তরুণ প্রজন্মের কবি, গল্পকার ও গবেষক আহমেদ ফিরোজ। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে বর্তমানে ভাষা, সাহিত্য ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণায় নিয়োজিত আছেন। কবিতা রচনার মধ্য দিয়ে সাহিত্যযাত্রার প্রারম্ভ, গান-গল্প-প্রবন্ধ-ছড়া-চিত্রনাট্য-কলাম প্রভৃতি বিষয়ে নিয়মিত লিখে চলেছেন। তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা বিবিক্ত (একটি সাহিত্যোদ্যোগ); বুক রিভিউ (সমালোচনা ও গবেষণা কাগজ)। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ক ফোঁটা জলের টানে (২০০৫); কাঠমানুষের কলমাবির্ভাব (২০০৮), রাতের ঘোড়া (২০১৭)। গল্পগ্রন্থ দি লাইট অফ ডেড নাইট (২০০৫)। উপন্যাস প্রেম রোগ বিলাস (২০১০)। প্রবন্ধ-গবেষণা শূন্যদর্শন (২০০৫, পরিবর্ধিত ২য় সংস্করণ ২০১১); সবকিছু ভেঙে পড়ে (২০০৫)। গবেষণা না-গল্প না-কবিতা (২০০৬)। জীবনী জসীমউদ্দীন (২০০৯); সোহরাওয়ার্দী (২০০৯); শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (২০১৩), শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক (২০১৭)। সংকলন ও সম্পাদনা বাংলা ভাষার নির্বাচিত ১০০ ছড়া (২০১০); শ্রেষ্ঠ কবিতা : আবুল হাসান (২০১৩), বাংলাদেশের নির্বাচিত ১০১ ছড়া (২০১৫), শূন্য দশকের লেখক অভিধান (২০১৬)। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদিত গ্রন্থ ১০টি। নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র স্বপ্নখেকো, জন্মক্ষুধা, দলন, মৃত্যুঘুম। সংগঠক আমরা বায়ান্ন। সম্প্রতি বইমেলা নিয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সালাহ উদ্দিন মাহমুদ।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ : এবারের নতুন বই সম্পর্কে কিছু বলুন?
আহমেদ ফিরোজ : ‘রাতের ঘোড়া’ আমার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ এবং ২৬তম গ্রন্থ। প্রচ্ছদ করেছেন শিবু কুমার শীল। প্রকাশক কথাপ্রকাশ। পৃষ্ঠা ১১২। মূল্য ১৩৫ টাকা। ২০০৮-এ বেরিয়েছিল ‘কাঠমানুষের কলমাবির্ভাব’। তারও আগে ২০০৫-এ ‘ক ফোঁটা জলের টানে’, প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। তারও আগে বলা যায়, ১৯৯৯ সাল থেকে নিয়মিত লিখছি বিভিন্ন লিটলম্যাগ, দৈনিক ও সাহিত্য পত্রিকায়।
