[পর্ব-১৭]
[ড. মায়া অ্যাঞ্জেল্যু—আমেরিকান কবি। তার জন্ম ১৯২৮ সালের ৪ এপ্রিল। মিসোরি রাজ্যের সেন্ট লুইস শহরে। ছিলেন একাধারে, কণ্ঠশিল্পী, অভিনেত্রী, নাট্যকার, শিক্ষক ও একজন জীবনীকার। তার পুরো নাম মার্গারেট অ্যানি জনসন।
১৯৯৩ সালে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি তার নিজের লেখা কবিতা ‘পালস অব মর্নিং’ আবৃত্তি করেন। এজন্য পরে গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডও পান। ইতোপূর্বে ১৯৬১ সালে একমাত্র কবি রবার্ট ফ্রস্টই প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ‘দ্য গিফট আউটরাইট’ কবিতাটি আবৃত্তি করার সম্মাননায় ভূষিত হয়েছিলেন।
১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা নিজের অভিষেক অনুষ্ঠানে মায়া এঞ্জেলোর কবিতা পাঠ করে তাকে সম্মান দেখান। কর্মজীবনে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। সমগ্র পৃথিবীর ৭০টিরও বেশি ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি সম্মাননা পান। প্রায় ৫০টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিলিট বা ডক্টর উপাধি পান।
১৯৬৯ সালে তার প্রথম আত্মজীবনী ‘আই নো হোয়াই দ্য কেজড বার্ড সিংস’ বইটি প্রকাশিত হলে বিশ্বব্যাপী তিনি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। বইটি পরবর্তী দুবছর ধরে নিউ ইয়র্ক টাইমস এর বেস্ট সেলার তালিকায় সর্বোচ্চ স্থান দখল করে ছিল। ২০১৪ সালের ২৮ মে সকালে অ্যাঞ্জেল্যু চিরনিদ্রায় চলে যান। চিন্তাসূত্রের জন্য এই মহান লেখকের আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ড ‘আই নো হোয়াই দ্য কেজড বার্ড সিংস’-এর বাংলা অনুবাদ করেছেন কথাশিল্পী-কবি-অনুবাদক ফারহানা রহমান। নাম দিয়েছেন, ‘আমি জানি খাঁচার পাখিরা কেন গান গায়’। আজ প্রকাশিত হলো ১৭তম পর্ব]
আমার নানু ব্যাক্সটারের শরীরে হয়তো বা চার ভাগের বা আট ভাগের একভাগ নিগ্রোর রক্ত ছিল। তিনি ছিলেন কোড্রুন বা অক্টোরুন প্রজাতির কেউ। অথবা এও বলা যেতে পারে, তিনি ছিলেন প্রায় সাদা প্রজাতির কেউ। তিনি ইলিনয়, কায়রোর একটি জার্মান পরিবারে তিনি বেড়ে উঠেছিলেন। এই শতকের শুরুর দিকে তিনি সেন্ট লুইসে নার্সিং বিষয়ে পড়ার জন্য আসেন। আমার নানা ব্যাক্সটারের সঙ্গে তার দেখা হয় হোমার. জি. ফিলিপ্স হাসপাতালে কাজ করার সময়। এরপর তারা বিয়ে করেন। নানা ছিলেন কালো নিগ্রো কিন্তু আমার নানু ছিলেন একেবারেই সাদা। তার চেহারায় নিগ্রোর কোনো চিহ্নই ছিল না। একেবারে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নানু খটখটে কর্কশ জার্মান উচ্চারণেই কথা বলতেন। আর নানা কথা বলতেন ইস্ট ইন্ডিয়ানদের মতো নিখুঁত শুদ্ধ উচ্চারণে।
