খতপটি
রক্তের কুসুম কেটে জরায়ু বুনেছি।
শিশুও জেনেছে আজ
রক্তপাঠ—মুখপাঠ এক জটিল বিজ্ঞান।
তোমাদের বিদ্যায়তনিক গ্রন্থে কেবলই
অক্ষরজ্ঞানী।
তোমাদের ধর্মের দোকানে নেশার মাতম।
কর্পোরেট লুটেরার সহি সওয়াব
. আর রক্তের কারবার।
. প্রত্যহ অজুর ভোরে
মনপ্রতিমার রক্তনুন কাদামাটি খুঁজে
খতপটি বানাই।
রক্ত তবু থামে না।
গলনালিতে আটকে থাকা কান্নার আপেল থেকে—
চোখের ভয়ার্ত গভীর থেকে—
বেরুতে পারি না!
নিজেকে গিলে ফেলি!
প্রবারণা-ফানুসের ফাঁকে চাঁদ দেখে—
ছিটকে পড়া মগজ মনে হয়!
নিজেকেই খুলে খুলে রাখি
ছিঁড়েখুঁড়ে পালাই—মনুষ্যজন্ম ভুলে থাকি!
মনপ্রতিমার রক্তনুন কাদামাটি খুঁজে খতপটি বানাই।
রক্ত তবু থামে না।
আগুনচাঁপার নাম মিয়ানমার
বিভাজনরেখা স্পষ্ট হয়েছে দিনে দিনে।
নাফের হাওয়া, বিস্তীর্ণ প্রান্তরের জমিজিরেত
আর শতবর্ষী কবরও তোমার থাকলো না।
তুমি কী ভেবেছিলে?
তোমার জাতিসত্তার নাম এক খণ্ডবিখণ্ড আগুনচাঁপা?
আর তোমার ভূমির নাম—দাহকাণ্ড?
ভেবেছিলে—
ধর্মের নাভিকুণ্ডে তুমিই বইবে লাশ—
তোমার পিতা-প্রপিতা-মাতা-জায়া-পুত্র-কন্যার?
কতগুলো বিচ্ছিন্ন আঙুল, পা ও মস্তকের দাহ
দীর্ঘশ্বাসের ভেতর পুরে রেখে
পেরিয়ে যাবে জন্ম জন্মান্তর?
না।
এ খেলা এমন—সর্বত্র একই দহনখণ্ড!
রক্তকাণ্ড কী ঘটেনি এমন—
গঙ্গায়, নীলে, অতি কাছের বাঁকখালিজুড়ে?
তবে!
মরুচোখ নিয়ে প্রতিটি সকাল কেন
পরবাসী হবে?
নাফের জলেতে আজ ধোও ওই রক্তছেঁড়া হাত।
জন্মের বীজ থেকে বেড়ে ওঠা জীবনের নান্দীপাঠ করো হে,
পাঠ করো বিতাড়িত সকলে—
জন্ম ভূখণ্ড তোমার, আমৃত্যু তোমারই অধিকার!
ও পরবাসী রোহিঙ্গা-
তোমার দেশের নাম মিয়ানমার, মিয়ানমার।
আবার এসো পিতা
নক্ষত্রমুকুরে মুখ দেখতে গিয়ে
তোমাকে মনে পড়ে যায়—
শিশুর প্রাণের দোলায় প্রাণ হতে গিয়ে
তোমাকে মনে পড়ে যায়!
কে না জানে—
এই জলমুকুরে, রোদের বৃন্তে, সবুজ জারক রসে
তোমার অধিক কেউ সিক্ত হয় নাই।
এই পোড়া ভূখণ্ডে, দাহকাণ্ডের উপাখ্যানে
আভূমি পদাতিক সৈনিক তুমি!
. ঘাঁই মেতে উঠে দাঁড়ালে—মানচিত্রের মঞ্চে
মহাকুরুক্ষেত্রের রণোন্মাদ বাণীতে—
‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো’
আমাদের দুর্গের ভেতর ভাষা-সংস্কৃতির বন্ধনে
ধর্মের কোনো বিভাজন অঙ্কিত ছিল না।
আজ বহু বছর পরে-
এই ধর্ম বিভাজিত দেশে—
হে পৌরাণিক বীর আদিগন্ত চিন্তক
আমারা তোমার দুর্গ যোদ্ধাগণ
তোমার পাঠ না নিতে না নিতে
সংঘের যুক্তিকে ফিরিয়ে দিতে দিতে—
না মানুষ, না বাঙালি হয়ে উঠেছি!