১১২ পৃষ্ঠার দীর্ঘ এই কাব্যগ্রন্থে ৮০টি কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। গত তিন/চার বছরের মধ্যে লেখা কবিতাগুলোই মুখ্যত এ-গ্রন্থে ঠাঁয় করে নিয়েছে। আর বই নিয়ে বলতে গেলে গ্রন্থ-শুরুর প্রাক-পর্ব-কথা থেকে পুনর্লিখন করে বলতে হয়, কবিতার বিস্তার এমনতর, কখনো লাতিন আমেরিকার গল্প পড়ে এসেছে, কখনো বোদলেয়ার। আবার সর্বময়তা জুড়ে ফিরে এসেছেন রবীন্দ্রনাথ; জীবনানন্দ কিংবা বুদ্ধদেব বসু ছেড়ে যাননি; পাশে পেয়েছি কাজী নজরুল ইসলাম থেকে রণজিৎ দাশ পর্যন্ত। প্রেরণার উৎস হয়ে কাজ করেছেন মুহম্মদ (স.), গৌতম বুদ্ধ কিংবা লালন; আবার কখনো পিতা, পিতামহ, মাতা, ভগ্নি, বন্ধু-সুহৃৎ।
নারী কবিতার প্রধান অনুষঙ্গ ও যাত্রী; পুরুষ তার সহোদর, পর্যটক। নারী-পুরুষ মিলে কবিতাকে অন্যতর এক মর্যাদা দিয়েছে, নারী দিয়েছে প্রাণ, পুরুষ তার অবয়ব। দর্শনের শূন্য অথবা শূন্যের দর্শন (শূন্যদর্শন)-এ পুরো জগৎ আন্দোলিত হয়েছে, হয়েছে বিমোহিত ও আকর্ষিত। বিকাশ-পর্বের যাত্রা সেখান থেকেই, অন্তরের মিলনে, দেহের সৌষ্ঠবে, আত্মার সন্ধানে।… সে-কারণে কবিতার দর্শন প্রকৃতির অন্নজলকামে সবসময় নাও হতে পারে, আবার হতে পারে অদৃশ্য দেখার মেলবন্ধনে। ছন্দ কিংবা অলঙ্কার সে তো নারীর গুণ, পুরুষের জন্মরোগ তা ভেঙে ফেলার অহঙ্কার। ভাঙাগড়া জগতেরই অংশ, সৃষ্টির সৌন্দর্য; কবিতার মুঠোফোন কানে কিংবা তাল-লয় ঘণ্টার শব্দে। এই শব্দখেলা প্রথম, প্রমথ, প্রমত্ত, প্রতত। তার পিঠে সওয়ার লাল ঘোড়া, নীল ঘোড়া, সবুজ বাংলাদেশ। কবিতার এই গতিকে আমি আনন্দময় যাত্রা বলেছি। অগ্রজ-অনুজ, বন্ধু-সুহৃৎ— সবার অংশগ্রহণে এ সম্পন্নযাত্রা। আজকের যে তরুণ-তরুণী তারা হয়তো ভুলেই গিয়েছেন নিজের ভেতরকার সমস্যায় মানব হৃদয় কীরকম জট পাকিয়ে গিয়েছে। অথচ তাই ভালো লেখার জন্ম দিতে পারে। এই ভূখ- থেকে বিশ্বব্যাপী আমি তারই সন্ধান করেছি। প্রেমে, স্পর্ধা আর সাহস আর সম্মান আর আশা আর অহমিকা আর মায়ামমতা আর আত্মত্যাগে।…
নতুন বই তাই প্রকাশের আগে এক ধরনের আগ্রহ ছিল এক তারিখে মেলায় আসবে তো। এক তারিখে এসেছে। এখন চাওয়া পাঠকের হাতে বইটি যতবেশি পৌঁছে দেয়া যায়। সে জন্য সহজলভ্য দামও রাখা হয়েছে। ১১২ পৃষ্ঠার বইয়ের মূল্য ১৩৫ টাকা, মেলায় ২৫% কমিশনে ১০০ টাকায় সংগ্রহ করা যাবে। এ জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই কথাপ্রকাশের স্বত্বাধিকারী মো. জসিম উদ্দিনকে। তিনি আন্তরিকভাবে ভালোবেসে থেকে বইটি করেছেন। দামও কম রেখেছেন; যেন কবিতাকে আরো কত সহজে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া যায়। কারণ তিনি মনে করেন, সাহিত্যের বিকাশই মানুষকে নিরন্তর মুক্তির পথে নিয়ে যাবে, সাধনায় নিমজ্জিত করবে; আর সুন্দর পৃথিবীকে আরো বেশি বাসযোগ্য করে তুলবে। আমার চাওয়াও একই।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ : বইমেলা সম্পর্কে আপনার প্রাপ্তি এবং প্রত্যাশা?
