(পর্ব—১৮)
এক.
এসএসসি পরীক্ষা শেষ। ভেতরের টান টান উত্তেজনাময় অভিযোজন উগড়ে ফেলে আপাতত ফলের আগ পর্যন্ত মুক্ত। শরীর-মন; দুই-ই পাখির পালকের মতো হালকা নরম ও উড়ু-উড়ু।
মনে পড়ছে, ইংরেজিতে কাঁচা ছিলাম বলে স্যারদের কথা মতো পরীক্ষায় রচনা কমন ফেলতে কত শত রচনা মুখস্ত করেছিলাম—জার্নি বাই ট্রেন, বোট, বাস—কত কি!
পরীক্ষায় সেসব কমন পড়েনি বটে, তবে সেই জার্নি বাই বাসে চেপে পরীক্ষার পরদিনই কালিহাতি রওয়ানা হয়ে গেলাম দুদিনের জন্যে। আব্বার ডান পাশে জানালার ধারে বসেছি আমি। আজ নিজেকে সম্পূর্ণ একক একজন পরিপূর্ণ মানুষ ভাবতে ভালো লাগছে। এতদিন মনে হতো আমি শুধু আমি নই, আব্বা-মায়ের অচ্ছেদ্য অংশ বিশেষ ব্যতীত।
এই প্রথম আজ মনে হচ্ছে আমি বড় হয়েছি। আদিগন্ত শস্যের সবুজ চশমা গলিয়ে দেখছি পথাশ্চর্য যা কিছু। ভীরু মনে ভাবছি—আকাশ-কুসুম-বিরহ-লতার ঝুমকো ফুলগুলো সবই যেন আমার।
মাস ছয়েক আগেই আমার পুলিশ খালু ভৈরব বাজার থেকে কালিহাতি থানায় বদলি হয়ে এসেছেন। টাঙ্গাইল জেলার খুবই সন্নিকটবর্তী উপজেলা কালিহাতি। টাঙ্গাইল পুরনো বাসস্ট্যান্ড থেকে মাত্র ২০ মাইলের দূরত্ব। সত্তর দশকের সেই সময়ে দ্রুতগামী বাস খুব কম ছিল এসব রাস্তায়। বিশেষভাবে কাছাকাছি দূরত্বের জেলা-উপজেলাগুলোয় চলাচলের জন্যে তো বটেই। তবে জামালপুর কিংবা শেরপুরের মুড়ির টিন কিংবা লক্কর-ঝক্কর মার্কা বাসে চাপলেও ঘণ্টা দেড়েক লেগেই যেতো কালিহাতি পৌঁছুতে। বিভিন্ন স্টেশনে নামা-ওঠা বিরতিসহ হাক-ডাক—সে এক স্মরণীয় বাসভ্রমণ।
কালিহাতি, এলেঙ্গা মিলে দুটি পৌরসভার অধীনে ১৩টির মতো ইউনিয়ন। এলেঙ্গা, দশকিয়া, নাগবাড়ি, বল্লা, সল্লা, সহদেবপুর প্রায় বাসস্ট্যান্ডে বাস থামে। আমিও কৌতূহলী চোখে সাইনবোর্ডের খুদে লেখায় স্টেশনের নামগুলো পাঠ করি মনোযোগ দিয়ে। হাতে বই নেই তো, সাইনবোর্ড পড়ি। কাজ নেই তো খই ভাজার মতো ব্যাপার। তবে ‘তালসোনাপুরের তালেব মাস্টার’ কবিতার বিখ্যাত কবি ও লোকগবেষক ড. আশরাফ সিদ্দিকীর বাড়ি যে কালিহাতির নাগবাড়ি, তা আগেই জানতাম। পরে জেনেছি স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর বাড়িও এই নাগবাড়ি। জেনেছি তার বাবা আব্দুল হামিদ চৌধুরী পূর্ব পাকিস্তান গণ-পরিষদের স্পিকার ছিলেন। নাগবাড়ি গ্রামের ঐতিহ্যবাহী বিশিষ্ট জমিদার বাড়ি হিসেবে পরিচিত ছিল তাদের এই বাড়িটি।
এই বাড়িতেই বিয়ে হয়েছিল আমার একমাত্র ননাস রেণু বুজির। বুজির কাছে গল্প শুনেছি, বর্ষাকালে নৌকা করে আব্দুল হামিদ চৌধুরী গুণী গাঁয়ে এসে তরফ গৌরাঙ্গী বংশের মেয়ে রেনু বুজিকে নিজে দেখেশুনে পছন্দ করেছিলেন তার ভাতিজার জন্যে। রেনু বুজির বড় ছেলে সাইফুল হক সিদ্দিকী ও মলির প্রেম-উত্তর বিবাহ খেতে এসে রফিক আজাদসহ দিন সাতেক ছিলাম এই নাগবাড়িতে।
