চিন্তাসূত্র: এবারের বইমেলায় আপনার কী কী বই আসছে? প্রকাশক কে? প্রচ্ছদ কে করেছেন? প্রকাশিত বই সম্পর্কে কিছু বলুন।
বাসার তাসাউফ : এবারের বইমেলায় আমার দু’টো বই প্রকাশিত হচ্ছে। প্রথমটি ভাষা বিষয়ক। নাম ‘বাংলা শব্দ অপপ্রয়োগ ও শুদ্ধ প্রয়োগ।’ এটি প্রকাশ করছে বায়ান্ন প্রকাশন। প্রচ্ছদ করেছেন মোহাম্মদ ইউছুফ। আমরা এখন কাগজের বুক তেমন পড়ি না। পড়ি ফেসবুক। ফেসবুকে ইংরেজি-বাংলা মিলিয়ে আমরা যেভাবে ভাষা চর্চা করিÑতাতে আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষা চর্চা হচ্ছে না। তাই আমাদের ভাষায় যা অপপ্রয়োগ হচ্ছে তা অপপ্রয়োগই থাকছে। অবশ্য অপ্রয়োগের যে কু-অভ্যাস আমাদের আছেÑ ভাষা সম্পর্কে অজ্ঞতা থাকার কারণে তা আর শুদ্ধ প্রয়োগ হচ্ছে না। ভাষা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান বা দক্ষতা না থাকায় এ অভ্যাস চাইলেও বদলাতে পারি না, বুঝতে পারি না কোনটা অপপ্রয়োগ আর কোন্টা শুদ্ধ প্রয়োগ।
১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে যে ভাষা আমরা পেয়েছি, পৃথিবীজুড়ে এখন যে ভাষার দিবস উদযাপন করা হয়Ñ সেই ভাষা ব্যবহারে আমরা মোটেও যত্নবান নই। কেবল ভাষার মাস (ফেব্রুয়ারি) অথবা বাংলা নতুন বছর শুরু হলে বৈশাখের প্রথম কয়েকদিন আমরা মাতৃভাষার প্রতি দরদী হই, হয়ে উঠি ভাষাপ্রেমী। কিন্তু বাকি এগারো মাস আমরা কি তা বজায় রাখি? আমরা স্মার্ট হওয়ার জন্য কথা বলতে গিয়ে ইংরেজি, আরবি, হিন্দি এবং উর্দু ভাষার শব্দ পর্যন্ত ব্যবহার করে থাকি। ঢাকায় ‘পুলিশ হেড কোয়ার্টার্স’ ইংরেজিতে লেখা। জেলা প্রশাসককে ডি.সি বলে সম্বোধন করলে আমাদের আভিজাত্য বজায় থাকে, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে লেখা হয় ‘উপজেলা নির্বাহী অফিসার’ আর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে সভাপতি কখনো বলা হয় না, বলা হয় চেয়ারম্যান। এই যে বাংলা ও ইংরেজি ভাষার সংমিশ্রণ চলছে, রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে, আদলতে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার চলছে। বাংলাদেশের উচ্চ আদালতের ভাষাও ইংরেজি। অধিকাংশ আইন-কানুন লেখা হয় ইংরেজি ভাষায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন গ্রাহকদের কাছে আসে ইংরেজিতে। চিকিৎসকরা দুর্বোধ্য ইংরেজি ভাষায় রোগীদের ব্যবস্থাপত্র দিয়ে থাকেন, এমনকী বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজ এখন ব্যবহারিক জীবনে হরহামেশা ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করছে। তাই ভাষা ব্যবহারে অদক্ষতা বা অজ্ঞতার নেপথ্যে বাংলা ভাষার প্রতি অবজ্ঞা ও ভাষার সঠিক ব্যবহার না হওয়া অন্যতম কারণ বলা যায়। এর ফলে ভাষার অপ্রয়োগ ও শুদ্ধ প্রয়োগ সম্পর্কে জ্ঞান থাকে না। বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত শব্দ শুদ্ধ প্রয়োগ করতে হলে ভাষার প্রতি ভালোবাসা থাকতে হবে এবং ভাষার চর্চা করতে হবে। এ বইয়ে বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত শব্দের অপ্রয়োগ ও শুদ্ধ প্রয়োগ বর্ণনা করা হয়েছে। অন্য বইটি রম্যগল্পের। নাম ‘ম্যাট্টিক পাস বউ।’ এটি প্রকাশ করেছে বেহুলাবাংলা প্রকাশন। প্রচ্ছদ করেছে লূৎফি রুনা। বিভিন্ন দৈনিকের রম্যাপাতায় ছাপা হওয়া ১৩ টি রম্যগল্প নিয়ে সাজানো হয়েছে বইটি।
চিন্তাসূত্র: সারাবছর লেখক-প্রকাশক বই প্রকাশ না করে এই একুশে বইমেলা এলেই বই প্রকাশের প্রতিযোগিতায় নামেন। মেলাকেন্দ্রিক বই প্রকাশকে আপনি কিভাবে দেখেন?