আহমেদ ফিরোজ : অমর একুশে গ্রন্থমেলা আমাদের প্রাণের মেলা। প্রতিজন বাঙালির অন্বয়-বন্ধনের মেলা। অন্য জাতিগোষ্ঠীর মধ্যেও আজ এর প্রাণ সঞ্চার করেছে। সে-কারণে এই মেলা থেকে আমাদের চাওয়া-পাওয়া যেমন বেশি থাকে, তেমনি অর্জনও কম নয়। তবে বইমেলা বাংলা একাডেমি-মুক্ত হওয়া জরুরি। জাতির মননের প্রতীক এই প্রতিষ্ঠানটির আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার সুযোগ রয়েছে। সেসব বিষয়ে আরো বেশি মনোযোগী হলো। তা ছাড়া নানা অব্যবস্থাপনার কথা বাংলা একাডেমি জানার পরও গুরুত্ব দিয়ে সমাধান করতে চায় না। আবার এক ধরনের কর্তৃত্বপরায়নতাও লক্ষ্য করা যায় লেখক, প্রকাশক ও পাঠকের প্রতি, তা একেবারেই মানা যায় না।তা ছাড়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘিরে ধীরে ধীরে যে সাংস্কৃতিক-বলয় গড়ে উঠছে, তার পরিচালনার দায়িত্ব লেখক-প্রকাশকের সঙ্গে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে যুক্ত করে যৌথ আয়োজনে আরো সুচারুভাবে পালন করা যেতে পারে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বাংলা একাডেমিও যুক্ত থাকল, তবে তা যেন হয় অংশগ্রহণমূলক, কর্তৃত্ব ফলানো নয়। আর কোনোভাবেই বাংলা একাডেমির ভেতরে কোনো বিক্রয় স্টল না-রাখা। সেখানে অনুষ্ঠান আয়োজন অব্যাহত থাকুক এবং তাদের অফিসিয়ালি বিক্রয়ের স্থানগুলো উন্মুক্ত থাকুক মেলার শেষ সময় পর্যন্ত।
আরেকটি বিষয়, মেলাকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে উদ্যানের আরো বেশি জায়গা নিয়ে সুন্দরভাবে আয়োজন করা এবং প্রকৃত প্রকাশকদের বেশি বেশি অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। কয়েকটি ভাগ, যেমন—মূল মেলা চত্বরের ধারাবাহিক বিন্যাসের পাশাপাশি কিছু গোলায়তন করা। যথা : লিটলম্যাগ চত্বর, শিশু-কিশোর চত্বর, মিডিয়া চত্বর, সরকারি-বেসরকারি আরো কিছু প্রকাশকের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা, জলযোগ ও আপ্যায়ন চত্বর; এর সঙ্গে আরো কিছু বিষয় ভাবা যেতে পারে। এ ছাড়া মূল মেলার মাঝখানে সুদৃশ্য স্থায়ী ফোয়ারা অথবা ফুলের বাগান তৈরি করে রাখা যেতে পারে। তার পেছন দিকটায় (শিখা চিরন্তনের দিকে) সীমিত শব্দযোগে মোড়ক উন্মোচনের জন্য মঞ্চ বানানো যেতে পারে। তার সামনে অন্তত ১০০ চেয়ার রাখা। কথা-আলোচনা শুনতে অথবা বিশ্রামের জন্য কিছুটা সময় বসতে পারল, বিশেষ করে শিশু ও বয়োবৃদ্ধরা। বিভিন্ন চত্বরের মাঝখানেও ছোট ছোট বসার জায়গা রাখা যেতে পারে। সেখানে কবি-সাহিত্যিক, প্রকাশক, পাঠক ও মিডিয়ার মধ্যে একধরনের আলাপচারিতা ও আড্ডার সুযোগ তৈরি হবে। খাবারের দোকান বা স্টলগুলো যেন অবশ্য অবশ্য রুচিসম্মত হয়। যারা ডাকডাকি না-করে অল্পমূল্যে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার সরবরাহ করবে। সেক্ষেত্রে কিছু নামকরা কোম্পানিকেও বছর-পর্যায়ক্রমে লটারির মাধ্যমে সুযোগ দেয়া যেতে পারে। তা ছাড়া সুন্দর, বাস্তবায়নযোগ্য যে কোনো প্রস্তাবনাকে স্বাগত জানানোর মানসিকতা মেলা কমিটির মধ্যে থাকতে হবে।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ : সমকালীন সাহিত্য নিয়ে আপনার চিন্তা-ভাবনা কেমন?
