(পর্ব-১১)
তুমি? হতবাক দৃষ্টিতে তাকায় মিলি। রাতে মাত্র দেখা হলো, আর সকালে আমার ক্লাসরুমের সামনে কেন? গত রাতটা একটুও ঘুমুতে পারিনি…কুণ্ঠিত স্বর শিমুলের। কী করবো বুঝতে পারছিলাম না। তাই চলে এলাম তোমার কাছে।
-এসেছ বেশ করেছ, নিজের ক্লাস করো। ঠিক দেড়টার সময়ে কলা ভবনের সামনে থাকবে। দেখো, আমার ক্লাসের সবাই কেমন তাকিয়ে আছে আমার আর তোমার দিকে, যা আমি চাইনি। যাও, ধমক দেয় মিলি। মাথা নিচু করে চলে আসে শিমুল ।
-ওর কোনো ক্লাস নেই। কী করবে শিমুল আহসান। নিজেকে নিয়েই বিব্রত। মিলি তো বলেছিল ক্লাসের সামনে না আসতে। গতকাল একদিনের মধ্যে যতোটা বুঝেছে মিলি সম্পর্কের মধ্যে একটা আড়াল চায়। জানাতে চায় না কাউকে। কেন? নিজের মনে অতলে তলায় শিমুল, আমার বাবা কৃষক, এটা নিশ্চয়ই ওর জন্য মহাসমস্যা। আমাকে কিভাবে নেবে ওর মা বাবা? মিলির বাবা জাঁদলের আমলা। থাকে ধানমন্ডি বিরাট ফ্ল্যাটে। সেখানে আমি এক টুকরো ঘাস। ঠিক হলো কি মিলির সঙ্গে সর্ম্পকে জড়িয়ে?
কয়েকটা টিউশনির টাকায় জীবন চলে। নিজের মনে ডুবতে ডুবতে শিমুল আহসান এসে দাঁড়ায় কলাভবনের বট গাছের নিচে। ঢাকা শহরের নানা প্রান্ত থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসগুলো আসছে। থামছে টিএসসি, ভিসির বাড়ির সামনে। ছাত্রছাত্রীরা নামছে হাঁসের হৈ চৈ উল্লাসের সঙ্গে।
বটগাছের নিচে অনেক ছাত্রছাত্রী দাঁড়িয়ে বসে গল্প করছে। শিমুল আহসান কী করবে? একা দাঁড়িয়ে বসে নখ খুঁটে কি সময় কাটানো যায়? হঠাৎ চোখ যায় বটগাছের গোল বেদীর দিকে। চমৎকার একটা স্মারক স্বাধীনতার। শিমুলের মনে পড়ে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ছিল আগ্রাসী বর্বর পাকিস্তানিদের পক্ষে। বিশেষ করে রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিকসন আর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা হেনরি কিসিনজার মিলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছিল কিন্তু বিরোধী ডেমোক্র্যাট দলের বিশিষ্ট সিনেটর জুনিয়র কেনেডি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন। তিনি ভারতে এসে শরণার্থী শিবিরে এসে শরণার্থীদের দুঃখ-দুর্দশা দেখেছেন, মর্মাহত হয়েছেন।
স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনের এই জায়গায় একটা বট গাছ ছিল মিছিল মিটিংয়ের প্রধান স্থান। এখানে, সেই বটতলা কেন্দ্র করে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর সমাবেশে কলাভবনের দোতলায় দাঁড়িয়ে তৎকালীন ছাত্রনেতা আ স ম আবদুর রব স্বাধীন বাংলার পতাকা তুলেছিলেন। কলাভবন ও বটতলায় দাঁড়িয়ে হাজার হাজার মানুষ সেই ঐতিহাসিক দৃশ্য দেখেছিলেন। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রথম দিকেই সব আন্দোলনের প্রতীক স্থান বটগাছটা কেটে ফেলেছিল। ওরা কতটা অন্ধ আর বধির ছিল, শত বছরের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় প্রলুব্ধ বাঙালির জাতির আন্দোলনের একটা প্রতীক বটবৃক্ষ কেটে ফেললেই যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়?
