(পর্ব-৪)
বিকেলের মিহি হলুদ আলো ছড়িয়ে পড়ছে নদীর জলে, নদীর দুই তীরের সবুজ বৃক্ষের ডালে, ডালের সবুজ পাতার ওপর। পূবালী লঞ্চ হুলারহাট ছেঁড়ে কাউখালী ঘাট ধরে এগিয়ে চলছে ইন্দিরহাটের দিকে। সন্ধ্যা নদী খুব বেশি চওড়া নয়। নদীর মাঝখানের জল কেটে কেটে এগিয়ে যাচ্ছে পূবালী। লঞ্চের ছাদে দাঁড়িয়ে দুই পারের মনোরম দৃশ্য-গরুর ঘাস খাওয়া, নদীর জলে গ্রাম্য বধূর গোসল, ছোট ছোট টাপুরিয়া নৌকার আনাগোনা দেখছে শফিক হায়দার।
সন্ধ্যা নদীর একটা বাঁক ঘুরতে গিয়ে পূবালী একেবারে পার ঘেঁষে চলছে। আর সেই সময়ে নদীতে কোনো এক নাম না জানা গ্রামের বৌঝি-ছেলে-মেয়ে-বুড়োরা গোছল করছে। তীক্ষ্ম চোখে নদী পারের মানুষের জীবনের অভিযাত্রা দেখদে থাকে শফিক অপার মুগ্ধ চোখে। হঠাৎ চোখে পড়ে এক নারী, সন্ধ্যার নদীর জলে গোসল সেরে সবার থেকে আলাদা হয়ে শাড়ি পালটাচ্ছে। ভেজা শাড়ির অর্ধেক শরীর থেকে পড়ে গেছে, অন্যদিকে শুকনো শাড়ি পরছে। দুই শাড়ি পরার সময়ের মধ্যে শাফিকের চোখে পড়ে নাভী, নাভীর ওপরের পেটা শরীরের সুন্দর লাবণ্য খচিত দেহ। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে যায় রিমির মাকে।
রিমির মা! এক অবাক নারী। দুই বছর আগে রিমির মাকে চিনতো না, জানতোও না। শফিকদের বাড়িতে চারটি ঘর। বাড়ির পূর্বের দিকে ঘরটা মুরাদ চাচার। মুরাদ চাচার মেঝো ছেলে গোলাম করিব চাকরি করে খুলনায় করিম জুটমিলে। মুরাদ চাচার পুরান বাড়ি জুনিয়া, উজানগাঁও থেকে আট নয় গ্রাম দূরে। সেখানেই মুরাদ চাচারা থাকতেন। কিন্তু উজানগাঁওয়ে ছোট ভাই সিকান্দার চাচা নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেলে এই ঘরে এসে বৃদ্ধ বয়সে চলে আসেন তিনি। বাড়িটা তো রক্ষা করতে হবে। সেই চাচার ছেলের খুলনার মিলে একটা ঝামেলা তৈরি হওয়ায়, কিবরিয়া স্ত্রী সাফিয়া, নয় বছরের মেয়ে রিমি আর ছয় বছরের ছেলে আবিরকে নিয়ে উজানগাঁওয়ে পিতার কাছে চলে আসে। ঘরটাও বেশ বড়, চৌচালা। মুরাদ চাচারও একটা অবলম্বন হলো। শফিক একদিন স্কুল থেকে এসে দেখে মোটামুটি শহরের সুন্দরী এক নারী মায়ের সঙ্গে কথা বলছে, রান্নাঘরে বসে।
এই আপনার ছেলে চাচী আম্মা?–সেই নারীই প্রশ্ন করে শফিককে দেখে।
মা করিমুননেছা মাথা নাড়ান, হয় বউ, আমার বড় পোলা।
-আমাকে চিনছো? ভদ্রমহিলা প্রশ্ন করে শফিককে।
-না, মাথা নাড়ায় শফিক।
-ক্যামনে চিনবে? তোমাগো দেহেই নাই। শফিক, তোর মুরাদ চাচার মাইঝা পেলো গোলাম কিবরিয়ার বউ, তোর ভাবি অয়।
