ছোটগল্পের বড় সুখ রাবীন্দ্রিক, বড় দুঃখও তাই। সাহিত্যের এই কনিষ্ঠ শাখার দিকে তাকালে রবীন্দ্র-আধিপত্যের দেখাই মেলে। সেই আধিপত্য আকাশের সমান যেমন বিপুল, তেমনি সমুদ্রের মতো গভীরও। এই বিশালতা-গভীরতার মাঝখানেই ছোটগল্পের বিস্তৃতি।
রবীন্দ্র প্রভাবের কথা বলার সঙ্গত কারণ রয়েছে। সেই প্রভাব যেমন বিষয়ে, তেমনি কাহিনির গাঁথুনিতেও। উত্তর-রৈবিক অনেক ছোটগল্প লেখকের রচনায়ই রবীন্দ্র-ছায়া প্রচ্ছন্নভাবে পড়েছে। কেউ সেই ছায়ায় সচেতনভাবে নিজের ভুবন নির্মাণ করেছেন, কেউবা অবচেতনে আশ্রয় নিয়েছেন। এতে ছোটগল্পের সমৃদ্ধিই ঘটেছে। ক্ষতি কিছু হয়নি। এমন দাবির পেছনে দুটি গল্পের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। একটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের [৭ মে ১৮৬-১৭ আগস্ট ১৯৪১] ‘পোস্টমাস্টার’, অন্যটি তাঁর সমসাময়িক লেখক চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের [১১ অক্টোবর, ১৮৭৭-১৭ ডিসেম্বর, ১৯৩৮] ‘বায়ু বহে পুরবৈয়াঁ’। রবীন্দ্র্রনাথের হাতে ছোটগল্পের যাত্রা বলেই হয়তো তাঁর সমসাময়িক লেখকেরাও তাঁরই রীতি গ্রহণ করেছেন। চারুচন্দ্রও তাই।
উভয় গল্পেরই মূল বিষয় হৃদয়বৃত্তি। তবে, একটিতে অসম বয়সের হৃদয়াকুতি, অন্যটিতে বিসম শ্রেণিগত সমস্যা প্রকাশিত। উভয় গল্পে উচ্চবিত্তের নিশ্চিত চাকচিক্যময় জীবনের কাছে নিম্নবিত্তের পরাজয়। উভয় গল্পেই নিম্নবিত্তের নিষ্ফল আকুতি প্রকাশিত। তবে, সেই আকুতি কোনো গল্পের নিম্নবিত্তের প্রতিনিধিই মৌখিকভাবে প্রকাশ করে না। কেবল আচরণ দিয়ে বোঝায়।
‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে চরিত্র মূলত দুটি। পোস্টমাস্টার ও রতন। ‘বায়ু বহে পুরবৈয়াঁ’য় চরিত্র অন্তত হাফ ডজন। তবে, গল্পটি আবর্তিত হয়েছে দুটি চরিত্রকে কেন্দ্র করেই। দুটি গল্পের মিল-অমিল বিশ্লেষণের আগে উভয়ের কাহিনি দেখা যাক।
উলাপুর গ্রামে নীলকুঠির সাহেবদের প্রয়োজনে একটি পোস্ট অফিস হয়েছে। সেই পোস্ট অফিসে একজন পোস্টমাস্টার যোগ দিয়েছেন। নিজের রান্না নিজে করেন। মাঝেমধ্যে গ্রামের ১২/১৩ বছর বয়সী পিতৃমাতৃহীন অনাথ বালিকা রতন তাকে জল এনে দেওয়া থেকে শুরু করে রান্নার কাজে সাহায্য করে। হুঁকোয় আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে ঘর মুছে দেওয়ার মতো টুকটাক কাজ করে দেয়। বিনিময়ে দুই বেলা খাবার পায় সে। পোস্টমাস্টার শহুরে মানুষ। এই অজপাড়াগাঁয়ে তার ভালো লাগে না। তাই একবার অসুস্থ হয়ে পড়লে, সুস্থ হয়ে উঠেই বদলির চেষ্টা করে। কিন্তু তার সেই দরখাস্ত মঞ্জুর হয় না। তাই কাজে ইস্তফা দিয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সিদ্ধান্ত পোস্টমাস্টারের জন্য যতই মঙ্গলজনক হোক, রতনের জন্য মন ভাঙার। সহসা রতন জানতে চায়, ‘দাদাবাবু, আমাকে তোমাদের বাড়ি নিয়ে যাবে?’ জবাবে পোস্টমাস্টার হাসে। বলে, ‘সে কী করে হবে!’১ পোস্টমাস্টারের এই ছোট্ট জবাবে রতনের মন ভেঙে যায়। তার মনে সম্ভব-অসম্ভবের কোনো কার্যকারণ সম্পর্ক কাজ করে না, কেবল কানে বেজেই চলে, ‘সে কী করে হবে!’