শিমুল ধীরে ধীরে ঘুরে ঘুরে দেখে বটবৃক্ষের নিচে লেখা একটা লাইন-১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সৈন্যরা যে বটগাছ কেটেছিল, সেখানেই আর একটি বটবৃক্ষ রোপণ করা হলো। বৃক্ষরোপণ করেছিলেন জুনিয়ার এফ কেনেডি, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে স্বাধীন হলে তিনি ভ্রমণে এসেছিলেন বাংলাদেশে। দেখা করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে, ফুল দিয়েছিলেন শহীদ বুদ্ধিজীবীর কবরে আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে এই সেই বটগাছটির জায়গায় এই বটগাছটির চারা রোপণ করেছিলেন। ইতিহাস, তুমি কাজ করে যাও গোপনে গোপনে।
পেটে খিদে অনুভব করে শিমুল আহসান। খিদে সহ্য করতে পারে না ও। দ্রুত মধুর কেন্টিনে যায়। মিষ্টি আর রুটি আর এককাপ চা খেয়ে বাইরে চলে আসে। ডাকসুর লাইব্রেরির সামনে আসতেই দেখা সেই গ্রুপটার সঙ্গে, যারা তিনতলায় মিলি মাহজাবীনকে ফুল দেয়ার সময়ে হঠাৎ হাজির হয়েছিল। ওদের কারণেই গোটা ঘটনা ঘটতে বা বাস্তবে রূপ পেয়েছে তাড়াতাড়ি। লামিয়াই দেখে আগে শিমুলকে।
ভাইয়া? দৌড়ে সামনে আসে, কী খবর? জমছে?
আচমকা ওদের দেখে চমকে উঠলেও দ্রুত সামলে নিয়ে বলে শিমুল, জমছে, খুব জমছে। থ্যাঙ্ক ইউ আপনাদের। আপনাদের জন্যই মিলি ফুল নিতে বাধ্য হয়েছিল।
-আপনি একা কেনো? আপু কোথায়? প্রশ্ন লিপির।
-ও ক্লাসে।
-আপনি অপেক্ষা করছেন? হাসে লিপি। চলুন, চা খাই।
-চলুন।
ওদের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে মামুর চায়ের দোকানের সামনের ফুটপাতে গিয়ে দাঁড়ায় সবাই। মনের মধ্যে যে বিরম্বিত প্রশ্ন ছিল, জানেন আমি এক ব্যর্থ পুরুষ, চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে ওবায়দুল হাসান।
-ব্যর্থ পুরুষ? কেন? অবাক তাকায় শিমুল আহসান।
-প্ল্যানটা অনেক দিন ধরেই আমার মাথায় ছিল, কিন্তু সাহস পাচ্ছিলাম না। কিন্তু সেদিন আপনার বিজয় দেখে আজ সকালে ফুলের তোড়া দিয়েছিলাম।
-কাকে দিয়েছিলেন? জানতে চায় শিমুল।
ওবায়দুল হাসান আর শিমুল আহসানের কথোপোকথন শুনছিল বাকিরা। তীক্ষ্ম চোখে দেখছিল আর শুনছিল লিপি লাবণ্য।
পাশে দাঁড়ানো লিপিকে দেখিয়ে বলে, ওকে দিয়েছিলাম । কী হৃদয় বিদারক ঘটনা, জানেন এই নিষ্ঠুর মেয়েটা ফুলগুলো মাটিতে ফেলে পা দিয়ে মাড়িয়ে দিয়েছে। বুকটা আমার…
-এই ছুঁচো তুই কখন আমাকে ফুল দিয়েছিস? ওবায়দুল হাসানের দিকে তেড়ে যায় চায়ের কাপ হাতে। তোর শরীরে আমি গরম চা ঢেলে দেবো।
ওবায়দুল হাসান নিজেকে আড়াল করার জন্য ঘুরে দাঁড়ায় শিমুল আহসানের পেছনে, ভাই এই সুন্দর মেয়েটার দজ্জাল হাত থেকে আমাকে রক্ষা করুন।
-তুই আমাকে ফুল না দিয়ে মিথ্যা বললি কেন? মাটির দিকে তাকিয়ে বলে, আমি তো মনে মনে কতবার চেয়েছি তুই আমাকে ফুল দিবি। দিস নাই তো…আবার মিথ্যা বলে! শেষের দিকে আহত অভিমানে লিপির গলা ধরে আসে। সবাই অবাক চোখে লিপিকে দেখে। মুহূর্তের মধ্যে ওদের ঘিরে গড়ে ওঠা চক্রটা কিংকতর্ব্যবিমূঢ়।
-অ্যাই তোরা অপেক্ষা কর, আমি আসতিছি। ওর সাইকেলে চেপে বসে বিমল মিত্র। চোখের পলকে আড়াল হয়ে যায় সাইকেল টিএসসির দিকে। লিপি অনেক দিন ধরে যা বলার জন্য ছটফট করছিল, সেটা বলার পরই লজ্জায় অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে লামিয়া, তাহলে রাজকন্যা? এই ছিল তোমার মনে? অথচ আমরা একসঙ্গে চলি, বিন্দুবিসর্গ কিছুই জানিতে পারি নাই!
