[পর্ব—১৫]
‘চলে যাবো সুতোর ওপারে’
এক.
কিচ্ছু ভালো লাগছে না আর। আজ খুব মনে পড়ছে সেই
স্নিগ্ধশীলা এক ফুপুর কথা, নাম তার জমিলা খাতুন।
ছোটবেলা থেকেই আমরা তাকে পাগল্লি ফুপু ডাকতাম।
কবে, কখন, কেন তিনি পাগল হয়েছিলেন, সে কথা কখনো পরিবারে আলোচনা হয়নি। সেই বয়সে তা জানতেও চাইনি। তারপাগলামি নিয়ে পাড়ার বিভিন্ন বাড়ি থেকে অভিযোগ আসতো বলে সেই সবেই মনোযোগ ছিল সবার। পাগলামির কারণ খোঁজার অবকাশ পায়নি কেউ। বিশেষত, কিছুকাল আগে স্বামী মারা গেছে যার, কে আর ভাববে তার মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে। এমনকী তার দুই পুত্র সন্তান যখন খুবই উপযুক্ত তখনো তার কোনো সুচিকিৎসার ব্যবস্থা তারা করেনি।
জন্মের পরে থেকেই ফুপুকে পাগল অবস্থায় দেখেছি, শুধু জানতাম, তিনি আমার আব্বার ইমেডিয়েট আপন বড়বোন। ভাই ছোট হলেও কেন যেন আব্বাকে খুবই ভয় পেতেন। পারতপক্ষে আমার আব্বার সামনে পড়তে চাইতেন না তিনি। কিন্তু আব্বার অনুপস্থিতে বলতেন, হাবেজ আর আমারে কী কইবো, আমি ওর বড় বইন তো!
তাকে ঠিক উন্মাদ বলা যায় না, এক ধরনের ইলিউশনের মধ্যে বাস করতেন বলে মনে হতো আমার। এপাড়া-ওপাড়া ঘুরে বেড়াতেন একাকী। সঙ্গতিহীন কথা বলতেন, যখন যেটা মনে হতো। বাড়িতে ঢুকে আমাদের অংশের উঠানে দাঁড়িয়ে আমার মায়ের উদ্দেশে প্রায়ই বলতেন, তুমি নেহুয়া পড়ুয়া বৌ, তোমার ঘর থিকা চাল চুরি করলাম, তুমি জানলাই না।
ধারণা করি, আমার মায়ের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েই হয়তো এমন সব কথা বলতেন হাসতে হাসতে। তার প্রধান সমস্যাই ছিল না বলে এক গৃহস্থ্যের জিনিস অন্যজনকে দান করে দিয়ে আসা। কখনো কখনো নিজের গায়ের চাদর, পরনের কাপড়ও দিয়ে আসতো অন্যকে, যাকে তার ভালো লাগতো।
এই ফুপুর প্রতি মাকে কখনো বিরক্ত হতে দেখিনি।
যেহেতু তার স্বামীর বড় বোন, সেজন্যে মা সব সময় খুব বিনীত আচরণ করতেন তার প্রতি। ঘরে ডেকে নিয়ে খাওয়াতেন। ফলে অন্যত্র তার পাগলামি প্রকাশ পেলেও আমাদের প্রতি তিনি স্নেহময়ী ছিলেন। কারও গাছ থেকে হয়তো একটা পাকা পেয়ারা বা পেঁপে ছিঁড়ে এনেছেন, সেটি আমার না হয় ছোট ভাই সেলিমের হাতে গুঁজে দিয়ে চলে যেতেন।
কোনোদিনও জানা হলো কী দুঃখ ও বেদনাবোধ পাশরিতে পাগলের অভিনয় তিনি করে গেলেন এমন নিঁখুততর।
পরিবারের অন্যান্য সদস্যেরা তার প্রতি অনেক সময় অন্যায় অনেক আচরণ করেছে। পরনের নতুন একটি শাড়ি একজন ভিক্ষুককে দান করে দেওয়ার অপরাধে ফুপুর ছোট ছেলে একবার তার মায়ের গায়ে হাতও তুলেছিল।এনিয়ে আমাদের পরিবারের অনেকেই দীর্ঘদিন তার ওই ছেলের সংশ্রব ত্যাগ করে চলেছে। মায়ের গায়ে হাত তোলার এই অপরাধ যেন খোদার গায়ে হাত দেওয়ার মতো ক্ষমাহীন।