বোনের এই শ্বশুরবাড়ি ঘিরে কবিরও ছোটবেলার অনেক স্মৃতি আছে। ছোট থেকে রেনু বুজি জোড়া দুই পায়ে ভাইকে শুইয়ে, দুলিয়ে-দুলিয়ে ঘুম পাড়াতেন, কর্মব্যস্ত মায়ের সঙ্গে তিনিও বোতলে দুধ খাইয়ে ভাইকে বড় করেছেন। কাজেই ‘আপা’বলতে ভাইও অজ্ঞান ছিল। বোনপিয়াসী ভাই, সব কিছুতে বোনের প্রভাব আষ্টেপৃষ্ঠে লেগেছিল তার প্রাণের ভেতর। যে কারণে কিছুদিন পর পরই গুণী গ্রাম থেকে বুজিকে দেখতে আসতেন এই নাগবাড়িতে। বোনের বিরহে পরবর্তী সময়ে ‘আপা’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন, কবিতাটি চট্টগ্রাম বোর্ডের পাঠ্যসূচিতে ছিল।
এছাড়া, বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য এই কালিহাতির সন্তান, তাদের ঐতিহ্যবাহী জমিদার বাড়ি ছিল কালিহাতীর দ্বিতীয় পৌরসভা অঞ্চল এলেঙ্গায়। এলেঙ্গা এখন ততোধিক পরিচিত যুমনা সেতুর কারণে।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে কালিহাতিতে যাদের অবদান ছিল অতুলনীয়, তারা হলেন আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ও শাহাজাহান সিরাজ, কবি রফিক আজাদ, কবি বুলবুল খান মাহবুব, কবি মাহবুব সাদিকসহ নাম না জানা আরও অনেকে। কালিহাতি অঞ্চলটি বিখ্যাত হওয়ার আরও কিছু কারণের মধ্যে অন্যতম একটি হলো খাদ্যরসিকের প্রাণের মিঠাই, পোড়াবাড়ির চমচম। আর নারীদের প্রিয় ব্যসন-ভূষণ বল্লা তাঁতের শাড়ি—কেউ কম যায় না। এক কালিহাতি উপজেলায়ই পঞ্চাশ হাজার তাঁত রয়েছে বর্তমানে।
এলাকার কৃতি সন্তান আশরাফ সিদ্দিকীর লেখা থেকে জানা যায় যে, কালিহাতিসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলো পাঠান শাসন আমলে ফটিকজানী নদীর তীরে অবস্থিত পুরাতন থানার স্থানে একটি সেনা ছাউনি বসানো হয়। সৈন্যদের ব্যবহারের জন্য ছিল অশ্ব ও হাকি। তাই হাতির কিল্লা বা কিল্লা-ই-হাতি নামে এ সেনা ছাউনি পরিচিতি লাভ করে। এ শব্দই কালক্রমে এই অঞ্চলের নামকরণে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে।
কালিহাতি পৌঁছুতে বেলা তিনটা বেজে গিয়েছিল সেদিন। কালিহাতি থানার কুড়ি কদম পরেই খালুজানের একতলা বাসা। খাওয়া-দাওয়ার পরে বড়মা ও খালু জানের সঙ্গে কথা বলে মনে হলো, সময় বা কাল-প্রবাহই শোকের অন্যতম নিরাময় টেবলেট। সময়ের দাবিতেই দিনে দিনে শোক-তাপ কিছুটা হালকা হয়ে এসেছে তাদের। নিভু নিভু দীপের মতো একটাই প্রত্যাশা এতদিন যে মনের কোণে সংগোপনে ছিল, তাও পূরণ হয়েছে।
আপনজনের মধ্যে থেকে একজন সন্তান দত্তক নিয়ে নিজের সন্তান হিসেবে লালন-পালন করার উদগ্র বাসনা। এই ইচ্ছের কথা জানিয়ে আমার মায়ের সঙ্গে বহুদিন থেকেই কথা বলছিলেন খালু জান ও বড়মা দুজনেই। কিন্তু আমার আব্বার ভয়ে মা কোনো অভয় দিতে পারেননি তাদের। একদিন আমাদের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে, আব্বার সামনে খালুজান দুঃখ করে বলছিলেন যে, এভাবে একাকী জীবন কাটানো তো খুবই দুঃসহ। চাকরির সুবাদে ঘুরে-ফিরে আমার দিন কোনো মতে কেটে যায়। লেবুর বোন তো খুবই কাতর থাকে ছেলেটার জন্যে। সারাক্ষণ কান্নাকাটি করে শুধু।
