চৈত্রের চিড়ধরা নদীর তীরের মতো ভাঙাচোরা দেহ আর চোয়ালভাঙা গাল তার। যেন কাঠফাটা রোদ্দুরে পত্রশূন্য কোনো কড়ুই শাখা। হালকা বাতাসেই বুঝি মড়মড় করে ভেঙে পড়বে। বয়স তার ঠাহর করা যায় না। পঞ্চাশ হতে পারে, পঞ্চান্নও। কারও কারও কাছে বড়জোর পঁয়ত্রিশ। নৌকার গুণটানার মতো দেহখানা টেনে টেনে বাইসাইকেলে পুরো শহর চষে বেড়ায় আসাদুল্লাহ নবাব।
দয়াহীন-মায়াহীন নগরীর সড়ক-অলি-গলিতে যানজট লাগে, লাগুক। জনজট লাগে, লাগুক। তাতে নবাবের কী! পিচগলা দুপুরে যখন ঘামে ভেজা জামা আর বগলের দুর্গন্ধে বাদুড়ঝোলা বাসযাত্রীরা কাহিল, তখন নবাব তেপান্তরের দুরন্ত রাখালের মতো প্যাডেলে চাপ দেয়। ঘামশূন্য-দুর্গন্ধহীন দেহ তার, হালকা বাতাস পেলে বুক ভরে শ্বাস নেয়।
নবাব যে অঞ্চল থেকে ঢাকা এসেছে, সেই অঞ্চলের নাম চন্দননগর। নামেই নগর, আদতে চর। এই অঞ্চলের অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থ পরিবারের ছেলেরা বাপ-দাদার ঠাটবাট ধরে রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টা করে। নবাবও তার ব্যতিক্রম নয়। তবু সে ধরে রাখতে পারে না। সুউচ্চ পর্বতচূড়া থেকে ঝর্ণা নিচে নেমে চলতে চলতে যেমন নদীতে মিশে লীন হয়ে যায়, তেমনি বাপ-দাদার ঠাটবাটটুকু নবাব পর্যন্ত আসতে আসতে প্রায় ভাটির দিকেই যাত্রা করে। অর্থ-বিত্ত বলতে গেলে ঘর আর ভিটাটুকু। বাকিটুকু গেছে হয় বিক্রিতে, নয় মেঘনার পেটে।
রাক্ষুসী মেঘনা একে একে ফসলি জমিগুলো গিলে খেলো। তবু যেন তার পেট ভরেনি। বাকি ঘর-ভিটিও খাওয়ার জন্য তার জিভ লক লক করে। যখন অজগরের পেটের মতো পিচ্ছিল কালো মধ্যরাতে মেঘের আড়ালে চাঁদ মুখ লুকিয়ে যায়, তখন নদীরও ক্ষুধা বাড়ে। একেক রাতে প্রচণ্ড আক্রোশে আছড়ে পড়ে একেকটা ফসলি জমির ওপর। অমনি জমিগুলোও পরাজিত মল্লযোদ্ধার মতো লুটিয়ে পড়ে মেঘনার ঘোলা জলে। মেঘনার এই সর্বগ্রাসী নির্লজ্জ নিষ্ঠুরতা নবাব দেখেছে। কিন্তু খোদার দুনিয়াতেই খোদাই যেখানে নদীর গতিরোধ করতে পারে না, সেখানে নবাব তো নবাব, তার চৌদ্দ পুরুষেরই কী সাধ্য জমিজিরাত রক্ষা করে?
জমিজিরাত হারানোর আগে নবাবের মনে দিগন্তরেখার মতো ক্ষীণ আশা ছিল, কৃষক হবে। কিন্তু চাষের জমি হারানোর পর সেই আশা-দুরাশায় মিলিয়ে গেলো—যেভাবে রক্তলাল গোধূলির পর পরাজিত সূর্য হারিয়ে যায় রাত্রির গহ্বরে। আবার অন্যের বাড়িতে যে রাখালের কাজ করবে, সে মুখও ছিল না। কারণ অপরাধের মধ্যে অপরাধ, ভুলের মধ্যে বড় ভুল সে করেছে। পড়াশোনা করেছে ভালো কথা—তাই বলে অজপাড়াগাঁয়ের ছেলের একেবারে বিএ পাস? গ্রামের বিএ পাস যুবকের পক্ষে ক্ষেতে-খামারে কামলাগিরি কি চাট্টিখানি কথা! এরচেয়েও বড় অপরাধ অল্পবয়সে বিয়ে করেছে। এই কথা নবাব যেমন জানে, তেমনি জানে স্ত্রী রাশেদাও। কেবল মা চায়, নবাব গ্রামেই গৃহস্থালি কাজকর্মই করুক। কিন্তু রাশেদা চায় শহরে যাক। গার্মেন্টসে কত মানুষ বড় বড় পদে চাকরি করে। করপোরেট না মাল্টিন্যাশনাল কী যেন কোম্পানি বলে, ওইসব কোম্পানিতে বড় বড় পদে চাকরি করলে অনেক পয়সা কামাই করা যায়। মা-স্ত্রী—দুই জনের মধ্যে স্ত্রীর মতের জয় হবে না তো কী নবাব নিজের প্রাণটা হারাবে?
