগেই। ট্রেনের তলায় যে লোকেরা আত্মহত্যা করে তারা তবু কিছুটা ভালো, তাদের আত্মহত্যার জন্য অল্প হলেও টাটকা মাংস বা রক্তের মতো স্বাদু জিনিসের স্বাদ পাওয়া যায়। কিন্তু অনেকেই আছে যারা আত্মহত্যা করে বিষ খেয়ে অথবা গলায় দড়ি দিয়ে গাছে বা নিজেদের ঘরে। এধরনের আত্মহত্যাকারীগণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনো কাজে আসে না। যারা ঘরের ভেতর আত্মহত্যা করে তারা বেশি অভিমানি, সংসারীয় বাস্তবজ্ঞান তাদের কম আর ঘরে আত্মহত্যা করার কারণে তাদের মাংস খেতে পাওয়া যায় না। যারা বাইরে, গাছের সাথে দড়ি বেঁধে আত্মহত্যা করে তারা বেশ ভেবে চিন্তেই আত্মহত্যা করে। তারা বেশ বাস্তবজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ। যুবক শেয়াল এগুলো ভাবে।
বাইরে আত্মহত্যা করার একটা ঘটনা তার মনে পড়ে—সে রাতে সে একটা বাড়ির দিকে যাচ্ছিল মুরগি চুরি করার জন্য এবং ডিঁহিতে পা দেয়া মাত্রই খিড়কির কাঁঠালগাছটির কাছে আত্মহত্যেচ্ছু লোকটিকে দেখতে পায়। প্রথমে সে লোকটিকে চোর ভেবেছিল। তারপর ভেবেছিল প্রেমিক। তারপর ভেবেছিল গৃহেরই কেউ একজন। যাই হোক, লোকটিকে দেখে সতর্কতার সাথে সে যেখানে ছিল সেখানেই নিঃশব্দে বসে যায়। সে লোকটার কর্মকা-ে বুঝে যায় লোকটা আত্মহত্যা করার ধান্দা করছে। লোকটার গাছে দড়ি বাঁধা আর এদিক ওদিক তাকিয়ে ঝুলে পড়ার দৃশ্য খুব মনোযোগ দিয়ে, লালা ঝরাতে ঝরাতে দেখছিল যুবক শেয়াল। লোকটির দেহের সাথে মৃত্যুর সিলমোহরের স্থায়ী ছাপ পড়েছে কিনা তা পাঠ করে সে। কিছুক্ষণ পর লোকটির শরীর নিথর হয়ে গেছে বুঝতে পারলে খুশি হয়ে ওঠে আর গুটি গুটি পায়ে সেদিকে এগিয়ে যায়। গিয়ে দেখে লোকটির শরীর ঈশপের গল্পের আঙ্গুরের থোকা হয়ে গেছে। অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও সে লোকটির পায়ে একটা চাটাও দিতে পারে না। খুব উঁচুতে লোকটি তার ফাঁস বেঁধেছে। লোকটির মাংস ক্ষিধের সাথে তো মিললই না, ফাঁকতালে মুরগির হিসাবটিও বিয়োগপ্রাপ্ত হলো। সুতরাং সে রাত তাকে অভুক্ত থাকতে হয়েছিল। আর বিষ খেয়ে আত্মহত্যাকারী লোকতো আরও একটা হত্যাকারী—একজন খুনি। একবার ঐ গোরস্থান এলাকার একজন বিষ খেয়ে মরেছিল এবং তার মাংস খেয়ে শেয়ালদের কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে মারা গেছিল। পোকামাকড়ও নিশ্চয় কিছু কিছু মারা গেছিল বিষ খাওয়া মানুষের বিষাক্ত শরীর ভোজন করতে গিয়ে।
শেয়ালটা এখানে আসার পর একটা কবরও হয়নি। পরে বুঝতে পেরেছে এটা একটা পরিত্যক্ত কবরখানা। শেয়ালটি আবারও ক্ষুধা কাতর একটি আওয়াজ করে এবং জোরে জোরে শ্বাস নেবার চেষ্টা করে। শুয়ে থাকে। দু’তিন দিন সে কিছু খেতে পায়নি। ‘ঢুকে যাচ্ছি ক্ষুধার ভেতর, ক্ষুধার খর ¯্রােতে ভেসে যাচ্ছি’ ঠিক এধরনের ভাবনা ভাবার সময় সে বেশকিছু মানুষের পদধ্বনি শুনতে পেল। ঝোঁপের আড়ালেই যুবক শেয়ালটি শিশুর মতো টলমল পায়ে উঠে দাঁড়ায়, জুল জুল করে তাকিয়ে দেখে ক্ষুধাভাঙ্গা চোখে।
কয়েকজন লোক এসে, উত্তর দিকের কোণে একটা কবর খুঁড়তে শুরু করল। শেয়ালটার চোখ একটু উজ্জ্বল হয় এবং ক্ষুধাটা আরো একটু চাগা দিয়ে উঠলে বুঝতে পারে, সে বেঁচে আছে। শুয়ে শুয়ে ধুকধুকায়। চোখ বন্ধ করে। কোদালের কোপের শব্দ তার কাছে একধরণের সঙ্গীতের মতো বাজে। সে মধুময় কোদালগান শুনে। সে মিষ্টি কোদালছন্দের মাত্রা গুনে এক… দুই… তিন…। বিড়ির গন্ধ দূর থেকে ভেসে আসে। চার… পাঁচ… ছয়…। মরা মানুষের মাংসের সুগন্ধ তার মগজের কল্পনার ভেতর মৃদু পায়ে হাঁটে। সাত… আট… নয়…। দু’একজন বিড়ি টানছে। কোদাল-মাটির ছন্দগন্ধ মাংসের গন্ধে রূপান্তরিত হয়ে তার পেটকে, নাককে, মনকে উত্তেজিত করে তুলছে। যারা বাঁশ কাটছে আর যে কবরকর কবর খুঁড়ছে সে বিড়ি টানছে না।