চেতনে কিংবা অবচেতনে হলেও তাদের পক্ষপাত প্রকাশিত হয়ে পড়ে। ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর ‘বায়ু বহে পুরবৈয়াঁ’ গলে চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ও তাই করেছেন।
একসময় পোস্টমাস্টারের বিদায়ের ক্ষণ ঘনিয়ে আসে। সে রতনকে ডেকে বলে, তার যাওয়ার পর রতনের কোনো সমস্যা হবে না। নতুন যে পোস্টমাস্টার আসবে, সেও রতনকে অনেক আদর করবে। এরপর বলে, ‘রতন, তোকে আমি কখনো কিছু দিতে পারিনি। আজ যাবার সময় তোকে কিছু দিয়ে গেলুম, এতে তোর দিনকয়েক চলবে।’২ এই দয়ায় রতনের হৃদয়ে আঘাত লাগে। সে ব্যথিত হয়। ধুলায় পড়ে পোস্টমাস্টারের পা জড়িয়ে ধরে। বলে, ‘দাদাবাবু, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, আমাকে কিছু দিতে হবে না। তোমার দুটি পায়ে পড়ি, আমার জন্যে কাউকে কিছু ভাবতে হবে না।’৩ এরপরই এক দৌড়ে পালিয়ে যায়। পোস্টমাস্টার নিশ্বাস ফেলে। বাড়ির পথ ধরে। নৌকায় উঠে বসে। কিছুদূর যাওয়ার পর রতনের জন্য তার মনটা কিছুক্ষণের জন্য কেঁদে ওঠে, মনে মনে ভাবে, ‘ফিরিয়া যাই, জগতের ক্রোড়বিচ্যুত সেই অনাথিনীকে সঙ্গে করিয়া লইয়া আসি।’৪ কিন্তু ততক্ষণে নৌকার পালে বাতাস লাগে। নৌকা ছুটে চলে গন্তব্যের দিকে। পোস্টমাস্টারও হৃদয়াকুতির জায়গায় বুদ্ধিবৃদ্ধিক চর্চাকে বড় করে তোলে। ভাবে, ‘জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে, ফিরিয়া ফল কী। পৃথিবীতে কে কাহার।’৫ বিপরীতে রতনের মনে নতুন কোনো তত্ত্ব নেই। সে কেবল পোস্ট অফিসের চারদিকে কেঁদে কেঁদে ঘুরে বেড়ায়। বিধাতার কাছে নিষ্ফল আকুতি জানায়।
‘বায়ু বহে পুরবৈয়াঁ’ গল্পের প্রধান চরিত্র কাল্লু। সে প্রথমে পেশায় মুচি; মুচির ছেলে। বাবার আগ্রহে ইংরেজি মাধ্যমে কিছুদিন পড়াশোনা করে। বাবার মৃত্যুর পর মুচির কাজ না করে আরও ‘ভালো’ কাজের উদ্দেশ্যে কলকাতায় পাড়ি জমায়। সেখানে বালিকা স্কুলের ঘোড়ার গাড়ির সহিসের চাকরি নেয়। প্রথম দিনই বালিকারা তাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করে। কেবল একজন বালিকা বাদ। সে বিভা। সে অন্য মেয়েদের তুলনায় গুরুগম্ভীর। বিচক্ষণা। কাল্লুর প্রতি কিছুটা সহৃদয় ভাব দেখায়। একসময় স্কুলগামী বালিকা জেনে যায়, কাল্লু ইংরেজি পড়তে জানে। বিভা অবাক হয়। সে কাল্লুকে নিজের বই পড়তে দেয়। তাতেই কাল্লুর হৃদয় উছলে ওঠে। সে অবসরে বিভার দেওয়া বই পড়ে। আর বইয়ের পাতায় পাতায় বিভার হাতের স্পর্শ অনুভব করে। নিজের মধ্যে পুরুষকে জাগতে দেখে। কাল্লু বিভিন্ন রূপকথা-উপকথা পড়ে দেখেছে, শাহজাদীর প্রেমে নিতান্ত গ্রামের দরিদ্র যুবকও পড়ে। সেই প্রেমও পরিণতি পায়। তাই সেও বিভাকে নিয়ে স্বপ্ন রচনা করে। কিন্তু সেই কথা কীভাবে বলবে, বুঝতে পারে না। সে বিভাকে নিজের গ্রামের আর ৫টা মেয়ের সঙ্গে তুলনা করে বোঝার চেষ্টা করে। তাতেও কোনো উপায় খুঁজে পায় না। তবু তার এই ভেবে সুখ যে বিভাকে সে প্রতিনিয়ত দেখতে পায়। এভাবে কিশোরী বিভা একদিন তরুণী বয়সে উপস্থিত হয়। পড়াশোনা করা স্কুলে শিক্ষকতা করে। কাল্লুকে সে তার দুই বেলার বেহারা করে নিয়েছে। এই কাজের সুযোগে কাল্লু দুই বেলা বিভার কাছাকাছি থাকতে পারে, তাকে দেখতে পায়। এই-ই তার সুখ। তার এই সুখস্বপ্নে বাধা হয়ে দাঁড়ায় বিভার হবু বর। বিভার হবু বরের আসা-যাওয়া শুরু হলে কাল্লুর মনে ঝড় উঠতে থাকে। তার ‘পায়ের তলা দিয়া মাটি সরিয়া চলিতে লাগিল, তাহার চোখের সামনে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড পাগলের মতো টলিয়া টলিয়া বোঁ বোঁ করিয়া ঘুরিতে লাগিল! কোথায় তাহার আশ্রয়? কোথায় তাহার অবলম্বন?’৬
দেখতে দেখতে বিভার বিয়ে হয়ে যায়। এরপর ভগ্নহৃদয় কাল্লু ঠিক করে পুরোনো পেশা মুচির কাজ করবে সে। আর স্কুলের চাকরি করবে না। সেই খবর পেয়ে বিভা জানতে চায়, কেন কাল্লু স্কুলের চাকরি ছেড়ে দেবে। কাল্লু মাথা হেঁট করে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে। বিভা আবারও জানতে চাইলে কাল্লু ধীর স্বরে বলে, ‘জী নেহি লাগতা!’ তারপর সে চাকরি ছেড়ে দিয়ে জুতা সেলাইয়ের কাজ নিয়ে বসে। বিভার বাসার সামনেই। ঝড়বৃষ্টি-রোদ কোনো কিছুই তাকে তার কাজ থেকে সরাতে পারে না। সে মুচির কাজ করে। যখন বিভাকে দেখে তখন তার কণ্ঠে গান বেজে ওঠে।
০২.
‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে রতনের চেয়ে বিত্তশালী পোস্টমাস্টার। শহুরে সন্তান। বিপরীতে রতন নিতান্তই গ্রামের মেয়ে। পিতৃমাতৃহীন, অনাথ। বয়স কম। পোস্টমাস্টার তাকে ছেড়ে গেলে, সে পোস্ট অফিসের চারদিকে পুরোনো স্মৃতির টানে ঘুরে ঘুরে কাঁদে। পোস্টমাস্টারের সঙ্গে তার সম্পর্ক চিরতরে ছিন্ন হয়ে যায়। ‘বায়ু বহে পুরবৈয়াঁ’ গল্পের ‘বিভা’ উচ্চবিত্তের মেয়ে, কাল্লু নিম্নবিত্তের। কাল্লু পেশায় প্রথমে মুচি, পরে সহিস। সবশেষে আবারও মুচি। কাল্লু অতি আবেগের কারণে বিভার বাসার সামনেই তার কাজের স্থান ঠিক করে নেয়। এতে তার সুবিধা, সময়-অসময়ে বিভাকে সে দেখতে পায়। এই তার সুখ। উভয় গল্পে বেশ কিছু মিল পাওয়া যায়। মিলগুলো হলো:
ক. ধনী-দরিদ্রের একতরফা হৃদয়বৃত্তি
খ. চরিত্র নির্মাণে একই রকম একরোখা, একই রকম আত্মকেন্দ্রিক
গ. উভয় গল্পের চরিত্র নিজ নিজ অবস্থানে অনড়
ঘ. বিচ্ছেদে সমাপ্তি
ঙ. শ্রেণিবিশেষের প্রতি স্রষ্টার পক্ষপাত।
তুলনা-প্রতিতুলনার সুবিধার্থে উল্লিখিত বিষয়গুলো একসঙ্গে আলোচনা করা যাক।
সামাজিক স্তরবিন্যাস-ধনী-দরিদ্রে ব্যবধান, অভিজাত-ব্রাত্যশ্রেণির পার্থক্য চিরকালই ছিল। কখনো প্রকট, কখনো প্রচ্ছন্ন। মানুষ সাম্যের উপদেশ দেয় সত্য, কিন্তু নিজে ক্ষমতা পেলে ‘বারো আনা’ই পক্ষপাত দেখায়। সেই পক্ষপাত তার স্বজনের প্রতি, স্বজাতির প্রতি। এমনকি স্বশ্রেণির প্রতিও থাকে। মানুষ নিজেকে যতটা ন্যায়পরায়ণ-সাম্যবাদী দাবি করে, বাস্তবে ততটা নয়। বাস্তবে একদিকে তার মনোরাজদণ্ড ঝুঁকে থাকেই। ওই পক্ষপাত থেকে তার মুক্তি নেই। এই ক্ষেত্রে সমাজের দশজন সাধারণ মানুষের সঙ্গে একজন লেখকেরও কোনো পার্থক্য নেই। উভয়ই এক। উভয়ের মনস্তত্ত্ব বই এক। ভাবাবেগের কাছে তাদের বিচার-বিবেচনাবোধ প্রায় পরাজিত হয়। তাদের মস্তিষ্কের ওপর হৃদয় ঠিকই কর্তৃত্ব করে। ফলে তারা যতই প্রাজ্ঞ কিংবা ন্যায়পরায়ণ হওয়ার চেষ্টা করুন, শেষ পর্যন্ত অনড় থাকতে পারেন না। চেতনে কিংবা অবচেতনে হলেও তাদের পক্ষপাত প্রকাশিত হয়ে পড়ে। ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর ‘বায়ু বহে পুরবৈয়াঁ’ গলে চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ও তাই করেছেন।
নিম্নবিত্তের রতন কিংবা কাল্লুর প্রেম-ভালোবাসা-আবেগ তাদের কাছে প্রভুভক্তি—এর বেশি কিছু নয়।
রবীন্দ্রনাথ ও চারুচন্দ্র; উভয়েই অভিজাতশ্রেণির প্রতিনিধি। তাদের চরিত্র ‘পোস্টমাস্টার’ ও ‘বিভা’—উভয়ে বিত্তশালী সমাজের প্রতিনিধি। উভয়েই স্বাবলম্বী। ‘রতন’ ও ‘কাল্লু’—উভয়ে দরিদ্র; অনাথ। রতন ও কাল্লু উভয়েই একতরফা ভালোবাসে। অন্যপক্ষ তাদের প্রতি বিন্দুমাত্র প্রেমাসক্ত কি না, সেই খবর তারা জানে না। জানতে চায় না। তারা কেবল ভালোবেসে যায়। সেই ভালোবাসায় সামাজিক অবস্থান, আর্থিক সঙ্গতি, বয়সের ব্যবধান—কোনো কিছুই তারা ভাবে না। ফলে পোস্টমাস্টার যখন উলাপুর গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়, তখন রতন ভেঙে পড়ে। বড় আঘাত পায়। পোস্টমাস্টার ভাবে না, সে চলে গেলে অনাথ রতনের কী হবে। রতনের ভবিষ্যৎ নিয়ে তার মনে গভীরভাবে কোনো আঁচড় পড়ে না। বরং পোস্টমাস্টার বিদায়ের সময় রতনকে যে টাকা দিতে চায়, তাতে যতটা বিত্তশালীর করুণা ঝরে পড়ে, ততটা প্রিয় মানুষের দরদের দেখা মেলে না। হৃদয়ের স্পর্শ পাওয়া যায় না। এখন ভিক্ষাপ্রার্থীকে লোকে যেভাবে, দয়া করে, রতনের সঙ্গে পোস্টমাস্টারও ঠিক তেমন আচরণই করে। এতে হৃদয়বতী রতনের অন্তরে আঘাত লাগে। সে অপমানে-বেদনায় ভেঙে পড়ে। হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে পোস্টমাস্টারের পা জড়িয়ে ধরে তার সেই দান প্রত্যাখ্যান করে পালিয়ে বাঁচে। রতনের এই কাতর প্রত্যাখ্যানে অক্ষম বেদনা-আক্রোশ-অভিমান একসঙ্গে