লিপি লাবণ্য মৃদু হাসে, ওই বলদটা তো কিছু কয় না?
-এই বলদ? লিপিকে ছেড়ে দিয়ে লামিয়া দাঁড়ায় ওবায়দুল হাসানের সামনে, তুই এত ভ্যাবলা ক্যান? একটা মেয়ে, লিপির মতো অসম্ভব সুন্দরী মেয়ে তোকে ভালোবাসে, আর তুই? মুখে চাপাটি মেরে থাকছিস?
-আমি কী করবো? কত বলতে চেয়েছি কিন্তু ও যেভাবে চোখ কটমক করে তাকায়। ভয়েই তো কিছু বলতে পারি নাই।
-তাই? মাথা নাড়ায় ও, হ্যাঁ।
ওদের সংলাপের মধ্যে সাইকেল চালিয়ে চলে আসে বিমল মিত্র, হাতে একতোড়া লাল গোলাপ। নেমেই বাড়িয়ে দেয় ওবায়দুল হাসানের দিকে, নে।
ওবায়দুল হাসান নেয়।
-এখনই আমাদের সামনে লিপি লাবণ্যের সামনে হাঁটু গেঁড়ে বস।
সঙ্গে সঙ্গে ওবায়দুল হাসান দুহাতে গোলাপের গোলাপের তোড়া নিযে হাঁটু মুড়ে বসে লিপি লাবণ্যের সামনে, আমাকে গ্রহণ কর।
লিপি লাবণ্য দুহাতে গোলাপের তোড়া নিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো ছবি উঠে যায় অনেকের মোবাইল ক্যামরোয়।
কেবলই তোমাকে দেখেছি। কেবলই তোমাকে অনুভব করেছি। সকালে ছুটে এসেছি তোমার বারণ করার পরও। আসলে আমার কিছু করার ছিল না।
দিনটা শুরু হয়েছিল শিমুল আহসানের তিক্ততার সঙ্গে। কিন্তু দুপুরের এই সময়ে সময়টা পরিপূর্ণ হয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের এই মাতাল প্রেমের গল্প গানে। দুপুরটা মাথার ওপর গনগনে সূর্যের তোরণ থেকে ফোটা ফোটা ফুলের রেণু ছড়ায়।
-চলুন ভাইয়া, আজাকের দুপুরের খারবারটা আমাদের সঙ্গে খাবেন, প্রস্তাব করে ওবায়দুল হাসান। আপনাকে পেয়ে আজকে দুপুরের সূর্যের নিচে রাতের লক্ষ তারা ফুটলো। দিনটা এমনভাবে যেতে দিতে পারি না।
-যেতে পারবো না আমি। বিনয়ের সঙ্গে বলে শিমুল। মিলি অপেক্ষা করতে বলেছে আমাকে।
-ওয়েলডান, কোথায় অপেক্ষা করতে বলেছে আপনাকে? জানতে চায় চটপট মেয়ে লামিয়া ফেরদৌস।
-বটগাছের নিচে।
-কটায় আসবে আপু?
-বলেছে ক্লাষ শেষে, একটার দিকে।
মোবাইলের ঘড়ি দেখে লামিয়া বলে, একটার সময়। এখন তো বারোটা আটত্রিশ বাজে। আর মাত্র বাইশ মিনিট। চলুন আমরাও আপনার সঙ্গে যাই। আপুকে, আপানাকে নিয়ে আমাদের আজ আমাদের উৎসব। সঙ্গে ওবায়দুল হাসান আর লিপি লাবণ্য।
পরিস্থিতিটা এমন যে, শিমুল আহসানের কিছু বলার থাকে না। পরিস্থিতিটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি হচ্ছে এবং চলছে। লামিয়া বলার সঙ্গে সঙ্গে বাকিরা হই হই করে ওঠে। একসঙ্গে বটতলার দিকে হাঁটতে থাকে। কী আর করা, শিমুলও হাঁটে পা মিলিয়ে। যদিও ভেতরে শঙ্কা, ওদের দেখে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া জানাবে মিলি মাহজাবীন, জানে না।
-হাকিম মামার চায়ের দোকান থেকে হেঁটে হেঁটে ওদের সঙ্গে শিমুল আহসান আসে বটবৃক্ষের সামনে। এসেই চক্ষু চড়কগাছ। মিলি উদগ্রিব চোখে ওকে খুঁজছে। কিন্তু শিমুলকে সরিয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়ায় লামিয়া, আপু আমাদের চিনতে পারছেন?
