আমেরিকান কবি সিলভিয়া প্লাথের মতো আরও এক কবি শব্দের মায়াময় রহস্যজাল বুনে পৃথিবীর তাবৎ বসন্ত দিন থেকে অকস্মাৎ ফিরিয়ে নিয়েছে মুখ। নভেম্বরের এক কনকনে শীতে, কুয়াশার উত্তরীয় জড়িয়ে নিয়ে বুকে, ডুবে গেছে মেহেকানন্দার জলে। তারা দু’জনেই হিমশীতল লন্ডনের বাতাসে মিশিয়ে দিয়েছে তাদের শেষ নিঃশ্বাস।
তার শব্দেরা কল্পনার সেই মেহেকানন্দার কথা বলে, অমোঘ অমসৃণ মৃত্যুর কথা বলে, মৃতের মাতৃমঙ্গল গেয়ে ওঠে। এইখানে তিনি রহস্যের কুয়াশায় ঢেকে ঢেকে যান। আমি তাকে দেখি সেলুলয়েডের ফিতায় হেঁটে যাওয়া নির্জন উপকূলে কুয়াশা জড়ানো ছায়া ছায়া এক মানবীর মতো। আলো আর আঁধারির খেলায় সে সমুদ্রের গহীন থেকে কবিতায় নাড়া দিয়ে যায়। ঝিনুকের খোলায় বসে সে ময়ূরকণ্ঠী ডেকে যায়। ডেকে যায় আর সব কবিদের। আমাদের মগ্ন চৈতন্যে দিয়ে যায় শিস। কবি মুনিরা চৌধুরী আমাদের চেতনায় করাঘাত করে।
২০১৮ সালের নভেম্বরের শেষ ভাগে একটি মৃত্যু আমাদের স্তব্ধ করে দেয়। কিছুদিনের জন্যে একটা ঘোর অমানিশার ভেতরে হেঁটে বেড়াই আমরা। হাজার প্রশ্ন মনে ভিড় করে আসে। তাকে চিনি না তবু তার হিমশীতল করস্পর্শ টের পাই। সে এসে আলতো নিশ্বাস ফেলে কানের কাছে আবার মিলিয়ে যায় দূরে বহু দূরে। তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে সিলভিয়া প্লাথের বিবর্ণ মুখ, নতুন করে আবার কবি সিলভিয়া প্লাথের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় সে।
লন্ডনে এক পরমা সুন্দরী বাঙালি কবির রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন গাড়ি নিয়ে। সমুদ্রের ধারে তাকে পাওয়া গেছে প্রাণহীন, যখন সে ছেড়ে গেছে জীবনের সবকিছু। আবার শোনা যায় এক্সিডেন্টে মৃত্যু হয়েছে তার! ফেসবুকে ভাইরাল হয় তার মৃত্যু সংবাদ। কারও ওয়ালে তার ছবি দেখে মনে পড়ে যায়, বন্ধু কবি ফেরদৌস নাহারের ওয়ালে দেখেছি তাকে। খুব যত্নে তার কবিতা পোস্ট করেছিল ফেরদৌস নাহার। সম্ভবত ‘পছন্দের কবিতা’ শিরোনামে একজন একজন করে কবির কবিতা প্রকাশ করে কবি ফেরদৌস নাহার। সেবারে সে বেছে নিয়েছিল কবি মুনিরা চৌধুরীকে। কবিতায় কী ছিল, তা আর আজ আর মনে নেই কিন্তু খুব ভালো লেগেছিল কবিতাটি সে কথা মনে আছে।
খুব গুছিয়ে কাজ করতে শুরু করেছিলেন মুনিরা। ইতোমধ্যেই বেরিয়েছিল তার তিন, চার খানি বই। মৃতের মাতৃমঙ্গল, নয় দরজার বাতাস, মেহেকানন্দা কাব্য। ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ ‘ কাম ক্লোজ টু মাই আই পেন্সিল।’
তার ইংরেজি কবিতা আমার কালেকশানে নেই, তবে বাংলায় লেখা কবিতা থেকে দুই একটা উদ্ধৃত করতে চাই।
আমি জেগে থাকি
কাটা হাতখানা অন্য হাতে নিয়ে সারারাত জাগি
অনন্ত ভোরের দিকে হাতের গহীনে জ্বলে ওঠে হাতের চিতা
হাড়-গলা গরম ঘন হয়ে এলে কেবল শীত শীত লাগে…ঘুম লাগে
এইসব মুনিরা ঘুমের ঘোরে কোথাও কোনো জানালা নেই; সই নয় দরজার বাতাস।
কবিরা জেগে থাকেন। ঘুমের ভেতরেও। কবি মুনিরা চৌধূরী তার নিজের ভাষ্যমতেই এই সর্বব্যাপী ঘুমের ভেতরেই জেগে আছেন। কবিতাকে ভালবেসে নিজের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই অনুপম ধারাটিকে।
এই কবিতায় সর্বব্যপী ঘুমের কথা তিনি বলেছেন এভাবে:
চোখজোড়া যেনো ঘুমের মধ্যে গলে যায়…
উঁচু উঁচু বিশাল ঢেউয়ের মধ্য দিয়ে নৌকা চালাই
নৌকায় আমার মৃত ঠাকুরমা আর মহা শূন্যের একটি পিংকি বিড়াল
চোখহীন ঘুমের সর্বত্র শুধু ঘুম
কপালের দু’পাশে সাগরের ঢেউয়ের মতই নাড়ি টিপটিপ করে
মনে হয় দুই খণ্ড ভাবনার সমুদ্র এরপর কী হল?