বিএ পাস নবাব স্ত্রীর প্ররোচনায় ঢাকায় পাড়ি জমায়। এই মহানগরে এসে একটি মালটিন্যাশনাল কোম্পানিতে ঢোকে। বেতন তখনো নামমাত্র। উঠেছে মেসে। কিছুদিন পর পদোন্নতি, বাড়লো বেতনও। পদোন্নতি হতে হতে সে এখন কোম্পানির অ্যাডিশনাল ডিরেক্টর। মেস ছেড়ে দুই রুমের একটা বাসা নেয়। নবাব একটা জিনিস খেয়াল করে—আয়ের সঙ্গে রুচির সম্পর্কও নিবিড়। তাই সে বিষয়টি আবিষ্কারের আনন্দে অথবা বেদনায় কিছুক্ষণ বিমূঢ় হয়ে থাকে। আরে শালা, জীবন তো একটাই, উপার্জন করো, খাও-দাও ফূর্তি করো। তারপর খোদার দুনিয়া দেখে-শুনে আবার খোদার কাছেই ফিরে যাও। কিন্তু তার জীবনে ফূর্তি আর হলো কই? বন্ধুরা যখন কড়কড়ে নোট নাড়াচাড়া করতে করতে বারে যাওয়ার প্ররোচনা দেয়, তখন নবাব নিজের মনের ঘরে অন্য স্বর শোনে। প্রতিদিনের চা-নাস্তা এমনকি দুপুরের খাবারের খরচও একটু কমিয়ে দিয়ে কিছু কিছু বাঁচিয়ে রাখলে ছেলে-মেয়ের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সে গড়ে দিতে পারবে। কিন্তু সে যে ছেলে-মেয়ের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের চিন্তায় কাতর হয়ে পড়ে, সেই ছেলে-মেয়ে তো পড়াশোনার ত্রিসীমায়ও ঘেঁষে না। কথাটা অবশ্যই তার মা বলেছিল। যাচাই করতে গেলে রাশেদা মুখের ওপর কড়া কথা শুনিয়েছিল, ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে মায়ের চেয়ে মাসির দরদ ভালো না। তাতেই যেন জোঁকের মুখে নুন পড়েছে, আর নবাবও অমনি নুনখাওয়া জোঁকের মতো চুপসে যায়। সেই থেকে ছেলে-মেয়ের পড়াশোনা নিয়ে কখনো কোনো প্রশ্ন করে না।
নবাব বরং নিজেকে প্রবোধ দেয়। সেও কি আব্বার স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছিল? আব্বা না চেয়েছিলেন ছেলে উকিল হবে! তো উকিল কি হতে পেরেছে সে? যে নবাব নিজেই আব্বার স্বপ্ন পূরণ করলো না, সে কেন নিজের ছেলে-মেয়েকে দিয়ে নিজের স্বপ্ন পূরণের কথা ভাবছে? ছিঃ নবাব, ছিঃ। তুই এত স্বার্থপর, নিজেকে ধিক্কার দেয়। নিজেকে ধিক্কার দেয় আর একবার নিজের পদোন্নতির কথা ভাবে, একবার স্ত্রী-সন্তানকে কাছে রাখার কথা ভাবে। দিন মোটামুটি ভালোই যাচ্ছিল। সে দেখে অ্যাডিশনাল ডিরেক্টররা তো বটেই, এসিসট্যান্ট ডিরেক্টর, ডেপুটি ডিরেক্টররাও অফিসের গাড়িতে যাতায়াত করে। নবাব অফিসের গাড়ি ব্যবহার করে না। তার একমাত্র সঙ্গী বাইসাইকেল। নিরাশার মহানগরীতে রোদ-বৃষ্টি-ঝড়, হরতাল-ধর্মঘট—সবসময়ই এই বাইসাইকেলই ভরসা।
একদিন এমডি বলে, কী নবাব সাহেব? আপনাকে রাস্তায় জ্যামে পায় না? নবাব দেখে, এমডির প্রশ্নে জানার আগ্রহ নেই, সেখানে বাবলা কাঁটার তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা আছে। তবু সেই অপমান হজম করে। বলে, না স্যার। রাস্তায় জ্যাম থাকলেও বাইসাইকেলের সমস্যা হয় না। ফুটপাত আছে তো। এমডি বোধ হয় নবাবকে জব্দ করতে না পারার পরাজয়ের গ্লানি মেনে নিতে পারে না। তাই কণ্ঠে আবারও তীব্র শ্লেষ ফুটে ওঠে—আই সি। এমডি এমনভাবে আইসি বলে, যেন নবাব ফৌজদারি অপরাধ করেছে।
এমডির কণ্ঠে আই সি শুনে কিছুটা বিব্রতও হয় সে। সহকর্মীদের দিকে তাকাতেই দেখে—প্রত্যেকের চোখে-মুখে বিদ্রূপের হাসি। সেই হাসি যেন ধনুকের ছিলার মতো বাঁকা হয়ে ভেসে উঠলো। তারই তীক্ষ্ণ তীর এসে বিঁধলো নবাবের বুকে। নবাব অজপাড়াগাঁ থেকে এই পর্যন্ত উঠে এসেছে। এ কথা সে নিজেই সহকর্মীদের অনেকবার বলেছে। পরিচয় পেয়ে সহকর্মীরা তাকে কিছুটা অবমূল্যায়ন যে করে, সেটা সে বুঝতে পারে। সে এতদিনে সত্যটা সত্যি সত্যি আবিষ্কার করতে পেরেছে—মানুষ কখনোই মানুষকে মানুষ হিসেবে বিচার করে না। মানুষ অর্থবিত্ত-ক্ষমতা দিয়ে মানুষকে বিচার করে। গাড়িবাড়ি থাকলেই সমীহ-সম্মান সবই পাবে, আর না থাকলে তাচ্ছিল্য। এসবই সে মনে মনে ভাবে। কখনো প্রকাশ করে না। অফিসে, বন্ধুদের আড্ডায় কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ সে করতে পারে না। ঘরেই যেখানে স্ত্রী-সন্তানের অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করার সাহস-শক্তি সে পায় না, সেখানে বাইরের লোককে কী বলবে!