ঝরে পড়লেও পোস্টমাস্টারের তাতে ভাবান্তর ঘটে না। কারণ, পোস্টমাস্টারের কাছে এই এক রতনের আলাদা করে কোনো গুরুত্ব নেই। সমাজের দশজন অনাথের প্রত্যাশার সঙ্গে এক রতনের অব্যক্ত-ভালোবাসার কোনো প্রভেদ দেখে না সে। কারণ, সে উঁচু শ্রেণির বাসিন্দা। তার লক্ষ্য গ্রাম ছেড়ে কলকাতার চাকচিক্যময় জীবন। সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষী যুবকের কাছে এক অনাথ-গ্রাম্য কিশোরীর ভালোবাসা নিতান্তই অযৌক্তিক, অবাস্তব। রতন একবারই শুধু পোস্টমাস্টারকে অনুরোধ করে তাকে নিয়ে যেতে, কিন্তু প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর আর আটকানোর চেষ্টা করে না। দাবিও জানায় না।
‘বায়ু বহে পুরবৈয়াঁ’ গল্পের বিভা ও কাল্লুরও প্রায় একই পরিণতি। বিভাকে প্রথম গাড়িতে দেখেই কাল্লু মুগ্ধ হয়ে যায়। নিজের সমাজ-শ্রেণি-অবস্থান ভুলে সে বিভাকে ভালোবেসে ফেলে। কিশোরী বিভা একদিন যুবতী বয়সে পড়ে। স্কুলবালিকা থেকে স্কুল-শিক্ষকে পরিণত হয়। কাল্লুর চোখের সামনে বিভা বড় হয়, তার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের আগপর্যন্ত কাল্লুর আশা ছিল, কোনো অলৌকিক ক্ষমতাবলে, রূপকথার গল্পের মতো করে একদিন বিভা তার হতেও পারে। কিন্তু কাল্লুর চোখের সামনে দিয়ে বিয়ের পর বিভা যখন স্বামীর সংসারে যায়, তখন তার সমস্ত আশার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। সে আশাভঙ্গের কথা প্রকাশ করতে পারে না। ‘আপন মন জ্বালা নীরবে’ তাকে দহন করে। পোস্টমাস্টার গল্পে রতন অন্তত একবার পোস্টমাস্টারকে অনুরোধ করে তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে। কিন্তু এই গল্পে কাল্লু কখনোই বিভার কাছে নিজেকে নিবেদন করে না।
মাস্টারে রতন ব্রাত্যশ্রেণীর হলেও কিশোরী, স্ত্রী জাতির প্রতিনিধি, তাই সে অন্তত একবার হলেও নিজের আকুতি জানাতে পারে। বিপরীতে দ্বিতীয় গল্পের কাল্লু পুরুষ জাতির প্রতিনিধি, তদুপরি রতনের মতোই দরিদ্র-অনাথ। অনাথ-দরিদ্র পুরুষকে মানায় না উচ্চবিত্তের রমণীকে প্রেম নিবেদন করা। তাই কাল্লুও সেই নিবেদন করে না। অর্থাৎ চারুচন্দ্র এখানে খুবই হিসাবী, উচ্চবিত্ত-রুচির। তাই সমাজের নিচুতলার পুরুষের সঙ্গে উঁচুতলার নারীর প্রণয়কে প্রশ্রয় দেন না। তিনি সমাজের সামাজিক কাঠামোর গোড়ায় কুঠারাঘাত করার সাহস পান না। অথবা ইচ্ছাই পোষণ করেন না।
সমাজে কিছু মানুষ থাকে, যারা আপন আপন মর্জিতে অনড় থাকে। তাদের সেই একরোখা ভাবের কারণে সমাজের কী হলো না হলো, তাতে কোনো ভ্রূক্ষেপ থাকে না। কেউ কেউ ভীষণ আত্মকেন্দ্রিক হয়। নিজেকে ছাড়া জগতের আরও ভালোমন্দে তাদের কোনো আগ্রহ থাকে না। আলোচ্য পোস্টমাস্টার, রতন, বিভা ও কাল্লু তেমন একরোখা। আত্মকেন্দ্রিকও বটে। তবে কেউ বেশি, কেউ কম। এর মধ্যে বিভার আত্মকেন্দ্রিক আত্মমর্যাদা-সামাজিক অবস্থানের প্রশ্নে ষোলো আনা হলেও কিছুটা সে মানবপ্রেমীও। কাল্লুকে সে চাকরি দিতে চায়, এ জন্য স্বামীর কাছে সুপারিশও করে সে। কিন্তু যত আগ্রহ নিয়ে বিভা অনুরোধ করে, ততোধিক দৃঢ়তার সঙ্গে তার স্বপ্ন প্রত্যাখ্যান করে। ফলে কাল্লুর আর চাকরি হয় না। কিন্তু কাল্লুও সেই চাকরি চায় না। বিভার স্বামী যেমন কাল্লুকে পছন্দ করে না, তেমনি কাল্লুও তাকে সহ্য করে পারে না। তাই সে চাকরি ইস্তফা দিয়ে পুরোনো পেশা জুতা সেলাইয়ের কাজেই যোগ দেয়। সেখানে বিভা অসহায়। তার কিছুই করার থাকে না। কিন্তু একজন দরিদ্র ও দীর্ঘদিনের পুরোনো ভৃত্যের প্রতি যেটুকু দরদ থাকার কথা, এর বেশি কিছু তার মধ্যে দেখা যায় না। অর্থাৎ সামাজিকতা রক্ষার দায়িত্বটুকু বাদ দিলে বিভা চরিত্রে প্রেমের কোনো নিদর্শন মেলে না।