না, এর আগে কী হয়েছিল? অবশ্য আগে-পরে বলে কিছু নেই
যাত্রা সব সময়ই বর্তমানের
নৌকা, মৃত ঠাকুরমা আর পিংকি বিড়াল সবকিছুই বর্তমান মুহূর্তের অস্তত্বশীল
সবকিছুই স্থিরীকৃত
স্থির আবার চলমান
ঘুমের বিপুল ননীর মধ্যে সবকিছু দোলে…
মুখে চোখ নেই। চোখে তারা নেই
আছে কেবল সর্বব্যাপী ঘুম
দুই চোখের পাতা জুড়ে ঘুমের প্রপাত।
মুনিরার জন্ম ৬ জানুয়ারি, ১৯৭৬ সালে যুক্তরাজ্যে। ওয়েলসের কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা যেহেতু বাংলাদেশের বাইরে, তাই বাংলাদেশ ও বাংলাভাষাকে জানার অদম্য আকাঙ্ক্ষায় একসময় তিনি দীর্ঘ দিনের জন্যে দেশে গিয়ে বসবাস করেন। শেখেন ভাষা ও সাহিত্য। বাংলা কবিতা ও গদ্য রচনার কলাকৌশল। এ বিষয়ে নিজেকে করে তোলেন পারদর্শী। প্রস্তুত করে্ন আগামীর একজন নিয়মিত সাহিত্যসেবী হিসেবে।
দেশ থেকে লন্ডনে ফিরে গিয়ে কাব্য চর্চার পাশাপাশি লন্ডনের কার্ডিফে বাংলাভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র হিসেবে তিনি গড়ে তোলেন বাংলা একাডেমি ইন্টারন্যাশনাল। অনিবার্যভাবে তিনি যুক্ত ছিলেন এই সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হিসেবে। তিনি সগৌরবে লন্ডনের কার্ডিফে একটুকরো বাংলাদেশ নিয়ে আসেন। প্রবাসী বাঙালি ছেলেমেয়েরা নিজেদের দেশের গৌরবোজ্জ্বল সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করে। দেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও বিশ্ব মানবতার কথা বলেন। পৃথিবীর নানান দেশের মানুষের সামনে প্রতিনিধিত্ব করেন বাংলাদেশকে। কবি মুনিরা চৌধূরী ছিলেন সেই সব সফল কর্মকাণ্ডের উদ্যোক্তা। হাতে হাত ধরে সবাইকে নিয়ে কাজ করে গেছেন নিরলস।
ইংল্যান্ডে জন্ম, বেড়ে ওঠা সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েও তিনি বাংলাকেই ভালোবেসেছিলেন। বাংলা ভাষাকেই মাধ্যম করেছিলেন তার কাব্য চর্চার জন্যে। ইংরেজিতেও লেখালেখি করেছেন একসময়।
বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে তার প্রভূত স্বপ্ন ছিল। যে স্বপ্নগুলো বাস্তবায়নের সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন বন্ধু কবি দেলোয়ার হোসেন মঞ্জুকে। মঞ্জু একজন কবি। দুজনার আদর্শ ও ভালোবাসার ক্ষেত্রটি এক হওয়ায় এই বন্ধুত্ব একটি সুগভীর বন্ধন তৈরি করেছিল। মুনিরা ও মঞ্জু দুজনেরই ছিল আলাদা আলাদা পারিবারিক জীবন। ছিল সন্তান সংসার স্বামী ও স্ত্রী। পৃথিবীর প্রথাগত সম্পর্কের আওতায় আসেনি ওদের সম্পর্ক। সমাজ সংসারে তাই ওদের সম্পর্ক ছিল অনুচ্চারিত। আত্মীয়, স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কারও কাছেই এই সম্পর্ক গ্রহণযোগ্য হয়নি। কবি দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু যখন দুরারোগ্য ক্যান্সারে ভুগে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন, তখন মুনিরা লিখলেন ‘অন্য কোনো সঙ্গ বা অনুষঙ্গে নয় আমরা এক সঙ্গেই মারা যাবো।’ পরদিন মারা গেলেন মঞ্জু। মুনিরা লিখেছিলেন সেই অদম্য একাত্মতার কথা—‘কে ডাকছে আমায়, তুমি না ঈশ্বর!’ এর কয়েক ঘণ্টা পরই মৃত্যু হয় মুনিরার।
