সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: নতুন কী বই এসেছে এবার?
পিন্টু রহমান: এবারের মেলায় এসেছে আমার তৃতীয় গল্পগ্রন্থ ‘হাওর পাড়ের কইন্যা’। বইটি প্রকাশ করেছে চৈতন্য প্রকাশন।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: গল্পের বিষয়বস্তু কী?
পিন্টু রহমান: গ্রামে বসবাস করি। ফলে গল্পগুলোয় গ্রামীণজীবন ও জীবনাচার বহুকৌণিক দৃষ্টিতে প্রতিফলিত হয়েছে। বিশেষত গল্পের ছলে সমসাময়িক সমাজ-বাস্তবতার চিত্রণ করেছি।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: কইন্যার স্বরূপ কী!
পিন্টু রহমান: অন্য দশজন বাঙালি মেয়ের মতো। কইন্যার মনে প্রেম আছে, ক্ষোভ-দ্রোহ-বিরহ আছে। বিরহে কইন্যা যেমন ব্যথিত তেমনি দ্রোহের আগুনে প্রতিবাদী। সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব নিকটবর্তী হলে মেয়ের অন্তরে স্ফুরণ ঘটে। কখনো কখনো মনে হয়, জল ও মেয়ে অভিন্ন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভিন্ন রূপ ধারণ করে। সুখের স্বপ্নে বিভোর হলে দুঃখ এসে হানা দেয়। জীবনের সমিকরণ বদলে যায়। কেউ কেউ পথ হারায় বটে- অনেকে মাজা শক্ত করে দাঁড়াতে সচেষ্ট। হাওড়ের জীবন এমনই!
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: গল্পগুলোতে কোনো একটি নির্দিষ্ট এলাকা চিহ্নিত করেছেন?
পিন্টু রহমান: ধন্যবাদ। এমন প্রশ্নের ফয়সালা করতেই গল্পের আয়োজন। সভ্যতার বিকাশে আমরা যতই আধুনিক হই না কেন, ভুলে গেলে চলবে না, আমরা কাদের উত্তরসূরি! আমাদের পূর্বপুরুষ একদা পশুপালন, মৎস্যশিকার, পাখিশিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতো। বিশ্বায়নের করালগ্রাসে পতিত হওয়ার আগ পর্যন্ত জল-জীবন ও কৃষি একসূত্রে গাঁথা ছিল। নদীমাতৃক বাংলাদেশ। আনাচে-কানাচে জালের মতো বিছিয়ে ছিল হাওর-বাওর, ডোবা-নালা, খাল-বিল। কইন্যা সমগ্র দেশে প্রতিনিধি। ভুলে গেলে চলবে না- ঢাকার বাইরেও বাংলাদেশ আছে, শহরের বাইরেও মানুষ বসবাস করে। বরং ওইসব বসতিরা সংখ্যগরিষ্ট। সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের সুখ-দুঃখ, প্রেম-ভালবাসা আমার গল্পের মূল উপজীব্য।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: বইমেলার কাছে আপনার প্রত্যাশা কী আর লেখক হিসেবে প্রাপ্তি কেমন?
পিন্টু রহমান: প্রত্যাশা অনেক। প্রাপ্তি সামান্য। প্রতিটি বইমেলা এগিয়ে যাওয়ার মাইলস্টোন হওয়া উচিত। বাস্তবে তা হচ্ছে না। মেলাকেন্দ্রিক বই হওয়ার কারণে প্রকৃত লেখকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। টাকার জোরে মৌসুমি বা সৌখিন লেখকরা বাজার দখল করে নিচ্ছে। তাদের বিপণন পদ্ধতিও ভিন্ন। আমলাতান্ত্রিক বা করপোরেট সুবিধার কারণে মানহীন বইগুলোই পাঠকের হাতে পৌঁছে যাচ্ছে। অথচ অনেক সমৃদ্ধ বই পাঠকের নাগালের বাইরে! এই অবস্থার উত্তরণ না হলে প্রাপ্তির খাতা শূন্য হয়ে যাবে।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: বিক্রিত বইয়ের সংখ্যাই কি জনপ্রিয়তার মাপকাঠি?
