‘‘স্মৃতি ভদ্র আমাদের গল্প শুনিয়েছেন স্মৃতিময়তার গল্প, স্মৃতিহীনতার গল্প সেসব। মানুষে মানুষে ভালোবাসার যেসব গল্প আমাদের আচ্ছন্ন করার শক্তি রাখে, তাঁর এসব কাহিনিতে আমরা তেমন সব ভালোবাসা খুঁজে পাই।’ ‘এলেনা বেলেনা’ এই গল্পের বইয়ের সবচেয়ে বড় সম্পদ তেমন সব মানুষ, যারা জীবনের কাছে হেরে গেলেও স্মৃতিময়তা আর স্মৃতিহীনতার মধ্যে দিয়ে আমাদের শিথানের কাছে এসে দাঁড়াতে পারে মরা কার্তিকের স্থবির চাঁদের করুণ রাগিণী নিয়ে।”
ইমতিয়ার শামীমের ভূমিকা পেরিয়ে ‘এলানা বেলেনা’র বর্ণিল অথচ করুণ রাগিণী শোনার আগ্রহে পাঠক বইটির গল্পসূচিতে চোখ রাখবেন। যেখানে রয়েছে মোট ষোলোটি গল্পের শিরোনাম। সেসব গল্পের আখ্যানে ভিন্নতা সত্ত্বেও গল্পগুলোর মধ্যে একধরনের যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। কী সেই যোগসূত্র? আলোচনা গড়ালে বিষয়টা স্পষ্ট হবে আশা করি।
আমাদের কথা সাহিত্যে গল্পকে দুভাবে উপস্হাপনের দৃষ্টান্ত দেখা যায়। একটি ধারায় মনে হয় লেখক বুঝি পাশে বসেই গল্পটি বলে যাচ্ছেন, পাঠক গল্পের শব্দ-বাক্যের আল পেরুতে পেরুতে, অনুভব করছেন গল্পটি তিনি ঠিক পড়ছেন না, বরং শুনছেন। অন্য ধারাটিতে লেখক থাকেন আড়ালে। শব্দ বাক্যের আল বেয়ে গল্পের গন্তব্যে পাঠকের নিজেকেই পৌঁছাতে হয়। স্মৃতি ভদ্রের গল্পগুলো দ্বিতীয়ধারার। সেসব গল্প লেখকের নিজস্ব শৈলী নিয়ে পাঠকের সামনে উপস্হিত হয়। ‘স্মৃতিময়তা’ তার গল্পজুড়ে কর্তৃত্ব করে যায়। ইতিহাস-রাজনীতি সচেতন এই লেখকের লেখার আরেকটি বিশেষ প্রতিনিধিত্বকারী অনুষঙ্গ হলো ‘সময়’। সে সময় কখনো অতীত,কখনো বর্তমান। মনোযোগী পাঠক নিঃসন্দেহে সেটি টের পান। এছাড়া বইটির গল্পে আরও রয়েছে সম্প্রীতি, মানবমনের বৈচিত্র্যের চালচিত্র-দাম্পত্যের জটিল রসায়ন। চিঠির মাধ্যমে অতীত-বর্তমানচারিতার বিশেষ ঝোঁক আছে স্মৃতি ভদ্রের। শব্দে শব্দে তার গল্পেরা ‘এ ভ্রমণ আর কিছু নয়’–আওড়ে যেন স্মৃতির কাছে, বিগত সময়ের কাছে ফেরে। স্মৃতি ভদ্রের নিবিষ্ট পাঠক মাত্রই স্বীকার করবেন–এজাতীয় ভ্রমণের চালক হিসেবে তিনি কতটা দক্ষ, স্বতঃস্ফূর্ত। তার চতুর্থ গল্পগ্রন্থ ‘এলেনা বেলানা’য় রয়েছে লেখকের হলমার্ক বিষয়যুক্ত অনেকগুলো গল্প। চিঠি বা ডায়েরি গল্পের বিশেষ চরিত্র হিসেবে ঘুরেফিরে এলেও এই পুনরাবৃত্তিতে পাঠক, ‘আমাদের ক্লান্ত করে/ ক্লান্ত–ক্লান্ত কর ‘, এমনটা বলার ফুরসত পান না যেন। কেননা বিষয় হিসেবে চিঠি কিংবা স্মৃতির কাছে(অতীতে) উজিয়ে যাওয়ার আখ্যানে থাকে ভিন্নতা আর চমক; পাঠককে যাতে নিবিষ্ট হয়েই ডুব দিতে হয়।
