কবিতা দিয়েই এমরান কবিরের শিল্প-যাত্রা। বেবিয়েছে দু’টি কাব্যগ্রন্থ। এগুলো হলো: কী সুন্দর মিথ্যাগুলো (২০১১) এবং পালকভরা সূর্যাস্ত (২০১৩)। কবিতার পাশাপাশি মগ্ন থাকেন গল্প নিয়েও। ২০১২ সালে বের হয় গল্পগ্রন্থ নিদ্রাগহন মহাশূন্যে।এ গল্পগ্রন্থের পাণ্ডলিপির জন্য পান জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার, ২০১০ সালে। গদ্যেও তিনি সাবলিল। কবিতা বিষয়ক গদ্যের সংকলন ‘আমি লিখেছি এইসব, আমি লিখি নাই’ বের হযেছে ২০১৪ সালে। এবারের বই মেলায় প্রকাশিত হলো বগুড়ায় মুক্তিযুদ্ধের বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে লেখা উপন্যাস নীল বোতাম। সম্পাদনা করেন ছোটকাগজ থার্ডম্যাগ ও সেন্ট্রাল জেল। বইমেলা, সাহিত্য চর্চাসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর মুখোমুখি হয়েছেন কথাশিল্পী সালাহ উদ্দিন মাহমুদ।
সালাহ উদ্দিম মাহমুদ: এবারের নতুন বই সম্পর্কে কিছু বলুন।
এমরান কবির: এবারের বইমেলায় আমার পঞ্চম গ্রন্থ, প্রথম উপন্যাস ‘নীল বোতাম’ বেরিয়েছে। বইটি প্রকাশ করেছে প্রকাশনা সংস্থা বেহুলাবাংলা। জেলা শহর বগুড়ায় ঘটে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধের বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে রচিত এ উপন্যাসটির মূল চরিত্র ভাষা সৈনিক গাজিউল হক, সত্তর দশকের কবি ও প্রাবন্ধিক, ছোটকাগজ নিসর্গ’র প্রকাশক শোয়েব শাহরিয়ার এবং তাঁর পরিবার। এ উপন্যাসের এক বিশেষ অংশ জুড়ে রয়েছে বহুভাষাবিদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর উপস্থিতি। প্রশ্ন উঠতে পারে মুক্তিযুদ্ধের সময় তো তিনি বেঁচে ছিলেন না, তাহলে তাঁর উপস্থিতি কিভাবে হলো। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চল্লিশের দশকের শেষ দিকে বগুড়া আযিযুল হক কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। সে-সময় তরুণ গাজিউল হকের চেতনা ও আদর্শ গঠনে বিশেষভাবে তিনি প্রভাবিত করেন। এ অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক গাজিউল হক স্মৃতির মাধ্যমে বার বার ফিরে যান সে-সব দিনে। রয়েছে ডাক্তার কসির উদ্দিন তালুকদারের ভূমিকার কথা। বাদুড়তলায় অবস্থিত তাঁর বাসভবন হোয়াইট হাউসটি আক্ষরিক অর্থেই এ অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার হেডকোয়ার্টার হয়ে উঠেছিল। পাক বাহিনি তাঁকে কবরে শুয়ে দিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে। রয়েছে সে সময়ে এম আর মুকুলের ভূমিকার কথা। রয়েছে শোয়েব শাহরিয়ারের পরিবারে ঘটে যাওয়া গণহত্যার কথা।
সালাহ উদ্দিম মাহমুদ: বইমেলা সম্পর্কে আপনার প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা?