সেদিন রাস্তায় ফুটপাতের কোলঘেঁষে বাইসাইকেলে চড়ে অফিসে যাচ্ছে নবাব। পেছন থেকে অনবরত গাড়ির হর্ন। অন্যমনস্ক। মনে হয়—মেঘনায় ঠিক মাঝখান বরাবর শিটি বাজিয়ে ছুটে চলছে ইস্টিমার। সেই ইস্টিমারের আঘাতে ঢেউ উঠছে, ঢেউ ভাঙছে। শিটির শব্দে নদীপাড়ের ঘন বৃক্ষরাজির আড়াল থেকে দুই-একটি কাঠবিড়ালি পেছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে কেমন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। চোখ পিটপিট করে দেখছে নদীতে ইসরাফিলের শিঙ্গার ফুঁ দিয়ে কে যাচ্ছে! সে শিঙ্গার ফুঁয়ে মনের ভেতর কেমন ভয়ধরানো অনুভূতি জাগে নবাবের, তার ব্যাখ্যা করতে পারে না। তার আগেই ভাবনার ছেদ ঘটে, যখন হঠাৎ দেখে তার বাইসাইকেল ধাক্কা খেয়েছে প্রাইভেটকারে। গাড়ির কাঁচ নামিয়ে ড্রাইভার অশ্রাব্য কিছু কথা শুনিয়ে দিলে সে কী বলবে, থই খুঁজে পায় না। তাই চুপ থাকে।
মেজাজটা তার চৈত্রের নিষ্ফলা-রুক্ষ মাঠ। প্রতিবাদ করতে না পারার অক্ষম আক্রোশ তাকে আহত বাঘের মতো কাতর করে তোলে। মনে হয় তপ্ত দুপুরের সমস্ত আগুন তার কপালের দুই পাশে ঝাপটা মারছে। কোটরাগত চোখ দুটি ভীষণ জ্বলে ওঠে। আপন মনে গজ গজ করতে করতে অফিসের পার্কিং জোনে ঢুকে পড়ে। কিন্তু বাইসাইকেল রাখার আগেই নতুন সিকিউটির ডাক—এই মিয়া এদিকে আসো। নবাব এগিয়ে যায়, কী ব্যাপার তুই তোকারি করছেন কেন? তার প্রশ্নের ভেতর ক্রোধ নেই, অভিযোগের হালকা প্রলেপ ছড়ানো আছে। তাতে সিকিউরিটি কৌতুক বোধ করে। তাই সিকিউরিটি ভুল স্বীকার করে না, উল্টো তর্কের দিকে পা বাড়ায়—কই তুই-তোকারি করলাম। নবাব মনে মনে ঠিক করে, সিকিউরিটির সঙ্গে তর্ক করবে না। পিওন জসিমকে কল দেয়। জসিম এসেই নবাবকে বলে, স্যার কী হয়েছে? ভীরু-বিহ্বল নবাবের মনে যেন এবার শক্তি ফিরে এলো। বলে, দেখুন তো, সিকিউরিটি বাইসাইকেল রাখতে দিচ্ছে না। আবার ব্যবহারও খারাপ করছে।
তারা যখন কথা বলছে, ঠিক তখন এসিসট্যান্ট ডিরেক্টর রোমেলের গাড়ি ঢোকে। সিকিউরিটি ত্রস্ত-ব্যস্ত হয়ে গেট খুলে দেয়। রোমেল গাড়ি থেকে নেমে নবাবের সামনে দাঁড়ায়—স্যার, কী হয়েছে? জসিমকে দেখে মনে সাহস যতটুকু পেয়েছিল, রোমেলকে দেখে কণ্ঠেও যেন জোর পেলো—বাইসাইকেল রাখতে দিচ্ছে না সিকিউরিটি। তার ওপর তুই-তোকারি করছে।
নবাবের কথায় রোমেলের মাথা যেন লজ্জায় হেট হয়ে আসে। ঠিক বোঝা যায় না, লজ্জা কি সিকিউরিটির আচরণের জন্য, না সিকিউরিটির সঙ্গে নবাবের ঝামেলার জন্য! ঘুরে দাঁড়ায় সিকিউরিটির দিকে—স্যারকে কী বলেছেন? রোমেলের ধমকে সিকিউরিটির চোখ-মুখের ওপর থেকে কৌতুকভাবটা হারিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে চোয়ালের ওপর যে রুঢ় ভাব ছিল, সেখানে ভয় পাওয়া খোরগোশের মতো করুণাপ্রার্থীর রূপ এসে আছর করে। বলে, স্যার। এটুকু বলেই পতোন্মুখ থুতু দ্রুত গিলে ফেলে। আবারও বলে, স্যার। বিষয়টি খেয়াল করে রোমেল। এবার গর্জে ওঠে—কী খালি স্যার স্যার করছেন? যা জিজ্ঞাসা করি, জবাব দেন।
একটি নৌকার সঙ্গে প্রায় ধাক্কা লাগতে লাগতেই সে নিজেকে সামলে নেয়। দেখে কোথায় নৌকা? এ যে তার বাইসাইকেল, সড়কে চলছে অসংখ্য যান্ত্রিক বাহন।