স্মৃতি ভদ্রের লেখালেখি তার স্বদেশ-বাংলাদেশে বসে নয়; তিনি প্রবাসে থেকে লেখালিখি করেন। দেশ থেকে দূরে বসে যাঁরা লেখালেখি করেন, তাঁদের সাহিত্য নিয়ে প্রায় আলাপ আলোচনা চোখে পড়ে। এই লেখকদের স্বতন্ত্র একটি ধারার লেখক হিসেবে চিহ্নিত করার প্রবণতা সাহিত্য জগতে চলমান। এই প্রবণতা প্রয়োজনীয় কি না, সেটা বর্তমান আলোচনার বিষয় নয়। আমরা বরং দেখবো, স্বদেশে না থেকেও তার গল্পগুলো কী ভীষণভাবে দেশ-কাল পাত্রে লীন।
বহুদিন আগে পুলিৎজার পুরস্কার প্রাপ্ত এক লেখকের একটি নিবন্ধ পড়েছিলাম (দুঃখিত এ মুহূর্তে তাঁর নামটি ঠিক মনে পড়ছে না), সেখানে তিনি মানুষের শিকড় অর্থাৎ জন্মভূমির প্রতি টান বিষয়ে ভারি চমৎকার করে বলেছিলেন– ‘মূল থেকে সরে গিয়ে যে যেখানেই যাক না কেন, মূলের প্রতি থাকবে তার তীব্র আকর্ষণ।’ নাড়িপোঁতা মাটির প্রতি এধরনের টান প্রতিফলিত হতে দেখি দেশ থেকে দূরে অবস্হান করা বহুসংখ্যক লেখকের লেখাজোকায়। জাপানের মাটিতে জন্ম নেওয়া পরবর্তী সময়ে ইংল্যান্ডের মাটিতে থিতু হওয়া কাজুও ইশিগুরো(Kazuo Ishiguro)’র কথা এখানে বলা যেতে পারে। বিশেষ করে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘অ্যা পেইল ভিউ অব হিলস্(A Pale View of Hills)’-এর কথা উল্লেখ করা যায়। এই উপন্যাসটি তাঁর বর্তমান আবাস ঘিরে গড়ালেও এক পর্যায়ে আমরা ইশিগুরোর জন্মভূমি জাপানকে ঘুরেফিরে সেখানে উপস্হিত হতে দেখি। আর দশজন দেশ ছেড়ে দূরে থাকা লেখকের মতো স্মৃতি ভদ্রের লেখার পরতে পরতেও জড়িয়ে থাকে নাড়িপোঁতা মাটি আর পূর্বপুরুষের স্মৃতির টান। যেখানে কান পাতলে শোনা যায় দেশ ভাঙার হাহাকার; ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের হৃদপিণ্ডের আলোড়ন। সে আলোড়ন নানামুখী। স্মৃতি ভদ্র সযত্নে তার গল্পে তুলে আনেন সময়ের সেসব আলোড়ন।
সময়ের হৃদয় খুঁড়ে ইতিহাসগন্ধী স্মৃতির কাছে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাবে এবইয়ের ‘টগরকুঞ্জ’, ‘পর্সেলিনের পরি’, ‘নকশিবাক্স’, ‘স্বাধীনবাংলা বেতার’, ইত্যাদি গল্পগুলো। এসব গল্পগুলো জীবন্ত হয়ে হয়তো স্মৃতিকাতরতায় মৌন করবে পাঠককে। ধুসর কিংবা গৌরবময় সময়ের কাছে পৌঁছে অনেক পাঠক হয়তো নস্টালজিক হবেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যা মিলান কুন্ডেরার ইগনরেন্সে বর্ণিত নস্টালজিয়ার মতো, ‘অতীতের প্রতি ফিরে তাকানোর আকাঙ্ক্ষাপ্রসূত বেদনা’। সাতচল্লিশ’ সেরকম এক বেদনার নাম। যা একটা বিরাট অংশের মানুষের জন্য হাহাকারের বেদনা জন্ম দেওয়ার ইতিহাস– ধর্মের নামে অধর্মের অমানবিক পুরাণ বিশেষ। চাইলেও তাকে অগ্রাহ্যের উপায় নেই–ইতিহাস সচেতন মানুষের পক্ষে সেটা প্রায় অসম্ভব। স্মৃতি ভদ্রের লেখায় সেই সচেতনতা চোখে পড়ে। সেটি আবার কেবলমাত্র সাতচল্লিশ ঘিরে স্হির থাকে না- মুক্তিযুদ্ধ, জঙ্গিবাদ, মুক্তবুদ্ধির বিপক্ষে অসুয়া উল্লাস, ইত্যাদি বিষয় গল্পের আখ্যান জুড়ে আবর্তিত হয়।