আমাদের হাতের ভেতর থেকে নখ
মুখের ভেতর থেকে দাঁত
চোখের ভেতর থেকে ঘৃণা
বেরিয়ে এসে তছনছ করে দিচ্ছে
তোমার সোনার বাংলা!
তাই আজ তোমার দিগনির্দেশিত তর্জনিকে
মনে পড়ে যায়।
যে দেশ ভষ্মীভূত আজ ধর্মসভায়
তাকে মনে পড়ে যায়-
এই দাহখণ্ড অগ্নিচিহ্নপত্রে
পৌরাণিক বীরের মতোন আরও একবার
দাঁড়াও পিতা
পাতাল ফুঁড়ে নেমে যাক তোমার পদযুগল
আকাশ ছুঁয়ে তোমার মস্তক
একটি ছাতার নিচে ‘বঙ্গের সঙ্গীতে’ হোক
আমাদের একত্রিত বাস।
মা-এক
প্রবোধের কোনও ছলেই ভোলাতে পারো না আজ
কী অব্যর্থ যাত্রা তোমার
দেখো আমার হাত থেকে হাত, পা থেকে পা
সব খসে খসে পড়ে আছে তোমার পথে—-
বন্ধ চোখের রন্ধ্রজুড়ে এত কৌশল জানো তুমি—-এমন বাহানা তোমার!
যেন অভিমানের কৌটো উপড়ে সবটুকু নিয়েছ নিজ করে!
দেখতে যাইনি তোমায়—সময়-অসময়জুড়ে নিজের জীবিকাজঙ্গম, সংসার আর সুখ-শখে বিভোল ছিলাম!
জানি তো।-আজ বুঝি চোখ খুলে অভিযোগের কোনো পাঠই দেবে না নিতে!
যেতে যেতে দেখো—আমার চোখজোড়া, মনখারাপের সবগুলো কথা বিছিয়ে রেখেছি পথে! জ্বালাবো,
এভাবে জ্বালাতন করতেই থাকবো তোমাকে—
এছাড়া আর কোথায় রাখবো এই বেদনাপ্রহর! কান্নাকণাগুলো!
মা-২
তোমার বেদনাআকীর্ণ শিরা প্রতিশিরায়
জরায়ুছেঁড়া যন্ত্রণাপিণ্ডে
আমি এক নিরুপায় রক্তপাত! মা
তোমার বেদনাআকীর্ণ শিরা-প্রতিশিরায়
জরায়ুছেঁড়া যন্ত্রণাপিণ্ডে
আমি এক নিরুপায় রক্তপাত!