শেয়ালটা শুয়ে শুয়ে গা ঘঁষটে ঘঁষটে একটা অবস্থান তৈরি করে, যাতে ঝোঁপের ভেতর থেকে শুয়ে শুয়েই আরো ভালো করে কবর খোঁড়ার জায়গাটা দেখা যায়। মাত্র একহাত মাটি শক্ত তারপরে মিহি বালির স্তর। খুব সহজেই খোঁড়া যাচ্ছে। অপেক্ষামাখা ভঙ্গিতে সে আবার চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। কবর খোঁড়া লোকটি ধীরে ধীরে কোমর সোজা করে দাঁড়ায় আর হাঁপায়—‘লাহু হামাকে বিড়ির আর্ধেকটা দিস।’ লাহু বলে—‘লিয়্যা যাও—কদ্দুর আগাইলো গোরের?’ ‘এই হয়্যা গেছে, বালু চলাইস্ছে আর বেশিক্ষণ লাগবে না’ কবরকারিগর বললে, লাহু নিজেই এসে বিড়িটা তার হাতে দেয় আর কবরের গভীরতা দেখে। কিছুক্ষণের জন্য কোদালের কোপ সঙ্গীত বন্ধ হলে শেয়ালটা চোখ খোলে। পেটের ভেতর ক্ষুধার করুণ বিষাক্ত সাপের ছোবলের মতো গান তার প্রাণ ধরে উপড়ে নিতে চায়। বিড়ি বিরতির পর আবার কবর খোঁড়া শুরু হয়। শেয়ালটি চোখ বন্ধ করে ফের। কিছুক্ষণের মধ্যে কবর খোঁড়া সম্পন্ন হলে খননকারী কবর থেকে উঠে দাঁড়ায় আর শান্ত ক্লান্ত হাসি নিয়ে বাঁশকাটাদের কাছে যায়—‘হামারতো হয়্যা গেছে, তোরঘে আর কদ্দুর কী?’ ‘এই হয়্যা গেছে’—বলতে বলতেই বাঁশের পাটাতনে শেষ পেরেকটি ঠোঁকে পাটাতন প্রস্তুতকারী। লাশ আসার অপেক্ষায় গোরস্থানের আমগাছটির নিচে বসে তারা। কিছুক্ষণের মধ্যে একটা লাশবাহী খাটিয়া আসে আগে আগে আর পেছনে রয়েছে কয়েকজন। কোনো দোয়া দরুদ ছাড়ায় লাশ দাফন করে লোকগুলো চলে যায়।
শেয়ালটা বিচার বিবেচনাহীন লোভের ভেতর পড়ে। সে উঠে দাঁড়ায় লোকগুলো চলে যাবার পরপরই আর ধীরে ধীরে হেঁটে যায় উত্তরের কোণার দিকে যেখানে নতুন কবরের এইমাত্র জন্ম হলো সেখানে। শরীরের প্রায় সব শক্তি সে পায়ে এনে জমা করে এবং বেশ সংযমির মতো হাঁটে লোভটাকে চেপে রেখে কিন্তু আরও উগ্র করে। হাঁটছে ধীরে ধীরে। কবরটার কাছে পৌঁছে আতর বা গোলাপজল বা চন্দনের কোনো গন্ধ সে পায় না। শত গরীব হলেও মৃতদেহের জন্য এটুকু বিলাসিতা করা হয়। এক্ষেত্রে কিছুই করা হয়নি। শেয়ালটা পাশের ভাঙ্গা কবরটার দিক থেকে খোঁড়া শুরু করবে বলে ঠিক করে। লোকজন যখন চলে গেছে আর শেয়ালটা যখন কবরটার কাছে পৌঁছে গেছে তখন দূরে কোথাও মাগরিবের আজান শুরু হয়েছে। কবরের উপর দড়ি দিয়ে একটা কবরপ্যাঁচ করা হয় আর খেজুরের কাঁটা যুক্ত ডাল পুঁতে দেয়া হয়। এ কবরের ক্ষেত্রে তাও করা হয়নি। কবরটা সম্পর্কে একধরণের সংশয় জাগলেও সেটাকে তার পেটের ভেতরের ক্ষিধেটা টুঁটি টিপে ধরে এবং সংশয়টাকেই খাবার জন্য ব্যস্ত হয়। কিন্তু সংশয়কে খাওয়া যায় না। ক্ষিধেটা তার শক্তি নিয়ে পায়ের ভেতর এসে হাজির হয় আর শেয়ালটা আঁচড়ে আঁচড়ে ভাঙ্গা কবরের দেয়াল দিয়ে নতুন কবরের দিকে একটি সুড়ঙ্গ খুুঁড়তে থাকে। খুঁড়তে খুঁড়তে এক একবার সে ওপরের দিকে তাকায়, কেউ আসছে কিনা দেখার জন্য। সংশয়টা বেশ ভারী হয়ে ওঠে যা অন্য সময় হলে বহন করা কঠিন হতো। কিন্তু ক্ষিধেটা বেশ ধারাল ছুরি হয়ে সংশয়টাকে কেটে টুকরো টুকরো করে আর পা দিয়ে খুঁড়তে থাকে কবরের গা। নতুন কবরের গহ্বরে ঢুকতে খুব বেশি সময় লাগে না। মাংসগন্ধহীন লাশের কাফন ছিঁড়ে ফেলতে সময় লাগে না। কিন্তু অবাক হয় শেয়ালটা, বেকুব বনে যায় শেয়ালটা, কবরটির আচরণে। তখনের সেই সংশয়টি এবার নতুন প্রাণ পেয়ে বাস্তবতার রূপ ধরে খামচে ধরে তাকে, তার টুুঁটি টিপে ধরে। কবরের ভেতর থেকে সে আর বের হয়ে আসে না। সংশয়টি অসংশয় হয়ে বিরাট এক হা করে তাকে গিলে নেয়। বাঘের মতো ক্ষিধেটা পেটের ভেতর থেকে বেরিয়ে, যুবক শেয়ালের টুঁটিতে দাঁত বসায়। ক্ষিধেটা তাকে আর বের হতে দেয় না কবর থেকে। সমগ্র শরীরে ক্ষিধের কলা, ক্ষিধের লাল লাল সুর। ক্ষিধেটা কটমট করে তার হাড় মাংস খায়। শেয়ালটি কবরের ভেতরে আর বাইরে নিস্তরঙ্গ অন্ধকার।
কবরটির মিথ্যে বলার কারণ
মৃতদেহ সামনে নিয়ে বসেছিল রইসুদ্দীন ঘরামির বউ আর যারা আশেপাশের বাড়ি বা পাড়া থেকে এসেছিল সেই মহিলাগণ। রইস ঘরামির বউ একরাশ পাতলা পোঁটা নাক থেকে পরনের কাপড়ে মুছে নিয়ে বলে—‘সকালে উঠে তাসরুল মহাজনের বাড়ির চালা ছাওয়ার জন্য বের হবার সময় মালেকের বাপ হঠাৎই “শরীর ভালো লাগছে না” বলে বারান্দার মাটিতেই শুয়ে পড়ে।’ এটুকু বলার পর সে আবার তার কান্নায় সুর দেওয়া শুরু করে।
রইস ঘরামির এমন হবার ঠিক আগক্ষণে রইস ঘরামির বড় ছেলে মালেক তার জন্মানো বাচ্চা-কাচ্চাদের ঝগড়া থামানোর চেষ্টা করছিল। মালেক যখন দেখে তার বাপ অসুস্থ হয়ে গেছে তখন বাচ্চাদের ঝগড়া থামানোর ঝগড়া বন্ধ রেখে বাপের বারান্দার কাছে আসে। মালেকের ছেলেগুলোও তার দাদার কী হয়েছে দেখার জন্য ঝগড়া স্থগিত রেখে বিস্ফোরিত চোখ নিয়ে বারান্দায় এসে দাদার দিকে তাকিয়ে থাকে। রইস ঘরামির বউ একটা দড়ির খাট ঘর থেকে বের করে আনে আর একাজে সাহায্য করছিল তার ছোট পুত্রবধুটা। সবাই মিলে ধরাধরি করে রইস ঘরামিকে দড়ির খাটে ওঠায় এবং মাথায় পানি ঢালার আয়োজন করে। রইস ঘরামির বড় ছেলে মালেক তখনই তার বড় ছেলে ভুলনকে মনু কবরেজের বাড়িতে পাঠায়, তাকে ডেকে আনার জন্য। পানি ঢালতে ঢালতেই মনু কবরেজ এসে হাজির হয়। সে নাড়ি পরীক্ষা করে এবং ‘রইস ঘরামি মরে গেছে’ বলে মতো জানায়। এটা শুনে প্রথমেই কান্না শুরু করে ঘরামির বউ এবং পরে পরে অন্যরাও কান্নার কাজটি শুরু করে দেয়।
