সাদিয়া সুলতানা, কথাসাহিত্যিক। জন্ম ১৯৮০ সালের ৫ জুন। নারায়ণগঞ্জে। ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে বেশ কয়েকটি গল্পগ্রন্থ ও উপন্যাস। এগুলো হলো, গল্পগ্রন্থ: চক্র, ন আকারে না, ঘুমঘরের সুখ-অসুখ, মেনকি ফান্দার অপরাধ কিংবা পাপ ও উজানজল। উপন্যাস: আমি আঁধারে থাকি, আজু মাইয়ের পৈতানের সুখ, ঈশ্বরকোল ও বিয়োগরেখা। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন ‘চিন্তাসূত্র সাহিত্য পুরস্কার-২০২২’। এবার বইমেলায় আসছে তার উপন্যাস ‘নীলগর্ভ’।
চিন্তাসূত্র: এবারের বইমেলায় আপনার কী কী বই আসছে? প্রকাশক কে? প্রচ্ছদ কে করেছেন? প্রকাশিত বই সম্পর্কে কিছু বলুন।
সাদিয়া সুলতানা: অমর একুশে বইমেলায় ‘জলধি’ প্রকাশনী প্রকাশ করছে আমার উপন্যাস ‘নীলগর্ভ’। ‘নীলগর্ভ’র প্রচ্ছদ ও নামলিপি করেছেন নাসরীন জাহান ববি ও নির্ঝর নৈঃশব্দ্য।
‘নীলগর্ভ’ উপন্যাসের ফ্ল্যাপ আর নাম থেকে পাঠক হয়তো কাহিনির কাঠামো সম্পর্কে একটা ধারণা করতে পারবে। আবার পারবেও না। নীলগর্ভের কাহিনি আবর্তিত হয়েছে সুরভি, হাসান আর অপর্ণাকে নিয়ে। কখনো কখনো সন্তানসুখ একটা দম্পতির প্রাপ্তি আর পূর্ণতা-এই দুইয়ের মধ্যে নিবিড় সংযোগ করে দেয়। এই সুখ কখনো ঘন, কখনো গাঢ়, কখনো কাছের, কখনো দূরের। নীলগর্ভ উপন্যাসে সুরভি, হাসান আর অপর্ণা ওদের নিত্যকার সুখ, অ-সুখে তাড়িত হয়। এই তাড়না কখনো ওদেরকে পরস্পরের কাছে আনে, কখনো বা দূরে ঠেলে দেয়। পরস্পরকে ছুঁয়ে থাকলেই কি একজন মানুষ আরেকজনের যন্ত্রণাকে স্পর্শ করতে পারে? হয়তো পারে, হয়তো পারে না। যারা পারে না তারাই হয়তো মৃত্যুতে মুক্তি খোঁজে। আর তাই আত্মবিধ্বংসী ভাবনাও কারো কারো কাছে পরম আরাধ্যের হয়ে ওঠে। এমন কয়েকজন মানুষের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব আর মানসিক টানাপোড়েন নিয়ে নীলগর্ভের আখ্যান এগিয়ে গেছে।
চিন্তাসূত্র: সারাবছর লেখক-প্রকাশক বই প্রকাশ না করে এই একুশে বইমেলা এলেই বই প্রকাশের প্রতিযোগিতায় নামেন। মেলাকেন্দ্রিক বই প্রকাশকে আপনি কিভাবে দেখেন?
সাদিয়া সুলতানা: আমার মনে হয় প্রতিযোগিতা যতক্ষণ সুস্থ থাকে, ততক্ষণ স্বস্তির। যখন অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়, তখনই তা সবার জন্য অস্বস্তিকর ও ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। কেবল মেলায় বই প্রকাশ করবেন বলে আমি অনেক লেখককে তড়িঘড়ি করে লেখা শেষ করতে দেখেছি। কেউ কেউ সরল স্বীকারোক্তিও দেন যে, মেলায় বই প্রকাশ করবেন বলে তিনি আখ্যানের আর বিস্তৃতি ঘটাননি, পৃষ্ঠা সংখ্যা বাড়বে বলে সমাপ্তিও টেনেছেন দ্রুত। এই বিষয়টা যে ওই লেখকের কত বড় ক্ষতি করে দিচ্ছে, তা হয়তো তিনি নিজেও বুঝতে পারছেন না।
মেলাকেন্দ্রিক বই প্রকাশকে ইতিবাচকভাবে দেখলেও আমি মনে করি, মেলায় বই প্রকাশের জন্য সারা বছর ধরেই লেখক ও প্রকাশকের কাজ করা উচিত, প্রস্তুতিও নেওয়া উচিত। লেখকের কাজ নিজের লেখাটা লিখে যাওয়া, লেখা সম্পাদনায় মনোযোগী হওয়া। আর প্রকাশকের কাজ যুতসই পরিকল্পনা করে ফেলা। তাহলে আর মেলার সময় তড়িঘড়ি করে বই প্রকাশ করতে হবে না। প্রস্তুতি আগে সেরে রাখলে বরং বইয়ের সৌন্দর্য বাড়বে। এই সৌন্দর্য যেমন লেখার ক্ষেত্রে বাড়বে, তেমনি বাড়বে বইয়ের প্রোডাকশনের ক্ষেত্রেও।
চিন্তাসূত্র: একুশে বইমেলা বাংলাদেশের সাহিত্যে কী ধরনের প্রভাব ফেলছে?