তারা খুব সুখী দম্পতী ছিলেন। আমার নানা তার পরিবার নিয়ে ভীষণ গর্ব করে বলতেন, ‘ওহ জেসাস! আমি আমার জীবন আমার স্ত্রী, সন্তান ও আমার কুকুরের জন্যই শুধু অতিবাহিত করেছি।’ তার এই কথাটি সবার কাছে সত্য প্রমাণ করার জন্যই তিনি তার পরিবারের প্রতি সর্বচ্চো খেয়াল রাখতেন। যত্ন-আদ্যি করতেন। জীবনের সবচেয়ে কঠিন সংঘাতময় সময়েও সেকথা ভুলতেন না।
বিশ শতকের ত্রিশের দশকের মাঝামাঝি ছিল এক কথায় স্বর্ণযুগ। সেইন্ট লুইসের নিগ্রোদের অংশটি ছিল সুক্ষ্মতম সোনার খনির শহর। জুয়াখেলা ও এই সম্পর্কিত যত নিষিদ্ধ কাজকারবার ওখানে এতই উন্মুক্ত ছিল যে, কখনোই বিশ্বাস করতাম না, ওরা সবাই আইন-বিরুদ্ধ লোক। আগন্তুক হিসেবে আমাকে আর বেইলিকে শিগগিরই আমাদের স্কুলের বন্ধুরা জানিয়ে দিয়েছিল যে, আমাদের যাতায়াতের পথে রাস্তার মোড়ে আসলে আমরা ঠিক কাকে দেখতে পাই। আমি একেবারে শিওর ছিলাম যে, ওরা ওদের নামগুলো নিজেরাই রেখেছে। সেটা করেছে আসলে ওয়াইল্ড ওয়েস্ট বইগুলো থেকে মেরে দিয়েই (কঠিনভাবে পিটাইতে পারা জিমি, দুই বন্দুক, মিষ্টি লোকটা, পোকার পিট, এগুলো ছিল ওদের নাম), আর আমার কাছে এসব কিছুর সত্যতা প্রমাণ করতেই হয়তো বা তারা ঘোড়াহীন কাউবয়ের মতো সেলুনের সামনে অকারণে আড্ডাবাজি করে চক্কর মেরে মেরে সময় কাটাতো। গুটিচালক, জুয়াড়ি, লটারিগ্রহীতা, হুইস্কি বিক্রেতাদের সঙ্গে শুধু যে আমাদের বড় বড় রাস্তার মোড়েই দেখা হতো তা নয়, বরং তারা আমাদের সাজানো গোছানো বসার ঘরগুলোতেও এসে হানা দিতো।
সেটাকেই আমার সবচেয়ে সুস্বাদু খাবার মনে হয়েছিল। আর এটাকেই বড় শহরের থাকার সবচেয়ে সুবিধাজনক একটি ব্যাপার মনে হতো।
আমরা স্কুল থেকে বাসায় ফিরে প্রায়ই ওদের দেখতাম, আমাদের লিভিং রুমে বসে আড্ডা পেটাচ্ছে। পায়ের ওপর পা তুলে হ্যাটটি হাতে ধরে সোফায় আরামসে বসে থাকতো। ঠিক যেভাবে এই বড় শহরে এসে প্রথমদিন আমরা বসে বসে মায়ের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, তেমন করে। চুপচাপ বসে বসে তারা আমাদের নানু ব্যাক্সটারের জন্য অপেক্ষা করতো।
নানুর ধবধবে ফর্সা গায়ের রঙ ও নাকের ওপর নাটকীয়ভাবে ঝুলে থাকা ডাঁটিবিহীন চশমাটি তাকে সবার কাছে শ্রদ্ধার পাত্র করে তুলেছিল। একইসঙ্গে তার ড্রেসের সঙ্গে পিনআপ করা চেইন যেভাবে মুখের ও কানের দুপাশে ঝুলে থাকতো, সেটাও তাকে অন্যদের কাছে এক বিশেষ অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছিল। এছাড়া, তার বিখ্যাত ছয় সন্তানের যে প্রতিপত্তি ছিল এবং এটাও সত্যি যে, তিনি সেই এলাকার ইলেক্টেড চেয়ারম্যান ছিলেন; যা তাকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছিল। আর এ কারণেই এলাকার কোনো গুণ্ডা, চোর, বদমাইশকে তিনি ভয় তো পেতেনই না বরং তার নিজের ব্যক্তিগত নানা কাজে তাদের ব্যবহার করতেন। পুলিশ ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে তিনি সবসময় যোগাযোগ রেখেই চলতেন। ফলে সারা গায়ে কাঁটাছেঁড়ার দাগ নিয়ে যেসব