আহমেদ ফিরোজ : সম্প্রতি একটি প্রবন্ধ লেখা শুরু করেছি, এখনো শেষ হয়নি। প্রবন্ধের শিরোনাম : বিশ্বসম্প্রীতি ও ভাষার শক্তি। সেখানে লিখেছি, একসময় যাকে না-গল্প না-কবিতা বলে চালিয়ে দিতাম, আজকাল তাকেই অণুগল্প, গুঁড়ো গুঁড়ো কবিতা, ন্যানো গল্প-উপন্যাস বলা হচ্ছে; কখনো তা ব্যক্তিগত গদ্য বা কথা বা প্রবচন বা ভঙ্গি আকারে প্রকাশ পাচ্ছে। টেক্সটই শেষপর্যন্ত এরূপ নামধারণ করছে। এর মধ্যে কেউ কেউ সাহিত্যের নানা শাখার ভেতরকার দেয়াল ভাঙার কথা বলছেন। কেউ-বা আবার সাহিত্যের দিগন্ত প্রসারিত হওয়ার কথা বলে নানা শাখার মিশেলের দাবি তুলছেন। সংবাদধর্মী কিছু লেখাও এর আওতায় চলে আসছে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করছি, এ-জাতীয় নানা লেখনি, আলোচনা ও প্রস্তাবনার কথা ভেবে অনেক আগেই দীর্ঘ ভূমিকাসহ ‘না-গল্প না-কবিতা’ শিরোনামে গবেষণামূলক বেশকিছু লেখা লিখেছি—যা ২০০৬ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। প্রথম মুদ্রণ শেষ হয়ে যাওয়ায় বইটির কোনো কপি বর্তমানে পাওয়া না-গেলেও, আগামী দু-এক বছরের মধ্যে নতুন সংস্করণ প্রকাশের আশা রাখি।
উত্তরাধুনিক চর্চাকারীরা যাকে টেক্সট বলল; ভারতের পশ্চিম বাংলায় কেউ কেউ তাকে ব্যক্তিগত গদ্য বললেন। একজন শিল্পী বা লেখকের মনে যে ভাব বা বিষয়-ভাবনা উদয় হলো, তিনি তার লিখিত রূপ প্রকাশ করা শুরু করলেন, একসময় লেখার ইতিও টানলেন। কখনো তা কাব্যরূপ পেল, কখনো ছোটগল্প রূপে চেনা গেল, কখনো প্রবন্ধ-নিবন্ধের আদলে মহড়া দিল। শেষপর্যন্ত তা লেখা হলো। কোনো একটা ফর্মে বা ছকে পড়ে তা নির্দিষ্টভাবে বিভিন্ন নামকরণ হলো। সাহিত্যের এই নানা শাখা বা ফর্ম বা ছক হলো সংজ্ঞায়িত রূপ, যেমন: কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, কিংবা নাটক, উপন্যাস ইত্যাদি। এগুলোর নির্দিষ্ট ও তাৎপর্যপূর্ণ সংজ্ঞাও নির্ধারিত রয়েছে। এর বাইরে গিয়ে তালপাতাকে আপনি অন্যকিছু বলতেই পারেন, তবে আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হবে, শূন্য করে শূন্য থেকে। যেমন:আমপাতা আমপাতা নয় জামপাতা, জামপাতা জামপাতা নয় কাঁঠালপাতা, কাঁঠালপাতা কাঁঠালপাতা নয় নারকেলপাতা—এভাবে। মানুষ মানুষ নয় গরু; গরু গরু নয় ছাগল ইত্যাদি আর কি? তাহলে যা কবিতা হলো না, গল্প হলো না, প্রবন্ধ-নিবন্ধও হলো না, তাই-ই শেষপর্যন্ত না-গল্প না-কবিতা অথবা টেক্সটে রূপ পেল বহুমাত্রিকরণে। সমকালীন সাহিত্য নিয়ে কথা বলতে গেলে সাহিত্য দর্শনের