[পর্ব-২১]
বিশ্বকে জানার মতো জ্ঞান অর্জনের প্রথম ও প্রধান সোপান স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পুরো মানিকগঞ্জে তখন সবে একটাই কলেজ। ১৯৭০ সালে এসএসসি পাস করেই ভর্তি হয়েছিলাম মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজে, তখন কলেজের বয়স মাত্র ২৯ বছর।
জেলা সদরে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী এই কলেজের বয়স বর্তমানে ৭৮ বছর। শত বছরের প্রাচীন না হলেও তৎকালীন ঘিওর উপজেলার তেরশ্রী গ্রামের জমিদার শ্রী-সিদ্ধেশ্বরী প্রসাদ রায়ের উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৪২ সালে ওই গ্রামেই কলেজটি প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রতিষ্ঠালগ্নে জমিদার শ্রী সিদ্ধেশ্বরী প্রসাদ রায় কলেজের অনুকূলে বিশ বিঘা জমি ও নগদ দশ হাজার টাকা দান করেছিলেন।
কলেজ প্রতিষ্ঠার কুড়ি বছর আগেই এই শিক্ষানুরাগী মানুষটি নিজ গ্রাম তেরশ্রীতে ১৯২২ সালে সর্বপ্রথম ‘তেরশ্রী কালী নারায়ণ ইনস্টিটিউট’ নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সংক্ষেপে ‘তেরশ্রী কে.এন ইনস্টিটিউট’ হিসেবে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির ব্যাপক পরিচিতি ছিল পুরো মানিকগঞ্জে। এ কারণে তেরশ্রী অঞ্চলটি ব্রিটিশ আমল থেকে শিক্ষা-দীক্ষা, শিল্প-সাহিত্য ও রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও অগ্রসর ছিল।
ব্রিটিশবিরোধী ও বামপন্থী আন্দোলনের কেন্দ্র হিসেবে বিখ্যাত ছিল এই স্কুল। ব্রিটিশ সরকার একে Hot Belt of Communism নামে আখ্যায়িত করেছিল। এই অঞ্চলে সংঘটিত হয়েছে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধ—এসব আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন তেরশ্রী কালী নারায়ণ বহুমুখী ইনস্টিটিউশন স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন ফ্যাকাল্টির ডিন আব্দুস সালাম এই স্কুলের ছাত্র ছিলেন। তিনি ছিলেন আমার সিরাজ ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একই সময় দুজনেই এই স্কুলের ছাত্র ছিলেন।
১৯৪২ সালে তেরশ্রী গ্রামেই প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘মানিকগঞ্জ কলেজ’। ১৯৪৩ সালে মানিকগঞ্জ শহরে স্থানান্তর করা হলে কলেজটি অর্থসংকটে পড়ে যায়।এই পরিস্থিতিতে স্থানীয় জনগণের অনুরোধে ১৯৪৩–৪৪ সালে টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুরের বিখ্যাত দানবীর বায়বাহাদুর রণদাপ্রসাদ সাহা কলেজটির উন্নয়ন ও পরিচালনার জন্য ষাট হাজার টাকা নগদ ও অন্যান্য আর্থিক সাহায্য দেন। বিনিময়ে তার পিতার নামানুসারে কলেজের নামপরিবর্তন করে রাখা হয় ‘দেবেন্দ্র কলেজ’। ১৯৪৯ সালে ডিগ্রি কলেজ হিসেবে উন্নীত হয়। ১৯৭২ সালে প্রথম বাংলা সম্মান কোর্স শুরু হয়।এই বছরই আমি এই কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করি। ১৯৮০ সালের ১ মার্চ সরকারি হলে কলেজের নামকরণ হয় ‘সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ, মানিকগঞ্জ’। ছায়াসুনিবিড় পুরনো এই কলেজের মোট আয়তন বর্তমানে ২৪ একর।
বাহান্নোর ভাষার আন্দোলনের বীজমন্ত্র ও অনুপ্রেরণায় শতবর্ষ আগে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের মতো একটি স্বাধীন দেশের গর্বিত নাগরিক হতে পেরেছি আমরা। এই অর্জনের পেছনে তিরিশ লক্ষ শহীদ ও মা-বোনের রক্তের উত্তাল ঢেউয়ের কান্না খেলা করে আজও আমাদের ধমনীতে।
কলেজের সামনের দিকে সবুজ তৃণে ঢাকা অসাধারণ বিশাল এক মাঠ, পেছনেই পুকুরের কালোজলের ছায়া শীতল অনন্য একপরিবেশে। কলেজে পা রাখলেই মনটা আনন্দে আপ্লুত হয়ে যেতো। এখনো তার স্মৃতি হৃদয়ে দ্রিম দ্রিম শব্দে বাজে। মাঠের তিন পাশজুড়ে কৃষ্ণচূড়ার রক্তাভ আলো সবুজ ঘাসের ডগায় খেলা করে। দিগন্তপ্রসারী স্বপ্নের এই মাঠের একশো মিটার দৌড়ে আমি প্রথম হয়েছিলাম, এই খেয়াল আমাকে আজও এক পরাবাস্তব জগতে নিয়ে যায় যেন।
সেদিন ছিল বাৎসরিক খেলার দিন। পাটের রশিতে লাল সবুজ নানা রঙের কাগজের পতাকা দিয়ে জমজমাট সাজানো মাঠ নববধূর মতো সেজেছিল। মির্জাপুর স্কুলে প্রথম খেলাধুলায় অংশ নিয়ে পুরস্কার প্রাপ্তির কথা মনে হতেই কলেজেও ১০০ মিটার দৌড় ছাড়া আরও দুটো ইভেন্টে অংশ নিয়ে তিনটি পুরস্কারই জিতেছিলাম।কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কবিতা আবৃত্তি করেছিলাম একবার।
দুই.