কিভাবে মুনিরার মৃত্যু হলো, কেন হলো—এ নিয়ে প্রচুর সংশয় আছে। কুয়াশাঘেরা এক রহস্যের জাল বিছানো রয়েছে আমাদের চোখে। মুনিরা চৌধুরীর লেখায়, কবিতায় বা ফেসবুক স্ট্যাটাসে বোঝা যায়, মঞ্জুর মৃত্যু তাকে অনিবার্যভাবে আত্মহননের পথে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, কেন তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সকল স্মৃতি উধাও করা হলো? সোসাল মিডিয়া থেকে তার সব চিহ্ন মুছে দেওয়া হলো! কোথায় কিভাবে তার মৃত্যু হলো! কোথায় তার ফিউনারাল হলো! কোথায় তাকে সমাধিস্ত করা হলো! শোনা যায় মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে সে ফোন করেছিল বাচ্চাদের গ্রোসারি দোকান থেকে। তাদের কিছু লাগবে কি না, জানতে চেয়েছিল। তাহলে কখন সে গেলো সমুদ্রপারে! আবেগের আবরণে ঢাকা পড়ে গেলো কি তার মৃত্যু রহস্য? মনে হাজারও প্রশ্ন আসে ভিড় করে। মুনিরা কেবল ভালোবেসেছিল। কোনো অপরাধ করেনি। তবে কেন এই রহস্য!
এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় সেই কতনা সুদূরের এক কালো রাত্রির কথা। ১৮৮৪ সালের ১৯শে এপ্রিল। কোলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে একটি অপমৃত্যুর কথা। কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর কথা। শোনা যায় ওপিয়াম কণ্ঠে ঢেলে আত্মঘাতী হয়েছিলেন তিনি। যে রাতে তিনি চলে যান, সেই রাত শেষ না হতেই শেষকৃত্যের সঙ্গে সঙ্গে তার সব স্মৃতিও বিনাশ করা হয়। সবাইকে বলে দেওয়া হয়, এই আত্মহত্যার কথা যেন কেউ জানতে না পারে! নিষ্ঠুরভাবে সব অস্তিত্ব বিলীন করে দেওয়া হয় কাদম্বরীর। ইতিহাসের একটি অন্যতম অধ্যায়কে মুছে দেওয়া হয় চিরতরে। কেন! সে কি কেবলই রবির সঙ্গে তার হৃদয়ের সম্পর্কের কারণে! কাদম্বরীকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনে রেখেছিলেন চিরদিন তার কবিতায়, গানে, স্মরণে কিন্তু তার মৃত্যু নিয়ে মুখ খোলেননি কোনোদিন!
কেন যেন মনে হয়, ঠিক তেমনিভাবেই মুনিরার জীবনাবসানের সঙ্গে সঙ্গে তাকে মুছে ফেলা হলো। কিন্তু কেন! যখন ভাবি এই এত বড় পৃথিবীতে মেয়েটি কি সাংঘাতিকভাবে একা হয়ে গিয়েছিল! সে যে ভালোবেসেছিল কাউকে, কেবল সেই অপরাধে সংসার, সমাজ, স্বামী, সন্তান, আত্মীয়, পরিজন, বন্ধু বান্ধব, বিবেক—সব কিছুর দংশনে নীলকণ্ঠী পাখির পালক হয়ে বেঁচে ছিল! কেউ কি তার পাশে ছিল কোথাও, এই ভাঙনের শোক এই মৃত্যু শোক, এই দিকদিগন্তব্যাপী হাহাকারে কেবল মানুষ হয়ে তার হাতটি ধরে! ছিল না। কেউ থাকে না। আমরা মানুষ বলে অহংকার করি বটে কিন্তু আমাদের এই অহম মিথ্যে।
মননে, মেধায় ও আধুনিক শিক্ষায় সমুজ্জ্বল মুনিরা ছিলেন মূলত একজন কবি। কবিতার ভেতরে তার শব্দেরা নড়েচড়ে ওঠে মৃতের শরীর বেয়ে। শীতের শেষে মৃত বৃক্ষের বাকলে যেমন জীবনের উন্মেষ, তেমনি তার কবিতার উন্মেষ মরা পৃথিবীর আলোয় আলোয়। কবি মুনিরা চৌধুরীর কাব্য ও তার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মূল্যায়ন হোক। যে সম্মানটুকু তার পাওনা, তা যেন সে পায়। তার অবিনাশী আত্মার শান্তি হোক।