আগেই বলেছি, স্মৃতি ভদ্রের গল্পে একটি উল্লেখযোগ্য অনুষঙ্গ হিসেবে ‘চিঠি’, ‘ডায়েরি’, অথবা চিরকুট ঘুরেফিরে আসে। তার এধরনের গল্পগুলোকে এপিস্টোলারি (Epistolary) ঘরনার গল্প বলা যায়। এই ঘরনার সাহিত্যের আখ্যান সাধারণত চিঠি বা ডায়েরি কেন্দ্রিক বয়ানের ভিত্তিতে লেখা হয়। লেখকের ভাষায় ‘শব্দের স্তূপ’ বা চিঠি-ডায়েরি কেন্দ্রিক অনেকগুলো গল্প রয়েছে ‘এলেনা বেলেনা’য়। সেসব চিঠি-ডায়েরির বর্ণিত সুখ-দুঃখ,প্রেম-বিরহ কথনের পরত ভাঙতে ভাঙতে গল্পগুলো আমাদের কখনো নিয়ে যায় উদভ্রান্ত সাতচল্লিশে, কখনো বা গৌরবময় একাত্তরে।
আলো-অন্ধকারময় কর্ম পদ্ধতির বয়ান কোথাও কোথাও শিথিল না হয়ে আরও ঋজু হলে এই গল্পটিও স্মৃতি ভদ্রের উল্লেখযোগ্য কাজ হিসেবে বিবেচিত হতো।
মানবিকতা খুইয়ে ফেলা কতিপয় মানুষের ধর্মের নামে অধর্মের অন্ধকারে হেঁটে যাওয়ার হালের বয়ানও উপস্হাপিত হয়েছে সেসব চিঠির ছত্রে। জীবনযুদ্ধে পরাস্ত মানুষের মর্মবেদনা ‘শব্দের স্তূপে’ দরদীহাতে সাজিয়েছেন লেখক। যার নজির পাওয়া যাবে নাম গল্পটি-সহ চিঠি, টগরকুঞ্জ, পর্সেলিনের পরি,লেটার বক্স ও হলুদ চাঁদ, কেয়ার অফ শূন্যতা’, ইত্যাদি গল্পগুলোতে। এই গল্পগুলোকে এপিস্টোলারি ঘরনার বলা যেতে পারে। বাংলা সাহিত্যসহ বিশ্বসাহিত্যে এঘরনার অজস্র লেখাজোকা রয়েছে।
শিরোনাম গল্পটি পড়তে পড়তে এ্যান পেরি(Ann Perry)’র ‘দ্য জিন কুইন্স(The Gin Queens)’বইটির কথা হয়তো আমাদের অনেকের মনে পড়বে। জিন কুইনের চিঠি চালাচালিরত বয়স্কা বিধবা দুই বান্ধবীর গল্পের আগাগোড়া যদিও মজার সব কাহিনি ঘিরে। দুই বন্ধুর সম্পর্কের মাঝে তৃতীয়জনের ছায়া সেখানে জটিলতা তৈরি করে না। একে অন্যের কাছ থেকে আড়ালে সরে যাওয়ার ব্যাকুলতা জাগায় না। বরং সেটা তাদের শম্বুক গতির পত্রবিনিময়ের ধারা আমূল পাল্টে দিয়েছিল। ‘এলেনা বেলেনা’ গল্পের কাহিনি বর্তমান অন্তর্জালিক ঘেরাটোপে আটকে পড়া দুই বান্ধবীর। যাদের প্রেরিত বার্তা দুইপ্রাপ্তে পৌঁছে যায় নিমিষে। বহুদিনের পর তারা একে অন্যের সন্ধান পায় ইন্টারনেটের মাধ্যমে। পুরনো দিনের স্মৃতি রোমন্থনের রিনিঝিনি বেজে যাওয়া সুখস্মৃতির ছন্দপতন ঘটে এক সত্য আবিষ্কারের ভেতর দিয়ে। কী