কান্নার শব্দপিঁপড়া পাড়ার অলিগলিতে ঢুকে পড়ে আর মহিলাগুলোকে মুখে করে নিয়ে এসে ফেলে দেয় রইস ঘরামির বাড়িতে। তারা রইস ঘরামির মৃত মুখের বাতাসের আওতায় চলে আসে। এসব পাড়াপড়শি মহিলারা এসে তাদের চোখ-মুখে মন ভারী করা ভাব কয়েকমিনিটের মধ্যেই এঁকে ফেলে। ছোট মসজিদের বড় এমাম এসে ‘লাশ বেশিক্ষণ রাখা ঠিক হবে না’ বলে ধোয়া দিতে বলে। মহিলাদের কান্না বন্ধ করতে বলে। কিন্তু মহিলারা তার কথায় কান না দিয়ে অভিন্ন গতিতে আর অভিন্ন স্বরে আর অভিন্ন গভীরতার কান্না চালিয়েই যায়। ‘উচ্চস্বরে কান্না করা গুনাহ, এতে মুর্দার কষ্ট আরো বেড়ে যায়’ একথা ছোট মসজিদের বড় এমাম আবার উচ্চস্বরে বললে কান্নাটা হঠাৎ করেই আরো বেশি উঁচু হয়ে একেবারে থেমে যায়। কিছুক্ষণ পর কান্নাটা আবার ধীরে ধীরে শুরু হয়ে, আগের গতি, স্বর আর গভীরতায় ফেরে।
লাশকে গোসল দেবার জন্য আঙ্গিনায় নামানো হয়। বিছানার চারটা চাদর দিয়ে একটা চৌকোণা ঘর তৈরি করে লাশ ধোয়ানোর ব্যবস্থা হয়। কয়েকজনকে কবর খোঁড়ার জন্য পাঠানোর আগে এমাম সাহেবকে মালেক জিজ্ঞাসা করে—‘কোথায় কবর দেয়া যেতে পারে?’ এমাম সাহেব বলে—‘ওদের গোরস্থানে কবর দেবার প্রশ্নই আসে না।’ কদিন আগে গড়গড়িপাড়া জামায়াতের সাথে গ-গোল হয়েছে, তাই ঐ নতুন গোরস্থান বাদ দিয়ে পুরাতন কবরস্থানেই দাফনের ব্যবস্থাপত্র দিল এমাম। এই গোরস্থানটি ছোট, তাই উভয় জামায়াতের লোকজন মিলে একটা নতুন মাটি কিনে নতুন গোরস্থান প্রতিষ্ঠা করেছিল কয়েক বছর আগে। দু’জামাতের মধ্যে গ-গোল হয়েছে ফলে ‘এই লুত্তাপাড়া জামায়াত আবার পুরাতন গোরস্থান ব্যবহার করবে’ এই মর্মে কয়েকদিন আগে সভায় সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে এই পুরাতন কবরস্থানে কবর নেবার জন্য কেউ মারা যায়নি। আজকেই রইস ঘরামির কবর হতে যাচ্ছে। রইস ঘরামির লাশ বরইপাতা গরমজলে ধোয়ানো শুরু হয়। ধোয়ানোর এক ফাঁকে, যারা ধোয়াচ্ছিল তাদের মধ্যে একজন হঠাৎ চমকে ওঠে আর ‘সোবহানাল্লাহ’ বলে চিৎকার করে। আর একজন ধোয়নকারী, চমকে ওঠার কারণ জিজ্ঞাসা করলে ‘সোবহানাল্লাহ’ বলা ধোয়নকারী ‘লাশটি নড়ে উঠেছে’ বলে তোঁতলাতে শুরু করে। তখন অন্য লোকটি অবিশ্বাসের মৃদু হাসির রেখা মুখে এঁকেছে ঠিক সেই মুহূর্তে সেও ব্যাপারটি লক্ষ করে এবং জন্ম নিতে যাওয়া হাসিটি মুহূর্তেরও আগে মারা যায়। তারা দু’জনই লাশ ধোয়ার জন্য চাদর দিয়ে তৈরি ঘর থেকে বের হয়ে আসে এবং সকলকে জানায়—‘লাশ নড়ে উঠেছে, লাশ জিন্দা আছে।’ বাড়ি ভরা সকল মানুষই একসাথে কয়েক মুহূর্তের জন্য চুপ মেরে যায় এবং আবার সরব হয়ে রইস ঘরামিকে বের করে। আবার মনু কবরেজকে ডেকে আনে। মনু কবরেজ এসে রইসের চেতন ফেরানোর জন্য এবং সুস্থতা দানের জন্য চিকিৎসা শুরু করে।
রইসুদ্দীন এখন আর মৃত নয়। কিন্তু কাফন কেনা হয়ে গেছে আর কবর খোঁড়ার কাজ চলছে। ‘এখন কী করা যায়?’ সেটা ভাবতে যাবার আগেই এমাম এসে হাজির হয়। ‘এখন কী করা দরকার?’ এমামকে এই প্রশ্ন করা হলে, কবর এমনি এমনি বন্ধ করতে নিষেধ করে এমাম এবং কবরের ভেতরে একটি কলাগাছের শরীর কাফন মুড়িয়ে দাফন করতে বলে। এমাম কারণ হিসেবে বলে—‘যে গোর খোঁড়া হয়ে গেছে সেটা এমনি এমনি বুঁজিয়ে দিলে গোর খুব গোস্বা করে।’
গোরের গোস্বা থামাতে পারে এমন একটি হৃষ্টপুষ্ট কলাগাছ কাটার জন্য কয়েকজন লোক বেরিয়ে পড়ে আর এমাম নিজেই উদ্যোগী হয়ে রইসুদ্দীনের সুস্থতার জন্য হাত তুলে দোয়া পরিচালনা করে। সকলেই মোনাজাতে হাত তুলে এবং রইস ঘরামির সুস্থতা কামনা করে। দোয়া শেষ হলে ছয় মাস বয়সী বা নয় মাস বয়সী একটা কলাগাছকে কাফনমোড়া করে কবরস্থানে নিয়ে গিয়ে কবর দেয় কয়েকজন লোক। শেয়ালটি এ কবরের ভেতর ঢুকেছে।
রইসুদ্দীন আর তার কবরের কথোপকথন