হাওয়ায় হাওয়ায়
বৃষ্টির মতো হালকা চালে চলি
গোপনেই তাকে গোপন কথাটি বলি
সে কী সে কথা গোপন রাখার পাত্র
পাহাড়ে নদীতে আকাশে সর্বত্র
উড়ছে ঘুরছে হাসছে নাচছে কেবলি
আড়চোখে চায়,জেনেছে সবাই সকলি।
বাতাসের কানে–কানে কানে আমি
বলেছিলেম গতরাত্রে
‘ওরে হাওয়া শোন, কিশোরী তো নই
কাঁচুলি পরেছি গাত্রে।’
কী যে করি হায় বাতাসও তাকায়
যুবকের মতো চোখে
লাজে মরে যাই, লজ্জায় ঢাকি
উড়ুনির ভাঁজে তাকে।
উদ্ধত ফণা তবু তোলে মুখ
ভেতরে তুমুল তৃষ্ণা
‘ওরে হাওয়া তুই উড়াস নে আর
লজ্জাও ভেঙে দিস না।’
বর্ষামগন
বর্ষার মেঘ ভাঙে দুপুরের রোদ
আলোস্যের আয়োজনে খোঁপা খুলে যায়
জলবতী নেমে আসে হস্তবরদ
বেড়াল নিভৃত–কাম তুমুল বিছানায়।
বৃষ্টির সয়লাব স্রোতে ঝমঝম ঝাঁঝর
পিছলে কাদা-জলে কেটেছে অঙ্গুলি
বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখে ধবল পাঁজর
আঁচলে টুপটাপ ঝরে আকাশ আধুলি।
ত্রস্তে দাঁড়ায়, উঠে ইতিউতি চায়
আকাশ নেমেছে ঝেঁপে, বৃষ্টির ছাঁটে
গোপন ক্যামেরা কী ভেতরে শিহরায়
বেচা যেন না হয় সে নয়নের হাটে।
মাঝে মাঝে বৃষ্টির এ খুনসুঁটি ভালো
তুমি যে সুন্দর ভারি আজই সে জানালো।
মোটরসাইকেল
আমাদের মগ্নচৈতন্যজুড়ে ছুটে চলে
চৌষট্টি বছরবয়সী মোটরসাইকেল।
চাকার ঝড় তুলে বারো হাজার মাইলের অগ্নিশিখা
ছড়িয়ে পড়েছিল বলিভিয়া ল্যাতিন আমেরিকা, কিউবা হয়ে বিশ্বময়—
শ্রেণিশোষণের মসনদ কাঁপিয়ে
চে’গুয়েভারার সাইকেল আমাদের মুক্তির প্রতীক
হয়ে উঠেছিল।
অথচ আজ ঠিক তার বিপরীতে
আমাদের ঘুমের ভেতর
রক্তের গন্ধ শুঁকে শুঁকে
-এ কোন মোটরসাইকেল হানা দেয়
দাঁত ও নখরে?
প্রয়োগবিদ্যার ভুলে এভাবেই বদলে যায়
মোটরসাইকেলের আরোহী চৌষট্টি বছরে।
উন্মাতাল
বৃষ্টির ঝপাৎ ঝুমে ঘুম ভেঙে গেলে
ভোরের মশারি আলোয়-নীল ডানা তুলে
আমিও উড়ে যাই রংবাজ হিলে
পরিরা পাখনা মেলে-কোর্ট হিলে এলে
দূর কোনো সঙ্গীতে বৃষ্টি হলে
পাহাড় চুড়োয় নাচি কাঁচুলি খুলে
আমারই শরীররঙে কর্ণফুলী দোলে।
আমি কি আমার থাকি! কে আমাকে ভোলে!
আমি কৃষ্ণ আমি রাধা নাচি ভুল জলে
আড়বাঁশি বেজে যাক মৃত্যুঅতলে—
[পরীর পাহাড়=কোর্ট হিল। রংবাজ পাহাড়=জেনারেল হসপিটালের পাহাড়, যেখানে ব্রিটিশরা বাইজী নাচাতো।]
দূরত্ব
অনেক দূর তো হেঁটেছি তোমার আয়ুষ্কালজুড়ে
কোনো কথা গলায় বিঁধে গেছে,
কোনো সময় করেছ আড়াল
শ্বাসপ্রশ্বাসে বুঝি, বুঝি তোমার ভনিতাকাল!
আজো আমি সমুদ্রজল!
আমার অতল জুড়ে—
. ভুলে না যাওয়া তটবালুরেখা—
ঠোঁটজুড়ে নুনের সাম্পান!
পাল তুলে হাল ধরে বিছিয়েছি জলের ফরাস!
সূর্যসমাধি দেখে ভেবো না
অন্ধকারই সত্য।
ভনিতাবৈভবে বুঝি ঢাকা পড়ে সত্যসময়?
আজ বুঝি আত্মার সুগন্ধী কত, কতটা পচন!
চামর দোলাও, যত বেশি গাল দিয়ে
প্রতাপের তাপে ছারখার করো—
ভাবো, তত বড় তুমি!
আমি এক হাওয়াগান,
নিজের সঙ্গে চলি—নিজেরই অনুষঙ্গে
তোমাকে যাতনা মানি জীবনবিভঙ্গে।
সাধ্য কী বলো—
তোমায় উড়ালে বাঁধি? আর উজানে টানি—
জীবনবিভায়!