সেই সত্যি? যা তাদের বন্ধুত্বায় আড়াল তৈরির তাগিদ দেয়? পাঠক, আপনি বরং নিজেই সেটি আবিষ্কারের আনন্দ মুঠোবন্দি করুন। সুলিখিত গল্পটি পড়ে নেবার আমন্ত্রণ। এরপর ‘কেয়ার অফ শূন্যতা’ গল্পটির কথা বলা যায়- যেটির আগাগোড়া আখ্যান নির্মিত হয়েছে চিঠির হাত ধরে। এলিস ওয়াকারের(Alice Walker) ‘দ্য কালার পার্পেল(The Color Purple) উপন্যাসটি পুরো মাত্রায় চিঠি নির্ভর না হলেও এতে ‘চিঠি’র একটি জোড়ালো ভূমিকা আছে। গল্পটি পড়তে পড়তে উপন্যাসের প্রোটাগনিস্ট সেলির সঙ্গে গল্পকথকের সাযুজ্য খোঁজার খেয়াল চাপে। দ্য কালার পার্পলের প্রধান চরিত্র সেলি। জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে জর্জরিত সেলি জীবনের কোলাহল থেকে নিজেকে মুছে ফেলার সিদ্ধান্তে ভেসে যাবে কিনা পাঠক হিসেবে এমন একটা আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায়নি। তার জীবনে অন্ধকার ঢেলে দিয়েছিল পাষণ্ড বাবা(কাহিনির শেষদিকে অবশ্য জানা যায় লোকটা আদৌও তার জন্মদাতা ছিল না। সৎবাবা। যার প্রধান লক্ষ্য ছিল সেলির মায়ের সম্পত্তি হাতানো আর সৎমেয়ে সেলির উপর বিকৃত লালসা চরিতার্থ করা।) – বৈবাহিক জীবনেও সুখ নামের বাস্তবতাকে কবজায় নিজেকে কম ক্ষয় করতে হয়নি। বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া বোন নেটির সন্ধানের সাথে সাথে কিছু সত্যি উদঘাটন সম্ভব হয়েছিল শেষমেশ– এত ঘাত-প্রতিঘাতেও কিন্তু যে নিজেকে কখনও তুচ্ছ বা ফুরিয়ে যাওয়া কেউ না ভেবে স্বস্তি পেয়েছিল–স্মৃতি ভদ্রের ‘কেয়ার অব শূন্যতা’, গল্পের প্রোটাগনিস্ট কথক যার সন্ধান পেতে ব্যর্থ হওয়ার অনুষঙ্গ শুধুও কি তার অভিমান নাকি– পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ক্রুর চোখ রাঙানি– সেটি বরং পাঠক নির্ণয় করুন।
লেখক স্মৃতি ভদ্র যুক্তরাষ্ট্রের নিউইর্য়ক নামের ঝলমলে নগরে থেকেও পুরোমাত্রার নাগরিক বনে যাননি। তার গ্রামীণ বা প্রাকৃতিক বর্ণনা, ফেলে আসা জন্মমাটির ঘ্রাণ জুড়ে থাকে-স্বদেশ, তার নিজের পরিচিত মহল্লাকে ভুলতে না পারার গল্প। তার সৃজন করা চরিত্র বা পরিবেশ তাই বানোয়াট মনে হয় না। গল্প/উপন্যাস বা সাহিত্যের যে শাখাই হোক না তা, এমন সব সৃষ্টির সময় একজন লেখক যখন তাঁর সৃজন করা চরিত্র বা পরিবেশের সাথে আন্তরিক ভাবে একাত্মবোধ করেন, তখন তাঁর লেখায় এক ধরনের নিপাট বাস্তবতা উঁকি দিয়ে যায়। নিজের সৃষ্টির ভেতরে নিজেকে সমর্পণের আন্তরিক তাগিদ আমরা রবীন্দ্রনাথের মধ্যে দেখি ছিন্নপত্রে ইন্দিরা দেবীকে লেখা পত্রে। “গল্প লেখবার একটা সুখ এই, যাদের কথা লিখব তারা আমার দিনরাত্রির সমস্ত অবসর একেবারে ভরে রেখে দেবে, আমার একলা মনের সঙ্গী হবে, বর্ষার সময় আমার বদ্ধ ঘরের সংকীর্ণতা দূর করবে, এবং রৌদ্রের সময় পদ্মাতীরের উজ্জ্বল দৃশ্যের মধ্যে আমার চোখের পরে বেড়িয়ে বেড়াবে।”