এই ঘটনার পরে ফুপু তখন প্রায়ই বলতেন, আমারে মাইরো না, খবরদার, আমি তোমাগো ভাতে মারবো, কাপড়ে মারবো, পানিতেও মারবো, সেই সময়টায় গ্রামের ঘরে ঘরে আবালবৃদ্ধবনিতা ট্র্যানজিস্টারে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতো প্রায়ই।
জানি না, ফুপুর অবচেতন স্তরে হয়তো বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের কিছু কথাও যুক্ত হয়ে থাকতে পারে। যেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘এরপর যদি ১টি গুলি চলে, এরপর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়। তোমাদের কাছে অনুরোধ রইলো, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাইনিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে, সবকিছু আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো। সৈন্যরা তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, তোমাদের কেউ কিছু কলবে না। কিন্তু আর তোমরা গুলি করবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না।’
আমার পিঠেপিঠি ছোট ভাই সেলিমকে খুব ভালোবাসতেন, কোলে করতে চাইতেন ফুপু। কিন্তু তার কোলে দেওয়া হতো না ভয়ে, কী করে বসে, সেই বিপদাশঙ্কায়! ছয় মাসের বয়স যখন সেলিমের, মা তাকে বারান্দার চৌকিতে রোদে শুইয়ে দিয়ে আমাকে বসিয়ে রেখে বাথরুমে গিয়েছেন। ইতোমধ্যে হঠাৎ করেই সেই সময় পাগলি ফুপু এসে তাকে কোলে তুলে নিয়ে বারান্দা থেকে নিচে নেমে সদ্য গোবর দেয়া ভেজা উঠানে শুইয়ে দিয়ে চলে গেলেন। আমি তো ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছি। সেলিমের চিৎকারে মা ছুটে এসে তাকে কোলে তুলে সোহাগে, চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিলেন। আমাকেসহ উপস্থিত সবাইকে ভীষণ বকা দিলেন। ততক্ষণে ফুপু পগারপার। আরও একবার ছোট্ট আমার শিশু মনে গেঁথে গেলো যে, মায়ের কাছে আমার চেয়ে আমার ভায়ের আদর বেশি।
আমাদের বাড়ির পেছনে উত্তর দিকে কোয়ার্টার মাইল দূরে ছিল এই ফুপুর বাড়ি। কাজেই তিনি থাকেন আমাদের মনপ্রাণজুড়ে খুচরো আনা-আধুলির মতো। তিন গ্রাম দূরে পাটাইকোণা বিয়ে হয়েছে ছোট ফুপুর। সারাজীবনে বারচারেক দেখেছি তাকে। ছোটখাটো মানুষ, মনটা খুবই স্বচ্ছ, ডাগর ও লাবণ্যে কচুলতার মতো।
