প্রতিবছরের একটি নির্দিষ্ট সময় সুইস ব্যাংকের অ্যাকাউন্টধারীদের হিসাবের তালিকা প্রকাশ করে সুইস ব্যাংকিং ফেডারেশন। ওই তালিকায় অন্যান্য দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশিদের টাকার হিসাবও দেওয়া থাকে। আর বাংলাদেশিদের টাকার পরিমাণ জানার পরপরই শুরু হয় বাংলাদেশ সরকারের অনুসন্ধান। আর্থিক গোয়েন্দারা এই অ্যাকাউন্টহোল্ডারদের অর্থের উৎসের সন্ধানে নামেন। এখন প্রশ্ন হলো, সুইস ব্যাংক আসলে কী? কারা এর গ্রাহক, কেন টাকা জমা রাখার জন্য সুইস ব্যাংককেই বেছে নেন?
সুইস ব্যাংক
সুইস ব্যাংক বলতে সুইজারল্যান্ডের কোনো একক ব্যাংককে বোঝানো হয় না। মূলত সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকিং নেটওয়ার্ককে বোঝানো হয়। একাধিক নাম ও শ্রেণীর ব্যাংক হলেও একত্রে সুইস ব্যাংক বলা হয়। যেমন, বাংলাদেশের ব্যাংক বলতে কেবল বাংলাদেশ ব্যাংক বোঝায় না, বরং সোনালী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, কৃষি ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক এমন সব ব্যাংকর সামষ্টিক দেশীয় পরিচয় হলো বাংলাদেশি ব্যাংক। তেমনি সুইজারল্যান্ডের সব ব্যাংককে একত্রে সুইস ব্যাংক বলা হয়।
প্রসঙ্গত, তিন শতাধিক ব্যাংক ও আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান রয়েছে দেশটিতে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় দুটি ব্যাংক হচ্ছে ক্রেডিট সুইস ও ইউবিএস।
সুইস ব্যাংকের হিসাব খোলার নিয়ম
এই ব্যাংকগুলোয় হিসাব খোলার নিয়মও আর দশটি সাধারণ ব্যাংকের মতোই। তবে, সুইস ব্যাংকের হিসাব খোলা ও টাকা জমার রাখার বিশেষ সুবিধা হলো এই ব্যাংকগুলোর গ্রাহকের হিসাব ও ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা কঠোরভাবে রক্ষা করে। সুইজারল্যান্ডের যত ব্যাংক আছে, সব ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করে ‘সুইস ফেডারেল ব্যাংকিং কমিশন’। সুইস ব্যাংকে সাধারণত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অস্থিতিশীল দেশের বিত্তবানরা সুইস ব্যাংকে টাকা জমা রাখেন।
গোপনীয়তা
সুইস ব্যাংকের বড় বৈশিষ্ট হলো, এই ব্যাংকগুলো কখনোই তাদের গ্রাহকদের তথ্য প্রকাশ করে না। তারা কঠোরভাবে গ্রাহকের তথ্য গোপন করে রাখে।
এই বিষয়ে ‘অ্যাসোসিয়েশন অব সুইস প্রাইভেট ব্যাংকার্স’-এর প্রধান মিশেল ডি রবার্ট কয়েক বছর আগে ব্রিটিশ গণমাধ্যম ‘বিবিসি’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, একজন ডাক্তার ও আইনজীবী যেভাবে তার রোগী বা মক্কেলের গোপনীয়তা রক্ষা করেন, সুইস ব্যাংকও সেভাবে গ্রাহকের তথ্য গোপন রাখে। তিনি আরও বলেন, ‘একজন সুইস ব্যাংকার তার গ্রাহকের কোনো তথ্য কাউকে দিতে বাধ্য নন, এটি রীতিমতো নীতি ও আইন বিরুদ্ধ।’ সম্ভবত এসব কারণেই সুইস ব্যাংকগুলো হয়ে উঠেছে বিশ্বের সবচেয়ে বিশ্বস্ত ব্যাংক।
সুইজারল্যান্ডের আইন অনুযায়ী কোনো ব্যাংকা তার কোনো গ্রাহকের অ্যাকাউন্টের কোনো তথ্য প্রকাশ করতে পারবে না। ওই ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট আছে কিনা, সে বিষয়েও মুখ খুলতে পারবে না কোনো ব্যাংকার!