কয়েকদিন পরে রইসুদ্দীন চলার মতো সুস্থ হলে, নিজের মরা বৃত্তান্ত, নড়া বৃত্তান্ত, কবর আর কলাগাছ বৃত্তান্ত শোনে বাড়ির লোকের কাছে। রাত হলে, রাতের শরীরে অন্ধকারমাংস পুষ্ট হলে, রইস চুপি চুপি তার জন্য খোঁড়া কবরটি দেখার জন্য গোরস্থানে যায়। ছোট একটা কুপি জ্বালিয়ে কবরের কিনারে দাঁড়ায়। কবরের গায়ের ফুটোটা তার নজরে আসে। ফুটো দিয়ে লাশ পচা গন্ধও বের হচ্ছে। সে অবাক—‘সে তো কবরের ভেতর নাই, ভেতরে আছে কলাগাছ, তবে এমন গন্ধ কেন? কলাগাছের গন্ধ কি লাশের মতো হতে পারে?’ সে তার কবরকে এমন একটি প্রশ্ন করলে আরও কিছু গন্ধপোকা কবর খুঁড়ে বের হয়ে আসে। এসব গন্ধপতঙ্গ তার নাককে বেশ যখম করে দেয়, তার ফুসফুস এবং হৃদপি-কে যখম করে দেয়। সে তার নাকে আর বুকে হাত বুলিয়ে বিড় বিড় করে বলে—‘মানুষ ছাড়া আর কেউ কথা বলতে পারে না… কবর মানুষকে পেটে নিয়ে থেকেও কথা বলতে পারে না… এ কবরটাতো পেটে ধরে আছে বোবা কলাগাছ… গরু ছাগল বিড়াল কুকুর মানুষের এত কাছাকাছি থাকে, তারাও কোনো কথা শিখে নিতে পারেনি।’ এরপর, সে তার চিন্তাটিকে বিড়ির আগুন দিয়ে পুড়ায় আর কথা বলা বিষয়ে ভাবনাটাকে উল্টে দেখে, তার মনে হয়—‘সবকিছুই কথা। গরু ছাগল কুকুর বিড়াল যেসব শব্দ করে সেসবও কথা। গন্ধও কথা। গন্ধকথা। কবর থেকে আসা গন্ধ বলছে—‘‘সে কলা গাছ নয়’’।’ বুকের ভেতর আরো জোরে শ্বাস টেনে নিয়ে সে নিশ্চিত হয়, খুবই নিশ্চিত হয়, গন্ধ যে বাক্য তাকে দেয় সে ব্যাপারে। সে সন্দিহান হয়ে পড়ে—আমি কি আমি? আমি রইসুদ্দীন ঘরামি? এই কবরঘরের ভেতরে আমি নাই? এই কবরের ধারে দাঁড়িয়ে আমি নাই? কলাগাছ কবরের ধারে দাঁড়িয়ে আর কবরে আমি? আমার শরীরের দুর্গন্ধ কলাগাছ পাচ্ছে? নাকি কোনো শেয়াল এ গন্ধকথা বলছে? এই ‘শেয়াল’ কথাটি হঠাৎ করেই মনে এলে তার মন ভাবনার এলোমেলোমি বাদ দেয়। শেয়াল তার অন্তর দখল করে নেয়।
তার চোখ লাল হয়ে আসে। অন্ধকার হয়ে আসে। তার চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। তার চোখ পাগলা হয়ে আসে, মাংস হয়ে আসে। শেয়াল হয়ে আসে। তার চোখ ঝড় হয়ে আসে। তার চোখ দিয়ে ঝড় আসে। তার ভেতর বাহিরে ঝড় ওঠে। তার মনে হয় তার গায়ে এখনই রোঁয়া বের হবে। কিন্তু কবরগ্রাম থেকে সে যখন ফিরে আসতে শুরু করে তখনও তার গায়ে রোঁয়া ওঠেনি।
একদিন নেতাই ডোমের শিশুকাল আর বৃদ্ধকাল হাত মিলিয়ে রক্তজবা ফুটিয়েছিল
‘হামার বেটাকো হাম মারদিয়া হাঁ… না না… হাম লাল ডোমকো মারদিয়া হাঁ… না না… হাম রাঙা সাহাবকো খুন করিয়াছি… না না… হামি খুন করিনি বাদলা লিয়েছি হাঁ। [আমি আমার ছেলেকে খুন করেছি… না না… আমি লাল ডোমকে খুন করেছি… না না… আমি রাঙা সাহেবকে খুন করেছি… না না… খুন করিনি বদলা নিয়েছি।] সন্ধ্যার কিছু পরে এভাবে ন্যাতা ডোম যখন চিৎকার করছিল তখন আশেপাশের মানুষজন প্রথম কয়েক মুহূর্ত তেমন কোনো গুরুত্বে নেয়নি কারণ মদ খেয়ে এমন হল্লা-হক্কা সে নিত্যিদিনই করে। কিন্তু এমন করে আরো কিছুক্ষণ চিৎকার করতে থাকলে এবং চিৎকারের ধরনটি অন্যদিনের চেয়ে আলাদা মনে হলে, তার চিৎকারের চাকুতে আনন্দের গুড় কেটে কেটে সকলের কাছে বিলায়িত হতে থাকলে, তার ঝুপড়ির দিকে হিন্দু পাড়া ও মুসলমান পাড়ার লোকজন পিঁপড়ে হয়।
যে পাড়ার নাম এখন হিন্দু পাড়া সে পাড়াতে আসলে বাস করে মুসলমান আর যে পাড়ার নাম মুসলমান পাড়া সে পাড়াতে বাস করে হিন্দুরা। এখন যেটা হিন্দু পাড়া সেখানে আগে হিন্দুরাই বাস করত কিন্তু সাতচল্লিশের পরে ভারত থেকে চলে আসা মুসলমান আর এখানের মুসলমান পাড়া থেকেও মুসলমানরা একঘর দু’ঘর করে হিন্দু পাড়াতে উঠে আসতে থাকে। অপরদিকে, মুসলমান পাড়াতে কিছু কিছু হিন্দু বসত গড়তে থাকে। বছর দশ পনের’র মধ্যে সমস্ত হিন্দু পাড়াতে বাস করতে থাকে মুসলমান আর হিন্দুরা বাস করতে থাকে মুসলমান পাড়াতে। ব্যাপারটা এভাবে উল্টো হয়ে গেলেও পাড়ার নাম যা ছিল তা-ই থেকে যায়। এ কারণেই হিন্দু পাড়াতে থাকে মুসলমান আর মুসলমান পাড়াতে হিন্দু। হিন্দু পাড়া আর মুসলমান পাড়ার মাঝামাঝি জায়গাতে ডোমপাড়া।
এই মুসলমান আর হিন্দু পাড়ার লোকেরা ‘ন্যাতা ডোম’ বলে ডাকে তাকে। একটু ভালো করে বললে -‘নেতাই ডোম।’ আর পুলিশের খাতাতে তার নাম উঠে গেল ‘নিতাই গঙ্গাপুত্র’ বলে। যখন তার নাম জিজ্ঞাসা করল পুলিশে তখন করুণ মুখেও বেশ গর্ব ফুটিয়ে বলল—‘নিতাই গঙ্গাপুত্র।’ এরা গঙ্গাদেবীর সন্তান, এজন্যই এমন গর্ব। স্বয়ং মহাদেব এদের পিতা। শ্মশানে একছত্র অধিকার ডোমদের। ডোমের আশীর্বাদ ছাড়া কেউ, ভবনদী পার হতে পারবে না, ঈশ্বর পাবে না। গর্ব তাদের হতেই পারে। নিতাই গঙ্গাপুত্রের বয়স লেখা হলো ৮০ বছর। এখনো বেশ শক্ত-সমর্থ ধরনের দেহ নেতাই ডোমের।