এমরান কবির: বইমেলা তো লেখক পাঠক ও প্রকাশকের মিলনমেলাও। একুশের বইমেলাটি আক্ষরিক অর্থেই সে-রকম হয়ে উঠেছে। তবে লিটল ম্যাগাজিন চত্বরটি মেলার মূল মেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে হলে ভালো হতো। তাতে তরুণ লেখকদের বই একটু বেশি বিক্রি হতো বলে মনে হয়। তরুণ লেখকদের পাঠক মূলত তরুণ লেখকরাই। অনেকেই আছেন সোহরাওয়ার্দী অংশে ঢুকে একাডেমি অংশে ঢুকতে চান না। আবার অনেকেই আছেন একাডেমি অংশে ঢুকে সোহরাওয়ার্দী অংশে ঢুকতে চান না। এত তাঁরা অনেক লেখকের বই কিনতে পারেন না ইচ্ছে থাকা স্বত্ত্বেও। কারণ লিটল ম্যাগাজিন চত্বরে তরুণ লেখকদের বই যেভাবে ডিসপ্লে করে রাখা হয় সোহরাওয়ার্দী অংশের বই মেলায় সেভাবে রাখা হয় না। এতে লেখক এবং সাধারণ পাঠক উভয়ই একটা নতুন বই সম্বন্ধে জানতে পারেন না।
সালাহ উদ্দিম মাহমুদ: সমকালনি সাহিত্য নিয়ে আপনার চিন্তা-ভাবনা কেমন?
এমরান কবির: সমকালীন সাহিত্য নিয়ে ডক্টর হুমায়ুন আজাদের দারুণ প্রবচন রয়েছে। ‘এখন চলছে গালাগালি ও গলাগলির সংস্কৃতি।’ কথাটি যত দিন যাচ্ছে ততই সত্য হয়ে উঠছে। এখন সাহিত্যবিচার চলে সম্পর্কের মাপকাঠিতে। যোগাযোগ ও বিশেষ লেনদেনের মাধ্যমে। এক ধরনের নেগোসিয়েশন চলছে সাহিত্য সমালোচনায়। আর হাজার হাজার বই বের হয় কিন্তু মেলায় ঘুরে পাঁচটি বই আজীবন সংগ্রহে রাখার মতো খুঁজে পাওয়া যায় না। পাঁচটি বই খুঁজে পাওয়া মুশকিল যেগুলো পুনঃপুনঃ পাঠের পিপাসা জাগাবে। এদিকে বস্তাপচা বইগুলো নিয়ে মিডিয়ার উচ্ছ্বাসের শেষ নেই। লেখকের আত্মতৃপ্তিরও শেষ নেই। এক ধরনের জোকারি জোকারি ভাব চলছে।
সালাহ উদ্দিম মাহমুদ: বর্তমান লেখকদের মধ্যে কাদের লেখা ভালো লাগে?
এমরান কবির: আগের বক্তব্য পড়লেই এ প্রশ্নের উত্তর মিলবে।
সালাহ উদ্দিম মাহমুদ: সাহিত্য নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
এমরান কবির: পরিকল্পনা তো অনেক। কিন্তু বাস্তবের কষাঘাতে পরিকল্পনার পরি উড়ে যায়। থেকে যায় কল্পনা। এর ভেতরেই কাজ করবার চেষ্টা করছি। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস নীল বোতাম লিখতে গিয়ে এমন কিছু উপাদান পেয়েছি সেগুলো নিয়ে একাধিক উপন্যাস লেখা সম্ভব। একাত্তরে বগুড়ায় রাজাকারদের ভূমিকা নিয়ে উপন্যাস লিখব একটা। স্টেট ব্যাংক লুট হয়েছিল একাত্তরে। কাহালুর মুরইল নামক একটা স্কুলের ক্লাসরুমে রাখা হয়েছেল লুটকৃত টাকার একটা বিশাল অংশ। সেখান থেকে স্থানীয় জনগণ লুট করেছিল ওই টাকার কিছু অংশ। স্থানীয়ভাবে এর প্রভাব ছিল ব্যাপক। স্থানীয় অর্থনীতি, সমাজ ব্যবস্থা, আইন শৃঙ্খলার উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল ঘটনাটি। কেউ গরিব থেকে গরিবতর হয়েছে, কেউ নিঃস্ব হয়েছে, কারও আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। এ ঘটনাকে উপজীব্য করে একটি উপন্যাস লেখার ইচ্ছে রয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটা উপন্যাস লেখা শুরু করেছি। একটি মাত্র চ্যাপ্টার লিখে আর লিখতে পারছি না। অপেক্ষা করছি।