বরাবরের মতো এবারও অমর একুশে গ্রন্থমেলায় কাব্যগ্রন্থের পরিমাণই বেশি। সাহিত্যের আর সব শাখার চেয়ে কবিতা-ই বেশি প্রকাশিত হয়। যদিও বইমেলায় কাব্যগ্রন্থের বিক্রি তুলনামূলকভাবে কম। এরপরও কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের আগ্রহ প্রমাণ করে—কবিতার প্রতি মানুষের আকর্ষণ আজন্মের। কবিদের আগ্রহ তো বটেই।
তবে এবার মেলায় প্রকাশিত শত শত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে মাত্র পাঁচটি গ্রন্থ বেছে নেওয়া অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। বাঙালি জীবনে পাঁচ সংখ্যাটি যেকোনো কারণেই হোক, বিশেষত্ব পেয়েছে আসছে। সাহিত্যেও এর ব্যতিক্রম নয়। এবার মেলা থেকে নির্বাচিত ৫ কবিতাগ্রন্থ হলো—আবু হাসান শাহরিয়ারের ‘অসময়ে নদী ডাকে’, আরিফুল হক কুমারের ‘পানপাত্রে ডাইনির ঠোঁট’, কাজী নাসির মামুনের ‘কাক তার ভোরের কোকিল’, শামীম হোসেনের ‘ডুমুরের আয়ু’ ও শামস আরেফিনের ‘নবজাতক স্বপ্নরা’।
অসময়ে নদী ডাকে
প্রকাশনী: প্লাটফর্ম প্রকাশনী
মূল্য: ১৬০ টাকা
প্রচ্ছদ: মোস্তাফিজ কারিগর
কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের ‘অসময়ে নদী ডাকে’ কাব্যগ্রন্থে ৫৬টি কবিতা স্থান পেয়েছে। এ গ্রন্থে বহুবার নদীর প্রসঙ্গ এসেছে। কেননা নৌকায় নদীতীরবর্তী জনপদে ঘুরে বেড়ানো কবির নেশা। কবি বলেন, ‘গাছ আর নদী ছাড়া আমি কোনো মুনিকে চিনি না।’ এই নদী তাঁর শৈশবের, যৌবনের, তারুণ্যের এবং বার্ধক্যের নদী। নদীর মতোই সরলভাবে বহমান তার জীবন। নদীর মতো স্বচ্ছ তার পথচলা। কবির নদীরা অনেক কথা বলে। তিনি নদীর রচনাবলি পড়েন। আসমুদ্র ঢেউভাষা শেখেন। কবি বলেন, ‘শব্দ না ধারালো হলে কবিতাও বোবা/ ঢেউ নেই, ভাষাও অচল।’ (ঢেউভাষা)।
এ কাব্যগ্রন্থে নদী নিয়ে তাঁর আক্ষেপ ফুটে ওঠে। আমাদের নদীগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। নদীর এমন বিলীন দৃশ্য কবিকে আহত করে। তাঁর কবিতায় পরিবেশ সচেতনতা লক্ষ করা যায়। তিনি চা ও কফির তুলনামূলক পার্থক্য খোঁজেন। চায়ের দোকানে ধোঁয়া-ধোঁয়া স্মৃতি খুঁজে ফেরেন। খোঁজেন হারানো মুখগুলো।
কবি তাঁর কবিতায় একফোঁটা ভোরের শিশির উপহার দেন। কবি অনেক কছিু জানেন না বলেই এতদূর এসে খাবি খান। তিনি পাঠকের জন্য গোলাপ উপহার আনেন। গোলাপ পাঠকের জন্য থাকুক; কাঁটা কেবল কবির জন্য। জনজীবনের আমূল পরিবর্তন কবির লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি। তিনি লেকের ব্যথিত জল দেখেন। দেখেন সুশীল মেঘ। শহরের অ্যালবামে অনেক দিঘির ছবি।
তাঁর একটি ক্ষুদ্র কবিতায় অনেক ব্যঞ্জনা ধরা পড়ে। মহাকাব্য না হয়েও তা মহাকাব্যের রূপ পরিগ্রহ করে। রাতকে তিনি অন্ধের শাদাছড়ি মনে করেন। কবির কবিতায় অসাম্প্রদায়িক চেতনা লক্ষ করা যায়। তিনি সব ধর্মের সব ধ্বনিকেই সমানভাবে শ্রদ্ধা করেন। এছাড়া মানুষের ভুলগুলো মধুর হয় তাঁর কবিতায়।