গোলাম কিবরিয়ার বউয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে শফিক। শহরের সাজুগুজু বউ গ্রামে খুব একটা দেখা যায় না। ভারী নিতম্বের অধিকারী মোটামুটি স্বাস্থ্যবান রিমির মা বলে, জানি না কত দিন থাকতে হবে, ছেলে-মেয়ের স্কুল কী করবো, বুঝতে পারছি না।
-হোনো বউ, করিমুননেছা বলেন, বিপদ আল্লায় দেয়। আবার আল্লায়ই আসান কইরা দেয়। আর কিবরিয়া হুনছি অনেক বুদ্ধিমান পোলা। ঠিক অইয়া যাইবে।
যৌবনের প্রারম্ভ দুয়ারের সম্মুখে দাঁড়িয়ে অনভিজ্ঞ শফিকের সামনে দুস্তর যন্ত্রণা ছাড়া আপতত কিছুই করার থাকে না। ঘুমিয়ে যায় অন্ধকারের শ্যামল চুম্বনের সঙ্গে।
দাঁড়ায় রিমির মা, ঠিক হলেই ভালো চাচি। এখন যাই। ছেলেমেয়ে দুটো কোথায় কে জানে? শফিকের কৈশোর উত্তীর্ণ বয়ঃসন্ধির শরীরের গোপন সুরভীত জেল্লা ছড়িয়ে দিয়ে চলে যায়। কয়েকদিনের মধ্যে জানা যায়, গোলাম কিরবিয়া মিলের অ্যাকাউন্টস বিভাগে চাকরি করে। বেশ কিছু টাকার হিসাব মেলাতে পারছে না। করিম জুট মিল কর্তৃপক্ষ মামলা করেছে। খুলনার খালিশপুরের বাসা থেকে তাই, ছেলে-মেয়ে-বউ নিয়ে উজানগাঁওয়ে ছোট চাচার বাড়িতে এসেছে, নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। যে বাড়িতে আগে থেকেই বাবা এসে থাকছে। উঠোনে নামলে, বাড়ির সামনে খালপাড়ে গেলে রিমির মায়ের সঙ্গে দেখা হয়। হয় টুকটাক কথাও। গোলাম কিবরিয়ার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। লম্বা গড়নের মানুষ। শরীরের রঙ ফর্সা।
কয়েকদিন থাকার পর গোলাম কিবরিয়া চাকরি উদ্ধারের অভিযানে খুলনা চলে যায়। রাতে শফিকের মা রুমে এসে জানায়, তুই মুরাদ চাচাদের ঘরে গিয়া ঘুমাবি রাতে।
-ক্যান? পড়া থেকে মুখ তোলে শফিক ।
-তোর ভাবি শহরের মাইয়া না? গ্রামে তো থাহে নাই। এতদিন গোলাম কিবরিয়া ছিল, রাইতে ভয় পায় নাই। ছোট ছোট দুইডা মাইয়া-পোলা লইয়া বউডা ডরে মইরা যাইবে। সন্ধ্যার আগে আইয়া আমারে কইয়া গেছে। আর বউডা ভালো। তুই পড়া শ্যাষ কইরা যাইস।
-মা, আমি পরের বিছনায় ঘুমাইতে পারি না।
-আমি কইছি বউরে। তোরে সামনের বারেন্দায় নতুন বিছানা কইরা দেবেআনে।
বিরক্ত শফিক, মা? মুরাদ চাচা তো আছে।
-হেয় বুড়া মানুষ। রাইতে ঘুমাইলে আর উঁস থাহে না। আর হে তো ঘুমায় পিছনের বারেন্দায়। পোলা-মাইয়া লইয়া বউ বড় ঘারের খাটে ঘুমায়। আমারে খুব কইরা কইয়া গেছে। মাইনষের বিপদে-আপদে থাকতে হয় বাজান। আমি ঘুমাইতে গেলাম। মা চলে যায় ঘরের ভেতরে। কিন্ত শফিক বিরক্ত। নিজের ঘরে নিজের বিছনায় যেভাবে ইচ্ছে ঘুমানো যায়, পরের ঘরে সম্ভব নয়। আর একটা বদ অভ্যাস শফিকের, ঘুমের ঘোরে লুঙ্গি উঠে যায়। নিচের দিকটা সদরঘাট হয়ে থাকে। যদি সকালে শহরের ভাবি দেখে, তাহলে? কান গরম হয়ে ওঠে। কিন্তু মা এমন করে বলেছে, না গিয়ে উপায় নাই।