পাগলি ফুপু আমার আব্বার মতোই লম্বা একহারা গড়ন, শ্যামলা লাবণ্যের পাতুরি যেন। শুধু মাথাটাই আওলা-ঝাওলা। কী আর করা। পরিবারের সদস্য বলে কথা। ফলে কেমন করে যেন তাকেও খুব ভালোবেসে ফেলি, যা কোনোদিনও তাকে বলা হয়নি একবারও। এই ফুপুর স্বামীর বাড়ি ছিল কালিগঙ্গার জলঘেঁষা নদীর পাড়েই। তার বাড়ির সি-গ্রিন রঙের কাঠের ঘরটি ছিল সবচেয়ে উঁচু। বারান্দায় দাঁড়ালে বর্ষাকালের খরস্রোতা কালিগঙ্গার ভীষণ মূর্তি দেখা যেতো মাভৈ মাভৈ রূপে।
চৈত্রমাসের গরমের সময়ে মনে হতো মায়াময় বারিধি এক। তখন আমাদের পুকুরের পানিও চণ্ডাল রূপে তেঁতে ওঠে গরমে। এ রকম সময়ে তখন নদীতে গোসল করার বায়না তুলতেন আগে হাওয়া আপা, সঙ্গে আমিও। মাঝে-মধ্যে নদীতে গোসল করতে মা তখন অনুমতি দিতেন। কালিগঙ্গার কালোজলে সাঁতরিয়ে গোসল শেষে এই ফুপুর বাড়িতে এসে কাপড় পাল্টাতাম। তারপর কাঁচা আম-ভর্তা মিষ্টি আলু সেদ্ধ নয়তো পোড়া আলু খেয়ে সমবয়সী বোনেরা মিলে গল্প করতে করতে বাড়ি ফিরে দুপুরের আহার করতাম।
বিলেত থেকে যখন এই ফুপুর বড় ছেলে বাড়িতে এলো, মনে আছে তখন জৈষ্ঠ মাস। পাকা আমের ধুম গাছে গাছে। ফুপুর বাড়িতে অনেক মিষ্টি আমের গাছ ছিল। তার বাড়ির খাটের তলাজুড়ে হলুদ রঙের পাকা আমে আলো ছড়াচ্ছিল বিদ্যুতের মতো। সেদিনই প্রথম ফুপুকে নিজ হাতে আম ছিলে সন্তানের পাতে দিতে দেখেছিলাম আমি। মাত্র ওই একদিনই।
সারা বছর সে আমাদের কাছে থাকা, পাশে থাকা ঝামেলা পাকানো পাগলি ফুপু, বড় আপনার সে যে। তখন কোথায় খায়, কোথায় ঘুমায় কিছুই জানি না। ওই একদিনই শুধু তাকে সন্তানের মাতৃরূপে সংস্থিতা হতে দেখেছিলাম। সেই একদিন ফুপুর চোখে মুখে অবিরল আনন্দ ঝরে যেতে দেখিছি আমি। শেষদিকে পাগলি ফুপু অসুস্থ হয়ে আমাদের পাশের গ্রামে তার মেয়ের বাড়িতে ছিলেন, সেখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কোনোদিনও জানা হলো কী দুঃখ ও বেদনাবোধ পাশরিতে পাগলের অভিনয় তিনি করে গেলেন এমন নিঁখুততর।
দুই.
তখন সময় ছিল স্বর্ণখচিত,স্বপ্নময়।
ভৈরব বাজারের রেলওয়ে হাই স্কুলটি আমার কাছে কেবল স্কুল নয়, সে যেন মেঘনা পারের বিদ্যামন্দির।এই স্কুলের শিক্ষকেরা যা শিখিয়েছে মেঘনা নদীর কলতান, তার উচ্ছল অথচ নির্বাক বয়ে চলার গতি, নীরবতা ও উদাসীনতা আমাকে কম কিছু শেখায়নি। অল্প দুঃখে কাতর, বেশি দুঃখে পাথর হতে শিখেছি এই নদীর কাছে পাঠ নিয়ে।
আমার মতো নদীকেও আমি কাতর হতে দেখেছি, তার মায়ের জন্যে। মায়ের প্রতি আমার অভিমান তখনো সরেনি। তাই বিশেষভাবে আমিই উদ্যোগ নিয়ে নীলুসহ মাঝে মধ্যেই যেতাম মেঘনা-পারে। স্কুলের মাঠ ছাড়িয়ে দশ মিনিট হেঁটে এলেই দুরন্ত এক ঘাস-সবুজের বন। তার পাশেই খানিকটা রুপালি বালুচর। তটরেখা বরাবর ওপারে তাকালেই শিল্পনগরী আশুগঞ্জ, মেঘনার জলে চরণ ডোবালেই যেন ছোঁয়া যাবে তাকে। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে আশুগঞ্জ উপজেলার রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব, তা আমরা সবাই জানি।