তাঁর কবিতায় আসে ভাষা, বিউটি বোর্ডিং, সময়, সুসং দুর্গাপুরের স্মৃতি। রবীন্দ্রনাথের জন্য কেবল দুটি পঙ্ক্তি। কবির জন্মদিনে স্বগতোক্তি তুলে ধরেন কবিতায়। আসে বিরহ, হলি আর্টিজানের দুঃসহ দৃশ্য। সুন্দরবনকে বাঁচাবার আহ্বান। পৃথিবীর রঙ ওঠে আসে কবিতার তুলিতে।
পুষ্কর দাশগুপ্তকে উৎসর্গ করেন ‘অনূদিত ভোর’ কবিতাটি। আষাঢ় কিংবা শীতের আখ্যান দেখি তাঁর কবিতায়। কবিতার শিরোনাম হয় ‘শামসুর রাহমান’, ‘আনা ফ্রাঙ্ক’, ‘শহীদ কাদরী’। তিনি বেত্রাবতী নদীর ডাকের কথা বলেন। পাঠকের প্রতি আহ্বান জানান জলে নামার। কবি মূলত অনেক কথা বলে যান অল্প কথায়। নিজের ক্ষুদ্রতাকে প্রমাণ করতে চান—অথচ এটাই যে তাঁর মহত্বের উৎকৃষ্ট প্রমাণ। কেননা কবি সব মানুষের পুঞ্জিতভূত ছায়া।
পানপাত্রে ডাইনির ঠোঁট
আরিফুল হক কুমার
প্রকাশনী : প্লাটফর্ম
মূল্য : ১২০টাকা
প্রচ্ছদ: রাজিব রায়
আরিফুল হক কুমারের ‘পানপাত্রে ডাইনির ঠোঁট’ কাব্যগ্রন্থে ২৬টি কবিতা রয়েছে। তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু দেশাত্মবোধ। পাশাপাশি এসেছে বঙ্গবন্ধু, টুঙ্গিপাড়া ও মুক্তিযুদ্ধ। তাঁর প্রায় কবিতাই দীর্ঘ। কবিতায় আকাশ-নদী-প্রকৃতি এসেছে প্রাসঙ্গিক কারণে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করেছেন। দুঃসহ যন্ত্রণার বর্ণনা দিয়েছেন সাবলীলভাবে।
তাঁর কবিতায় বাংলাদেশ, দেশের অনেক প্রত্যাশা, স্বপ্ন এসেছে। বেশকয়েকটি কবিতায় নদীর প্রসঙ্গ এসেছে দেশাত্মবোধের অনুষঙ্গ হয়ে। কবিতায় তিনি বিজয়ী সূর্যকে দেখিয়েছেন। কবির প্রত্যাশা—‘আমরা ভালো থাকবো।’ কেননা ‘আমরা ফিরে যাবো না’।
গোবিন্দগঞ্জ এসেছে কবিতার শিরোনামে। কবি বলেন, ‘ঈশ্বরের আসন স্পর্শ করেছে/ মানুষের আহাজারি।’ এসেছে নাসিরনগর। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান হিসেবে তাঁর এই কবিতা। কবিতার শিরোনামে এসেছেন ওয়ালী কিরণ। কবিতায় কবির প্রার্থনা- ‘মা, আমাদের আনত ললাটে/ এঁকে দাও জয়ের তিলক।’
কাক তার ভোরের কোকিল
কাজী নাসির মামুন
প্রকাশনী: প্লাটফর্ম
মূল্য: ১৬০ টাকা
প্রচ্ছদ: রাজীব দত্ত
কবি কাজী নাসির মামুনের ‘কাক তার ভোরের কোকিল’ গ্রন্থে মোট কবিতা রয়েছে ৪১টি। এ গ্রন্থের কবিতায় প্রেম, জীবনবোধ, মমতা, নশ্বর চিন্তা, স্বপ্ন, প্রতারণা, বেকারত্ব, ব্যাচেলর জীবন, স্বার্থপরতা, পরিবেশ সচেতনতা, নাগরিক জীবন, ইতিহাস, রিয়েল এস্টেট এবং পৌরাণিক গল্প উঠে এসেছে।
তবে নামকরণের হেতু খুঁজে পেলাম না। এই শিরোনামে কোনো কবিতাও অন্তর্ভুক্ত হয়নি। হয়তো কবি নগর জীবনে সকালের ডেকে ওঠা কাককে গ্রামীণ জীবনের ভোরের কোকিলের সঙ্গে তুলনা করেছেন। গ্রামে ভোরে ঘুম ভাঙে কোকিলের কুহুতানে। আর শহরে ঘুম ভাঙে কাকের কর্কশ ধ্বনিতে।
তাঁর কবিতায় প্রেমের বিস্তার লক্ষ করা যায়। রয়েছে মানবিক আবেদন। মনস্তাত্ত্বিক বোঝাপড়া কবিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। পরিবেশ সচেতনতা কবিকে এক ধাপ অগ্রগামী মানুষ করে তোলে। কবি বলেন—‘বিপন্ন সবুজ মুছে গেলে/ পাতার অদৃষ্টে একফোঁটা বৃষ্টি লিখে দিও।’