লেখালেখির পাট চুকলে আবারও মুখ করুণ করে বসে থাকে নেতাই ডোম। খুন করার পরপরই চিৎকার চেচামেচি করেছে ঐ কিছুক্ষণ। তারপর থেকে একদম চুপ। তার চারপাশে লোকজনের ভিড়। একটা বাঁশের মোড়ায় বসে আছে দারোগা। অপর পুলিশ ডাণ্ডা হাতে দাঁড়িয়ে। ‘এই এই ভিড় করো না’ বলে ডাণ্ডা হাতে দাঁড়ানো পুলিশ দাঁড়িয়েই থাকছে আর মানুষজনও তার বলার সাথে সাথে একটু নড়ে চড়ে সরে যাবার ভান করে আবার স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে পুলিশ, লাশ আর নেতাই ডোমকে। কয়েকজন পুলিশ খুনের আলামতো সংগ্রহ করছে আর তালপাতার পাটি দিয়ে লাল ডোমের লাশ বাঁধছে অন্য ডোমদের নিয়ে।
বিধবা বউটা বসে আছে দাওয়ায় মাথা নিচু করে। নেতাই ডোম মুখ তুলে দাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলল—‘মায়ি, এক গিলাস হামকো জল পিলাদে।’ [মা জল দে তো একটু।] যাকে মা ডাকা হলো তার নাম নিরূপা, নেতাই ডোমের বড় পুত্রবধু। নিরূপা জল দিয়ে আবার বসল খুঁটিতে হেলান দিয়ে। পুলিশের গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে, পুলিশদের হাতে হাতে টর্চ আর দর্শক লোকজনের কারো কারো হাতে হারিকেন। এত রাতে আলোর প্রাচুর্য দেখে খোয়াড় থেকে দু’তিনটা শুয়োরের বাচ্চা বের হয়ে কুঁউ কুঁউ শব্দ তুলে ঘোরাফেরা করছে। নিরূপার ছেলেটা শুয়োরছানাদের সাথে খেলায় মেতে গেল। ঘুমিয়ে সে গেছিল। মানুষের চেঁচামেচিতে তার ঘুম ভেঙ্গেছে। নেতাই ডোমের কাছে বসে আছে দু’পুলিশ। লাশ বাঁধা হচ্ছে।
দু’মাস পরই এই লাশের বিয়ে হবার কথা ছিল শহরের ডোম কলোনিতে, বীরন্ত ডোমের ছোট মেয়ের সাথে। নেতাইয়ের ছোট ছেলে লাল; লালকান্ত গঙ্গাপুত্র। লাল ডোম নামে হিন্দু-মুসলমান সকলেই তাকে চেনে। কুলা বোনাতে তার মতো ওস্তাদ লোক আর নেই এই ডোমপাড়ায়। শুধু এই ডোমপাড়া কেন অন্য উপজেলাতেও নেই। সুতরাং নবাবগঞ্জ শহরের বা শিবগঞ্জেরও সকল ডোম, লাল ডোমকে চিনত। তার মতো ছেলেকে জামাই হিসেবে পাবার জন্য লালায়িত ছিল বিবাহপোযোগী ডোমকুমারীদের বাবারা। বীরন্ত ডোম তার ছোট মেয়েটার সাথে লালকান্তের বিয়ে দিতে রাজি হয়ে গেছিল প্রস্তাব পাওয়া মাত্র। বীরন্ত শহুরে ডোম। হত্যার খবর পেয়ে সে শহর থেকে এসে হাজির হয়েছে ঘটনাটা বোঝার জন্য। তার সাথে নাছোড়ের মতো এসেছে মেয়েটিও। এ মেয়েটির সাথে লালকান্তের বিয়ে হবার কথা ছিল। আসার পর মেয়েটি সবাইকে অবাক করে দিয়ে বেশ জোরে কাঁদতে থাকে আর লাল ডোমের লাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। বীরন্ত ডোম লালকে জামাই হিসেবে পাবে মনে করে খুশি হয়েছিল। সে কাজ করে মর্গে। লাশ কাটে। কিছুদিন আগে এক হিন্দু মেয়ের লাশ কাটতে গিয়ে যে সোনার চেইনটা পেয়েছিল, সেটি তার মেয়ের বিয়েতে যৌতুক দেবে এমনও ভেবেছিল। সেও তার মেয়ের এমন কান্না দেখে অবাক হয়ে যায়। তারা লালকান্ত ডোমের লাশে পাটি লেপ্টানো দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থাকে।
এই অঞ্চলের সবচেয়ে নিচু জায়গা হচ্ছে এই ডোমপাড়া। বিশাল একটা গর্ত। এই গর্তের মাঝ বরাবর ঢিবির মতো উঁচুতে দশ-বারো ঘর ডোম বাস করে। এখানে বাস করার আগে ডোমেরা বাস করত মহারাজপুর হাটের পুব পাশে, বড় রাস্তার ধারে, খাস জমিতে। এখানে তখন এ খালটা ছিল না। যে বছর ডোমেরা এখানে আস্তানা গাঁড়ে তারই বছরখানেক আগে বন্যার জল ছেয়ে ফেলেছিল গোটা দেশ, সাথে সাথে এ অঞ্চলও। বেনে পানি নদী দিয়ে সরাসরি ঢুকতে পারেনি, ভাতারমারির বিলের বাঁধ কেটে গিয়ে জল ঢুকে পড়ে গ্রামে, গ্রামালয়ে। পানি যখন কমতে লাগল তখন নদীর দিকের বাঁধটা তোড় থামতে না পেরে কেটে যায় আর পানি বেরিয়ে যায়। পানি বেরিয়ে যায় ঠিকই কিন্তু যাবার সময় বেনে জলের দুরন্ত ঘূর্ণির তোড়ে বিশাল একটা খাল, খালের একেবারে মাঝখানে বড় একটা ঢিবি (যেখানে এখন ডোমেরা বাস করছে) আর নদী পর্যন্ত একটা খাড়ি তৈরি করে দিয়ে যায়। যেদিন জল কমতে শুরু করেছিল সেদিন বাজারের লোকজন দেখে (বর্তমানে যেখানে খাড়ি তার উপর) একটা আমগাছের নিচে যে একটু ডাঙা ছিল, সেখানে একটা ব্যাঙ একটা সাপকে গিলছে। এ দৃশ্য দেখে লোকজন ভয় পায় কিন্তু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতেও থাকে। অনেক রাত