[শরাফত হোসেন মূলত কবি। প্রকাশিত কবিতার বই ‘ঘাসফুল তোমার সাথে’ ও ‘ফিরে আসি কাচের শহরে’। জন্ম ১ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। বাবা কবি জয়দুল হোসেন, মা হাসনেয়ারা বেগম। স্কুল জীবন থেকেই নানা সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তিনি যুক্ত। লেখালেখির শুরু ওই সময়েই। একাধিক জাতীয় দৈনিকের বিশেষ সংখ্যা সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০০৭ সাল থেকে ‘সাহিত্য একাডেমি পত্রিকা’র নির্বাহী সম্পাদক। সম্পাদনা করছেন ‘বুক রিভিউ’। বর্তমানে কাজ করছেন সংবাদ মাধ্যমে। পড়াশুনা ব্যবসায় প্রশাসনে। জাতীয় কবিতা পরিষদ, জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনালসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক একাধিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। কাজ করে যাচ্ছেন শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি প্রসারে। সম্প্রতি তার মুখোমুখি হয়েছেন কথাশিল্পী সালাহ উদ্দিন মাহমুদ]
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ : এবার আপনার কোনো বই বের হয়েছে?
শরাফত হোসেন: সে রকম করে বলতে গেলে এবারে নতুন বই নেই; বেশকিছু সংকলনে লেখা আছে। এরমধ্যে মানবর্দ্ধন পাল সম্পাদিত ‘দুঃসময়ের কবিতা’ প্রকাশ করেছে অক্ষর প্রকাশনী, মিলন সব্যসাচীর সম্পাদনায় বাঙালি থেকেও আসছে একটি কবিতার সংকলন, আনিস মুহম্মদ সম্পাদিত ইংরেজিতে অনূদিত কবিতারও একটি সংকলন প্রকাশিত হবে হবে জানালো। প্লাটফর্ম থেকে প্রকাশিত আমার কবিতার বই ‘ফিরে আসি কাচের শহরে’ স্টলে নেই, বিক্রি হয়ে গেছে। কবিতার বইয়ের বাজার নেই বললেই চলে; এই সময়ে বই শেষ হয়ে যাওয়াটা অবশ্যই আনন্দের। নিজেকে আধা জনপ্রিয় কবিদের কাতারে ভেবে পুলক অনুভব করছি। নতুন বই করার প্রেরণা বলতে পারেন।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: বইমেলা সম্পর্কে আপনার প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা?
শরাফত হোসেন: প্রাপ্তি বলতে একরাশ ভালোবাসা- নতুন বইয়ের গন্ধ, পাঠকের সঙ্গে সংযোগ। নবীন লেখকদের সঙ্গে স্বাক্ষাতের সুযোগ। পুরনো পরিচিতদের সঙ্গে নতুন করে পরিচিত হওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা। ভার্চুয়াল এই সময়ে লেখকদের সে সুযোগ কমে গেছে, বইমেলা কিছুটা হলেও এই আক্ষেপ দূর করতে পেরেছে। কিছু প্রয়োজনীয় বই, কিছু নতুন বই সংগ্রহ করা, কিছু অনুরোধের ঢেঁকি গেলা- এসবই প্রাপ্তি বলতে পারেন। আর প্রত্যাশা বাংলাদেশে লেখালেখি পেশাদারিত্বের দিকে এগিয়ে যাক এই মেলাকে কেন্দ্র করে। অন্যান্য দেশের মতো সম্পাদনার বিষয়টি গুরুত্ব পাক। আমাদের অধিকাংশ লেখক মনে করেন, সম্পাদনার বিষয়টি লজ্জার, ফলে লেখার মান যাচ্ছেতাই হচ্ছে। বিষয়টি লজ্জার নয়; পেশাদারিত্বের। বইমেলাকে কেন্দ্র করে যেহেতু কয়েক হাজার বই প্রকাশিত হচ্ছে, সেহেতু বিষয়টি জরুরি হয়ে পড়ছে। না হলে আমাদের সাহিত্য গৌরব হারাবে।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: সমকালীন সাহিত্য নিয়ে আপনার চিন্তা-ভাবনা কেমন?
শরাফত হোসেন: সাহিত্য আসলে চিরকালীন, যদি তা সাহিত্য হয়ে ওঠে। সমকালীন সাহিত্য বলতে আপনি হয়তো এই সময়ে সাহিত্য চর্চার কথা বলতে চাইছেন। যদি তা-ই হয়, তাহলে বলব, এই সময়টা খুব অস্থির যাচ্ছে। এখন অনেকেই সাহিত্য চর্চা করছেন আত্মপরিচয়ের সংকটের জায়গা থেকে। সাহিত্যের প্রতি দায়বদ্ধতার অভাব রয়েছে। হয়তো সবসময় ছিল, আমি নিজে এই সময়ের বলে উপলব্ধিটা এমন। এখন অনেকেই লেখার বিষয়ে যতটা আগ্রহী, প্রস্তুতির ক্ষেত্রে ততটা নয়। এই সময়ে নবীন লেখকরা মিডিয়ার কল্যাণে আলোচনায় আসছে। পাশাপাশি প্রস্তুতি না নিলে কিন্তু একসময় হতাশা কাজ করবে। তবে আমি খুবই আশাবাদী, এই নবীন লেখকদের প্রাণচাঞ্চল্য দেখে। সমকালকে ধারণ করেই সবাই সাহিত্যের ইতিহাসের অংশ হবেন-এমনটাই প্রত্যাশা।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: বর্তমান লেখকদের মধ্যে কাদের লেখা ভালো লাগে?