কবিতায় কবি স্মৃতিকাতর হন। ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতি ধরা দেয় কবিতার পরতে পরতে। তাঁর শব্দচয়ন, বাক্যগঠন অকৃত্রিম মাধুর্য্য নিয়ে ধরা দেয়। কবিতায় উপমা প্রয়োগে যথার্থতা খুঁজে পাওয়া যায়।
ডুমুরের আয়ু
শামীম হোসেন
প্রকাশনী: প্লাটফর্ম
মূল্য: ১৬০ টাকা
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
কবি শামীম হোসেনের ‘ডুমুরের আয়ু’ বইতে ৫৭টি কবিতা স্থান পেয়েছে। সেদিন আড্ডাতে কথা হচ্ছিল ‘ডুমুরের আয়ু’ নিয়ে। কথা হচ্ছিল এর নির্মাণ, বিষয়বৈচিত্র্য, নামকরণ ইত্যাদি বিষয়ে। সে আলোচনার সারমর্ম হিসেবে আমি বলতে পারি—শামীম হোসেনের কাব্যগ্রন্থটি পাঠক পড়বে, চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বে, অন্য সব কবিতার ঈর্ষার কারণ হবে, সুতরাং ডুমুরের আয়ু অনন্ত যৌবনা।
তাঁর কবিতায় প্রাচীন আবহ পাঠকের মন কাড়ে। একেবারে মাটিমগ্ন কবিতা। কবিতায় নদী-জল-প্রকৃতি এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। অন্তর্নিহিত ক্ষোভ-হতাশা উৎসারিত পঙ্ক্তিমালা পাঠককে বিমোহিত করে। অনিশ্চয়তার দোলাচলে মানুষ তবু আশ্রয় খোঁজে। ডুমুরের মতোই মানুষের জীবন। ডুমুরের আয়ু যেমন বেশিদিনের নয়; মানুষের জীবন কখনো কখনো তার চেয়েও কম।
তাঁর কবিতায় ইতিহাস, গ্রামীণ আবহ, স্মৃতিকাতরতা উঠে আসে পরম মমতায়। কবিতর স্থান-কাল-পাত্র প্রাচীন হলেও সমসাময়িক আবেদন তৈরি করে অবচেতন মনে। কেননা ‘ডুমুরের আয়ু’র কবিতাগুলো বিষয়বৈচিত্র্যে অনবদ্য। যেন ভাব ও অভাবের সম্মিলন। ভালো লাগার মুহূর্ত তৈরি করার ক্ষমতা রাখে।
নবজাতক স্বপ্নরা
শামস আরেফিন
প্রকাশনী: চৈতন্য
মূল্য: ১২০ টাকা
প্রচ্ছদ: শাকীর এহসানুল্লাহ
কবি শামস আরেফিনের ‘নবজাতক স্বপ্নরা’ কাব্যগ্রন্থে ৪২টি কবিতা রয়েছে। তাঁর কবিতায় বাস্তবতা ধরা দেয়। সমকালীন অসঙ্গতি, পরিবেশ ধ্বংস, ফরমালিন, আত্মহত্যা প্রবণতা, বিরহ, স্বাধীনতা, সুখ-দুঃখ, স্মৃতি, প্রেম প্রভৃতি তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু।
তিনি ক্রিকেট তারকা মাশরাফির উদ্দেশে লিখেছেন কবিতা। সেখানে প্রস্ফুটিত হয়েছে দেশপ্রেম। এছাড়া সুন্দরবনকে বাঁচানোর আকুতি চোখে পড়ে তাঁর কাব্যে। দেশে সংঘটিত হত্যা-গুম কবি হৃদয়কে নাড়া দেয়। আর তাই তো মানবতার চরম বিপর্যয় উঠে আসে কবিতার পঙ্ক্তিতে।
সিকদার আমিনুল হককে নিবেদিত কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তাঁর কাব্যগ্রন্থে। টক শোর নামে বুদ্ধিখেকো মানুষের বিরাজনীতিকরণ তুলে এনেছেন সতর্ক হাতে। কবিতার পঙক্তিতে পঙক্তিতে দেশপ্রেম, সমাজভাবনা, আগামীর সুন্দর স্বপ্ন তুলে ধরেছেন। অর্থনীতিখেকো দানবের বিরুদ্ধে উচ্চকিত হয়েছে তীব্র প্রতিবাদ।
প্রকৃতিপ্রেম তাকে বিশাল মাহাত্ম্য দান করেছে। নাগরিক শালিক আর বিরহী কৃষ্ণচূড়া তাকে বিহ্বল করে। গ্রামীণ ভালোবাসা আত্মাকে পবিত্র করতে পারে বলে নিজেই গড়ে তোলেন স্বপ্নরাজ্য। তার নবজাতক স্বপ্ন একদিন শৈশব, কৈশোর পেরিয়ে যৌবনদীপ্ত হবে- এ কামনা কবির। পাঠকের অনুভূতিতেও তা খোদাই হয়ে থাকুক।