-সঙ্গে সঙ্গে চোখে মুখে উচ্ছাসের আলো চলে আসে মিলি মাহজাবীনের, তোমাদের না চিনতে পারার কোনো কারণ আছে? তোমরা হলে পাকা আপেল।
-সঙ্গে সঙ্গে চোখ পড়ে ওদেরে পেছনে দাঁড়ানো শিমুলের দিকে, কই ছিলে? তোমাতে খুঁজছিলাম।
-ভাইয়া আমাদের সঙ্গে ছিল, জবাব দেয় ওবায়দুল হাসান। আপু, একটা দাবি নিয়ে এসেছি।
-দাবি? কী দাবি? অবাক মিলি মাহজাবীন।
-আজকে আমাদের সঙ্গে দুপুরের খাবার খাবেন।
মাথা নাড়ায় প্রবলভাবে মিলি, স্যরি। কিছু মনে করো না। আমি বাইরে কিছু খাই না।
-ওসব আজকে শুনছি না। হাত ধরে মিলিয়া, কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, ওই যে দেখছেন জুটি। ওরা আমাদের বন্ধু। আমরা একসঙ্গে জার্নালিজমে পড়ি। ওটা ওবায়দুল হাসান, ফুল হাতে মেয়েটি লিপি লাবণ্য। আজকে শিমুল ভাইয়ের সামনে ওবায়দুল হাসান লাল গোলাপের তোড়া দিয়ে প্রেম নিবেদন করেছে। আমরা এই অসাধারণ ঘটনার সেলিব্রেট করতে চাই। শিমুল ভাই তো আছেই, আপনি আমাদের প্রধান অতিথি। না করবেন না প্লিজ। কারণ, আপনারা আমাদের পাইওনিয়ার।
হাসে মিলি মাহজাবীন, তোমরা তো আচ্ছা পাগল।
-পাগলামি ছাড়া জীবন জমে নাকি? মন্তব্য বিমল মিত্রের। আজকে না হয় আমাদের সঙ্গে একটু আধটু পাগলামি করলেন আপু।
-পাগলামি খুব পছন্দ কর?
-করি, খুব করি আপু। আমি সেদিন ছিলাম না, যেদিন শিমুল ভাই আপনাতে ফুল দিয়েছিল। ওদের কাছে পরে শুনে মনে হলো, জীবনের শ্রেষ্ঠ একটা মধুর দৃশ্য থেকে বঞ্চিত হলাম। কিন্তু আজকে লিপি লাবণ্য আর ওবায়দুল হাসানের ফুল দেয়ার দৃশ্য থেকে জীবন স্বাথৃক হলো। এই স্বার্থকতা পরিপূর্ণতা পাবে, যদি আপনি আর শিমুল ভাই আমাদের সঙ্গে দুপুরের খাবারটা।
-ঠিক আছে, কোথায় খাবে? চলো।
সবাই মিলে নিউমার্কেটের দিকে হাঁটতে থাকে।
নিউ মার্কেটের নিউ বেঙ্গল বিরিয়ানি হাউজে বিরিয়ানি খেয়ে গ্রুপ ছবি তুলে ছেলে মেয়েরা চলে যায়। শিমুল আহসান আর মিলি মাহজাবীন রিকশায় চলে আসে ক্যাম্পাসে। দুজনে বসেছে আবার সেই ঐতিহাসিক বটবৃক্ষের নিচে। মিলি চুপচাপ। মিলির নির্লিপ্ততা দেখে চুপসে যায় শিমুল। -কী হয়েছে ওর?
-হ্যাঁ বলো, রাতে ঘুমুতে পারোনি কেনো? নির্লিপ্ত গলা মিলির। তোমার ঘুম তুমি ঘুমুবে। সেখানে একরাতে আমি কী করলাম?
-না মানে…
তোতলানো আমি পছন্দ করি না। যা বলবে সরাসরি বলবে। আমি কি তোমাকে ঘুমুতে নিষেধ করেছিলাম? জেগে থাকতে বলেছিলাম?
-চুপ থাকে শিমুল।
-শোনো, বাসার অবস্থা বেজায় খারাপ আমার।
শিমুল আহসান তাকায়, মানে?