আবার পোস্টমাস্টারের কথা যদি বলি, তবে দেখি, তার হৃদয় বলে কিছু নেই। যা আছে, তা কেবল একজন অবস্থাসম্পন্ন মানুষের দান-খয়রাতের মানসিকতা, কিংবা বলা যেতে পারে শহরের বাবুদের বকশিশ দেওয়ার স্বভাব। তাতে না আছে হৃদয়ের সংযোগ, না আছে মানুষের প্রতি দরদ কিংবা সম্মানবোধ। বিপরীতে রতন যুক্তিহীনভাবে পোস্টমাস্টারের ওপর অধিকার বজায় রাখতে চায়। চায় বলেই সে পোস্টমাস্টারের সঙ্গে যেতে চায়। এই ঘটনা প্রমাণ করে—মানুষ যার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়, তাকেই ভালোবাসতে চায়। যে ছুড়ে ফেলে, তাকেই আঁকড়ে ধরতে চায়। এ যেন অজেয়কে জয়ের দুর্মর বাসনা। আর যে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দেয়, তাকে সে অবজ্ঞা করে। এ যেন বিধির বিধান। এই চিত্র ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে যেমন পাওয়া যায়, তেমনি ‘বায়ু বহে পুরবৈয়াঁ’য়ও। উভয় গল্পেই ভালোবাসার প্রতিদানে প্রত্যাখ্যান। অবজ্ঞার জবাবে ভালোবাসার দৃশ্য। কোথাও প্রকট, কোথাও প্রচ্ছন্ন। উপরিতলে যা-ই ঘটুক, ভেতরের চিত্র একই।
উভয় গল্পের চরিত্রগুলো নিজ নিজ অবস্থানে অনড়। কেউ নিজের অবস্থান থেকে একচুলও নড়ে না। পোস্টমাস্টার ও বিভা—দুজনই উচ্চবিত্তের প্রতিনিধি, তাদের বিত্তের অহং রয়েছে। তাদের সামাজিক-অর্থনৈতিক সম্পর্কের মতো জীবনসঙ্গী নির্বাচন ও বন্ধুত্বেও রয়েছে আভিজাত্যের ছোঁয়া। তারা কেউ নিজেদের সামাজিক অবস্থান ভুলে নিম্নবিত্তের সঙ্গে প্রণয়ে আবদ্ধ হবে না। এমনকি পারতপক্ষে বন্ধুত্বও নয়। নিম্নবিত্ত চিরকালই উচ্চবিত্তের দাস, সেবক। এই সত্য উচ্চবিত্তের রন্ধ্রে রন্ধ্রে গ্রথিত। তারা জানে, অর্থ যার করায়ত্ত, জগৎ তারই বশীভূত। তাই তারা ‘নিছক’ হৃদয়ের দামে হৃদয় কেনার মতো বোকামি করে না। তারা অর্থবিত্তের দিক থেকে সমানে সমান নীতিতে বিশ্বাসী। আচরণেও তাই। নিম্নবিত্তের রতন কিংবা কাল্লুর প্রেম-ভালোবাসা-আবেগ তাদের কাছে প্রভুভক্তি—এর বেশি কিছু নয়।
অন্যদিকে, রতন ও কাল্লু কেবল হৃদয়ের দাস। তারা বিত্তের ছলাকলা বোঝে না। অবুঝ হৃদয়ের বিনিময়ে হৃদয়ে সাড়াই আহ্বান করে। কিন্তু সেই সাড়া যে সম্ভব নয়, তা বোঝার মতো বোধ নেই। সামাজিক বাস্তবতা তাদের ধারণার বাইরে, কল্পনার অতীত। তাই তারা বোঝে না। কাল্লু বোঝো না, সে বিভার ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নয়। রতনও মানতে চায় না, সে পোস্টমাস্টারের সংসারের কেউ না। দুটি অবুঝ হৃদয় বিত্তশালীর প্রেমে মজে, ভালোবাসায় অন্ধ হয়—অযৌক্তিকভাবে। পরিণতিতে হয় প্রত্যাখ্যাত। বেদনায় হয় লীন। আবার যেচে কেউ তাদের হৃদয়ের আকুতির কথা প্রকাশও করে না। উভয়েই যুক্তিহীন অভিমান পুষে রাখে বুকে। সেই অর্থহীন-নিষ্ফল অভিমান বুকে চেপে বেদনায় ভেঙে পড়ে। এখানে রতন ও কাল্লুতে কোনো প্রভেদ নেই। দুজনে স্বভাবে প্রায় এক, দুজনের পরিণতিও এক।
যদিও পোস্টমাস্টার গল্পে গ্রামীণ দৃশ্যের বর্ণনা তেমন দেওয়া হয়নি। কেবল কাহিনির প্রয়োজনে প্রদীপ, মাটির সরা, নৌকা, বৃষ্টির মতো প্রাসঙ্গিক কিছু অনুষঙ্গ উচ্চারিত হয়েছে।
‘পোস্টমাস্টার’ ও ‘বায়ু বহে পুরবৈয়াঁ’—উভয় গল্পেরই সমাপ্তি বিচ্ছেদে। এ যেন নিয়তির লিখন। বিধাতা যেমন সৃষ্টির ললাট লিখে রাখেন, তেমনি স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ-চারুচন্দ্রও রতন-কাল্লুর ভাগ্য লিখে রেখেছেন আগে থেকেই। সেই ছক অনুযায়ীই এগিয়ে চলেছে গল্পের কাহিনি। কোথাও বিচ্যুতির লেশমাত্র ঘটেনি। পোস্টমাস্টার গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে গল্পের সমাপ্তি, সেখানে একা পড়ে থাকে রতন। আর বিভার বিয়ে হওয়ার মধ্য দিয়ে কাল্লুর সঙ্গে চিরতরে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়।