সাদিয়া সুলতানা: এই প্রভাব নানামুখী। আমার তো মনে হয় একুশে বইমেলার একেকটা দিন পাঠক আর লেখকদের জন্য ঈদের মতো। ঈদ মানে তো খুশি আর আনন্দ, বছরের নির্দিষ্ট দুটো দিনে আমাদের জন্য ঈদের এই আনন্দ বরাদ্দ হয়। আর বইমেলার আনন্দ হয় মাসব্যাপী। বইমেলায় প্রতিদিন পাঠক, লেখক পরস্পরের সান্নিধ্যে আসেন। লেখালেখিকে ঘিরে আড্ডা দেন। আবার বিভিন্ন প্রজন্মের মানুষ তালিকা করে বইমেলায় ঘুরে ঘুরে বই কেনেন। বই বিক্রি হলে লেখক, প্রকাশক এবং প্রকাশনা সংশ্লিষ্ট সকলের মুখেই হাসি ফোটে। এছাড়া বইমেলা ঘিরে লেখক-পাঠকের মিথস্ক্রিয়া আর সাহিত্য বিষয়ক আলাপচারিতাও বাড়ে। এসবই তো ইতিবাচক।
চিন্তাসূত্র: একুশে বইমেলা প্রকাশনা শিল্পে তরুণদের উৎসাহিত করার ব্যাপারে কী ধরনের ভূমিকা রাখছে বলে আপনি মনে করেন?
সাদিয়া সুলতানা: এক্ষেত্রে বইমেলা ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। আমি দেখেছি বইমেলা ঘিরে বিভিন্ন প্রকাশনী তরুণ লেখকদের পাণ্ডুলিপি আহ্বান করছে এবং অনেক প্রকাশনী তাদের খরচেই তরুণদের বই প্রকাশ করছে, বইয়ের প্রচার করছে। আবার প্রকাশনা শিল্পে তরুণ প্রজন্মের অনেকেই এগিয়ে আসছে এবং তারা বেশ ভালো করছে।
চিন্তাসূত্র: প্রকাশনা উপকরণের সহজলভ্যতার কারণে যে কেউ ইচ্ছা করলেই বই প্রকাশ করতে পারেন। এতে বছর বছর বাড়ছে বইয়ের সংখ্যা। বইয়ের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মান বৃদ্ধি ঘটছে না বলে অনেকেরই অভিযোগ; বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন। বই প্রকাশের ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালা প্রয়োজন আছে কি?
সাদিয়া সুলতানা: বইয়ের মান বৃদ্ধি বলতে এখানে লেখার মান ধরে নিচ্ছি। আসলে কোন বইটা মানসম্মত আর কোনটা মানসম্মত নয়, তা একমাত্র পাঠকই ধরতে পারেন। এখন প্রশ্নটা হলো, পাঠকের হাতে মানসম্মত বইটি পৌঁছাচ্ছে কি না। বই প্রকাশ তো হবেই, মানুষ বুঝে না বুঝে সৃজনশীলতার চর্চা করবে, এখানে বাধা দেওয়ার কিছু নেই। কিন্তু পাঠকের কাছে মানসম্মত বইটি পৌঁছানো প্রয়োজন। এখানে লেখক, প্রকাশক উভয়েরই ভূমিকা আছে বলে আমার মনে হয়। বইয়ের প্রচার-প্রসারের জন্য গালভরা বিজ্ঞাপন না দিয়ে সঠিক ও সত্যভাবে বইয়ের বিষয়বস্তু বা আকর্ষণীয় দিক পাঠকের সামনে তুলে ধরা উচিত। আর আমি দেখেছি বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পড়ে পাঠক একবার প্রতারিত হলে সে কিন্তু সহজে আর ওই লেখকের লেখার কাছে ফিরে যায় না।