এই যে এভাবে রবি ঠাকুরের দেখানো পথ ধরে একজন লেখক যখন তাঁর সৃষ্টির সাথে একাত্মবোধ করবার ব্যাকুলতা দেখান তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই সংশ্লিষ্ট লেখার সাথে অজান্তেই এক ধরনের যোগাযোগ স্হাপিত হয়ে যায় পাঠকের। যা কিনা আরোপিত বা বানোয়াট সাব্যস্ত লেখার ক্ষেত্রে ঘটে না বলে মনে করি। স্মৃতি ভদ্রের গল্পে মনোসংযোগ ঘটালে গল্পের চরিত্র/পরিবেশ ইত্যাদির সাথে লেখকের একাত্মবোধ করবার সর্বোচ্চ আন্তরিকতা চোখে পড়ে।
এলেনা বেলেনায় যে ১৬টি গল্প রয়েছে সেগুলো: টগরকুঞ্জ/ স্বাধীন বাংলা বেতার/ কালকূট/ তেলাপোকা/ লেটার বক্স ও হলুদ চাঁদ/ প্যারিস রোড/ নকশিবাক্স/ অবরুদ্ধ/ শূন্যসময়/ বেলকনি/ পোর্সেলিনের পরি/ অন্তর্লীন অন্ধকার/ কেয়ার অফ শূন্যতা/ শেষ ভোর/ চিঠি/ এলেনা বেলেনা। এখানে কয়েকটি গল্প নিয়ে অল্পবিস্তর বলার চেষ্টা করেছি।
‘টগর কুঞ্জ’ গল্পটিকে ভালোবাসার গল্প যেমন বলা যায়– বিচ্ছেদের গল্পও বলা যায়। সবচেয়ে বেশি হয়তো চিহ্নিত করা যায় ভাঙনের গল্প হিসেবে। ভূখণ্ডের ভাঙন- সম্পর্কের ভাঙন। ধর্মে ধর্মে রেষারেষিতে যে ভাঙন পাখা দিয়ে ছিল। রাতুলের সঙ্গে গল্পকথকের তিল তিল করে গড়ে উঠা বন্ধুত্বের সম্পর্ক- ভালোবাসার সম্পর্ক— যে সম্পর্কে বিষ নিশ্বাস ফেলে যুদ্ধ কিংবা দাঙ্গার সূত্রে ধর্মীয়বৃত্তে তোমরা-আমরায় বিভক্ত হওয়ার বেদনা। বেদনা উজিয়ে স্মৃতিভার কেবলি চিবুক নাড়ে, ‘ –পড়ো মোর মনে– শতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে।’ একদিন যে সম্পর্ক ছিল স্পর্শের নাগালে– রাতুলের দেশ ছাড়ার কারণে দূরবর্তী সে সম্পর্ক স্পর্শের বাইরে চলে যাওয়ায় চিঠির আশ্রয়ে কথক জানান দিয়ে যান অতীত স্মৃতি– টগর কুঞ্জের হালহকিকত। ভারি মন কেমনের গল্প টগর কুঞ্জ দিয়ে শুরু হয় এলেনা বেলেনার পাতা উলটানোর পালা। এ গল্পে আবুল হাসান ও উৎপল বসুর কবিতার কিছু লাইন আওড়ানোর সুযোগ পাওয়া যাবে– আবুল হাসান আর উৎপল বসুর কবিতার কোলাজ এগল্পের বিষণ্ন সুন্দরের বুকে ঝিনুক ব্যথা হয়ে সঙ্গত করেছে ভারি চমৎকার ভাবে। এ গল্প ‘মোহাবিষ্টের’ মতো বার বার পড়া যায়’।