মানিকগঞ্জ শহরের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে যতীন ঘোষ খুব পরিচিত ছিলেন। কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়মিত আসতেন তিনি। তার মিষ্টির দোকানটি কলেজের কাছে। শিক্ষার্থীর কাছে খুব পরিচিত ছিল, ‘যতীনঘোষের মিষ্টির দোকান’ নামে। কাজেই তার নামটি কলেজের প্রায় সব শিক্ষার্থী জানতো। আমাকে বিশেষভাবে চিনতেন তিনি হাফিজ মিয়া সাহেবের কন্যা হিসেবে। আমাদের পর পর চারটি দোকানের শেষ মাথায় ছিল তার দোকানটি। কলকাতার বড় প্রেসব্যবসায়ী হিসেবে আমার আব্বাকেও খুব সমীহ করে চলতেন তিনি।
কাজেই আমার প্রতিও তার এক ধরনের স্নেহের দৃষ্টি যে ছিল, তা বুঝতে পারতাম। মানিকগঞ্জ শহরের সাংস্কৃতিক ঝান্ডা ছিল তার হাতে, বাকি আমার বোন কবি জাহানারা আরজুর ছোট ভাই লাবলু ভাই ও শবনু আপাও খুব সক্রিয় ছিলেন এইসব অনুষ্ঠানে। কলেজের বাৎসরিক নাটকে অভিনয়সহ সব কিছুতেই অংশ নিতেন এই দুই ভাই-বোন।
এদিকে যতীনদার সুন্দরী কন্যারাও অভিনয়ে খুবই পারদর্শী ছিল। মানিকগঞ্জে নতুন কোনো ডিসি এলেই দ্বিতীয় দিনে পরিচিত হতো যতীন ঘোষের পরিবারের সঙ্গে। এই পরিচয়-সূত্রে এক ডিসির সঙ্গে তার প্রথমা কন্যার প্রেম পরিণয়ে পৌঁছুতে খুব বেশি দেরি হয়নি।
অধিকাংশ দিনে যতীন ঘোষ নিজে দোকানে উপস্থিত থাকলে আমার কাছ থেকে দই মিষ্টির টাকা নিতে কর্মচারীদের নিষেধ করে দিতেন। একদিন দুপুরের দিকে তার দোকানে ঢুকেছি দই মিষ্টি খেতে, ভেতরের একটি কেবিনে তখনই তিনি খেতে বসতে যাচ্ছিলেন। আমাকে দেখে দই মিষ্টি না দিয়ে তার সঙ্গে খেতে ডাকলেন। আমি বুঝতে পারছি না, হঠাৎ করে এমন আমন্ত্রণ গ্রহণ করা ঠিক কি না। তার সঙ্গে বসে দুপুরের খাবার খাবো, ব্যাপারটিতে খুব ইতস্তত করছি মনে মনে। কিন্তু এমনভাবে অনুরোধ করলেন যে, ফেলতে পারলাম না। বিশাল কাসার থালের মধ্যেখানে একবাটি ভাত ও ছোট কাসার বাটিতে হরেক রকম সবজি। মাছের ভাজা ও রান্না, সুক্তোসহ ছয়-সাতটি বাটি থালার ভাতের চারপাশ দিয়ে সাজানো। আরও কত কিছু যে ছিল আজ আর মনে নেই। তবে, সেদিনই প্রথম হিন্দু পরিবারের সুস্বাদু রান্নার স্বাদ গ্রহণ করেছিলাম। যতীন দাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, বৌদি সব রান্না করেছেন। এরপর তার বাড়িতেও খেয়েছি ২/৩ বার।
তার মেয়েদের মুখের মাসি ডাক ভীষণ এনজয় করতাম সেই সময়, মনে হতো আমি ওদের সত্যিকার মাসি যেন। অথচ যখন ভৈরব বাজারে ছিলাম, এক হিন্দু পরিবারের নববধূ পানির কল থেকে জল ভরে নিয়ে যাচ্ছিল, সেই সময় আমিও সেখানে উপস্থিত, তার ভরা কলসের জলে আমার ছায়া পড়ায়, কলসীর জল উবুড় করে আমার সামনে এমন ছড়াৎ ছড়াৎ করে ঢেলে দিলেন যে, আমি যেন ইচ্ছে করে ভারী অন্যায় করেছি। তার চোখে ছিল ঘৃণার চাহনি!