এবার সিকিউরিটি বেশ ভয় পেয়েছে বলে মনে হয়। বলে, উনি তো সাইকেলে এসেছেন। সাইকেল রাখতে মানা করেছি। রোমেল বুঝতে পারে না, বাইসাইকেল কেন রাখা যাবে না। তাই কণ্ঠে যতটা রাগ ঢেলে দেওয়া যায়, তার পুরোটা ঢেলে বলে, নিষেধ করলেন কেন? তার ওপর তুই তোকারি কেন করলেন? সিকিউরিটি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে, রোমেল আবারও গর্জে ওঠে, কী ব্যাপার জবাব দিচ্ছেন না কেন? এবার সিকিউরিটি হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে, উনি এত বড় স্যার, আমি বুঝবার পারি নাই। ভাবছিলাম, পিওনদের কেউ।
রোমেল এবার মেজাজ ধরে রাখতে পারে না—চুপ বেয়াদব। সিকিউরিটিকে আরও বকাঝকা করে তাকায় নবাবের দিকে। বলে, স্যরি স্যার। চলুন। দেরি হয়ে যাচ্ছে।
পার্কিং জোনের এই হই-হট্টোগোলের কথা এমডির কান পর্যন্ত পৌঁছে যায়। অফিসে ঢুকতেই এমডির রুমে ডাক পড়ে। নবাবকে দেখেই এমডি বলে, কী ব্যাপার? রাস্তায় বাইসাইকেল চালান, ডানে-বাঁয়ে তাকানোর প্রয়োজন মনে করেন না? এমডি ডেকেই এমন কিছু বলবে, নবাব অনুমান করতে পারেনি। তবু, আস্তে বলে, স্যার, আমি কী করেছি? নবাবের জবাব শুনে এমডি ক্ষেপে ওঠে। নবাবের মনে হয় বুনো শুয়োর ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করে বলছে—কী করেছেন মানে? গাড়ির হর্ন, সিগন্যাল কোনো কিছুই তো ফলো করেন না। তারপর অফিসে এসে সিকিউরিটির সঙ্গে ঝগড়া। লোকে তো অফিসে এসে কমপ্লেইন করে। চেয়ারম্যান স্যার ক্ষেপেছেন। সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, অফিসের কোনো কর্মকর্তা বাইসাইকেল চালাতে পারবে না। আপনি অ্যাডিশনাল ডিরেক্টর হয়েও বাইসাইকেল চালান। ছিঃ ছিঃ নবাব সাহেব। কোম্পানির মান-ইজ্জত কিচ্ছু রাখলেন না। আপনাকে ফার্স্ট অ্যান্ড লাস্ট ওয়ার্নিং, আর বাইসাইকেল চালাতে পারবেন না।
নবাব কিছু একটা বলতে যাবে, এমন সময় এমডির গর্জন, চুপ করুন। নবাব চুপই করে থাকে। এছাড়া তার আর কীই-বা করার আছে। ডেস্কে বসে কাজ করবে, এমন সময় পাশের সহকর্মীর টিপ্পনি, কী নবাব সাহেব, আর কত কিপটামি? এবার প্রাইভেটকার কিনে ফেলুন। না হয় অন্তত একটা স্কুটি। সহকর্মীর কথাগুলো তার ভালো লাগে না। তবু জবাব দেয়—কী বলছেন! যে সেলারি পাই, তাতে সংসারই চলে না। আবার স্কুটি! তার জবাব সহকর্মীকে দমাতে পারে না, উল্টো খোঁচা খেতে হয়—কী বলেন? আপনার অর্ধেক সেলারি পেয়েও সোবহান সাহেব গাড়ি কিনেছেন। ভাই সোশ্যাল স্ট্যাটাস বলেও তো একটা কথা আছে।
সহকর্মীর টিপ্পনির অর্থ বুঝতে পারে না নবাব। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি কিভাবে সম্ভব? অনেক ভেবেও থই পায় না। তার মনে থাকে, বিত্তহীনের ইগো থাকতে হয় না। আত্মসম্মানবোধও না। চালচুলোহীন মানুষের আত্মসম্মান হলো নর্দমায় পড়ে থাকা কলার খোসার মতো। নেড়ি কুত্তার পায়ে পায়ে লেপ্টে যাবে। তারপর রাস্তায় খসে পড়বে। সেই খোসায় পা দিয়ে কখনো কোনো মানুষ আছাড় খাবে। আর গালি দেবে কুত্তার বাচ্চা বলে। অবশ্যই সেই গালিতে আর যাই থাকুক, কলার খোসার প্রতি কোনো খেদ থাকবে না, এটা নিশ্চিত। গরিবের আত্মমর্যাদাকে মাহাত্ম্যশূন্য প্রমাণে কলার খোসার সঙ্গে কেন তুলনা করতে হবে, তাই ভেবেই নবাবের হাসি পায়। মনে মনে বলে, জগতের সবকিছুর কি যথাযথ মানে থাকতে হবে! না থাকলেই বা কী?