রতন-পোস্টমাস্টারের মিলন হয় না। কারণ, রতন নিতান্তই কিশোরী। তদুপরি নিম্নবিত্তের সন্তান। বিপরীতে পোস্টমাস্টার অবস্থাসম্পন্ন শহুরে পরিবারের সন্তান। বয়স তার পরিণত। রতনের হৃদয়াকুতি তাকে বিচলিত করতে পারে না। পরন্তু তার মনে হয়, ‘পৃথিবীতে কে কাহার?’ অবচেতন মনেও পোস্টমাস্টারের মনে বিত্তের অহংই বেজে ওঠে। সেখানে হৃদয়ের দাবি পরাজিত।
রবীন্দ্রনাথ নিতান্ত দরিদ্র কিশোরের সঙ্গে বিত্তশালীর সম্পর্ক মেনে নিতে পারেননি। না পারার কারণ, অত্যন্ত কৌশলে নারীচরিত্র এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন, যেন তার বয়স এতই কম দেখানো হয়েছে, বিত্তের প্রসঙ্গ বাদ দিলেও কেবল বয়সের অসমতার কারণেও সেই সম্পর্কের পরিণতি দেওয়া যেন সম্ভব না হয়। অসম বয়সও মিলনের পথে বাধা নয়। বিসম কিংবা অসম বয়সীদের মধ্যে পরিণয়ের ঘটনা নতুন নয়। আবার ধনী-দরিদ্র কিংবা মালিক-প্রভূতে পরিণয়ের সম্পর্ক নতুন নয়। বাস্তব জীবনে যেমন এর নজির ছিল, তেমনি রবীন্দ্র-পূর্ববর্তী সাহিত্যেও দৃষ্টান্ত কম নয়। এরপরও রবীন্দ্রনাথ অসম বয়স ও শ্রেণিবৈষম্যের প্রাচীর ভাঙতে চাননি, নিতান্তই নিজের শ্রেণির প্রতি পক্ষপাতিত্বের কারণেই।
রবীন্দ্রনাথের ‘কৌশলী’ পথ অনুসরণ করেছেন চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তিনি বিত্তশালী বিভার বিপরীতে দরিদ্র কাল্লুকে সৃষ্টি করেছেন। কাল্লুর মনে প্রেম দিয়েছেন, সেই প্রেম একতরফা। বিভার মনে সামান্য দয়া দিয়েছেন, সেই দয়াও উঁচুতলার বিশালকায় প্রাচীরঘেরা। তিনিও সেই প্রাচীর টপকাতে রাজি হননি। প্রথার বিরুদ্ধে যাওয়ার মতো হৃদয়সংবেদী হননি।
০৩.
এ তো গেলো মিলের কথা। অমিলও আছে। প্রথমত পরিবেশ; দ্বিতীয়ত পটভূমি; তৃতীয়ত নারীশিক্ষা।
পোস্টমাস্টার গল্পের পটভূমি গ্রাম। ফলে বিভিন্ন ঋতুতে সেই গ্রাম কী রূপ ধারণ করে, তার বর্ণনা রবীন্দ্রনাথ দিয়েছেন। সেই বর্ণনায় মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্কের পরিচয়ও মেলে। সেখানে অসুস্থ পোস্টমাস্টারের সেবায় রতনের যে স্নেহময়ী রূপের পরিচয় পাওয়া যায়, তার সঙ্গে প্রকৃতি ও আবহমান বাঙালি নারীর সাক্ষাৎ সম্বন্ধ রয়েছে। এই চিত্র চিরায়ত। রবীন্দ্রনাথ বলছেন,
এই নিতান্ত নিঃসঙ্গ প্রবাসে ঘনবর্ষায় রোগকাতর শরীরে একটুখানি সেবা পাইতে ইচ্ছা করে। তপ্ত ললাটের উপর শাঁখাপরা কোমল হস্তের স্পর্শ মনে পড়ে। এই ঘোর প্রবাসে রোগযন্ত্রণায় স্নেহময়ী নারী রূপে জননী ও দিদি পাশে বসিয়া আছেন এই কথা মনে করিতে ইচ্ছা করে, এবং এ স্থলে প্রবাসীর মনের অভিলাষ ব্যর্থ হইল না। বালিকা রতন আর বালিকা রহিল না। সেই মুহূর্তেই সে জননীর পদ অধিকার করিয়া বসিল, বৈষ্ঠ ডাকিয়া আনিল, যথাসময়ে বটিক খাওয়াইল, সারারাত্রি শিয়রে জাগিয়া রহিল, আপনি পথ্য রাধিয়া দিল, এবং শতবার করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “হাগো দাদাবাবু, একটুখানি ভালো বোধ হচ্ছে কি”?৭
কিন্তু যেই স্নেহশীলা কিশোরীর সেবায় পোস্টমাস্টার রোগমুক্ত হলো, সেই অবলাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার কিংবা তার মনের খবর নেওয়ার প্রয়োজনও বোধ করল না সে। এখানে বরং পোস্টমাস্টারকে তার জন্মস্থান ইট-পাথরের শহরের মতো নির্দয় মনে হয়। বিপরীতে ‘বায়ু বহে পুরবৈয়াঁ’ গল্পে কাল্লু কেবল বিভা ও তার সখীদের আনা-নেওয়া করত। এরপরও কাল্লুকে স্থায়ী কোনো চাকরি দেওয়ার জন্য বিভা তার স্বামীকে অনুরোধ করে। উভয় গল্পের এই চার চরিত্র বিশ্লেষণে একটি কঠিন সত্য বেরিয়ে আসে। পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধি যদি বিত্তশালী হয়, তাহলে নারীকে ব্যবহার করে মাত্র। তার কাছে নারীহৃদয়ের কোনো মর্যাদা নেই। নারীর প্রতি তার সম্মানবোধ কিংবা প্রীতিও নেই। বিশেষত অজপাড়াগাঁয়ের নিতান্ত কম বয়সী অশিক্ষিত অনাথ কিশোরী উচ্চশিক্ষিত শহুরে পুরুষের জীবনে অবাঞ্ছিতই বটে। আর বিভা নারী। তার হৃদয় কোমল। যতই উচ্চবিত্তের শহুরে প্রতিনিধি হোক, দীর্ঘদিনের পুরোনো ভৃত্যের প্রতি ভালোবাসা না জন্মাক, প্রেম না জাগুক, কিন্তু নারীহৃদয়ের শান্ত কোমল পরশটুকু আছে। সেই স্নেহশীলা নারীর পরিচয় তাকে এখানে মহৎ করে তোলে। বিভা তার স্বামীকে বলে, ‘ওগো শুনছ, দেখো, আমাদের স্কুলের সেই যে সহিসটা আমার বেয়ারার কাজ করত, সে আমার এখানে কাজ করতে চায়৷ তাকে রাখব? তাকে এতটুকু বেলা থেকে দেখছি, বড় ভালো লোক সে।’