এই ঘটনাটি, আমার অসাম্প্রদায়িক চিন্তার ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল। তখন এমনও মনে হয়েছিল যে, এই অসূয়া বিষের জন্যেই কি হিন্দু-মুসলিম একদেশে থাকতে পারলো না? ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ করে আলাদা হতেই হয়েছিল অবশেষে। কিন্তু সেই বিভাজন কোনো গন্তব্যে যেতে পারেনি। পাঁচ বছরের ব্যবধানে মাতৃভাষার দাবিতে ১৯৫২ সালে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে যারা ভাষা আন্দোলনে শহীদ হলেন, তাদের অন্যতম শহীদ রফিক ছিলেন এক সময় এই দেবেন্দ্র কলেজের ছাত্র। শহীদ রফিকের মায়ের সমাধিও এই কলেজ প্রাঙ্গণে।
বাহান্নোর ভাষার আন্দোলনের বীজমন্ত্র ও অনুপ্রেরণায় শতবর্ষ আগে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের মতো একটি স্বাধীন দেশের গর্বিত নাগরিক হতে পেরেছি আমরা। এই অর্জনের পেছনে তিরিশ লক্ষ শহীদ ও মা-বোনের রক্তের উত্তাল ঢেউয়ের কান্না খেলা করে আজও আমাদের ধমনীতে।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে এই কলেজের ছাত্র আবুল কাশেম খান, গোলাম কিবরিয়া তজু, আব্দুস সাত্তার (পিন্কু), আবুল হোসেন, রতন চন্দ্র বিশ্বাস, আনছার আলী, মো. কফিল উদ্দিন, বিমান বিহারী সাহা প্রাণ দিয়েছেন। এখনো মনে পড়ে, কী ভয়াবহ দিন ছিল সেদিন!
একটি ভাষণের স্পর্শ এত প্রগাঢ়, তার প্রতিটি শব্দ এত ইঙ্গিতময়, ব্যঞ্জনা রসের আকর—এর আগে ভাবা যায়নি এভাবে। বিভাগীয় ও রাজধানী শহর কাঁপিয়ে পাড়াগাঁর কেরোসিন কুপির আলো ছড়িয়ে এভাবে রন্দ্রে রন্দ্রে কিভাবে ছড়িয়ে পড়ে আলোর মিছিল, এক নেতার এক ভাষণে—সে অভিজ্ঞতার স্বাদ বাঙালি একবারই পেয়েছে শুধু।
মানিকগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণে কোনঠাসা হয়ে পড়ে পাক বাহিনী। প্রতিশোধপরায়ণ পাকবাহিনী তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকারদের সহায়তায় ১৯৭১ সালের ২২ নভেম্বর ভোরে তেরশ্রী পুরো গ্রামে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। তেরশ্রী, সেনপাড়া, বড়রিয়া ও বড়বিলা গ্রামের ঘুমন্ত মানুষের ওপর নারকীয় তাণ্ডব চালায়। সকাল থেকে ৭ ঘণ্টাব্যাপী নির্বিচারে চলে গুলি। বেয়নেট চার্জ ও বাড়িঘরে পেট্রোল ঢেলে আগুন দিয়ে তেরশ্রী জমিদার সিদ্ধেশ্বর প্রসাদ রায় চৌধুরী, অধ্যক্ষ আতিয়ার রহমানের মতো আলোকিত মানুষসহ ৪৩ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। সেই দিনটির স্মরণে ২২ নভেম্বর ‘তেরশ্রী গণহত্যা’ দিবস পালন করা হয় প্রতিবছর।
তিন.