পিন্টু রহমান: না, মোটেও তা নয়। অধিক পঠিত হলেই যে গুরুত্বপূর্ণ লেখক, আমি তা বিশ্বাস করি না। লক্ষ করলে দেখব, সময়ের পথ পরিক্রমায় অনেক জনপ্রিয় লেখক আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে; আবার অপরিচিত ভিন্নমাত্রায় উপস্থাপিত হচ্ছে। বস্তুত যা সত্য- একজন লেখকের প্রতিনিধিত্ব করে কেবল তাঁর সৃষ্টি!
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: লেখকের রাজনীতি সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?
পিন্টু রহমান: প্রচলিত রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে করি না। কেননা, প্রতিটি রাজনৈতিক দল দলীয় আদর্শ প্রায় বিসর্জন দিয়ে বসেছে। একজন লেখকের উচিত নিজস্ব বিবেক-বোধ দ্বারা পরিচালিত হওয়া। সে তা’ই লিখবে, যা বিশ্বাস ও হৃদয়ে লালন করে। হৃদয়ের সঙ্গে মিথ্যাচার করলে লেখক পথ হারায়। তবে লেখককে রাজনৈতিক সচেতন হওয়া জরুরি।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: মাঝেমধ্যে পদকের বিরুদ্ধে আপনাকে সোচ্চার হতে দেখি, কারণ কী?
পিন্টু রহমান: ব্যক্তিগত ক্ষোভ-আক্ষেপ নেই। পদক নিয়ে বিতর্ক পূর্বে ছিল, আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। পদক বর্তমানে মহামারির আকার ধারণ করেছে। ন্যূনতম বাছ-বিচার নেই, গলায় পদক ঝোলাতে পারলেই হলো! ভাব দেখে মনে হয়, এক পদকেই জীবন কাবার! ইদানিং পদকের বাহুল্য লক্ষ করছি। মফস্বল পর্যন্ত প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়েছে। এমন কিছু লেখকের সঙ্গে জানাশোনা আছে যাদের প্রত্যেকের পদক শতাধিক। বিষয়টি লজ্জাজনক। সাধারণ মানুষ আমাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: এর জন্য দায়ী কে?
পিন্টু রহমান: দাতা-গ্রহিতা উভয়ই দায়ী। দায়ভার আমাদেরও। মহান ব্যক্তিদের নামে পদক ব্যবসা করে আমরা তাদের চরিত্র হনন করছি। এর বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন হওয়া উচিত। বাংলা একাডেমির উচিত লেখার ন্যূনতম মান নির্ধারণ করে দেওয়া। তা না হলে সত্যি সত্যি সবকিছু নষ্টদের দখলে চলে যাবে।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: সাহিত্য নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
পিন্টু রহমান: বিশেষ কোনো পরিকল্পনা নেই। লেখালেখি আমার পেশা নয়, নেশা। নেশার পেয়ালায় চমুক দিয়েছি। যতদিন নেশা থাকবে, ততদিন লেখা অব্যাহত থাকবে। সামর্থ্যের চূড়ায় উঠতে প্রতিনিয়ত চেষ্টা করি। কিন্তু সম্ভব হয় না। একজন লেখক কখনোই তার সামর্থ্যের সীমারেখা স্পর্শ করতে পারে না। অতৃপ্তি নিয়ে মরতে হয়। মাঝে মাঝে মনে হয়, বিশেষ একটি গল্পের জন্য ফাঁদ পেতেছি। অথচ কিছুতেই ধরতে পারছি না।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: ধরতে না পারার জন্য কি হতাশ?
পিন্টু রহমান: না। প্রত্যয়ী। যত বেশি সময় যাচ্ছে তত আত্মবিশ্বাস বাড়ছে। কিছু না কিছু শিখছি। পরিণত হচ্ছি। ভালো কিছু পেতে হলে অবশ্যই আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: আপনি কি প্রচারবিমুখ থাকতে পছন্দ করেন?
পিন্টু রহমান: প্রচারবিমুখ মানুষ হয় না। তবে প্রচারের শিল্পিত রূপ আছে। রূপের ব্যত্যয় ঘটলে আসামির কাঠগড়াই দাঁড়াতে হয়। লেখক স্বাধীন। মত-প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। কিন্তু স্বেচ্ছাচারী হলে বিপদ।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: লেখালেখির সাফল্যে ঈর্ষা আপনাকে বিব্রত করে?
পিন্টু রহমান: না। উপভোগ করি। এছাড়া ঈর্ষা সবসময় দোষের না। কখনো কখনো লেখালেখিতে প্রভাবক হিসেবে সহায়তা করে।