শরাফত হোসেন: আসলে এটা নির্ভর করছে লেখার ওপর। ব্যক্তির চেয়ে লেখাটাই মুখ্য। একজন বিখ্যাত লেখকের সব লেখা যেমন ভালো লাগে না; একজন অল্প পরিচিত লেখকের সব লেখাও খারাপ লাগে না। নাম বলতে গেলে অনেকের কথা বলতে হবে। অসংখ্য নাম। বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ এমনকি ইউরোপ-আমেরিকার সাহিত্য এখন আর গণ্ডিবদ্ধ নেই। সীমানা অতিক্রম করেছে অনেক আগেই। দেশে-বিদেশে এত এত নাম- সবার লেখা মুগ্ধ হয়ে পাঠ করি। কারও কারও লেখা নতুন চিন্তার খোরাক জোগায়।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: সাহিত্য নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
শরাফত হোসেন: ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা- পাঠ, পুনর্পাঠ এবং নিয়মিত লিখে যাওয়া। আসলে বর্তমানই ভবিষ্যতের যোগসূত্র তৈরি করে। ফলে যে বইগুলো এখনো পড়া হয়ে ওঠেনি, সেগুলো পাঠ করতে চাই। আসলে লেখার জন্য পরিকল্পনার চেয়ে বেশি জরুরি হলো প্রস্তুতি। কবিতার ক্ষেত্রে আঙ্গিক ও প্রকরণের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়া।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: সাহিত্যের কোন শাখা আপনাকে বেশি টানে?
শরাফত হোসেন: অবশ্যই কবিতা। কবিতাকে ভালোবেসেই লিখতে শুরু করেছি। কবিতাতেই আত্মার টান অনুভব করি।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: লেখালেখির ক্ষেত্রে আপনার অনুপ্রেরণা…
শরাফত হোসেন: প্রথমত আমার বাবা কবি জয়দুল হোসেন। তার কবিতা পড়েই লেখার আগ্রহ জাগে। কবিতা এত সুন্দর-এই ভাবনাটা শিশুকাল থেকেই ভেতরে কাজ করে, এই মানুষটির কারণে। যদিও লেখালেখি নিয়ে তাঁর সঙ্গে সরাসরি কথা হয় না তেমন। ছোটবেলা থেকেই টেবিলে থাকা বাবার লেখাগুলো আমাকে কবিতার পথে টেনে নিয়ে যায়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মুগ্ধতাও বেড়েছে।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: প্রচারবিমুখ থেকে সাহিত্যচর্চার সার্থকতা কতটুকু?
শরাফত হোসেন: এটা আসলে নির্ভর করে আপনার ব্যক্তিত্বের ওপর। কেউ ভাবেন প্রচারেই প্রসার, কেউ ভাবেন প্রচার সাহিত্যে মৌলিক জায়টিকে বাধাগ্রস্ত করে। আমি মনে করি, প্রচারের দরকার আছে। তবে আপনি না চাইলেও মানসম্পন্ন সাহিত্যের প্রচার হবেই। আবার মানহীন লেখা যতই প্রাচার করুন, পাঠক তা গ্রহণ করবে না। আসলে বিষয়টি অনেকটা নির্ভর করে সময়ের ওপর। দেখুন, এই সময়ে অনেকে নিজেকে লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে মরিয়া হয়ে ওঠে পড়ে লেগেছেন, অনেকেই তাদের চেনে-জানে। দুই-চার জায়গায় লেখাও ছাপা হচ্ছে। এই প্রচার কিন্তু কখনোই সাহিত্যের সার্থকতা নির্দেশ করে না। আবার অনেকেই আছেন, যাদের হয়তো আপনি চেনেন না, একদিন জীবনানন্দ কিংবা অদ্বৈতর মতো আবিষ্কার করবেন। তবে সমকালে সাহিত্যের মূল্যায়ণ জরুরি বলেই মনে করি। মূল্যায়ন করার মতো লোকের অভাবও বোধ করি। প্রচার হয়তো এক্ষেত্রে যোগসূত্র হিসেবে কাজ করতে পারে।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: আপনার বই আপনাকে কেমন পুলকিত করে?
শরাফত হোসেন: এটা বলে বোঝানো মুশকিল। ধরুন অনেক বইয়ের মাঝখানে আপনার বইটি উঁকি দিচ্ছে। অজান্তেই অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করবে। হয়তো কোথাও বেড়াতে গেলেন, কিংবা দেশের বাইরে কোনো দোকানে গেলেন বই কিনতে, সেল্ফে আপনার বইটি দেখলেন- ভাবুন এর চেয়ে শিহরণ আর কী হতে পারে?
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: আপনার লেখালেখির সাফল্যে অন্যের ঈর্ষা আপনাকে বিব্রত করে?
শরাফত হোসেন: কখনো কখনো করে। আপনার সামনে কিন্তু কেউ ঈর্ষা প্রকাশ করবে না, আবার আপনি তার কথায় বুঝতে পারবেন- কিছু বলতে পারবেন না, যেহেতু ঈর্ষার প্রকাশ সরাসরি করছে না, সেহেতু সত্য বলার সৎ সাহস নেই বলেই এমনটা হয়। অসত্য বরাবরই বিব্রতকর। আবার প্রেরণাও দেয়। সতর্ক হতে সহায়তা করে। শুরুতেই বলেছিলাম প্রস্তুতির কথা। অসলে আপনি যখন জানবেন, নিজের সফলতার কথা, আপনি সৎ হলে প্রস্তুত হবেন প্রতিনিয়ত। কোনো বিষয় আপনার অজানা থাকতে পারে- না জানা দোষের কিছু নয়। নিজেকে প্রস্তুত না করা দোষের। শিল্পে ফাঁকি চলে না।