তিনিও মনে হয়, ইংরেজি সাহিত্যে পড়া, তুখোড় বক্তা, দেখতেও স্মার্ট ওসমান গণী নামের ছেলেটিকে যথেষ্ট যোগ্য মনে করেছেন নির্বাচনে জেতার জন্যে। ধারণা করি, অর্থকড়ি দিয়েও সাহায্য করেছেন তিনি।
কী করে সান্ত্বনা দেই তাকে, সন্তানধারণের বয়সও তো নেই। নিজের ভাতিজি তপাকে এত আগ্রহ করে কাছে এনে রাখলাম, কিন্তু সেই যে গেলো সে, আর ফিরে এলো না। মিয়া ভাই, দিন না আপনাদের রানু মেয়েটিকে। একটু মা, বাবা ডাক শুনি ওর মুখে। আমরা মানুষ করি নিজের সন্তানের মতো করে। তাহলে লেবুর বোনের একাকিত্বটা একটু কাটবে।
আব্বা, আমার খালু জানের অশ্রুসজল এই কাতরতা ও অনুনয় শুনে ‘না’ করতে পারেননি তাদের। সেই থেকে আমার ছোট বোন রানুকে দত্তক কন্যা হিসেবে লালন-পালনের দায়িত্ব নিয়ে তারা কাছে রেখেছেন মাস ছয়েক মতো হবে। আব্বা রানুকে দেখতেই মূলত আমাকে নিয়ে কালিহাতি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সেদিন। রানুর বয়স তখন পাঁচ পেরিয়ে ছয়ে চলছিল। কালিহাতি স্কুলে তাকে ভর্তি করে দিয়েছেন খালু জান। প্রতি সন্ধ্যাবেলা রানুকে পড়াতে বসান খালু জান। পড়ায় মনোযোগ নেই রানুর। বইয়ের অক্ষরে আঙুল চেপে তাকিয়ে থাকে উঠানের গাছপালার দিকে। বড়মাকে মা ডাকলেও খালু জানকে আব্বা ডাকতে সে কিছুতেই রাজি হয় না।
আমার চেইন স্মোকার আব্বা এক সময় সিগারেট ছেড়ে হুক্কা ধরেছিলেন বলে আব্বাকে সে ‘হুক্কা আব্বা’ ডাকতো। অগত্যা খালু জান তাকে হুক্কা আব্বা ডাকতে রাজি করাতে পেরেছিলেন। পড়াশোনায় যখন কিছুতেই মনোযোগ ফেরাতে পারছিলেন না, তখন তার অহংকারে বাতাস দিয়ে খালু জান বলতেন, রানু, শোন্, তুই যে পড়িস না, কী হবে তোর? তোর বড় বোন দিলু পড়াশোনা করে চাকরি-বাকরি করবে। গাড়ি চালাবে। আর তুই তখন গোবরের সাঁজি কাঁখে করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবি। বুঝলি, পড়, পড়।
তবু সে নির্বিকার।
থাক, আমার এত পড়তে হবে না। আমি ফাইভ ক্লাস পর্যন্ত পড়ে, সেলাই-ফড়ি করবো, তারপর মাস্টারি করবো। তাহলেই আমার চলবে। এ পর্যন্তই আকাঙ্ক্ষা, এর বেশি নয়। কেননা খেলাধুলা আনন্দ করে ঘুরে বেড়ানোতে তার বেশি আনন্দ। এই অবস্থায় যখন একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো। আব্বা তখন দুলাভাইকে পাঠিয়ে আবার বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে এলেন রানুকে। যুদ্ধের এই ভয়াবহতার মধ্যে মেয়েটি যুদ্ধের ময়দানে রেখে তিনি ঘুমাতে পারছিলেন না একটি রাতও। খালু জানকে কথা দিয়েও তাই সন্তানের স্নেহের কাছে হার মেনেছিলেন আমার আব্বা।
দুই.