৮ এই অনুরোধে বিভার স্বামীর মন গলে না। বরং তাচ্ছিল্যভরে প্রত্যাখ্যান করে সে। বিভা ক্ষণিকের জন্য হলেও মনঃক্ষুণ্ন হয়। স্নেহশীলা-মাতৃরূপের দিক থেকে দেখলে রতন ও বিভার মধ্যে কিঞ্চিৎ মিল পাওয়া যায়। সেই মিল নারী বলেই; সমান্তরাল চরিত্র হিসেবে কোনোভাবেই নয়।
পটভূমির দিক থেকে দেখলে দুই গল্পেই ভিন্নতা আছে। পোস্টমাস্টার গল্পের ঘটনা ঘটে সম্পূর্ণ গ্রামে। সেই উলাপুর গ্রামের জলবায়ু-মাটি-গাছপালার সঙ্গে চরিত্রগুলোর দিনযাপন। শহুরে পোস্টমাস্টারের হাঁপিয়ে ওঠা। পল্লির অবলা রতনের দুর্বল হয়ে পড়া। যদিও পোস্টমাস্টার গল্পে গ্রামীণ দৃশ্যের বর্ণনা তেমন দেওয়া হয়নি। কেবল কাহিনির প্রয়োজনে প্রদীপ, মাটির সরা, নৌকা, বৃষ্টির মতো প্রাসঙ্গিক কিছু অনুষঙ্গ উচ্চারিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ-চারুচন্দ্র দুজনেই ব্রাত্যজনের মনে প্রেম দিয়েছেন, কিন্তু ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার দেননি। তাদের দুজনের চোখেই ব্রাত্যজন, কেবলই সংখ্যা, তাদের হৃদয়ের দাবি থাকতে পারে না, সেই দাবির মূল্য না।
‘বায়ু বহে পুরবৈয়াঁ’ গল্পেও একই রকম। পটভূমি শহুরের বটে, কিন্তু আমেজ অবস্থাসম্পন্ন গ্রামের। তবে সেখানে নাগরিক জীবনের ছোঁয়া মেলে। লোকজনের কথাবার্তা এমনকি হাসি-ঠাট্টায়ও শহুরে নির্দয় আচরণের সাক্ষাৎ মেলে। বিভা যখন কাল্লুকে চাকরি দেওয়ার অনুরোধ নিয়ে যায়, তখন তার স্বামী বলে, ‘কে, সেই কালো কুচকুচে শয়তানটা? সে ভালো লোক! তুমি দেখোনি তার চোখের চাউনি—যেন কালো বাঘের চোখ! তাকে রেখো না, সে কোন দিন ঘাড় ভেঙে রক্ত খাবে, আমায় খুন করবে!’৯ তার কথায় তাচ্ছিল্য আছে। অবজ্ঞা আছে। মানুষের প্রতি বিদ্বেষ আছে। বর্ণবিদ্বেষের মতো ঘৃণ্য মানসিকতা প্রকাশের প্রমাণ আছে। এদিক থেকে দেখলে গ্রামীণ জীবনে দয়ার্দ্র আচরণে সঙ্গে শহুরে জীবনের নিষ্ঠুরতা বড় আঘাত দেয় মানুষের হৃদয়ে।
পোস্টমাস্টার গল্পে কেবল পোস্টমাস্টারের ভালো লাগা না লাগা, আর রতনের আকুতির বর্ণনাই আছে। ওই অঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থা বলতে নীলকুঠিদের স্বার্থের ধারণা দেওয়া আছে। কিন্তু সংস্কৃতি, রাজনীতি প্রসঙ্গে কোনো বর্ণনা নেই। শিক্ষা প্রসঙ্গে যেটুকু আছে, সেটুকু মূলত রতনের বর্ণমালা অ-আ শেখা। এর বাইরে আর কে কী পড়ে, তার কোনো বর্ণনা নেই। অথচ ‘বায়ু বহে পুরবৈয়াঁ’ গল্প শুরুই হয়েছে নারীশিক্ষার প্রসঙ্গ দিয়ে। অর্থাৎ কাল্লু যে ঘোড়ার গাড়ির সহিস, সেই গাড়িতে চড়ে ওই অঞ্চলের কিশোরীরা স্কুলে আসা-যাওয়া করত। সেই স্কুলগামী বালিকা বিভাই একদিন এমএ পাস করে স্কুলের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পায়। চারুচন্দ্র গল্প বলার সঙ্গে সঙ্গে সমাজে নারীশিক্ষার অগ্রগতির বর্ণনা দিয়েছেন।
এর বাইরে বড় অসঙ্গতি চরিত্র নির্মাণ ও বিকাশে। পোস্টমাস্টারে দুটি চরিত্র। চরিত্রগুলোর মধ্যে সম্পর্ক ও কাজের সীমারেখা আছে। রয়েছে নির্দিষ্ট কাজ ও দায়িত্ব। গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই চরিত্রগুলোর উপস্থিতি দেখা যায়। অন্যদিকে ‘বায়ু বহে পুরবৈয়াঁ’য় শুরু থেকে যেসব চরিত্র থাকে, সেগুলোর মধ্যে কাল্লু ও বিভা ছাড়া বাকি চরিত্রগুলো গল্পের মাঝখান থেকে হারিয়ে যায়। স্বাভাবিক বিকাশ কিংবা পরিণতি কোনোটাই তাদের ভাগ্যে জোটে না। পরন্তু বিভার স্বামীর আগমন ঘটে।
০৪.