একজন ডাক্তার বা আইনজীবী যদি তার রোগী বা মোক্কেলের গোপন তথ্য প্রকাশ করে, তাহলে দেশের প্রচলিত আইনে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারে সংশ্লিষ্টরা ঠিক এভাবেই কোনো সুইজারল্যান্ডের কোনো ব্যাংক তার কোনো গ্রাহকের গোপনীয়তা ভঙ্গ করলে ওই গ্রাহকও তার ব্যাংকের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে একজন ব্যাংকারের সর্বোচ্চ ৬ মাস কারাদণ্ড হতে পারে। একইসঙ্গে ৫০ হাজার সুইস ফ্রাঙ্ক দণ্ডও।
পৃথিবীর প্রায় সবদেশের বিচার বিভাগ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যেকোনো সময় ব্যাংক অ্যাকাউন্টের যাবতীয় তথ্য জানতে পারে। কিন্তু সুইজারল্যান্ডের কোনো ব্যাংকার কখনোই গ্রাহকের কোনো তথ্য প্রকাশ করতে পারেন না। গ্রাহকের এই তথ্য গোপন রাখার উদ্দেশ্যেই ১৯৩৪ সালে আইনও পাস করা হয়েছে।
অবশ্যই বিশেষ প্রয়োজনে সমঝোতা চুক্তি সাপেক্ষে রাষ্ট্রকে তথ্য দিতে পারে। কারণ, সুইস ব্যাংকের গোপনীয়তার সুবিধা নিয়ে মানি লন্ডারিংয়ের সুযোগ নেন অনেকেই। সাম্প্রতিক বিশ্বে অপরাধীদের কালো টাকার প্রধান আশ্রয়কেন্দ্র হচ্ছে সুইস ব্যাংকগুলো।
সুইস ব্যাংকে টাকা জমার ঝুঁকি কম
সুইজারল্যান্ডের অর্থনীতি-অবকাঠামো স্থিতিশীল। ঝুঁকির পরিমাণও কম। একইসঙ্গে সুইস ব্যাংকাররা খুব দক্ষ। গ্রাহকের টাকা কীভাবে বিনিয়োগ করতে হয়, সে ব্যাপার তারা যথেষ্ট পারদর্শী। তাছাড়া, সুইস ফ্রাঙ্ককে পৃথিবীর অন্যতম স্থিতিশীল মুদ্রা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
সুইস ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও আইন
পৃথিবীর প্রায় সবদেশের বিচার বিভাগ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যেকোনো সময় ব্যাংক অ্যাকাউন্টের যাবতীয় তথ্য জানতে পারে। কিন্তু সুইজারল্যান্ডের কোনো ব্যাংকার কখনোই গ্রাহকের কোনো তথ্য প্রকাশ করতে পারেন না। গ্রাহকের এই তথ্য গোপন রাখার উদ্দেশ্যেই ১৯৩৪ সালে আইনও পাস করা হয়েছে।
তবে, ব্যতিক্রমও আছে। বিদেশি অপরাধী, করফাঁকির সঙ্গে জড়িতদের ধরতে ‘সুইস ব্যাংকারস’অ্যাসোসিয়েশনের ওয়েবসাইটে কিছু নির্দেশনাও দেওয়া রয়েছে। ওই সব নির্দেশনায় গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট সম্পর্কে তথ্য দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
এইসব নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে, (১) দেওয়ানি মামলা (যেমন বিবাহ বিচ্ছেদ সংক্রান্ত মামলা) এবং (২) মানি লন্ডারিং ও করফাঁকির মতো অরাধীদের ব্যাংক হিসাবের তথ্য দেওয়া যাবে।
সুইস ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলার নিয়ম
সুইস ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলতে গেলে সব সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কে ধারণা নিতে হবে। নতুন অ্যাকাউন্ট চালুর জন্য দীর্ঘ-প্রক্রিয়ার জন্য তৈরি হতে হবে।
সুইস ব্যাংকগুলো তাদের নতুন গ্রাহকদের নিয়ে প্রচুর অনুসন্ধান করেন। গ্রাহকের বৈধ পরিচয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া ছাড়াও তার সব সম্পদের উৎস দেখাতে হবে। আয়ের পরিমান ও উৎস ব্যাপারে পুরোপুরি জানার পরই সুই ব্যাংক কর্তৃপক্ষ পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়। বড় অঙ্কের টাকা জমা রাখার জন্য অন্যান্য ব্যাংক অ্যাকাউন্টের স্টেটমেন্ট দেখানোরও নিয়ম রয়েছে। প্রয়োজনে সেই টাকার উৎসের কাগজপত্রও নিরীক্ষা করতে পারে সুইস ব্যাংক।
সুইস ব্যাংকের হিসাবধারীরা বিদেশি হলে তাদের সশরীরে উপস্থিত হয়েই অ্যাকাউন্ট খোলার আবেদন করতে হবে। গ্রাহকের সব সম্পদের উৎস সম্পর্কে ভালোভাবে না জানা পর্যন্ত সুইস ব্যাংক কর্তৃপক্ষ গ্রাহককে নতুন হিসাব খোলার অনুমতি দেয় না।
সুইস ব্যাংকে জমা রাখা টাকার লেনদেনের নিয়ম
বিদেশিরা সাধারণত সুইস ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা লেনদেন করেন না। ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করলে সুইস ব্যাংকের অ্যাকাউন্টের গোপনীয়তা প্রকাশিত হয়ে পড়ে। একইসঙ্গে নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা যায় না। এই কারণে টাকার বিষয় গোপন রাখার উদ্দেশ্যে গ্রাহকরা সাধারণত অ্যাকাউন্ট সবার সামনে লেনদেন করা থেকে বিরত থাকেন।
(নিবন্ধটি ইন্টারনেট অবলম্বনে রচিত)