ভূগোলের সাভানা অঞ্চলের পরিবেশ পরিচিতি পাঠ করে দরজা বন্ধ করে পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে যায় শফিক। রাত সাড়ে আটটা বাজে, পাশের বাড়ির শামসু ভাইয়ের ট্রানজিস্টারে রাত সাড়ে আটটার খবর পড়ছেন সরকার কবিরউদ্দিন। শফিকের ভয় ডর একটু কম। রাতে বিরাতে পুরো গ্রাম ঘুরে বেড়ানোর একটা দল আছে ওর। বাওনের খালের পাড়ের শাহাবুদ্দিন, নয়া বাড়ির মিলন মাঝি তিন জনে উজানগাঁওয়ের প্রত্যেকটা বাড়িতে রাতে ঘুরে বেড়ায়, শীতের সময়ে শিন্নি রান্না করে খায় জঙ্গলে চুলো জ্বালিয়ে। ছোট উঠান পার হয়ে মুরাদ চাচার ঘরের দরজায় ধাক্কা দেয় শফিক। দুই তিনটা ধাক্কা দেওয়ার পর বড় ঘরের ভেতর থেকে হালকা আলোর সঙ্গে পায়ের মৃদৃ শব্দও শুনতে পায়।
-কে? শফিক বুঝতে পারে রিমির মায়ের গলা।
-ভাবি, আমি শফিক।
-এক মিনিট। রিমির মা হারিকেনটা মাটিতে রেখে দরজা খোলে। ভেতরে ঢুকে শফিক দরজা বন্ধ করে তাকায় রিমির মায়ের দিকে। রিমি মায়ের মুখ ভয়ে ফ্যাকাসে রঙ ধারণ করেছে। কাঁপছে একটু একটু নাকের নথটা।
-কী অইচে ভাবি?
হাত ধরে খপ করে, জড়ানো গলায় প্রশ্ন করে, আসতে দেরি করলে কেন? ভয়ে আমার শরীর কাঁপছে, এই দেখো।
শফিকের ধরা হাত কাঁপছে থরথর করে, কেন ভয় পাইছেন?
ঘরের মধ্যে চলো। শফিকের হাত ধরে ঘরের মধ্যে যায় রিমির মা। বসে খাটে। খাটটা বেশ বড়। একপাশে রিমি আর আবির ঘুমে কাদা। পেছনের বারান্দা থেকে ভেসে আসছে মুরাদ চাচার হালকা নাকের ডাক। চারদিকে নিঝুম অন্ধকার। বাড়ির পেছন দিক থেকে ভেসে আসছে কয়েকটা কুকুরের কোরাস, ঘেউ ঘেউ ঘেউ। যা গ্রামের স্বাভাবিক ঘটনা। কুকুরের ঘেউ ঘেউ ডাকের সঙ্গে সঙ্গে রিমির মা শফিকের একেবারের শরীরের সঙ্গে নিজের শরীর লাগিয়ে বসে। জীবনে প্রথম কোনো যৌবনবতী নারী এভাবে শফিকের শরীরের সঙ্গে নিজের শরীর জড়িয়ে দেয়, যদিও ভয়ে, কিন্ত শফিকের জন্য অন্য অভিজ্ঞতা। ওর শরীর কেঁপে ওঠে শরীরের গভীর গোপন গন্ধে!
-এত কুকুর ডাকে কেন? রিমির মায়ের প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির পেছনে, পূর্বের দিকের জঙ্গলের ভেতর থেকে ডাকে একপাল শিয়াল, হাউ হাউ হাউ।
রিমির মা ডান হাতটা দিয়ে শফিকের গলা পেচিয়ে ধরে, শফিক কী হবে? আমার অনেক ভয় করছে।
হাসে শফিক, ভাবি ভয়ের কিছু নাই। রাইত অইলে জঙ্গলের ভেতর দিয়া শিয়াল আসে মুরহিগ ছাগলের লোভে বাড়ির আশেপাশে। আর হেই সমায় কুত্তাগুলান লড়ান দেয় শিয়ালদের। তখন এই ডাকাডাকি হরে ওরা।
-তাই বলে এত জোরে?