এ-বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। সে-কারণে সাহিত্য-রচনার শাখা ও বিষয়সমূহও এখন গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কি লিখব, কেন লিখব, আর কি লিখব না? তবে সুন্দর দিন আসবেই। অনেকেই ভালো লিখছেন। তাঁদের সবাইকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ : সমকালীন লেখকদের মধ্যে কাদের লেখা ভালো লাগে?
আহমেদ ফিরোজ : তরুণ-তরুণীদের লেখা সবসময় আমাকে টানে। বুড়োদেরও কারো কারো। তবে লেখায় টানের সন্ধান করি সবসময়। যে লেখায় টান থাকে না, তা পড়তে ভালো লাগে না। মাঝে মাঝে বাধ্য হয়ে কিছু লেখা পড়ি। সেখানে ভালোবাসা থাকে না, থাকে প্রয়োজনের ইঙ্গিত। সাহিত্য প্রয়োজনের চেয়ে প্রেমের, ভালোবাসার। আর প্রেম নান্দনিকতাকে আবিষ্কার করে। যে প্রেমে শুভবোধ ও নান্দনিকতা নেই; সে প্রেম প্রেম নয়, কামনার আক্রোশ। দেহ ভাড়া পাওয়া যায়, মন কখনো নয়। সাহিত্য মনকে জাগায় : সত্য চিহ্নিত করে, সুন্দরকে স্বাগত জানায়। আবার আনন্দের বার্তাও দেয়। সমকালীন সেইসব লেখকদেরই খুঁজি, খুঁজে পেলে অনেকবেশি আনন্দিত হই। খুব ভালো লাগে। তাদের জন্য নিরন্তর শুভেচ্ছা…
আরেকটি কথা, বুড়োদের বলতে রবীন্দ্রনাথের মতো তরুণপ্রাণ সবুজদের বলিনি। বলেছি, যাঁরা লেখায় বুড়ো হয়ে গেছেন; দেওয়ার কিছু নেই, অথচ মেলা এলেই বই বের করেন, মিডিয়ায় মুখ দেখান, প্রকাশকদের মাথা চিবিয়ে চিবিয়ে খান; শেষপর্যন্ত এঁরা পাঠকদের জন্য মুলো হাতে সারা বইমেলা চষে বেড়ান। এই বুড়োদের জন্য আরো কিছু কথা : কাল এগিয়ে যাচ্ছে, বিস্তার ঘটছে না-গল্প না-কবিতার। সাহিত্য থেকে মানুষের মুখে মুখে। সাহিত্য তো মানুষেরই অবয়ব। চিন্তাধারা ও কল্পনার সুবিন্যস্ত ও সুপরিকল্পিত লিখিত রূপ। সহিতের ভাব ও মিলন এই নিয়ে সাহিত্য। সাহিত্যে শিল্প যদিও রচনাদির কৌশলকে বলা হয়। অথচ সাহিত্যিকদের সমাজ ও সীমানা রয়েছে—যা সাহিত্যজগৎ বা সাহিত্যাকাশকে নির্দেশ করছে। কিন্তু রচনা বা নিবন্ধাদির অধ্যয়ন ও প্রণয়নপ্রচেষ্টা সাহিত্যচর্চার অন্তর্গত সাহিত্যানুশীলনের বিষয়। কিন্তু প্রকৃত সাহিত্যসাধককে সাহিত্যচর্চা ও রচনা করাতেই সিদ্ধ হতে হয়, সাধনা করতে হয়। সাহিত্যসেবক, সাহিত্যলেখক বা রচনাকারী সবসময় সাহিত্যবৃত্তি তথা সাহিত্য রচনা দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন, এমন নয়। শিল্পচর্চা সে জায়গায় প্রধান হয়ে ওঠে। শিল্প কারুকার্যের কারখানা, চারুকলা ও আর্ট। তবে নির্মাণকলা ও রচনাকৌশল শিল্পের অন্যতম বাহন। এ জন্য রবীন্দ্র-কাব্যকে নির্মাণ-কলা শিল্পোৎকর্ষের চমৎকার নিদর্শন বলা হয়।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ : সাহিত্য নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