১৯৭০ সাল। সর্বত্র নির্বাচনের জয়ঢাক বাজে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণও বেজায় উতালা। আমার দুলাভাই ওসমান গণীর কী খেয়াল হলো, সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি নির্বাচনে নামলেন। এই খবর শুনে আমার আব্বা বিমর্ষ। তাতে কী আসে যায়? স্বপ্নবাজ মানুষ তিনি। একবারটি যদি সংসদ সদস্য হতে পারা যায়, তখন কে আর পাবে তাকে!
বাঁচবো তো সিংহের মতো, অন্যথায় মুষিক হয়ে বেঁচে কী লাভ? এই ছিল তার দর্শন। তার নিজ অঞ্চলে কাহারবা তাল ঠোঁকা কিছু শুভাঙ্ক্ষী বন্ধু ছিল, তাদের উসকানি তো ছিলই, উপরন্তু অভিভাবকতুল্য রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক এবং এক সময়ের পাকিস্তানের গণপরিষদের বিদগ্ধ সদস্য আবদুল আলিম-আল-রাজি এই নির্বাচনের দৌড়ের বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে দিলেন। বাস! আর রোখে কে? তিনিও একই অঞ্চলের দেলদুয়ার থানার বরটিয়া গ্রামে ১৯২৫ সালে জন্মগ্রহণ করেছেন। ১৯৮৫ সালের ১৫ মার্চ তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আমৃত্যু দুলাভাই তাকে রাজনৈতিক গুরু হিসেবে মেনেছেন। তার মুখে সব সময় শুনেছি মহৎ প্রাণের এই মানুষটির কথা। তিনিও মনে হয়, ইংরেজি সাহিত্যে পড়া, তুখোড় বক্তা, দেখতেও স্মার্ট ওসমান গণী নামের ছেলেটিকে যথেষ্ট যোগ্য মনে করেছেন নির্বাচনে জেতার জন্যে। ধারণা করি, অর্থকড়ি দিয়েও সাহায্য করেছেন তিনি।
যতদূর জানি, ধারাবাহিকতার কোনো ছাত্ররাজনীতির ইতিহাস ছিল না দুলাভাইয়ের। কিন্তু নিজ এলাকার গ্রাম-উন্নয়ন তথাশিক্ষা সম্প্রসারণে স্কুল কলেজ, রাস্তা-ঘাটের উন্নয়নের কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন বটে ছাত্রাবস্থা থেকে। নিজ-গ্রামটি অজপাড়াগাঁ হলেও পাশেই ছিল ইতিহাসসমৃদ্ধ নাগরপুর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী জমিদার বাড়ি।
প্রায় ৫৪ একর জমির ওপর শৈল্পিক কারুকার্যমণ্ডিত নাগরপুর চৌধুরীবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন যদুনাথ চৌধুরী। কথিত আছে, কলকাতার আদলে নাগরপুরকে সাজানোর পরিকল্পনা নিয়েছিলেন এই জমিদার। এখান থেকেই তিনি জমিদারি পরিচালনা করতেন। রঙমহলের পাশে ছিল সুদৃশ্য চিড়িয়াখানা। সেখানে শোভা পেতো ময়ূর, কাকাতুয়া, হরিণ, ময়না ইত্যাদি। ঝুলন্ত দালান, ঘোড়ার দালান, রঙমহল, পরীর দালান ছিল দৃষ্টিনন্দন ও দর্শনীয়। দেশবিভাগের পরে তদানীন্তন সরকার চৌধুরী বাড়ির সব সম্পদ অধিগ্রহণ করে। বর্তমানে নাগরপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজটি চৌধুরী বাড়ির মূল ভবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চৌধুরী বাড়ির দক্ষিণে ১১ একর জমির ওপর একটি বিরাট দিঘি রয়েছে, এটি উপেন্দ্র সরোবর নামে পরিচিত, যা এখনো কালের সাক্ষী হয়ে জলসিঞ্চন করে যাচ্ছে।
এই নাগরপুর-দেলদুয়ার মিলে টাঙ্গাইল-৬ আসন সৃষ্টি হয়েছে বর্তমানে।এই আসন থেকে দুলাভাই দাঁড়িয়েছিলেন স্বাতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে। যেহেতু আওয়ামী লীগের পেছনে ঘুরে-ঘুরেও শেষাবধি মনোনয়ন পেলেন না, তখন বাধ্য হয়ে ব্যক্তিগত ইমেজের ধ্বজাধারী হিসেবে স্বতন্ত্র দাঁড়ালেন আনারস মার্কা নিয়ে। নির্বাচনি মিছিলে লিড দিতে পারে এমন যুবক মামাতো, চাচাতো দুলাভাইয়ের সব শালাই আমাদের বাড়ি থেকে গয়হাটা চলে গেলো ইলেকশন কভার করতে। আমরা প্রতীক্ষায় আছি ফল জানতে।
এখনো মনে আছে, আমার চেয়ে কয়েক বছরের বড় ছোট কাকার ছেলে রেজা ভাই গয়হাটা থেকে যেদিন ফিরে এলো বাড়িতে।সবাই তাকে ঘিরে খবর শুনতে উদগ্রীব হয়ে আছি। তখনো পুরো ফল আসেনি, যতটুকু খবর তাতে দুলাভাই পাস করবে বলে মনে হচ্ছে না। রেজা ভাইকে যখন জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে তোমরা এতদিন কী কাজ করলা?
তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের নেতৃত্বে নির্বাচনে বিপুল ভোটে প্রাদেশিকভাবে জয়লাভ করে এবং ঘটনাপ্রবাহে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনা একটি দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেদিন।
আরে জানো না, আমরা দুলাভাইয়ের পক্ষে স্লোগান দিয়ে ভোট চেয়ে আসতে না আসতেই আওয়ামী লীগের মিছিল থেকে পাল্টা স্লোগান দিয়ে বলে, ‘আনারসের মধ্যে ফাঁটা, ওসমান অইলো গাইরেলের বেটা’। ইজ্জত এক্কেবারে পাংচার।
-কেন? এ কথা কয় ক্যান?
ঐ যে, জানোই তো, দুলাভাই গো বাড়িতে আগে যে অনেকগুলো ঘোড়ার গাড়ির বিজনেজ ছিল, তাই।
ওদেশে তো রাস্তা-ঘাট ভালো না, পাল্কি আর ঘোড়ার গাড়ি ছাড়া একসময় কিছুই ছিল না। শালারা, ওই অতীত টাইনা নিয়া আজেবাজে কথা বলে জনগণকে অন্যমুখে ফিরাইয়া নিয়া গেছে। আমাগো কতায় কোনো কাম অয় নাই। আওয়ামী লীগের যে জোয়ার, দুলাভাই ওই দলে দাঁড়াইলে এক চাঞ্চে পাস অইতো।
ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসনামলে ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে প্রথম সাধারণ নির্বাচনটি ছিল একার্থে টার্নিং পয়েন্ট। মনে পড়ে, পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৭০ সনের অক্টোবরে নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও বন্যার কারণে ডিসেম্বর পর্যন্ত পিছিয়ে যায়। কিছু কিছুক্ষেত্রে ১৯৭১-এর জানুয়ারি পর্যন্ত পিছিয়ে যায়।
পূর্ব পাকিস্তান অংশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ, পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিপিই দলসংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করে। ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে আওয়ামী লীগ ১৬০টি আসনে জয়লাভ করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। সাধারণ নির্বাচনের একইসঙ্গে প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ পূর্ব-পাকিস্তানে অ্যাসেম্বলির জন্যে ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টিতে জয়লাভ করে। পাকিস্তান পিপলস পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানে ১৩৮টি আসনের ৮১টিতে জয়লাভ করে।
যুগান্তকারী এই জয়ের নেপথ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগটিও ভূমিকা রেখেছিল বলাই বাহুল্য। একই বছরের ১১ নভেম্বরে সংঘটিত বঙ্গোবসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের দক্ষিণ উপকূলে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল। পরবর্তী ত্রাণ কাজে পশ্চিম পাকিস্তানের উদাসীনতা এবং ঘূর্ণিঝড়ে বিপর্যস্ত মানুষের প্রতি পাকিস্তান সরকারের এমন নিষ্ঠুরতা দেখে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেছিল তীব্র রোষে।
২৪ নভেম্বর এক সভায় মওলানা ভাসানি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে অদক্ষতার অভিযোগ তোলেন। অবিলম্বে তার পদত্যাগ দাবি করেন। তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের নেতৃত্বে নির্বাচনে বিপুল ভোটে প্রাদেশিকভাবে জয়লাভ করে এবং ঘটনাপ্রবাহে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনা একটি দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেদিন।
চলবে…
বালিকার চরৈবেতি-১৭॥ দিলারা হাফিজ