শুরুতেই বলেছি, ছোটগল্পের বড় সুখ রাবীন্দ্রিক, বড় দুঃখও তাই। রবীন্দ্ররীতির বিপরীতে নতুন কোনো রীতি বাংলা ছোটগল্পে আজও দানা বেঁধে উঠতে পারেনি। আলোচন্য দুই গল্পেরও এমন বক্তব্যের প্রমাণ মিলেছে বললেও অত্যুক্তি হবে না। রবীন্দ্র-গল্পের কাহিনি বর্ণনা, চরিত্র নির্মাণ, পরিণতির রীতিই গ্রহণ করেছেন চারুচন্দ্র। অন্তত এই গল্পে তারই স্বাক্ষর মেলে। তফাত কেবল স্থানে। একটি গ্রামীণ পটভূমিতে রচিত, অন্যটি শহুরে। একটি চরিত্র বেশি, অন্যটিতে মাত্র দুটি। এর বাইরে উভয় গল্পেই বিচ্ছেদের সুর, উভয় গল্পেই ধনীর উন্নাসিকতা দরিদ্রের হাহাকার প্রকাশিত। রবীন্দ্রনাথ সমাজের যে সম্মানকে উঁচুতে তুলে ধরেছেন, হৃদয়াকুতির দাম দেননি; চারুচন্দ্রও তাকে সেখানে রেখেছেন। আভিজাত্যের দেয়াল ডিঙিয়ে মানবপ্রেমের জয়গান গাননি। তারা উভয়েই আভিজাত্যের পূজারি, কেউই প্রেমের বংশীবাদক নন।
উভয় লেখকই ব্রাত্যজনের মনে প্রেম দেখেন, কিন্তু সেই প্রেমের পরিণতি দেন না। তারা উচ্চবিত্তের প্রতি নিম্নবিত্তের প্রেমকে প্রভুভক্তি-পূজা হিসেবেই দেখেন। অধিকার হিসেবে নয়। তাদের কাছে উচ্চবিত্তের নর-নারীর প্রতি নিম্নবিত্তের প্রেমানুভূতিকে নিতান্তই পরিহাসের ছলে দেখেছেন। রবীন্দ্রনাথ-চারুচন্দ্র দুজনেই ব্রাত্যজনের মনে প্রেম দিয়েছেন, কিন্তু ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার দেননি। তাদের দুজনের চোখেই ব্রাত্যজন, কেবলই সংখ্যা, তাদের হৃদয়ের দাবি থাকতে পারে না, সেই দাবির মূল্য না। স্রষ্টা হিসেবে দুজনেই নিষ্ঠুর, অমানবিক; উচ্চবিত্তের প্রতিভূ।
তথ্যসূত্র
১। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘পোস্টমাস্টার’, গল্পগুচ্ছ, মৌ প্রকাশনী, বাংলাবাজার ঢাকা, প্রথম প্রকাশ, ২০১১, পৃষ্ঠা: ১৯
২। তদেব, পৃষ্ঠা: ১৯
৩। তদেব, পৃষ্ঠা: ১৯
৪। তদেব, পৃষ্ঠা: ১৯
৫। তদেব, পৃষ্ঠা: ১৯
৬। চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘বায়ু বহে পুরবৈয়াঁ’, সমরেশ মজুমদার সম্পাদিত একশ বছরের সেরা গল্প, মিত্র ও ঘোষ, কলকাতা, পুনঃপ্রকাশ, ২০২১, পৃষ্ঠা: ৪৫
৭। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘পোস্টমাস্টার’, গল্পগুচ্ছ মৌ প্রকাশনী, বাংলাবাজার ঢাকা, প্রথম প্রকাশ, ২০১১, পৃষ্ঠা: ১৮
৮। চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘বায়ু বহে পুরবৈয়াঁ’, সমরেশ মজুমদার সম্পাদিত একশ বছরের সেরা গল্প, মিত্র ও ঘোষ, কলকাতা, পুনঃপ্রকাশ, ২০২১, পৃষ্ঠা: ৪৭
৯। তদেব, পৃষ্ঠা: ৪৭