হয়ে গেলেও ব্যাঙটা অল্পই একটু গিলতে পারে সাপটিকে। সাপটা আছাড় পাছাড় করে একসময় মরে যায়। লোকজন কী যে দেখতে চেয়েছিল তারা নিজেরাও তা বুঝতে পারে না কিন্তু এই রকমভাবে দৃশ্যটা অনেকক্ষণ ধরে থেকে গেলে তারা দৃশ্যের একঘেয়েমিতে বিরক্ত হয় এবং বাড়ির দিকে হাঁটা ধরে। যদিও একজীবনে এমন একটা দৃশ্য আর কোনোদিন দেখতে পাবে কিনা জানা নেই। হয়তো এটাই শেষ। অনেক জীবন এমনও যাপিত হয়ে গেছে, যারা এ রকম দৃশ্য দেখতে পাওয়া দূরে থাক দেখতে পাবার কথা চিন্তা করতে পারার আগেই মারা গেছে। লোকজন আশঙ্কা করতে থাকে—‘এমন দৃশ্য পৃথিবীর এখানে কেন ঘটল! অতি শ্রীঘ্রই হয়ত এখানে কোনো বড় দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে।’ মানুষের ধারণা মতো তেমন বড় কোনো দুর্ঘটনা এখানে ঘটেনি কিন্তু পরদিন লোকজন বাজারে এসে দেখে, বাজারের কাছে যেখানে সাপ ব্যাঙের আহার অনাহার চলছিল সেখানের কাছের বাঁধ কেটে গেছে আর হো হো শব্দে বুনো পানি বেরিয়ে যাচ্ছে নদীর দিকে। জল কমে গেলে লোকজন দেখে বিশাল লাঙ্গলের ফলার আঁচড়ের মতো একটা আঁচড় রেখে গেছে দূর হতে আসা অপরিচিত জলেরা, বেগানা জলেরা। এটাই ডোমপাড়া আর ডোমখাড়ি বা ছোট নালা উৎপন্নের ইতিহাস। খাড়িটার এপারে বাজার। শুকনো সময়ে পানি থাকে না কিন্তু বর্ষাকালে ঢিবির উপর থাকা ডোমপাড়ার চারদিকে গোলাকারে পানি জমে যায়। পরিখার রূপ ধারণ করে। বর্ষার সময় ডোমেরা বাঁশের উপর দিয়ে হেঁটে পরিখা পার হয়।
৪৩ সালের দিকে নেতাই ডোম প্রায় আট বছরের। ডোমপাড়া থেকে ডোমখাড়িটা নদীর দিকে চলে গেছে। ডোমপাড়ার চারপাশ, ডোমখাড়ি আর নদীটা বর্ষা মৌসুমে তই তই করে। ডোমখাড়ির পাশে বিশাল মাঠ। নীলকুঠির মাঠ। রাঙা সাহেবরা নীল চাষ করাতো এখানে। এখানকার মানুষেরা মাথার ঘাম জমিতে ফেলে নীল চাষ করত। নিয়ে যেত রাঙা সাহেবরা। বড় বড় স্টিমার এসে লাগত মহানন্দার ঘাটে। কেউ নীল চাষ করতে না চাইলে লাল হয়ে যেত পিঠ। চাষীদের জীবন ছিল—হয় নীল নয় লাল। এসব ছোটকালের কথা, নেতাই ডোমের মনে আছে এখনো জীবন্ত ছবির মতো। একজন ধর্ষক কত বেশি শক্তিশালী হতে পারে! রাঙা সাহেবের একটা মাত্র লাথিতে দশ হাত দূরে ছিটকে পড়েছিল আট বছরের নেতাই। হঠাৎ এমন লাত্থিতে স্তব্ধ হয়ে গেছিল, কান্না ভুলে শুকনো চোখে দেখেছিল তার মা’র ধর্ষা হওয়া। তখনতো আর জানত না ঐ রাঙা লোকটা ধর্ষক আর তার মা ধর্ষিতা। তার মা রাঙা সাহেবের কুঠিতে ঝাড়– দিত। নেতাই মায়ের আঁচল ধরে নীলকুঠিতে যেত প্রতিদিন। সেদিনও গেছিল। সেদিন রাঙা সাহেবের আচরণটা ছিল অন্যরকম। রাঙা সাহেবের অমন আচরণের পর মা’র আঁচল ধরেই ফিরে এসেছিল সে। মায়ের কান্নাও দেখেছিল কিন্তু কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি। শুধু মুখের দিকে তাকিয়ে দেখছিল থেকে থেকে। এসব কথা ভাবতে ভাবতে নেতাই অদূরের আমগাছটাকে তাকিয়ে দেখল। তার মা জীভ বের করে ঝুলে গেছিল ঐ আমগাছেই। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত ঐ আমগাছটার আম সে খায়নি। প্রথমে আমগাছের ওপর রাগ ছিল, তার মনে হয়েছিল তার মাকে ঐ আমগাছটাই মেরে ফেলেছে। পরে যখন বড় হয়ে সবকিছু বুঝতে পারে তখন খুব রাগ হয় রাঙা সাহেবের ওপর। ডোমদের কান্নার খুব বেশি গুরুত্ব নেই, নিচু জাত। খাড়ির ধারে পুঁতে ফেলা হয়েছিল মায়ের শরীর। বাড়ি থেকে বড় জোর ৩০-৩৫ কদম দূরে। তারপর অনেকদিন পার হয়ে গেলেও নেতাই ডোমের মনে ধর্ষকের প্রতি একধরণের ক্ষোভ থেকেই যায়। ‘এই ব্যাটা ওঠ্’ দারোগা বললে, ডাণ্ডা হাতে দাঁড়ানো পুলিশটা দারোগার বিপরীতে বলল ‘স্যার, এখনো লাশ বাঁধা হয়নি।’ নেতাইয়ের স্মৃতির সুতো ছিঁড়ে গেল। ‘এই ব্যাটা ওঠ্’ শুনে চমকে ওঠে নেতাই ডোম আর ‘স্যার এখনো লাশ বাঁধা হয়নি’ শুনে আবার পাথরের মতো বসে থাকল।