-আপনে নতুন আইছেন তো, সেজন্য আপনের কাছে জোরে মনে হয়। কয়েক মাস থাকলে সব ঠিক অইয়া যাবে।
শফিক চেষ্টা করছে খুলনা শহরের ভাবির সঙ্গে একটু শহরের ভাষায় বলতে। নিয়মিত রেডিওতে নাটক শোনে, গল্পের বই পড়ে শহর এবং গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রার একটা ছবি আঁকছে।
সকালে ওঠার অভ্যাস শফিকের, রাত নটা বাজলে বিছানায় যায়। চোখে ঘুম আসছে, ভাবি শুয়ে পড়েন। আমি যাই।
-আমি যাই মানে? কোথায় যাবে? রিমির মা প্রায় দুহাতে জড়িয়ে ধরে শফিককে।
রিমির মায়ের বড় বড় দুটি স্তন ওর পিঠের ওপর আছড়ে পড়েছে পাহাড়ের ভার নিয়ে। শরীরের ভেতরের শরীর গরমে উষ্ণতায় তেতে উঠছে। অভিজ্ঞতাহীন শফিক কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না, বিমূর্ত এই রাতে কী ঘটছে? কিছুটা হলেও জানে শরীরের খেলা।
-আমি সামনের ঘরে যাই।
-না, তুমি সামনের ঘরে গেলে আমি ভয়েই মরে যাবো। তুমি আমার পাশেই ঘুমাও। নবম শ্রেণীর ছাত্র শফিকের যেটুকু কাণ্ডজ্ঞান, জানে এইঘরে রিমির মায়ের সঙ্গে ঘুমানো ঠিক না। কিন্তু রমণীয় এক রমণীর ভয়ার্ত অন্ধকার রাত্রির কাতর আবেদন মঞ্জুর না করে পারে না শফিক।
পাশাপাশি দুটি বালিশ রাখলে শফিক একটা বালিশে মাথা রাখে। সঙ্গে সঙ্গে ওকে প্রায় জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে রিমির মা। ঘরের মধ্যে জ্বলছে হারিকেনের মৃদু আলো। যদিও প্রায় জড়িয়ে ধরে শুয়েছে রিমির মা, কিন্ত ভয় যাচ্ছে না। টের পাচ্ছে শফিক রিমির মা একটু একটু কাঁপছে। যৌবনের প্রারম্ভ দুয়ারের সম্মুখে দাঁড়িয়ে অনভিজ্ঞ শফিকের সামনে দুস্তর যন্ত্রণা ছাড়া আপতত কিছুই করার থাকে না। ঘুমিয়ে যায় অন্ধকারের শ্যামল চুম্বনের সঙ্গে। সকালে ঘুম ভাঙে পাখির ডাকে। হারিকেন এখনো জ্বলছে কিন্তু নিভু নিভু প্রায়। সারা রাত জ্বলতে জ্বলতে কেরোসিন ফুরিয়ে প্রায়। শফিক চট করে নিচের দিকে তাকায়, না লুঙ্গি ঠিকই আছে।
খালের পারে দাঁড়ালে উসমানের বাড়ির পরেই বিরাট এক কোলা-ধানের মাঠ। সেই মাঠ পার হলে কচানদী।
শফিক উঠে বসলে, ঘুম ভাঙে রিমির মায়ের। চট করে বসে, আবিষ্কার করে শরীরে শাড়ি নেই, কেবল ব্লাউজ আর ব্রা। বুকের অনেকখানি বের হয়ে গেছে। দ্রুত হাতে শাড়ি তুলে বুকদুটো আড়াল করে, ঘুম ভাঙলো তোমার?