আমাদের বাড়ির চাকরিজীবী ভাইয়েরা রমনা রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনে, রক্তে স্বাধীনতার সেই উত্তাল হাওয়া এবং অস্থিরতা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। ভাষণটি বিকেল ২টা ৪৫ মিনিটে শুরু করে বিকেল ৩টায় শেষ হয়। ১৮ মিনিট স্থায়ী এই ভাষণে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) বাঙালিদের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। এই ভাষণের একটি লিখিত ভাষ্য স্বল্প সময়ের ব্যবধানেই বিতরণ করা হয়েছিল। এটি তাজউদ্দীন আহমদ কর্তৃক কিছু পরিমার্জিত হয়েছিল। পরিমার্জনার মূল উদ্দেশ্য ছিল সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবিটির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা।
১২টি ভাষায় ভাষণটি অনুবাদ করা হয়৷ নিউজউইক ম্যাগাজিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাজনীতির কবি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। আমরা জানি, ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো এই ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ভাষণে, দাবি আদায় না-হওয়া পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে সার্বিক হরতাল চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর এই নির্দেশ শুনে রেসকোর্স ময়দান থেকেই অফিস-আদালতের মুখে ছাই ছিটিয়ে, সব কাজ বন্ধ রেখে সেই রাতেই বাড়িতে চলে এসেছিলেন কেউ কেউ। আমাদের চাচাতো ভাই ঘটু ছিলেন সোহরাওয়ার্দী কলেজের লাইব্রেরিয়ান, তিনি চাবি বুঝিয়ে দিয়ে এসেছেন। তামেজ ভাই এজি অফিসে কাজ করতেন, তিনিও এসেছেন। আব্বার যেহেতু স্বাধীন ব্যবসা, তাই তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ না করে পরিস্থিতি অনুধাবন করতে তিনি রয়ে গেছেন ঢাকাতেই। কিন্তু আমরা সবাই তাকে নিয়ে চিন্তিত।
তুমুল আবেগ ও উত্তেজনা নিয়ে তামেজ ভাই বঙ্গবন্ধুর ভাষণের প্রতিটি বাক্য আমাদের ধরে ধরে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্যে সবাই সতর্ক করে দিচ্ছেন। লাঠিসোটা, বল্লম, টেঁটা—যার ঘরে যা আছে—তা শানিত করে রাখতেও বলছেন। সব ধরনের প্রস্তুতির কথা বলছেন আর ছোট ছোট জটলা করে কথা বলছেন। ঢাকা থেকে নতুন কেউ এলেই তাকে ঘিরে বঙ্গবন্ধু সর্বশেষ সংবাদ শুনতে মরিয়া হয়ে উঠছেন হাতের কাজ ফেলে। একটা যুদ্ধ, একটা অশনিসংকেত না চাইতেও যে ধেয়ে আসছে, সেটি খুব করে বুঝতে পারছি।
রেডিওতে কান পেতে বসে আছে সবাই খবরের জন্যে। নতুন কিছু প্রচার হলো কি না, সারাক্ষণ সেই দিকে খেয়াল। পরীক্ষার আগের রাত্রে পরীক্ষার্থীদের যেমন অবস্থা হয়, খাওয়ার জন্যেই খাওয়া নয়, বাঁচার জন্যেই যেন যেটুকু খানা, বিশ্রামের জন্যে যেটুকু চোখ মুদে থাকা—কোনো কিছুতেই যেন মনোযোগ নেই, পরীক্ষার পড়া ছাড়া।
পাকিস্তানিদের তাড়িয়ে স্বাধীনতা ফিরে পাওয়া ছাড়া যেন আর কোনো কাজ নেই কারও হাতে। তীরন্দাজের তীর থেকে ছুটে আসা এরকম একটি রক্তাক্ত তাজা খবর নিস্তরঙ্গ পাড়াগাঁয়েও যে কতটা তুমুল স্ফূলিঙ্গের সৃষ্টি করতে পারে, কতটা দাবানল ছড়িয়ে পড়তে পারে চতুর্দিকে, সেদিন বুঝেছিলাম প্রাণের বোধি ও আধির আবেগে। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ার সোনামাটি কেঁপে কেঁপে উঠেছিল একটি তর্জনি হেলনে।
একটি ভাষণের স্পর্শ এত প্রগাঢ়, তার প্রতিটি শব্দ এত ইঙ্গিতময়, ব্যঞ্জনা রসের আকর—এর আগে ভাবা যায়নি এভাবে। বিভাগীয় ও রাজধানী শহর কাঁপিয়ে পাড়াগাঁর কেরোসিন কুপির আলো ছড়িয়ে এভাবে রন্দ্রে রন্দ্রে কিভাবে ছড়িয়ে পড়ে আলোর মিছিল, এক নেতার এক ভাষণে—সে অভিজ্ঞতার স্বাদ বাঙালি একবারই পেয়েছে শুধু।
যাকে ব্যাখ্যা করা যায় আসন্ন যুদ্ধের পটভূমি এবং ঢেউসমূহের রণবাদ্য হিসেবে। বার বার মনে পড়ছে কাজী নজরুল ইসলামে সেই রণসংগীত:
চল চল চল!
ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল
নিম্নে উতলা ধরণী তল,
অরুণ প্রাতের তরুণ দল
চল রে চল রে চল
চল চল চল।
চলবে…
বালিকার চরৈবেতি-২০॥ দিলারা হাফিজ