পেছন ফিরে তাকাতেই বার বার বড়মা আর খালুজানের ভেজা চোখ-মুখের স্মৃতি আমাকেও যেন কেমন সজল ও সকাতর করে তুলেছিল।
জনশ্রুতি ছাড়াও গুপ্তযুগে রচিত মহাভারত প্রণেতা মহর্ষী বেদব্যাসের পদ্ম পুরাণ গ্রন্থে যে ‘কালিদহ সায়র’-এর উল্লেখ পাওয়া যায় সেই কালিদহ সায়রের তলদেশ থেকে ধীরে ধীরে স্থল ও জনপদে পরিণত হয়েছিল এই আশুগঞ্জ। মেঘনার এপারে দাঁড়িয়ে সহপাঠীদের নিয়ে ওপারের আশুগঞ্জ দেখে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতাম সেই সময়ে।
স্কুলের একতলা ভবন পেছনে রেখে সামনে তাকালে হাতের ডানদিকে মেঘনা নদীর বুক চিরে দাঁড়িয়ে আছে ১৯৩৭ সালের ৬ ডিসেম্বর স্থাপিত কিং ষষ্ঠ জর্জ ব্রিজ। এই ব্রিজ স্থাপনের পরেই চালু হয়েছিল আশুগঞ্জ ও ভৈরববাজারের মধ্যে প্রথম রেলপথ সংযোগ। ভৈরব বাজার থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যেতে ব্রিজে পারাপার শেষ হতেই শুরু হয়ে যেতো আশুগঞ্জের সীমানা।
ভৈরবের মাটিতে দাঁড়িয়ে আশুগঞ্জ শহরটিকে দেখাও আমার জন্যে নতুন অভিজ্ঞতা। স্কুল ছুটির পরে তাই নীলুকে নিয়ে এই অভিজ্ঞতায় নুনের ছিটা দিতে আসতাম। সুদীর্ঘ ৬৫০ মাইল প্রবাহিত এই মেঘনা নদীই চারটি মোহানা পথে একদা মিলিত হয়েছে বঙ্গোপসাগরে। ভাবা যায়, মেঘনা কত উন্মাতাল ও উচ্চাভিলাষী নদী। অথচ তাকে দেখলে মনেই হবে না।
এতো শান্ত নদী কখনো সাগরে পৌঁছায়?
ভৈরব বাজারের মেঘনা তখন তরঙ্গসংকুল ছিল না মোটেও। একান্তই শান্ত শিষ্ট নদী মনে হয়েছে, যেন তাকে কোলে নিয়ে অনায়াসে বসে থাকা যায়। কারণ, মেঘনার দুকূলবাসী কখনো খুব বেশি উৎকণ্ঠায় নিদ্রাহীন রাত কাটায়নি, পদ্মাপারের জনপদের মতো। যদিও প্রাথমিকভাবে এর উৎসস্থল আসামের ‘বরাক’নদী।
এরপর সিলেট, সুনামগঞ্জ এবং হবিগঞ্জেরের বহু পথঘাট পেরিয়ে সুরমা-কুশিয়ারা-কালনি নাম পরিহার করে ভৈরব বাজারের কাছে পুরনো ‘ব্রহ্মপুত্র’ নদের সঙ্গে মিলিত হয়ে ‘মেঘনা’নাম ধারণ করেছে। এরপরে আরও দক্ষিণে এগিয়ে চাঁদপুরে এসে মেঘনাও পদ্মা নদীর মিলন-মধুর ধারাটিই মোহানা নামে পরিচিতি পেয়েছে।
অন্যান্য নদীর চেয়ে এই মেঘনা সবচেয়ে গভীরতম এবং দীর্ঘতম নদী।যা তার বাহ্যিক রূপ দেখে মনেই হয় না। কিন্তু ভেতরে-ভেতরে সে খুব গভীরতাগামী বলেই মেঘনা নদী সাহিত্যেও প্রভাব ফেলেছে বিস্তর। চল্লিশের দশকের কবি আহসান হাবীব ‘মেঘনাপারের ছেলে’ শিরোনামে কবিতা লিখে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। কবিতাটি পাঠ্যপুস্তকেও ছিল। ধারণা করি কবিতাটি অনেকেরই জানা।