বাসার তাসাউফ : আমি অভ্যাসবশত লেখালেখি করি। আমার মতো এমন অভ্যাসবশত আরও অনেকেই লেখালেখি করেন। কেন করেন? জিজ্ঞেস করলে তারা কী জবাব দেবেন জানি না। তবে আমার জবাবটা হলো, লিখতে ভালো লাগে। আর ভালো লাগে বলেই আমি লেখালেখি করি। তবে বইমেলাকে সামনে রেখে পাণ্ডুলিপি গোছালেও লেখালেখি চলে সারাবছর ধরে। বই প্রকাশ করতে কেবল ফেব্রুয়িার মাসের জন্য অপেক্ষা করি। আমার ধারণা, আরও অনেক লেখকই আমার মতো তা-ই করে থাকে। এজন্য মেলাকেন্দ্রিক বই প্রকাশকে আমি ইতিবাচক মনে করি। তবে বইমেলাকে কেন্দ্র করে তাড়াহুড়ো করে পাণ্ডুলিপি গোছানো, প্রুফ না দেখে, সম্পাদনা করে দ্রুত বই বের করে স্টলে সাজিয়ে রাখার জন্য বই ছাপানো হলে সেই বইটা ভালো বই হতে পারে না। আর এর কারণে বইমেলায় প্রকাশিত বইয়ের প্রতি পাঠকের নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়। এটি একজন লেখকের প্রতি পাঠকের আস্থা থাকে না।
চিন্তাসূত্র: একুশে বইমেলা বাংলাদেশের সাহিত্যে কী ধরনের প্রভাব ফেলছে?
বাসার তাসাউফ : একুশে বইমেলা যে বাংলা সাহিত্যে কতটা প্রভাব ফেলছে তা বলাবাহুল্য। আমার ধারণা, বইমেলা না হলে বাংলা সাহিত্যে এত এত বই লেখা হতো না। এত এত লেখকের জন্ম হতো না। সারা বছর পত্রিকা কিংবা লিটল ম্যাগে লিখে একজন লেখক যতটা পরিচিতি পায়, এক মেলায় একটি বই প্রকাশিত হলে একজন লেখক তার চেয়ে অনেক বেশি পরিচিত হয়ে ওঠে। একজন লেখক পাঠকের খুব কাছাকাছি যেতে পারে। পাঠককের পছন্দ ও অপছন্দ সম্পর্কে সচেতন হয়ে লেখার প্রস্তুতি নিতে পারে। এ ছাড়া বইমেলাকে কেন্দ্র করে প্রকাশকেরা তাদের বেশির ভাগ বই প্রকাশ করে থাকে। পাঠকও অপেক্ষায় থাকে প্রিয় লেখকের প্রিয় বইগুলো একসঙ্গে কেনার। এসব দিক বিবেচনায় বইমেলায় বেশ ভালো প্রভাব ফেলছে।
চিন্তাসূত্র: একুশে বইমেলা প্রকাশনা শিল্পে তরুণদের উৎসাহিত করার ব্যাপারে কী ধরনের ভূমিকা রাখছে বলে আপনি মনে করেন?
বাসার তাসাউফ : সময়টা ডিজিটাল প্রযুক্তির। আগের চেয়ে অনেক সহজে বই ছাপার কাজটা সারা যায়। বই ছাপানো, প্রকাশ করা, প্রচার, পাঠকের হাতে পৌঁছানোর সহজ পদ্ধতি আছে। তাই বইমেলা এখনকার তরুণদের বেশ আগ্রহী করে তুলেছে।
চিন্তাসূত্র: প্রকাশনা উপকরণের সহজলভ্যতার কারণে যে কেউ ইচ্ছা করলেই বই প্রকাশ করতে পারেন। এতে বছর বছর বাড়ছে বইয়ের সংখ্যা। বইয়ের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মান বৃদ্ধি ঘটছে না বলে অনেকেরই অভিযোগ; বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন। বই প্রকাশের ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালা প্রয়োজন আছে কি?
বাসার তাসাউফ : এমনি হলে বেশ ভালো হতো। কিন্তু তা কি আদৌ সম্ভব হবে? আমার মনে হয়, তা কখনও সম্ভব হবে না। যদি চলচ্চিত্রের মতো বই প্রকাশের ক্ষেত্রে ‘সেন্সর’ বা ছাড়পত্র দেওয়ার ব্যবস্থা থাকত তাহলে প্রতি বছর এত এত বই, অবই প্রকাশিত হতে পারত না। সেন্সর না হলেও অন্তত একটা নীতিমালা থাকলেও বই প্রকাশে কিছুটা সতর্ক থাকত। এখন তো যে কেউ চাইলেই বই লিখে ফেলে প্রকাশকের হাতে ছাপার খরচ দিয়ে বই বের করতে পারে। আমি মনে করি, যেসব লেখক প্রকাশককে ছাপার খরচ দিয়ে কোনও প্রকার প্রুফ দেখা ও সম্পাদনা ছাড়া বই প্রকাশ করে সেই বই আসলে প্রকাশ করা না বের করা। অর্থ্যাৎ এসব বই লেখক কর্তৃক বের হয়। আর যে সব বই প্রুফ রিড হয়ে, বিনা প্রমাদে, সুসম্পাদিত হয়ে আসে সেই বই প্রকাশিত হয়।
বইমেলার নতুন বই
বইয়ের নাম : বাংলা শব্দ অপপ্রয়োগ ও শুদ্ধ প্রয়োগ
লেখক : বাসার তাসাউফ
ধরন : ভাষা চর্চা
প্রকাশক : বায়ান্ন
প্রচ্ছদ : মোহাম্মদ ইউছুফ
মূল্য : ২৫২ টাকা
বইয়ের নাম : ম্যাট্টিক পাস বউ
লেখক : বাসার তাসাউফ
ধরন : রম্যগল্প
প্রকাশক : বেহুলাবাংলা
প্রচ্ছদ : লূৎফি রুনা
মূল্য : ২৫০ টাকা