-হ্যাঁ ভাবি, সকালে পাখির ডাকে মোর ঘুম ভাঙে। যাই। কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করে নেমে যায় বিছানা থেকে। নেমে ঘুরে দাঁড়ায়, তাকায় বিছনার ওপর। জীবনে প্রথম দেখে অসংবৃত কাপড়ে এক ঘুমভাঙা নারীর শরীরখানি। পাশে ঘুমিয়ে দুটি ছেলেমেয়ে, রিমি আর আবির। দরজা খুলে বাইরে আশে শফিক। আজকের সকালটা অন্য সকালগুলো থেকে একেবারেই অন্যরকম, ভিন্ন। মুরাদ চাচার ঘর থেকে উঠোনে নামে। পাশের বাড়ি থেকে গরুর হাম্বা ডাক আসছে। দক্ষিণের পোতায় আমজুর মা মুরগির খোপ ছেড়ে দিয়েছে। মুরগিগুলো উঠোনজুড়ে ক-ক করছে। সময়টা কার্তিকের মাঝামাঝি। সকালের দিকে হালকা কুয়াশা পড়ে। একটু শীতের বাও পাওয়া যায়। উঠোন পার হয়ে যায়, বাড়ির সামনে ছোট খালের পারে। খালে তিরতির স্বচ্ছ পানি বয়ে যায়। পানির মধ্যে কয়েকটা ছোট ছোট করহিনা মাছ সাঁতার কাটছে। খালের পারে দাঁড়ালে উসমানের বাড়ির পরেই বিরাট এক কোলা-ধানের মাঠ। সেই মাঠ পার হলে কচানদী।
শফিক চার হয়ে খালের অপরপারে যায়। হাঁটে রাস্তার ধারে খোলা মাঠের সবুজ ঘাসের ওপর। ঘন সবুজ ঘাস, ঘাসের সঙ্গে শিশিরের সংসার। দুটি পা ভিজে যায়, অবাক সুখে শফিকের শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে শিশির মাখানো ঘাসের ওপর। কতবার কতভাবে শিশিরে পা ডুবিয়েছে, পা ভিজে গেছে কিন্তু কখনো এমন সুখ অনুভব করেনি শফিক। পূবাকাশ রঙিন করে সূর্য উঠছে। ছড়িয়ে পড়ছে আলো কলাগাছের ডগার ফাঁক দিয়ে। সেখান থেকে চুইয়ে আসা আলোর বিন্দু চুম্বন খাচ্ছে শিশির বিন্দুর ওপর। বিন্দু বিন্দু শিশির কণার ওপর দেখতে পাচ্ছি গত রাতটাকে লুটোপুটি খেতে। কী সুন্দর মখমলে শরীরের সঙ্গে ভোরের শিশিরের সঙ্গত বাজে!
সকালে গোসল করে তৈরি হচ্ছে শফিক স্কুলে যাওয়ার জন্য। মা করিমুননেছা পান্তা ভাত আর পোড়া মরিচের সঙ্গে আধ টুকরো ডিম রেখে গেছে টেবিলের ওপর। রিমির মা এসে ঢোকে, তুমি কোথায় যাচ্ছ?
-ইস্কুলে যাচ্ছি।
চোখ রাখে ঘরের মধ্যে। এগিয়ে আসে শফিকের কানের কাছে, শোনো শফিক গতরাতে আমার খাটে যে তুমি ঘুমিয়েছিলে কাউকে বলো না যেন। ঠিকাছে?
মাথা নাড়ায় শফিক, বলবো কেন?
-লক্ষ্মী ছেলে! মাথার ঘনচুলে আদর করে ঘরের ভেতরে ঢুকে যায়, চাচি আম্মা কোথায়?
শফিক পান্তাভাত, পোড়া মরিচ আর ডিমের আধ টুকরো খেয়ে স্কুলে চলে যায়। দুপুরের পরই ফিরে ভাত খাচ্ছে শফিক। একটা তরকারির বাটি নিয়ে আসে রিমির মা। ওর পাশে রাখলে দেখে তিনটে বড় বড় টুকরো ইলিশ মাছ। ইলিশ মাছের একটা গন্ধে শফিক মুগ্ধ। দ্রুত একটা টুকরো পাতে নেয়।
করিমুননেছা পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন, আবার তুমি এসব আনতে গেলে কেন?
হাসে রমির মা, চাচি শফিককে ঘুষ দিচ্ছি। ও যদি না থাকতো গতরাতে তো ঘুমাতেই পারতাম না শিয়াল আর কুকুরের ডাকে।
-হয়, গত রাইতে কুত্তা আর হিয়ালগুলো বড় উৎপাত করছে, করিমুননেছা সমর্থন করে।
-জীবনে এইসব তো শুনি নাই, তার ওপর অন্ধকার রাত। ভয়ে কাঁপছিলাম থরথর করে। আর কী অবাক কাণ্ড, আমার শ্বশুর ঘুমিয়ে যায় সন্ধ্যার সঙ্গে সঙ্গে। কী করে যে থাকবো, বুঝতে পারছি না?