‘স্বাধীন বাংলা বেতার’, প্রতিটি মানুষের ভেতরে যেমন একটা গল্প থাকে– একটা বাড়ি জুড়েও থাকে গল্প। একটা নয় অনেক গল্প। কখনো কখনো সেটা খুঁজে পাওয়া যায়– কখনো যায় না। গল্পগুলো গর্বের হতে পারে– তিতকুটে সত্যের হতে পারে– সন্ধান পাওয়া মানুষের বুকে গর্ব গুঁজে দেয় কিংবা বেদনার মতো বাজে অব্যক্ত যন্ত্রণায়। সেরকম একটি গল্প স্বাধীন বাংলা বেতার। অতীত খুঁড়ে উদ্ধার করা গৌরবের স্মৃতি আর কিছু তিতকুটে সত্যের মুখোমুখি করবে পাঠককে এ গল্প।
‘কালকূট’, মারণঘাতী বিষ হিসেবে চিহ্নিত কালকূট। স্বাভাবিক ছন্দ নয় বরং অস্বাভাবিকত্বের আগাম সংকেত গল্পের শিরোনাম জুড়ে। শিরোনাম মারফত পাওয়া ধারণা ধরে প্রাথমিক ভাবনাটা এমন হতে পারে– এ গল্প বিষক্রিয়ায় কারো মৃত্যু ঘিরে আবর্তিত। ধারণা হয়তো খুব ভুল নয়–কিন্তু মৃত্যু তো কেবল মানুষের হয় না। সম্পর্কেরও মৃত্যু। সেই মৃত সম্পর্ক টেনে নেওয়ার ক্লান্তি আছে–মৃত্যু আছে। গল্প জুড়ে যাকে ভিলেন হিসেবে ভাবা হয়েছিল– তাকেই ত্রাণকর্তার বেশে উপস্হাপনের চমক আছে। স্মৃতি ভদ্রের আর দশটা গল্পের মধ্যে এগল্পের বয়ান কিছুটা ভিন্ন ধরনের–মায়ালু শব্দের ঘেরাটোপ ছেড়ে তিনি এখানে ঋজু টান টান ভাষায় গল্পটা বলার কৌশল গ্রহণ করেছেন– যার উত্তোরণ সার্থক বলে মনে করি।–সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বভাব-রুচির দুই নারীর জীবন যাত্রার দারুণ গল্প এটি। তাদের জীবনে ঝেঁপে আসা জটিলতা নিয়ন্ত্রণে নিজস্ব কৌশল প্রয়োগের সফলতা কিংবা ব্যর্থতার আখ্যান কালকূট। তাদের বেছে নেওয়া পথ ঠিক কী বেঠিক, সে তর্ক এড়িয়ে বলা যায় এ গল্প সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বভাব-রুচির। এ গল্পে তিনি তার পরিচিত গণ্ডি ভেঙে নতুনভাবে পাঠকের সামনে হাজির হয়েছেন। গল্পের বুনন, বয়ানের ভিন্নধারার দক্ষতায় অন্য আরেক স্মৃতি ভদ্রকে আবিষ্কার করবেন পাঠক। নতুনের এই আবিষ্কার নিঃসন্দেহে আনন্দদায়ক।
‘শেষ ভোর’ গল্পটিকেও স্মৃতি ভদ্রের অন্য সুরের গল্প হিসেবে ধরা যায়। এটি এক সাহসী লেখকের গল্প– যিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সব সময় প্রতিবাদী থাকার তাগাদা পেয়ে এসেছেন। বিয়েও করেছেন খুন হয়ে যাওয়া তাঁর শিক্ষককন্যাকে যে কন্যা বাবার খুন হওয়ার পর মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। তিনি চাননা স্বামীর পরিণতিও তার বাবার মতো হোক। বাবার করুণ স্মৃতি, সাথে স্বামীকে নিয়ে নিত্য চিন্তার টানাপোড়েনে পরাস্ত স্ত্রী একসময় প্রবাসী সন্তানের কাছে চলে যান–স্বামী তাকে ধরে রাখতে ব্যর্থ হন–বলা ভালো তিনি সেরকম কোনো চেষ্টাও নেননি। তার মানে তিনি তার প্রথাবিরোধী লেখালিখিতেই সচল থাকবেন–অথচ হঠাৎ একভোরে তার মধ্যে কেমন