সেলারি তুলতে গিয়ে দেখে বিনামেঘে বজ্রপাত। সেই বজ্রপাতে আঘাত আছে কিন্তু শব্দ নেই। তাই আঘাতটা একা তারই গায়ে লাগলো। কেউ টেরটি পর্যন্ত পেলো না। কেননা সেই আঘাত সন্তর্পণে কেবল তারই মাথায় লেগেছে। কী করবে, কোথায় যাবে, ভাবতে ভাবতে সে হাজির হয় ক্যাশিয়ারের সামনে। ক্যাশিয়ার যেন আগে থেকেই জানতো নবাব আসবে। তার চোখেমুখে কী এক কৌতুক ছড়িয়ে রয়েছে। যেন মাঝনদীতে নৌকাডুবির যাত্রী খড়কুটো ধরে ভাসতে ভাসতে গাছের শ্বাসমূলপূর্ণ চর ভেবে যেখানে উঠেছে, সেটি কোনো ভূখণ্ড নয়, আস্ত একঝাঁক কুমিরের পিঠ। এতক্ষণ ডুবতে ডুবতে আর ভাসতে ভাসতে বাঁচার ক্ষীণ আশা থাকলেও কুমিরের ঝাঁকে পড়ে সেখানে দুরাশারই জয় হলো। তবু প্রাণপণে বুকের ভেতর থেকে নিশ্বাস টেনে বুকে সাহস এনে ক্যাশিয়ারকে বলে, রফিক সাহেব আমার সেলারি থেকে দশ হাজার কেটে ফেললেন যে? ক্যাশিয়ার ঘোলাটে চোখের ভেতর কালো মার্বেলের মতো মণি দুটিকে স্থির করে আগে, এরপর চোখ দুটি পিটপিট করতে করতে বলে, আমি কাটার কে? চেয়াম্যান স্যারের নির্দেশ।
ক্যাশিয়ার কথাগুলো এমনভাবে বললো, যেন আশ্রয়প্রার্থীকে পিঠের ওপর থেকে লেজের আঘাতেই খরস্রোতা নদীর তীব্র ঘূর্ণির ভেতর ছুড়ে মারলো কুমির। এরপরই ধারালো দাঁত বসিয়ে দেবে ভরসাশূন্য আশ্রয়প্রার্থীর ঘাড়ে। নবাব খোদার কাছে বিচার দেবে বলে আকাশের পানে তাকায়। দেখে সেখানে আকাশ নেই, আছে নির্দয় ইট-সিমেন্ট-বালুর ছাদ। এই নিরেট ছাদ ভেদ করে তার করুণ সুর খোদার আরশ পর্যন্ত যে পৌঁছাবে না, সে বিষয়ে নিঃসংশয়।
দশ হাজার টাকা কম সেলারি নিয়ে বাসায় ফেরে। সকালে ঘুম ভাঙতেই সংসারের টাকা পাঠিয়ে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাশেদার ফোন, কী ব্যাপার তোমাকে না কইলাম, এই মাসে দশ হাজার ট্যাকা বেশি দিতে? হেয় তো আগের মতো ফকিন্নির খয়রাত দিলা! নবাব সেলারি কমে যাওয়ার কথা বলে, নিজের অসহায়তার ব্যাখ্যা দেয়। কিন্তু রাশেদা ক্ষেপে ওঠে, তোর মতলব বুঝি না মনে করছস? তুই আরেক বিয়া করছস। তাই ট্যাকা চাইলেই তোর উপ্রে খোদার গজব পড়ে! দাঁড়া তোরে মজা দেখামু!
কী মুশকিলে পড়ে নবাব! বিনা কারণে অফিস তার সেলারি কমিয়ে দিলো। রাশেদারও অবিশ্বাস। কাকে বলবে এই দুঃখের কথা! ভাবতে ভাবতে অফিসে যায়। কাজে ঠিকমতো মনোযোগ দিতে পারে না। ছোট্ট একটা কাজে দশটা ভুল করে। এমডি ডেকে ইচ্ছামতো শাসায়। বলে, এরকম ভুল হতে থাকলে স্যরি বলা ছাড়া কোনো গতি থাকবে না। নবাব ভাবে—ঢাকা তাকে সামান্য অর্থের মুখ দেখিয়েছে সত্য, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে সর্বস্ব। ভাবতে ভাবতে কোথায় যে হারিয়ে যায়! সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিতে দিতে মহানগরীকে তার মহাসমুদ্র মনে হয়। আর সড়ক? তাকে মনে হয় খরস্রোতা কোনো এক নদী। যার তরঙ্গ তাকে একবার ভাসিয়ে তোলে, আরেকবার ডোবায়। সেই নদীতে অসংখ্য নৌকা ভাসে, সে সব নাওয়ে আবার নানা রকমের কুপিও জ্বলে। একটি নৌকার সঙ্গে প্রায় ধাক্কা লাগতে লাগতেই সে নিজেকে সামলে নেয়। দেখে কোথায় নৌকা? এ যে তার বাইসাইকেল, সড়কে চলছে অসংখ্য যান্ত্রিক বাহন। সেই সবের হেডলাইটকেই তার এতক্ষণ নৌকার কুপি মনে হয়েছিল। ভাবতে ভাবতে বাসায় যখন পৌঁছায়, তখন নববধূর মতো লজ্জাবতি ভাদ্রের চাঁদ মেঘের আড়ালে লুকিয়ে যায়। না, লুকোয় না হয়তো, একেবারেই হারিয়ে যায়।
এমনটা হবে তারা হয়তো ভাবতে পারেনি। একমাত্র ছেলে রাশেদ ক্ষেপে ওঠে—কী করলে মা? ব্যস এটুকুই। এরপরই ঘর থেকে বের হয়ে যায় সে।
চাঁদ নিয়ে রোমান্স করার মতো যথেষ্ট সময় তার হাতে নেই। মনটাও আজ বাবলা কাঁটার খোঁচা খাওয়ার মতো খচখচ করছে। ক্লান্তি দেহকে প্রায় গ্রাস করে নিয়েছে। তাই কিছু খাবে কি খাবে না, ভাবতে ভাবতেই বিছানায় পড়ে। হঠাৎ দেখে—বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে এসেছে দুর্গম বনপথে। ঘুরতে ঘুরতে গহিন জঙ্গলে এসে পৌঁছায়। পেছন ফিরে দেখে বন্ধুদের কেউ নেই। সামনে ক্ষিপ্র চিতা; জ্বল জ্বল করছে চোখ দুটি। এই বুঝি ঝাঁপিয়ে পড়বে তার ওপর। সে রুদ্ধশ্বাসে ছুটতে থাকে। ছুটতে ছুটতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তার নিশ্বাস ঘন হয়ে আসে। হয়তো বন্ধ হয়ে আসে। তবু শুনতে পায়, দূর থেকে ঠক ঠক শব্দ ভেসে আসছে। কেউ কি আসছে? একসময় সেই আওয়াজ আরও তীব্র হয়ে কানে বাজে। ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়া দেহটা টেনে তোলে। এরপর সোজা হয়ে দাঁড়াতে যাবে, টাল সামলাতে পারে না। ধপাস করে পড়ে যায়। আর তখনই মনে হয়—দরোজায় যেন সজোরে লাথি পড়লো। সঙ্গে মানুষের কোলাহল। খরগোশের মতো কান খাড়া করে। শুনতে গিয়ে দেখে, নাহ! সে তো বনে হারিয়ে যায়নি। ঘরেই ঘুমাচ্ছিল। আর তার ঘরের দরোজাতেই কেউ লাথি দিচ্ছে। চোখ কচলাতে কচলাতে দরোজা খুলে দেখে স্ত্রী-সন্তান এসে হাজির। সে কিছু বলতে যাবে, এর আগে, রাশেদা খেঁকিয়ে ওঠে, কোন মাগি নিয়ে শুয়ে আছস? দরোজা খুলোস না ক্যা? বলতে বলতে নবাবকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে। ছেলে-মেয়েকে বলে, তোর বাপ এখানে থাক। তোরা পুরা ঘর দেখি আয়, ঘরে কে আছে? নবাব ক্ষীণকণ্ঠে বলে, কী বলছ এসব? কে থাকবে ঘরে? রাশেদা আরও ক্ষেপে ওঠে—চুপ। একদম চুপ। ভাবছস কী? কিচ্ছু বুঝি না? তোর সব খবর জানি।
এরইমধ্যে তিন ছেলে-মেয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। বলে, নাহ, ঘরে কেউ নাই।
অফিসের ঘটনা, স্ত্রীর আচরণ নবাবকে বিমর্ষ করে তোলে। কী করবে, বুঝতে পারে না। মাথা ঝিমঝিম করে। দুই হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে কিছুক্ষণ বসে থাকে খাটের কোণায়। স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে তাকে ঘিরে বসে। ছেলে জানায়, সে ইতালি যাবে। টাকা লাগবে ১৫ লাখ। নবাব কী বলবে, বুঝতে পারে না। মনে মনে বলে, পনেরো টাকা নেই পকেটে, পনেরো লাখ কোথায় পাবো? কিন্তু মুখে কিছুই বলে না। রাশেদা ধমক দিয়ে বলে, চুপ কইর্যা থাইকবা না। ট্যাকার ব্যবস্থা করো।
নবাবের গলায় নিরাশার সুর, আমি টাকা কোথায় পাবো? তার কথা বিশ্বাস করে না রাশেদা, কেন এত ট্যাকা বেতন। সব কী করস? নবাবের কণ্ঠে অসহায়ত্ব, টাকা কী করি মানে? প্রতিমাসেই তো সংসারের খরচেই যায়। তাকে কথা শেষ করতে দেয় না রাশেদা, আমাদের বোঝাস? যেইহানেই পাস, ট্যাকা আইন্যা দিবি। নইলে তোর মায়ের কাছে যে হক পাইবি, সেই জমি বেইচ্যা দে।
নবাব এবার বেশ কষ্ট পায়, মা এখনো জীবিত। তার জমি তিনি দেবেন, না নিজেই বিক্রি করবেন, সেটা তার ব্যাপার। বলেন, মায়ের জমির ভাগ আমি চাইবো কী হিসেবে? আমার পক্ষে সম্ভব না।
রাশেদাও নাছোড়বান্দা, সম্ভব না? আচ্ছা কিভাবে সম্ভব করতে হয়, দেইখমু। দপদপ পা ফেলে ভেতরে রুমের দিকে চলে গেলে নবাব বাথরুমে ঢোকে। কিছুক্ষণ পর বের হয়েই বাইসাইকেলের প্যাডেলে পা রাখে।
হাতিরঝিলে উঠতে না উঠতেই মোবাইলফোন বেজে ওঠে। ধরবে কি না, ভাবে কয়েক মুহূর্ত। না, ধরবে না। অফিসে যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু রিং যে বারবার বাজছে। এত রিং বাজলে তো চিন্তামুক্ত হয়ে সাইকেল চালানো অসম্ভব। তাই সে রাস্তার একপাশে থামে। পকেট থেকে মোবাইলফোন বের করে। দেখে মায়ের কল। রিসিভ করতেই মায়ের গলা, বাবা তুই তো কোনো খবর রাখিস না। তোর ভাই অসুস্থ। ডাক্তার দেখামু। টাকা দিস ৫০ হাজার। মায়ের কথায় নবাব বিচলিত হয় বটে, কিন্তু মাকে আশ্বস্ত করার মতোও কিছু বলার নেই তার। তাই বলে, মা, এত টাকা নাই।
মায়ের সম্ভবত ‘না’ শোনার মানসিক প্রস্তুতি ছিল না। অনেকটা বিরক্তির স্বরেই বলে, ও। বউয়ের পেছনে লাখ লাখ টাকা ঢালতি পারবি আর ভাইয়ের জন্য সামান্য কটা টাকা দিতে গেলেই টান পড়বো? নবাব আহত হয়। অসহায় কণ্ঠে বলে, মা। তার কথা শেষ করতে দেয় না মা। বলে, থাক। আর কইতে অইবো না।
মায়ের সঙ্গে মোবাইলফোনে কথা শেষ হওয়ার আগেই রাশেদার ফোন। নবাব মায়ের কল কেটে দিয়ে রাশেদার কল রিসিভ করতেই কর্কশ কণ্ঠ—বাসা থেকে বের হয়েই কোন মাগির লগে কথা কও? নবাব এমন প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিল না। তাই বলে, সাবধানে কথা বলবে।
নবাবের কথায় রাশেদা আরও ক্ষেপে যায়, কী করবি তুই? আজকের মধ্যে ট্যাকার ব্যবস্থা কইরবি। তোর মাকে কল দে। জমি বেইচতে ক। নবাব বিরক্ত হয়, কণ্ঠেও সেই স্বর—ধ্যত! কলটা কেটে দেয়।