কয়েকটি চরণ এরকম
আমি মেঘনা পারের ছেলে
আমি মেঘনা নদীর নেয়ে।
মেঘনা নদীর ঢেউয়ের বুকে
তালের নৌকা বেয়ে
আমি বেড়াই হেসে খেলে।
১৯১৭ সালে প্রগতিশীল ধারার এই কবি কিন্তু জন্ম গ্রহণ করেছিলেন বরিশালের শঙ্করপাশা গ্রামে।
মেঘনার কাছে গেলে বিকেলটা যেন হঠাৎ করেই মধুর হয়ে উঠতো। মনে হতো আমাদের গ্রামের সেই সাগরদিঘির পারে হাঁটছিলেন।এমনিতেও বাড়ি থেকে আসার পরে অভিমানের বেদনাবোধ যায়নি, ভেতরে ভেতরে এই ক্ষুব্ধ অভিমান আমাকে বিষণ্ন করে রাখে। নীলুকেও তো বলতে পারি না সব খুলে। কেবলি মনে হয়, ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েই চলে যাবো এখান থেকে।
সেদিন নীলুসহ চার বান্ধবী মেঘনার জলে পা ভিজিয়ে একটু একটু করে হাঁটছি হঠাৎ জলদেশ থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকাতেই দেখি সেই দুই বন্ধু তারা। সেই সাদা পোশাক, সেই মিটিমিটি হাসি। পাশে নীলুকে আস্তে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি ওদের আসতে বলেছ? নয়তো জানলো কী করে আমরা যে এখানে আছি আজ?
নীলু খুব মৃদু কণ্ঠে বললো, না আমি জাভেদকে কিছু দিয়ে চলতে শুরু করলাম। বলিনি, তবে বাবু জানে আমি এখানে আছি। হঠাৎ এতদিন পরে আমার যেন চক্ষু খুলে গেলো নীলুর কথায়। আমার সরল মন, এতদিন নিজের মতো করে ভেবেছি, বিশ্বাস করেছি নীলুকেও।
আজ মনে হলো, বাবুর সঙ্গে নীলুর একটা কিছু সম্পর্ক নিশ্চয় আছে, নইলে বাবুকে জানাতে যাবে কেন? নীলু আমার চেয়ে উচ্চতায় এবং গায়ে গতরেও বেশ বড়সড় ছিল। শ্যামলা রঙের লাবণ্যময় মেয়ে। ওর পাশে আমি প্রায় লিলিপুট। বাবুর বন্ধু জাভেদ। আমি নীলুর বন্ধু।
বাবু প্লাস নীলু হলে, জাভেদ প্লাস দিলু হলে ক্ষতি কী? নিশ্চয় এমন ভাবনা থেকেই এক বন্ধু অন্য বন্ধুর প্রতি অনবরত আমার মন গলানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। এ কথা আমার মাথায় ৩/৪ ইঞ্চি পেরেকের মতো ঢুকে গেলো পারমানেন্টলি। আমি আরও সতর্ক হয়ে উঠলাম। দেখতে দেখতে আমাদের ফাইনাল পরীক্ষাও শেষ হলো। আমি নীলুর প্রতি ততোধিক বিরক্তিবোধ নিয়ে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। যেখানে আমার নাড়ি পোঁতা আছে।
যাওয়ার দিন সেই পেয়ারা তলা, উঠোনবাড়ি আর কলপারকে হাই বলে ট্রেন স্টেশনে গিয়ে এক লাফে উঠে পড়লাম ট্রেনে। পেছন ফিরে তাকাতেই বার বার বড়মা আর খালুজানের ভেজা চোখ-মুখের স্মৃতি আমাকেও যেন কেমন সজল ও সকাতর করে তুলেছিল।
চলছে…
বালিকার চরৈবেতি-১৪॥ দিলারা হাফিজ