-আমি আমার জীবনে গত সন্ধ্যায়ই প্রথম সন্ধ্যার পরে, রাত করে বাসায় ফিরেছি। তাও গাড়িতে নয়, রিকশায়। আমার মা বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে নেননি। মায়ের অভিজ্ঞ চোখের দৃষ্টি বুঝেছে, আমি কোনো কিছুতে কারও সঙ্গে জড়িয়ে গেছি। আমাকে নিয়ে গতরাতে বাসায় তুমুল আলোচনা পর্যালোচনা সমালোচনা সেমিনার সিম্পোজিয়াম হয়েছে। আমার যে অবক্ষয় হয়েছে, মূলে আমার বাবা বিশিষ্ট আমলা গোলাম রব্বানীর আদর প্রশয়ে হয়েছে। অনেকগুলো অভিযোগের তীর বাবার দিকে গেলে, বাবা গোটা পরিবারের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন।
-বুঝলাম না।
-তুমি বুঝবে না, সেটাই স্বাভাবিক। আমার বাবা গোলাম রব্বানী মাকে বলেছে, তুমি যা ইচ্ছে তাই কর মিলির বিয়ে নিয়ে, আমার কিচ্ছু বলবার নেই। আমার আত্মসন্মান আগে…। বুঝতে পেরেছ, আমাকে শিগগিরই বিয়ের শিকলে ঝুলিয়ে দেবেন আমার মা। পাত্র অনিবার্যভাবে সেই বশিরউদ্দিন, মায়ের বড় বোনের ছেলে, যিনি বছর খানেক আহে ব্রিটেন থেকে চাটার্ড অ্যাকাউটেন্ট হয়ে এসেছেন। সেই হারামজাদাকে স্বামী হিসেবে মেনে নিতে হবে আমাকে।
-তোমার লেখা পড়া? আর এক বছর পর তোমার মাস্টার্স ফাইনাল।
হাত ধরে মিলি, শিমুল! আমার কাছে তোমার শ্রেষ্ঠ সম্পদ কী জানো?
শিমুল আহসান অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে।
-জানি, তুমি জানো না। আমার কাছে তোমার শ্রেষ্ঠ সম্পদ তোমার সরলতাটুকু। বেশিদিন না, মাত্র একটা দিনের অর্ধেক একটা রাতের প্রথম অর্ধের কিছুটা সময় তোমার সঙ্গে কাটিয়েছি, আমি তোমার সরলতায় মুগ্ধ। আমি সমাজ রাষ্ট্র পরিবার টাকা পয়সা বিলাস সব বিষয়ে সচেতন। আমার বন্ধুদের চোখের দৃষ্টি দেখে বলে দিতে পারি, ওরা কী চায়। সেদিক থেকে তুমি একেবারে আলাদা। সরল, বন্য। বাড়ি তোমার বরিশালে। আমি বাসায় কোনোদিন বলতে পারবো না, বরিশালের একটা ছেলে শিমুল আহসান আমি ওকে পছন্দ করি, ভালোবাসি। কারণ, ওরা জানে, বিশ্বাস করে বরিশাল অঞ্চলের মানুষ ভালো না। গোয়ার। মাথা ফাটায়। কিন্তু তোমাকে ওরা দেখেনি, দেখলেও বিশ্বাস করবে না মানুষ হিসেবে তুমি কতটা অমায়িক!
-মিলি? বুকের যাবতীয় মমতা দিয়ে ডাকে। আমি কী করবো? তোমাকে ছাড়া তো আমি। বিশ্বাস করো, গত রাতটা আমি এক মুহূর্তও ঘুমাইনি। কেবলই তোমাকে দেখেছি। কেবলই তোমাকে অনুভব করেছি। সকালে ছুটে এসেছি তোমার বারণ করার পরও। আসলে আমার কিছু করার ছিল না।
-তুমি যদি ঘুমুতে না পারো, আমি কি ঘুমিয়েছি? একটা দিনে তুমি আমার গোটা সত্তা গ্রাস করেছো কুমিরের মতো।
-আমি কুমির?
-কুমির না তো কী? শোনো, এখন তোমাকে খুব সাহসী হতে হবে।
-বুঝলাম না।
-তোমার মেসের ঠিকানা চেয়েছিলাম, দাওনি। কেন দাওনি?
-এখনই দিচ্ছি। মোবাইলে ঠিকানা কম্পোজ করতে করতে তাকায় মিলির দিকে, ঠিকানা দিয়ে কী করবে?
-প্রস্তুত থেকো, বাসায় বিয়ের তোড়জোড় শুরু হলে আমি চলে আসবো তোমার কাছে। তুমি আমাকে নিয়ে তোমার গ্রামের বাড়ি বরিশালের পিরোজপুরে নিয়ে যাবে। পারবে না?
শিমুল আহসান অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে মিলি মাহজাবীনের দিকে।
চলবে…