আজকের দিনের শুরুটাও অন্যান্য দিনের মতোই ছিল। সকালে উঠে রাজুর চায়ের দোকান থেকে চা খেয়েছিল। চা পাওয়াও এক হাঙ্গামা। বাড়ি থেকে একটা টিনের খোরা নিয়ে গিয়ে দাঁড়াতে হয়। দোকানে বসে, দোকানের পাত্রে ডোমদের খাওয়া নিষেধ। ছোট জাতের ছোঁয়ায় দোকান আর দোকানের পাত্র অপবিত্র হয়। অনেকক্ষণ সাধ্য-সাধনা করলে রাজু ছোঁয়া বাঁচিয়ে চা ঢেলে দেয় নেতাইয়ের টিনের খোরাতে, টাকা নিয়ে কাঠের ক্যাশবাক্সে রাখে। টাকা আর টাকার বাক্স কখনো অপবিত্র হয় না। ওখানেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেয়ে নিয়ে আর এক পাত্র নিয়ে আসে বিমলের ছেলে কমলের জন্য। বিমল নেতাই ডোমের বড় ছেলে। বিমলই কমলকে চায়ের নেশা ধরিয়ে দিয়ে গেছে। ট্রাক চাপা পড়ে বিমলটা অকালে মরেছে। রেখে গেছে ছেলে আর নিরূপাকে। বিধবা বউমা নিরূপাকে দেখে মায়া লাগে নেতাইয়ের, নিরূপাকে প্রায়ই বলে—‘তু চ্যাংড়া মানুষ আছিত, তু সাদি কারলে বাহু।’ [বউমা, তুই আবার বিয়ে করে ফেল।] নিরূপা বলে—‘হাম বিহা নেহি কারেগা, তু শ্বশুরজি আছিত, হামারা বেটা আছে, তোদের মো দেখেই হামার দিন চালিয়া যাইবে।’ [না, বাবা আমি বিয়ে করব না। তুই শ্বশুর আছিস, ছেলেটা আছে, তোদের মুখ দেখেই কাটিয়ে দেব জীবন।] আজকেও বলেছে একবার। উত্তরও একই। নেতাই সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত নাতীর সাথে খেলেছে, দুএকটা ডালি, কুলা বুনিয়েছে। তারপর শুয়োরের মাংস দিয়ে ভাত খেয়ে শুয়োর চরাতে গেছে নদীর ধারে। সাথে বেঁধে নিয়েছিল এক বোতল পাকা তাড়ি। আজকে জিতুয়া। বউটা উপবাসি ছিল।
নদী ধারের ছোট ছোট ঝোঁপের বুনো ঘাসকন্দ, কচু, শেকড়-বাকড় খেয়ে শুয়োরগুলো যখন বাড়িমুখো হচ্ছিল তখন সূর্য ডুবন্ত। শুয়োরপালের পিছে পিছে হাঁটার সময় খাড়ির মাথায় নেতাই দেখতে পায় খড়ের কঙ্কাল। কালী মাতার কঙ্কাল। কয়েকদিন আগেই বেশ জাঁকজমকে হয়ে গেছে কালীপূজা। নেতাই কোনোদিন পূজা-টুজার দিকে যায় না। মদ খেয়ে চুর হয়ে পড়ে থাকে বেশিরভাগ সময়। শুয়োর চরানো আর দু’একটা ডালি-কুলা বানানো ছাড়া তেমন কোনো কাজ করে না। কালীপূজার দিন কালীমন্দিরের সামনে দিয়ে যাবার সময় বাহির থেকেই দেখতে পেয়েছিল কালী’মায়ের জীভ বের করা মূর্তি। দড়িতে ঝুলন্ত নিজ মায়ের জীভ বের করা স্মৃতিচ্ছবি আর মন্দিরের ভেতরে কালী’মাতার জীভ বের করা রূপ মিলে যায় তার মদ খাওয়া মনের ভেতর। হঠাৎ তার মনে হয়েছিল—‘কালীমাকে ইকটু প্রণাম কারিয়া যাই।’ [কালী মাকে একটু প্রণাম করে যাই।] মন্দিরে ঢুকতে দেয়নি ঠাকুর—‘এই ব্যাটা ডোম, মন্দিরে ঢুকতে পাবি না।’ ‘আচ্ছা ঢুকব না, তোর মন্দিরে বাল ঠেকাই’—বলে চলে এসেছিল নেতাই। সেদিন মন্দিরে মা কালীকে প্রণাম করতে পারেনি কিন্তু আজ শুয়োর চরিয়ে ফেরার সময় কালীমাতার খড়ের কঙ্কালে একটা প্রণাম করেছে নেতাই—‘এ কালী মায়ি, তু হামারা বিধবা বাহুকে দেখিস, অর বেটাটাকে দেখিস, হামি বুঢ়া ডোম আছি, কিতনা দিন আর হাম বাঁচেগা মায়ি।’ [মা কালী, বাড়িতে বিধবা বউমা’টাকে দেখিস, ওর ছেলেটাকে দেখিস, আমি বুড়ো ডোম কদ্দিন আর বাঁচব।] এই প্রার্থনা করার সময় বাতাস বয়েছিল। বাতাস লেগে সড়সড় করে শব্দ উঠেছিল কালী মায়ের খড়ের শরীরে। শুয়োরগুলো এগিয়ে গেছিল বেশ কিছুদূর। নেতাই হাঁটছিল ধীরে ধীরে। নেতাইয়ের মা’র দেহ যেখানে পুঁতে দেয়া হয়েছিল সেখানে এসে থমকে দাঁড়িয়ে গেছিল নেতাই। সাদা ওটা কী? হাড় কি? তার মায়ের হাড়? মদ পান বেশি হয়েছে বলে কী হাড় চিনতে পারবে না! আর এতদিন কী মানুষের হাড় থাকে! না নিশ্চয়ই হাড় নয়, হাড় হলেও তার মায়ের হাড় নয় বা হতেও পারে। ধর্ষা মায়ের মুখটা আর রাঙা সাহেবের বা ধর্ষক সাহেবের মুখটা তার মনে পড়েছিল এসময়। মায়ের মুখ আর ধর্ষক রাঙা সাহেবের পায়ের ছবি, নেতাই মাথার মধ্যে নিয়ে, মন ভীষণরকম খারাপ করে মায়ের কবরের জায়গাটাতে বসে পড়েছিল। বহুদিন পরে আজ এমন হচ্ছিল তার। ‘এ হাড় মায়েরই’ তার মনে হয় গভীরভাবে। আকাশ-পাতাল চিন্তাঘূর্ণি তাকে তাড়া করে। সন্ধ্যা পার হয়ে গেছিল। নিস্তব্ধ চারদিক। একসময় ভাবনার সুতা ছিন্ন হলে আবার হাঁটা ধরেছিল বাড়ির দিকে। হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিল—‘বহুত দেরি হো গেইসে।’ [বেশ দেরি হয়ে গেছে।] আবার ভাবছিল—‘দেরি হো গেইসে তো গেইসে, কেয়া হোগা, হামারা বেটা লাল শুয়োরকো খোয়াড়মে ভর দেগা।’ [হোক দেরি, নিশ্চয়ই শুয়োরগুলোকে খোয়াড়বন্দী করে রাখছে লাল।]