ছন্দপতন ঘটে যায়– তার বাড়ির সামনের মাঠে সংঘটিত একটি হত্যাকাণ্ড তার ভেতর বাড়িতে হঠাৎ পরিবর্তনের সূচনা ঘটায়–তার হঠাৎ বিপরীত মেরুতে গিয়ে দাঁড়ানোর বিষয়টা যতটা স্পষ্ট হওয়া দরকার ছিল, ততটা যেন হয়নি। হয়তো লেখক হেমিংওয়ের ‘আইসবার্গ’ থিওরীর ভক্ত হওয়ায় সবটা খুব স্পষ্ট করার পথে হাঁটেননি। পাঠক হিসেবে মনে হয়েছে গল্পটির সম্পাদনায় আরেকটু যত্নশীল হওয়ার প্রয়োজন ছিল।
‘তেলাপোকা’-এই গল্পের শুরুর চলন বেশ থ্রিলে ভরা। আলো আর অন্ধকারের দুজন প্রাণীর ব্যাক টু ব্যাক বয়ান উঠে এসেছে। সামান্য অমনোযোগী হলে কে যে কোনটা–কার কী বক্তব্য থই হারানোর সম্ভাবনা। মানুষ না বলে কেন ‘দুজন প্রাণী’ বলছি সে ধোঁয়াশা গল্প শেষে স্পষ্ট হবে। গল্পের প্রারম্ভে উত্তেজনাকর যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল–গল্প পরিণতিতে যেতে যেতে সেটি যেন কেমন থিতিয়ে গেছে। আলোর জীব অন্ধকার ছড়াতে উদ্যোত– অন্ধকারের জীবদের কোণঠাসা করে একদার আলোর জগতের জনটি, যিনি ভোল পালটে নিজেও হয়ে উঠেন অন্ধকার জগতের অংশ। আলো-অন্ধকারময় কর্ম পদ্ধতির বয়ান কোথাও কোথাও শিথিল না হয়ে আরও ঋজু হলে এই গল্পটিও স্মৃতি ভদ্রের উল্লেখযোগ্য কাজ হিসেবে বিবেচিত হতো।
স্মৃতি ভদ্রের গল্পেরা হাত ভরে একচেটিয়াভাবে আনন্দ দেবে বলে আমাদের সামনে উপস্হিত হয়না। তার গল্প আমাদের প্রশ্নবিদ্ধ করে,আমরা ভাবিত হই।
‘লেটার বক্স ও হলুদ চাঁদ’, খুব ভালো লাগার মতো একটি গল্প। এ গল্পের আখ্যানে মাঝে মধ্যেই পরাবাস্তবতার উঁকিঝুঁকি ধরা পড়ে। যা গল্পটিকে অন্য এক মাত্রা দিয়েছে। ভিনদেশে বসবাসকারী অচেনা একজন মানুষের ফেলে যাওয়া চিঠির সূত্রে অন্য আরেকজন যিনি নিজেও দেশ ছেড়ে সবেমাত্র সেই দেশের ব্যস্ততম শহর নিউইর্য়কে এসেছেন তা নিয়ে গল্প। চিঠিগুলো অচেনা মানুষের। যিনি একদা কথক যে বাড়ির এ্যাটিকের(চিলেকোঠা) ঘরটি ভাড়া নিয়েছেন সেখানে থাকতেন। স্বপ্নের দেশে বসত গড়লেই স্বপ্ন মুঠোবন্দি হবে–এমন ভাষ্যের বিপরীত অথচ বাস্তব কাহিনি নিয়ে সাজানো এ গল্পের আখ্যান। যা পাঠক মনে বিষণ্নতা ছড়াবে। এ গল্পের বয়ান ভারি মন কেমনের- ভালোলাগারও।
‘কেয়ার অফ শূন্যতা’ গল্পের শুরু ও শেষ সবটাই চিঠিতে। এই গল্পে চিঠির প্রেরক এবং প্রাপকের সম্পর্কটাকে ধোঁয়াশায় রাখার একটা নৈব্যক্তিক কৌশল লেখক নিয়েছেন। এ কৌশল পাঠককে বিভ্রান্ত করার জন্য হয়ে থাকলে অনেকটাই সফল বলতে হবে। গল্পশেষে আড়াল ভেঙে সম্পর্ক দুটো স্পষ্ট হলে অনেক পাঠক হয়তো চমকাবেন। অন্য ভাষায় এধরনের গল্প পড়বার অভিজ্ঞতা যাদের আছে তাদের হয়তো এই চমকের ধাক্কা কম লাগবে। বাংলা ভাষায় এমন গল্প কমই পড়েছি। এ গল্পের ভাষাভঙ্গি আর চলন খুব মনোরম।