আহমেদ ফিরোজ : নিয়মিত লিখতে চাই। অনেক বেশি লিখতে চাই। অসংখ্য বিষয় ও ভাবনা নিয়ে লিখতে চাই। লেখা হয় নাই, এমন বিষয়সমূহ আবিষ্কারের নেশা কাজ করে। কখনো কখনো এই কষ্টবোধ প্রবল হয়ে ওঠে, জীবন এতো ছোট কেন? তাছাড়া সাহিত্যের গণ্ডি বা সীমা ভাঙতে চাই। উন্মুক্ত করতে চাই, বিকাশ করতে চাই প্রকাশের সবকিছু। স্বপ্ন রাঙাতে চাই নতুন পত্র-পল্লবে।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ : সাহিত্যের কোন শাখা আপনাকে বেশি টানে?
আহমেদ ফিরোজ : যে কোনো টেক্সটই কাছে টানে। এর মধ্যে কবিতা প্রথম, দ্বিতীয় প্রবন্ধ-গবেষণা। এক্ষেত্রে একটি কথা বলে রাখা দরকার, এ-পর্যন্ত সাহিত্যের যত শাখা আবিষ্কৃত হয়েছে, ভবিষ্যতে আরো যত শাখা আবিষ্কৃত হবে, তত শাখায় লেখার আগ্রহ। কোনোটাতেই অরুচি নেই। তবে দীর্ঘ লেখার ক্ষেত্রে অলসতা কাজ করে। প্রতিনিয়ত সেখান থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টায় আছি। প্রাণপণে এখন সেই সাধনা।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ : লেখালেখির ক্ষেত্রে আপনার অনুপ্রেরণা?
আহমেদ ফিরোজ : অন্তরআত্মাকে সম্মান করি। সম্মান করি জ্ঞান ও জ্ঞানের উৎসকে। সম্মান করি অগ্রজ ও তার অবদানকে। সম্মান করি দৃষ্টি ও সৃষ্টিজগৎকে। সম্মান করি অদেখা স্রষ্টাকে, যিনি আমার মাঝে বসবাস করেন। সম্মান করি বিন্দু ও সিন্ধুকে।
ফলে প্রকৃতিই মূল অনুপ্রেরণা। অনুপ্রেরণা মানুষের প্রেমে ও ঈর্ষায়। অনুপ্রেরণা ত্যাগে। সৌরজগতের নানা অজানা-অদেখা অনুপ্রেরণা না-হলেও, তার আবিষ্কারের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকি, অপেক্ষা করি। সেও একধরনের অনুপ্রেরণা। যদিও অন্যায়-অত্যাচায় সর্বদা পরিত্যাজ্য। তবু সম্মানের লড়াইকে স্বাগত জানাই। আর কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম এবং জীবনানন্দ দাশকে অবশ্য পাঠ্য মনে করি। বারবার হাজারবার। বিজ্ঞানের আবিষ্কার এবং ধর্মের সমালোচনাকে অস্বীকার করি না। সত্যকে খোঁজার চেষ্টা করি। সেক্ষেত্রে বলা যায়, সত্যান্বেষণই প্রেরণার মূল কথা। মন্দকে পরিত্যাগ করি, ঘৃণা করি, অসমাদর করি।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ : প্রচারবিমুখ থেকে সাহিত্যচর্চার সার্থকতা কতটুকু?