শরতের ভ্যাপসা গরমে মাথার ভেতর মগজ টগবগ করে। কী করবে নবাব? হাতিরঝিলে ঘাট ধরে নিচে নামতে থাকে। নিচের সিঁড়িতে বসে পানির দিকে তাকায়। দেখে কুমারি স্তনের মতো মেঘের গম্বুজে ছেয়ে গেছে ভরসাশূন্য আকাশ। তারই ছায়া পড়েছে সেই জলে। একটা চিল উড়ে গেলো মেঘের নিচ দিয়ে? তার ছায়াও পড়লো পানিতে। মনের ভেতর অশান্ত ঝড়, মাথায় যেন গনগনে চুল্লির আগুন। সেই আগুনে আঁজলা ভরে পানি দেয়। তাতে মাথা তো ঠাণ্ডা হয়ই না, উল্টো যেন আগুনে ঘি পড়ে। মগজ যেন গরম ভাতের মতো বলক দিয়ে ওঠে। আর সেই বল্ক ওঠা পানিতে ভিজে যায় জামা-কাপড়। নবাব উঠে দাঁড়ায়। পকেট থেকে রুমাল বের করে মাথা মোছে। অফিসে যেতে হবে, চাপ দেয় প্যাডেলে। রাস্তার কিনারঘেঁষে বাইসাইকেলে ছুটে চলে। আজ কি গতি একটু বেশি! মেইন রোডে উঠতেই হঠাৎ চেন ছিঁড়ে যায়। ব্রেক কষতে গিয়ে দেখে কাজ করছে না। ব্রেকের তার ছিঁড়ে গেছে। পেছন থেকে বিকট শব্দে হর্ন বাজছে ট্রাকের। সে কি একটু বামে সরে আসবে? ভাবতে ভাবতেই রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে।
নবাবের যখন সংজ্ঞা ফিরে আসে, তখন সে দেখে হাসপাতালের বেডে। মধ্যরাত। নার্স বলে, পথচারীরা এখানে এনেছে। এখন পর্যন্ত তেমন কেউ খোঁজ নেয়নি। একটা ফোনকল এসেছিল, দেখুন। নবাব মোবাইলফোন বের করে দেখে, রাত দশটার দিকে বড় মেয়ে ফোন করেছিল। নার্সকে বলে, আমাকে কখন রিলিজ করবে? প্রশ্ন শুনে নার্স হাসে। বলে, এই মধ্যরাতে তো না। সকালে বাসায় যেতে পারবেন। একটা দীর্ঘশ্বাস নবাবের বুকের গভীর থেকে প্যাচিয়ে প্যাচিয়ে বের হয়ে আসে। সে ভাবে—নার্স কি টের পেলো? বড় মেয়েকে কল ব্যাক করবে? নাহ! দরকার নেই, এর চেয়ে মেসেজ দিয়ে রাখাই ভালো।
সকাল দশটায় বাসায় ফেরে। মিনেট তিনেক কলিং বেল দেওয়ার পর ছোট মেয়ে নাহিদা দরোজা খুলে দেয়। মাথায় ব্যান্ডেজ দেখে বলে, বাবা কী হয়েছে? নাহিদার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে, কাল অ্যাকসিডেন্ট করেছি। রাতে হাসপাতালে ছিলাম। পুরো কথা শোনার আগেই নাহিদা হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। তার কান্নায় হয়তো বাকিদের ঘুম ভাঙে। এগিয়ে আসে রাশেদা। ব্যান্ডেজের দিকে তাকায়। এরপরই কণ্ঠে চরম বিদ্রূপ ছড়িয়ে পড়ে, ট্যাকা চাইলেই নাটক শুরু হইয়া যায়? সারারাত কোন মাগির ঘরে কাটাইলা। আর এখন আসছ অ্যাকসিন্ডের নাটক কইরতে?
রাশেদার কথায় নবাব আহত হয়। এমন দুঃসময়েও তার প্রতি সামান্য সমবেদনা থাকবে না? একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বেডরুমে ঢোকে। খাটে বসতে যাবে, এর আগে গতিরোধ করে দাঁড়ায় রাশেদা—তোর এসব নাটক থামা। ট্যাকার কী কইরলি বল। নবাব কাতর কণ্ঠে বলে, দেখলে তো অ্যাকসিডেন্ট করেছি। রেস্ট দরকার। কথা তো পরেও বলতে পারবে। নবাবের কথায় রাশেদার বিরক্তি যেমন চরমে ওঠে, কী? আমার কথার দাম নাই? বলতে বলতে মাথার ব্যান্ডেজ ধরে টান দেয়। ‘মা গো’ বলেই ঢলে পড়ে নবাব। ব্যান্ডেজ গলে রক্ত ঝরতে থাকে।
রাশেদা-শাহেদা-নাহিদা স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে থাকে। এমনটা হবে তারা হয়তো ভাবতে পারেনি। একমাত্র ছেলে রাশেদ ক্ষেপে ওঠে—কী করলে মা? ব্যস এটুকুই। এরপরই ঘর থেকে বের হয়ে যায় সে।
সেই মেঘের ফাঁকে দুই হাত বাড়িয়ে স্বর্গীয় দূত জিবরাইল দাঁড়িয়ে আছে। না, জিবরাইল নয়, আব্বা দাঁড়িয়ে আছে। আব্বা ডাকছে।
রাশেদ আরও কিছু কি বললো? নবাবের কানে ঢোকে না। মাথায় আর যন্ত্রণা হচ্ছে কি না, বুঝতে পারে না। তার চোখে ভেসে ওঠে, বাবার মৃত্যুর আগের মুহূর্ত। বাবা মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে মারা গেছে। নবাবের ফুপুর বাড়িতে। মৃত্যুর আগে আব্বাকে সে হাসপাতালে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু গ্রামের ডাক্তার বলেছে, আপনার আব্বা বাঁচবেন হয়তো মাত্র কয়েক ঘণ্টা। হাসপাতালে নিলে নিতে পারেন। কিন্তু কোনো লাভ হবে না। পথেই মারা যাবেন। মাঝখান থেকে পথের ঝাঁকুনিটা খাওয়াবেন? কী করবে, বুঝতে পারে না নবাব। রাশেদা তাগিদ দিতে থাকে, যা হইবার, হইবো। অহন বাড়ি চলো। বাড়িতে ঢুকে ঘরে পা রাখতে না রাখতেই পেছন থেকে ফুপাতো ভাইয়ের চিৎকার—নবাব রে মামা আর নাই।
আজ এতকাল পর আব্বার মৃত্যুর দিনের কথা কেন মনে পড়ছে নবাবের? বুঝতে পারে না। না কি বুঝতে চায় না? সে ভাবছে, সেই চিন্তাসূত্র ছিন্ন করেই আব্বার ডাক এলো—কী ভাবছিস বাবা? আব্বার ডাকে কী ছিল—ঠিক বুঝতে পারে না। মনে হয়, দূর সমুদ্রের বুক থেকে যেন শীতল হাওয়া বয়ে গেলো তার কপাল ছুঁয়ে। আব্বার কণ্ঠ এমন শীতল-মায়াবি কেন। ভাবতে ভাবতেই স্বগতোক্তি করে, আব্বা। ভাবছি জীবন এমন কেন? যাদের জন্য রক্তমাংস পানি করলাম, আমার জন্য তাদের কারও কোনো মায়া নাই?