নাম গল্প ‘এলেনা বেলেনা’র শুরু বিদেশে থাকা, নিয়মে বাধা, নিঃসঙ্গ এক হেমন্ত দুপুরে একা একজন মহিলার সোশ্যাল মিডিয়াতে আধা-মনোযোগে শুরু করা একটা মেসেজের আদান-প্রদান দিয়ে। ধীর এই গল্পের গতি, এক অন্তর্লীন বিষাদের সুর তাতে। আস্তে আস্তে পাল্টাতে থাকে এর গতি,ঝর্নার মতো চড়াই উৎরাই ধরে এগোতে থাকে গল্প। আমাদের সময়ের সাথে খুব প্রাসঙ্গিক-রোজকার জীবন পরিবর্তন হয় না কোথাও, কিন্তু ভার্চুয়ালি ওই ফিরে পাওয়া সম্পর্ক আমূল বদলে দেয় মূল চরিত্রের নিঃসঙ্গ, শৃঙ্খলায়, গতেবাঁধা জীবনের গতিপ্রকৃতি। এই গল্পে ঢুকে, পাঠক নিবিষ্ট হয়ে যান নস্টালজিয়ায়, ফিরতে না পারার আকুতিতে, আর একটু একটু করে অতীতের উন্মোচনের। দক্ষ ক্ল্যাসিক্যাল শিল্পীর মতো লেখক গল্পকে নিয়ে যান আলাপ, বিস্তার পেরিয়ে দ্রুত ঝালার মধ্যে দিয়ে এক চরম মুহূর্তের দিকে। গল্পটি টানটান ভাবে ধরে রাখে পাঠককে ।
এ বইয়ের বাকি গল্পগুলোও পাঠক মনে সুখপাঠ্যের অনুভূতি জাগাবে নিঃসন্দেহে। এ বিশ্বাস জন্মেছে তার পূর্ববর্তী বইগুলো পাঠের অভিজ্ঞতা থেকে। স্মৃতি ভদ্র যে শুধুমাত্র গল্পে নয় গদ্য রচনাতেও সিদ্ধ হস্ত, তার প্রমাণ ‘রসুই ঘরের রোয়াক। ‘রসুই ঘরের রোয়াক’ নামের অসম্ভব জনপ্রিয় বইয়ের লেখক স্মৃতি ভদ্র সময় উজিয়ে বিগত দিনের সমাজ, সংস্কৃতি, জীবন তথা আত্মগত ধারাবিবরণী উপস্হিত করেছেন দারুণ দক্ষতায়। রসুই ঘর এখানে নারীর একান্ত আপনার থাকেনি, রোয়াক ছাড়িয়ে লেখার পরতে পরতে উঠে এসেছে হারানো দিন, ঘর-মন ভরতি মানুষের আন্তরিক সহাবস্হানের পাঁচালি– তাই এটিকে শুধুমাত্র ‘বাঙালির হাজার বছরের শান্ত সিগ্ধ, সুখী গার্হস্হ্য গাথা’ বলা যাবে না, বরং বাঙালির সমাজ-সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে এ বই গুরুত্বের দাবিদার।
গল্পকার স্মৃতি ভদ্র গল্পে, গল্পে আমাদের অন্তর্গত ব্যথায় দিব্যি জ্বেলে দিতে জানেন আলোর প্রদীপ। যেখানে সুখের ভেতরও গভীর বেদনায় বেজে যায় সাতচল্লিশ, একাত্তর, ধর্মান্ধ সময়, আপাত জীবনে পরাস্ত মানুষ কিংবা আটপৌড়ে দাম্পত্যের নড়ে উঠা ফাঁপা সংসারের পদাবলী। স্মৃতি ভদ্রের গল্পেরা হাত ভরে একচেটিয়াভাবে আনন্দ দেবে বলে আমাদের সামনে উপস্হিত হয়না। তার গল্প আমাদের প্রশ্নবিদ্ধ করে,আমরা ভাবিত হই। তার গল্পের স্মৃতি-বিস্মৃতির ধারাভাষ্য পাঠ করে আমরা অস্বস্তিতে পড়ে যাই। ‘এলেনা বেলেনা’-বইটির গল্পগুলো পাঠক মনে গভীর ভাবনার অনুরণন তুলবে বলে বিশ্বাস করি।