-তুমি চিন্তা কইরো না বউ। রাইতে গিয়া শফিক তোমার ঘরের সামনের খাটে ঘুমাইবে। ও একটা আজরাইল, কোনো কিচু ভয় পায় না, আশ্বাস দেয় করিমুননেছা।
-সেইটাই আমার একমাত্র ভরসা।
কুকুর আর শিয়ালগুলো গেলো কই? শালারা পুরো উজানগাঁওজুড়ে ডাকছে না কেন? ডেকে ডেকে ফানা ফানা করে ফেলুক উজানগাঁও।
দুপুরের খাবার খেয়ে শফিক চলে যায় ফুটবল খেলতে। ফুটবল খেলে সন্ধ্যার আগে হাত পা ধুয়ে ঘরে ঢুকে পড়তে বসে হারিকেন জ্বালিয়ে। কিন্তু মনোযোগী পড়ুয়া শফিকের চোখে বইয়ের অক্ষরগুলো অন্যরূপ ধারণ করে দেখা দেয়। অক্ষরগুলো রিমির মায়ের শরীরের মসৃণ রেখার মতো তরল ছবি আঁকছে। হাই তোলে শফিক। ঘরের দিকে তাকায়, মা যদি বলতো আজ পড়ার দরকার নেই। ঘুমুতে যা।
কিন্তু শামসুর রেডিওতে বাজছে সন্ধ্যা সাতটার সৈনিক ভাইদের জন্য অনুষ্ঠান দুর্বার। পড়া বাদ দিয়ে কান পাতে রেডিওর গানে। রেডিওতে অনুরোধের আসরে রুনা লায়লা গাইছেন তুফান ছবির গান, ‘ও নদীর পানি তোর মতলব জানি…/ তোর ছোঁয়ায় যৌবনে লাগলো কাঁপন…।’গানের অনুষ্ঠান দুর্বার শেষ হলে মা আসেন নামাজ শেষে, ভাত খাবি?
-দেন মা।
দ্রুত ভাত খেয়ে মুখ মুছতে মুছতে উঠোনে নেমে মুখের পানি কুলি করেই এক দৌড়ে এসে দাঁড়ায় রিমির মায়ের বন্ধ দুয়ারের সামনে। ধাক্কা দেয় দরজায়, সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে হাসি মুখে আমন্ত্রণ জানায় রিমির মা, এসো তোমার অপেক্ষায় ছিলাম।
ক্ষিপ্রতার সঙ্গে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে নিজেই দরজা লাগায় শফিক।
আজ একটু তাড়াতাড়ি এলে মনে হয়? রিমির মায়ের প্রশ্নে থমকে যায় শফিক। নিচের দিকে তাকায় ও। হাত ধরে রিমির মা, লজ্জা পাচ্ছ কেন? চলো, ভেতরে চলো।
সামনের বারান্দা থেকে ঘরের ভেতরে ঢুকেই শফিকের কেমন যেন লাগে। খাটের ওপর বসে পড়ছে রিমি আর আবির। আশা করেছিল গতরাতের মতো রিমির মা ভয়ে জড়িয়ে ধরবে। সারাদিন স্কুলে একটাই পাঠ নিয়েছে শফিক, সাহসের পাঠ। রিমির মা জড়িয়ে ধরলে শফিকও জড়িয়ে ধরবে। অথচ আজকের ভূগোলটা একেবারে ভিন্ন।
-বসো, তাড়া দেয় রিমির মা। নিজেও বসে খাটে, উজানগাঁওয়ে আসার পর ছেলে-মেয়েদের একদম পড়াশোনা হযনি। বন্ধ। তাই আজকে একটু পড়ানোর চেষ্টা করছি।
বসে শফিক খাটে কিন্ত ভেতরটা একেবারে সেদ্ধ চাল। কোনো বিদ্যুৎ নেই শরীরে। এদিহে রেডওিতে রাত সাড়ে আটটার খবর পড়ছেন আসমা আহমেদ মাসুদ। রাত বাড়ছে, অথচ আজ কোনো ভয়ের উপলক্ষ নেই। কুকুর আর শিয়ালগুলো গেলো কই? শালারা পুরো উজানগাঁওজুড়ে ডাকছে না কেন? ডেকে ডেকে ফানা ফানা করে ফেলুক উজানগাঁও।
চলবে…