গুণ্ডারা ঝাকানাকা পোশাক পরে নানুর কাছে আসতো, তারাও চার্চে প্রার্থনারত ঈশ্বরের ভক্ত মানুষজনের মতো করে নানুর কাছ থেকে কিছু সাহায্য পাওয়ার আশায় বাসায় এসে বসে থাকতো। তারা ভয়ে সেঁটিয়ে থাকতো এই ভেবে যে, যদি নানু তাদের জুয়ার আসর সম্পর্কে কোনো ব্যাপারে রাগান্বিত হন বা তাদের যে বন্ধুটি জেলে পচে মরছে, তাকে নিয়ে কোনো রকম উচ্চবাচ্য করেন, তাহলেই সর্বনাশ হয়ে যাবে। বন্ধুটির হয়তো আর কখনো জামিন পাওয়াই হবে না। এসব কিছুই তারা খুব ভালো করেই জানতো আর খোঁজখবর রাখতো। তারা এও জানত যে, আসন্ন নির্বাচনে নানুর হয়ে জনে জনে ভোট ভিক্ষা চাইতে যেতে হবে তাদের। প্রায়শই যেহেতু তিনি তাদের নানা সুযোগসুবিধা দিতেন, তাই তারাও বিনিময়ে তাকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করতো।
সেন্ট লুইসে এসেই আমি প্রথমবারের মতো পাতলা করে কাঁটা হ্যাম (শুয়োরের ঊরুর চাক মাংস) খেয়েছিলাম (আমি এটিকে খুবই সুস্বাদু মনে করতাম)। স্যান্ডুইচের ওপর ছোট ছোট মিষ্টি চকলেট, লেটুস পাতা ও নানা রকমের মিশ্রিত বাদাম ছেটানো থাকতো। এসব ছাড়াও ভিক্ট্রোলাস (গান শোনার রেকর্ডার) ও পারিবারিক বন্ধনের সঙ্গেও এখানে এসেই প্রথম পরিচিত হয়েছিলাম। আরাকাসওতে আমরা নিজেরাই আমাদের খাবারের মাংসগুলোকে যেহেতু সংরক্ষিত করে রাখতাম, সেহেতু আধা ইঞ্চি মোটা করে কাটা শুয়োরের মাংসের চাকগুলোকে আমরা সকালের নাস্তার সময় খেতাম। কিন্তু সেন্ট লুইসে আমরা অদ্ভুত গন্ধযুক্ত জার্মান দোকান থেকে কাগজের মতো পাতলা স্লাইস করা মাংস কিনতাম। সেগুলোকে স্যান্ডউইচের মধ্যে দিয়ে খেতাম। নানু যেমন সারাজীবন ধরে তার জার্মান উচ্চারণেই কথা বলে গেছেন আর কখনোই তিনি সেটা ভুলে যাননি; ঠিক তেমনি করেই তিনি তার জীবনে কখনোই মোটা-কালো জার্মান পাউরুটির স্বাদও ভুলতে পারেনি। আর এসব পাউরুটি আমরা স্লাইস করা ছাড়া আস্তই কিনতাম। স্ট্যাম্পসে লেটুস পাতাকে আলুর সালাদ বা বাঁধাকপির সালাদ পাতার ওপর দিয়ে খাওয়ার জন্যই ব্যবহার করা হতো। চিনাবাদামকে ক্ষেত থেকে সরাসরি তুলে এনে খাওয়া হতো। কিন্তু যেসব রাতে খুব ঠাণ্ডা পড়তো, তখন সেগুলোকে নিয়ে ওভেনের নিচে রেখে রোস্ট করে খাওয়া হতো। ওই সময় মৌ মৌ সুগন্ধে পুরো বাড়ি ভরে উঠতো।
আমরা আরও আরও অনেক বেশি বেশি খাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে রইতাম। কিন্তু সেটি ছিল শুধু স্ট্যাম্পেসেরই রীতিনীতি। আর সেন্ট লুইসে চীনাবাদাম কেনা হোতো কাগজের ব্যাগে আর সেটা আনা হতো বাজার থেকে কিনে। সঙ্গে থাকতো নানা রকমের ছোট ছোট চকলেট। ফলে আমরা একইসঙ্গে নোনতা আর মিষ্টি খাবার মিশিয়ে মিশিয়ে খেতাম। সেটাকেই আমার সবচেয়ে সুস্বাদু খাবার মনে হয়েছিল। আর এটাকেই বড় শহরের থাকার সবচেয়ে সুবিধাজনক একটি ব্যাপার মনে হতো।
চলবে…
আমি জানি খাঁচার পাখিরা কেন গান গায়-১৬॥ মায়া অ্যাঞ্জেল্যু