আহমেদ ফিরোজ : প্রচারবিমুখ বলে কোনো কিছু নেই। লিখছেন তো প্রচারের সঙ্গেই যুক্ত হচ্ছেন। কেননা লেখার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য থাকে প্রকাশ করা, মানুষকে জানানো অথবা জাগানো। সে আগে হোক কিংবা পরে। কেউ পড়বে অথবা কাউকে পড়াবেন বলেই শুরু। আর আকাশের সব তারকা সমান হয় না। সব আলো সমুজ্জ্বল থাকে না। ক্লাসেও সবার এক রোল হয় না। পঞ্চাশ জন ছাত্র-ছাত্রী থাকলে কাউকে-না-কাউকে ঊনপঞ্চাশ হতে হয়, অপরজন পঞ্চাশও হন। প্রদীপের আলো যেমন সবখানে সমানভাবে পড়ে না, তেমনি সব আলো আলো নয়, কোনোটা আলেয়াও। আবার সবাই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সম-শ্রমও দিতে পারেন না। সে-কারণে কেউ কেউ এগিয়ে থাকবেন, আর কেউ কেউ পিছিয়ে। এর অর্থ এই নয় যে, তারা দলচ্যুত। বিশালাকায়ের যেমন বিরাট অবদান থাকে, তেমনি বিন্দুর অবদানও কম নয়। আবার বড় সবসময় বড় নয়, ছোটও সবসময় ছোট নয়। জগতে সবকিছুরই প্রয়োজন আছে। তা না-হলে ভালোর ভিড়ে ভালোই একসময় মধ্যম হয়ে যাবে। সে জন্য কারো অবদানকে ছোট করে দেখতে নেই, না-হলে বড়র অস্তিত্ব প্রমাণিত হয় না। কে প্রচারে আছেন, আর কে নেই? তার চেয়ে বড় প্রশ্ন : কে কতটা ভালো লিখতে পারছেন। শেষপর্যন্ত তারই হিসেব হবে। সাহিত্যের ইতিহাস যুগে যুগে তারই সাক্ষ্য দেয়।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ : আপনার ছাব্বিশতম বই আপনাকে কেমন পুলকিত করে?
আহমেদ ফিরোজ : প্রথম প্রকাশনার মতোই। আবেগাশ্রিত করে, আপ্লুত করে, উত্তেজিত করে, সম্মোহিত করে, অণুপ্রাণিত করে, নতুন করে স্বপ্ন দেখতে সাহায্য করে।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ : আপনার লেখালেখির সাফল্যে অন্যের ঈর্ষা আপনাকে বিব্রত করে কি?
আহমেদ ফিরোজ : এমন করে কখনো ভেবে দেখিনি। তবে সবখানেই প্রতিযোগী থাকে। কখনো একক, কখনো দলগত। আমি একক ও দলের বিপক্ষে নই। কেননা একক দল তৈরি করে, আবার দল একক নির্দেশ করে। সে-কারণে ঈর্ষা কিংবা বিদ্বেষে ভয় পাই না। বরং মানুষের দৌড় পর্যবেক্ষণ করি। বলা যায়, তা ভালোই লাগে। আনন্দের সঙ্গে সুন্দরকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করি। আর আবিষ্কার পরিবর্তন বা ব্যতিক্রম নয়, নতুনের আবাহন।