‘মিথ্যামানব’ নামের একটি উপন্যাস প্রায় অর্ধেক লিখেছি। বাঁকিটুকু শেষ করতে পারছি না সময়ের অভাবে। বর্ষাকালে কতিপয় তরুণের ব্যাঙ খাওয়া নিয়ে একটি ছোটগল্প লিখেছিলাম। সেটা নিয়ে একটা উপন্যাসের পরিকল্পনা করেছি। বগুড়ার প্রাচীন ইতিহাস এবং বর্তমানে মিথ এর সাথে একাত্ম হয়ে যাবে। এক পর্যায়ে শওকত আলীর ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে শুরু হবে এ উপন্যাসের একটি অংশ। এ নিয়ে পড়াশুনাও করেছি। কিন্তু সময় পাচ্ছি না লেখার। শূন্য দশকের উপন্যাস নিযে একটি গদ্য লেখা শুরু করেছি। দুইহাজার চৌদ্দ সাল পর্যন্ত যাদের উপন্যাস বেরিয়েছে সেগুলো লেখা সম্পন্ন করেছি। পনেরো ষোলো ও সতেরো সাল নিযে শুরু করতে পারিনি। ছোটগল্পের বাঁক বদল নিয়ে আরেকটি গদ্য লেখা শুরু করেছি। ষাটের দশক পর্যন্ত লিখেছি। বাঁকিটুকু লেখার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। এর বাহিরে তিলোত্তমা সিরিজের কিছু গল্প লিখেছি। আরও কিছু গল্প মাথায় নিয়ে ঘুরছি। সমকালীন সাহিত্য নিয়ে বিভিন্ন কাগজে লিখছি। কিন্তু এগুলোর ভেতরে সবচেয়ে অগ্রাধিকার দিচ্ছি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা উপন্যাসটির জন্য। আমার লেখালেখির সবচেয়ে বড় বাঁধা সময়। সময়ের খুবই অভাব আমার।
সালাহ উদ্দিম মাহমুদ: সাহিত্যেও কোন শাখা আপনাকে বেশি টানে?
এমরান কবির: সব শাখাই। নাটক বাদে।
সালাহ উদ্দিম মাহমুদ: লেখালেখির ক্ষেত্রে আপনার অনুপ্রেরণা…
এমরান কবির: আমার শৈশব। শৈশবে আমার মায়ের ধমক দিয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা। এবং ফাল্গুন, চৈত্র-বৈশাখের দুপুরগুলো। এসব খাঁ খাঁ দুপুরে মা আমাকে ঘুমিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতেন। আমার ঘুম আসত না, মা ঘুমিয়ে পড়তেন। ওই না-ঘুমানি সময়ে আমি পাঠ্যপুস্তকেই নিমগ্ন হতাম। তখন বিশেষ করে পড়তাম বাংলা বইয়ে দেয়া লেখকদের জীবনী। আমার মনে হতো আমি যদি লেখক হই তাহলে আমারও জীবনী লেখা হবে এভাবে। এই শিশুতোষ চিন্তাই সম্ভবত আমার লেখক হবার প্রধান স্বপ্ন-বীজ।
সালাহ উদ্দিম মাহমুদ: প্রচারবিমুখ থেকে সাহিত্যচর্চার সার্থতা কতটুকু?
এমরান কবির: প্রচারবিমুখতার কয়েকটি দিক আছে। খারাপ দিক হলো একটা ভালো বই সম্পর্কে পাঠক অজ্ঞাতই থেকে যায়। এতে পাঠককে বঞ্চিত করা হয়। ভালো দিক হলো নীরবে কাজ করা যায়। কাজের জন্য নীরবতা খুবই প্রয়োজন।
সালাহ উদ্দিম মাহমুদ: আপনার বই আপনাকে কেমন পুলকিত করে?
এমরান কবির: কোনো বই বের হয়ে যাবার পর যখন পড়ি তখন আমি নিছকই পাঠক। পাঠক হিসেবে তখন আমি সমালোচকও। সমালোচকের সূক্ষ দৃষ্টি তখন আমার লেখার উপর থাকে।
সালাহ উদ্দিম মাহমুদ: আপনার লেখালেখির সাফল্যে অন্যের ঈর্ষা আপনাকে বিব্রত করে?
এমরান কবির: এসব ভেবে লিখি না। নিজের একটা কমিটমেন্টের জায়গা থেকে লিখি। নিজে সন্তষ্ট হলে তবেই-না প্রকাশ পায়। তারপর কেউ যদি ঈর্ষা করেও তা আমলে নেই না। কারণ আমার অত সময় নেই।