কদিন পরই লালের বিয়ে শহরের ডোম কলোনিতে। নিজে দেখে এসেছে মেয়েটাকে। লালকান্তের বিয়ের ব্যাপারে ভাবতে ভাবতে সে হাঁটতে থাকে। মেঘ মেঘ করছে আকাশ। একটা তারাও নেই আকাশে। অমানবিক নিস্তব্ধতা আর অন্ধকার চারদিকে। নেতাই এসব কিছুই খেয়াল করছিল না। ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার দেখার চেষ্টা করছিল মায়ের হাড়টাকে, তারপর আরো একটু দূরে, খড়ের হাড় নিয়ে কালী’মাতা শুয়েছিল বালিতে তাও দেখার চেষ্টা করছিল। থামছিল, দেখছিল আর হাঁটছিল নেতাই। বাড়ির দিকে কিছুদূর আসতেই সম্বিত ফিরে পায় সে। শব্দটা আগে থেকেই শোনা যাচ্ছিল কিন্তু তার ভেতরের এলোপাতাড়ি ভাবনার জাল ফেঁড়ে ঢুকতে পারছিল না। বাড়ির কাছে এসে নাচ গানের আওয়াজ শুনতে পেয়ে মনে পড়ে দিনু ভগতের বেটির বিয়ে। বিয়ের গান চলছে ঢোল আর কাঁসির তুমুল তালের সাথে। কান খাড়া করে শুনছিল নেতাই, আনমনে মাথাও দোলাচ্ছিল আর গানের তালে তালে একটু একটু করে সুর মেলাচ্ছিল—
বালিয়া হিলে কমরিয়া হিলে না
কমরিয়া হিলে বালিয়া হিলে না…
তার নিজের বিয়ের কথা মনে পড়ছিল এই বিয়েবাদ্য শুনতে শুনতে। বিয়ে হবার সময় একই সঙ্গে ছিল চুল উপড়ানো আর চুল গজানোর মতো অবস্থা। তখন পুরুতরা আসতে চাইত না ডোমদের বিয়ে পড়াতে। পুরুত ছাড়াই খুব সহজেই বিয়ে হয়ে যেত মোড়লের সামনে। মোড়ল হুকুম করলেই বউয়ের হাত ধরে বিয়ের মন্ত্র পাঠ। নেতাই ডোম এসব কথা মনে করতে করতে নিজেও একবার মন্ত্রটি পাঠ করে—
‘চাঁন সুরুজ গুহা
আজকে হামার বিহা’
আজ বহুদিন পর আনমনে নিজের কণ্ঠে আবার সেই মন্ত্র উচ্চারিত হতেই চমকে, হেসে উঠেছিল। তার বিয়েতে কনেপক্ষ যে মর্যাদিখানা দিয়েছিল তার তুলনা হয় না। সবাই খুশি হয়েছিল। শুধু হাড্ডিগুড্ডি খানার দিনে কয়েকজন একটু মন খারাপ করেছিল। কনে পক্ষকে নিয়মমাফিক যে বত্রিশ টাকা ও দু’খানা শাড়ি দিতে হয় তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু দেয়া হয়েছিল। দিন বদলেছে। ছেলেরাই এখন টাকা নিয়ে বিয়ে করছে। লালকান্ত বিয়েতে হাজার দশেক টাকা নেবে কনে পক্ষের কাছে। এসব কথা ভাবতে ভাবতে সে কখন পৌঁছে গেছিল একেবারে বাড়ির কাছে, বুঝতেই পারেনি। বাড়ির ভেতর ঢুকতে যাবার সময় সে দেখে, দিনু ভগতের বেটিকে নিয়ে মেয়েরা, বাচ্চারা আর কিশোর-যুবকরা শহরের ডোমপাড়াতে বাজনা বাজাতে বাজাতে যাচ্ছে আশীর্বাদ নেবার জন্য। বাড়িতে ঢুকা বাদ দিয়ে, এ দৃশ্য নেতাই ডোম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল দেউড়ির কাছে দাঁড়িয়ে। বিয়েমিছিল কিছুদূর চলে গেলে সে ধস্তাধস্তির শব্দ শুনতে পায়। শব্দটা আসছিল বিধবা বউটার ঘর থেকে। ‘এ বাহু কেয়া হুয়া তেরা ঘরমে… কেয়া হুয়ারে?’ [কী হয়েছে রে মা?] উদ্বিগ্ন কণ্ঠে নেতাই চিৎকার করে। তার চিৎকারপ্রশ্নের উত্তর ছিল একটা গোঙানি। শুয়োরের খোয়াড়ের দিকে তাকিয়ে দেখে শুয়োরগুলোকে খোয়াড়বন্দী করা হয়নি। বউটার ঘরে যেতেই তার রাঙা সাহেবের কথা মনে পড়ে। লালকে বা রাঙাসাহেবকে বা ধর্ষককে বাধা দিতে গেলে ভীষণ এক লাথি কষায় রাঙাসাহেব বা লালকান্ত বা ধর্ষক। নিতাই গঙ্গাপুত্র দশহাত দূরে ছিটকে পড়ে আশি বছরের দেহ নিয়ে। সংগে সংগে উঠেই শুয়োর মারা বর্শাটা তুলে নিয়ে লালের দিকে বা রাঙা সাহেবের দিকে বা ধর্ষকের দিকে ছুঁড়ে মেরেছিল নেতাই।
পুলিশেরা লালের লাশ তুলে নিল লাশবাহী গাড়িতে। লাশবাহী গাড়িতেই বলে কয়ে উঠে গেল নেতাই ডোম। গাড়ির মেঝেতে লালকান্তের পাটি মোড়ানো লাশ। পাটিতে মোড়ানো লাশটা দেখে নেতাই গঙ্গাপুত্রের দু’চোখ দিয়ে দরদর করে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। সে পুলিশের দিকে তাকিয়ে অনুরোধ করে—‘স্যার, আমি লালের মাথাটা কোলে করে নিচেই বসি, লালের মাথার দিকে পাটিটা একটু খুলে নিই?’ এবার চোখ মুছে বাড়ির দিকে তাকিয়ে একবার নিরূপাকে দেখল। নিরূপাও কাঁদছে। লালের মাথা কোলের ওপর তুলে নেবার আগে নিরূপার দিকে তাকিয়ে নেতাই বলল—‘ভালো থাকিস মায়ি।’ [ভালো থাকিস মা।] বীরন্ত ডোমের কন্যা যার সাথে লালকান্তের বিয়ে হবার কথা ছিল তার দিকে একটু তাকার পর লালকান্তের মৃতমুখের দিকে তাকাল নেতাই ডোম। লালকান্তের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে পাথরের মতো চোখে। লাশগাড়ীতে থাকা পুলিশেরা নেতাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে বিকারহীনভাবে। লালকান্তের বুকে মুখ রাখল নেতাই যেন লালের গন্ধ, তার রক্তের গন্ধ, তার মৃত্যুর গন্ধ বুকে ঢুকিয়ে নিতে চাইছে। নেতাই ডোম চুপচাপ, একেবারে চুপচাপ। খুব চুপচাপ লালকান্তের বুকে মাথা ঠেকিয়েই আছে।
মর্গের কাছে গাড়ি থামল। লালকান্তের বুকে মাথা রেখে কখন নেতাই ডোম মরে গেছে কেউ বুঝতেই পারেনি। মর্গের ডোমেরা পিতা-পুত্রের লাশ দুটি, খুনি-খুন্যের লাশ দুটি নামাল।