নবাবের স্বগতোক্তি শুনে আব্বার কণ্ঠে বিদ্রূপ ফুটে ওঠে—কে কার জন্য রক্তমাংস পানি করে? এরপরই আদুরে গলায় বলে, মানুষ হয়ে যেদিন জন্মেছ, সেদিন সমস্যাসংকুল জীবন বেছে নিয়েছ। এটাই জীবন। জীবনে যুদ্ধ আর যুদ্ধই সত্য। জীবনের চারিদিক সমস্যাসংকুল জেনেও যিনি চক্রব্যূহ ঢুকে পড়েন, তিনি মহাবীর। যুদ্ধে জয়ী হওয়াই তার প্রধান লক্ষ্য নয়, উদ্দেশ্য শত্রুবিনাশ করা। তোমার জীবনের শত্রু কী?
নবাব আব্বাকে চিনতে পারে না। আব্বা এসব প্রশ্ন কেন করছেন। তবু আব্বার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া উচিত মনে করে। বলে, কী আব্বা? আব্বা এবার কণ্ঠকে যথাসম্ভব খাদে নামান। এরপর ধীর লয়ে বলেন, নিষ্ঠুর দারিদ্র্য। দারিদ্র্য আর নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে তুমি যুদ্ধ করবে। যদি শত্রুকে বিনাশ নাও করতে পারো, তাতেও সমস্যা নেই। তোমার কাজ হলো লড়াই চালিয়ে যাওয়া।
আব্বার কথাগুলো নবাবের কাছে দুর্বোধ্য ঠেকে। তারও বেশি অচেনা মনে হয় আব্বাকেই। আব্বা আসলে কে? স্বর্গীয় কোনো দূত? কী বলছেন তিনি? আবারও তার কণ্ঠ ভেসে আসে। যেন কুরুক্ষেত্রে অর্জুনকে যুদ্ধের পাঠ দিচ্ছে শ্রীকৃষ্ণ। বলছে—দেখো প্রকৃত বীর শত্রুর শক্তি দেখে ভয় পায় না। বরং শত্রুর তৈরি চক্রব্যূহ ভেদ করে ঢুকে পড়ে দুর্গে। এই ঝুঁকি তাকে সবসময় বিজয়ী বীরের তকমা দেয় না। তাকে শহীদ করেও দিতে পারে। তাতে তার মৃত্যু মহিমান্বিত হয়ে ওঠে। তুমি কষ্ট পাচ্ছ কেন? তোমার কাজ ছিল লড়াই করার। তুমি করেছ। জিততে পারোনি, এটা ব্যর্থতা নয়। নিয়তি। মানুষ তার নিয়তি লঙ্ঘন করতে পারে না।
আব্বার কথাগুলো নবাবের কানে দ্বৈববাণীর মতো লাগে। এতদিন আব্বা কোথায় ছিলেন। আব্বা এসব দুর্বোধ্য কথা কেন বলছেন? নবাব আবার ভাবনার অতল গহ্বরে ডুব দেয়। হঠাৎ তার কানে আসে রাশেদার কণ্ঠ—ওই শাহেদা, দ্যাখ তো তোর বাপ মইরে টইরে গেছে কি না? সাড়াশব্দ তো নাই। শাহেদার কণ্ঠ শোনা যায় না। সে কী করে তাও বোঝা যায় না। কেবল নাহিদা ঝুঁকে পড়ে নবাবের মুখের কাছে। আর হঠাৎ ফুঁপিয়ে ওঠে।
নবাব মেয়ের দিকে তাকাতে চায়। পারে না। একবার চোখ যায় স্ত্রী-সন্তানের দিকে, একবার দয়াহীন-মায়াহীন ছাদের পানে। দেখে সেখানে ছাদ নয়, শূন্য আকাশের তলে কোমল ঠোঁটের মতো মসৃণ মেঘের পাপড়ি উড়ে বেড়াচ্ছে। সেই মেঘের ফাঁকে দুই হাত বাড়িয়ে স্বর্গীয় দূত জিবরাইল দাঁড়িয়ে আছে। না, জিবরাইল নয়, আব্বা দাঁড়িয়ে আছে। আব্বা ডাকছে। নবাবের চোখ বেয়ে দুই ফোঁটা তপ্ত জল গড়িয়ে পড়ে।