[পর্ব-১৪]
মা, তোর বদনখানি মলিন হলে
আমি নয়ন জলে ভাসি…
বয়ঃসন্ধি কাল পার করছি।
হৃদয়ে বসন্ত আসেনি এখনো, শরীর-মনেও নয়। এজন্যেই বোধ করি উর্দুভাষি জাভেদের কৃষ্ণমার্কা কথাবার্তা শুনে আমার বিরাগ যেন দিনে দিনে বিরক্তির একশেষ ডেকে এনেছিল। ভৈরব বাজার থেকে ফিরে যেন হাফ ছেড়ে বেঁচেছি।
বাড়িতে এসেই আবার আগের মতো মেতে উঠেছি চাচাতো বোন খেলার সঙ্গীদের নিয়ে। উত্তাল তরঙ্গের মতো নিজেদের উঠানে খেলার সঙ্গীদের নিয়ে চললো আমার নানারকম খেলা। ছিবুড়ি, কুতকুত, গোল্লাছুট ছাড়াও সমান তালে চলেছে পুতুল খেলাও।
কলকাতা থেকে আনা খুব সুন্দর বিস্কুটের একটা লম্বা টিনের বাক্স ছিল আমার নানির হেফাজতে। তার থেকে বাক্সটি নিয়ে আমার পুতুলের ঘরবাড়ি বানিয়েছিলাম অনেক আগেই। পড়তে যাওয়ার সময় সেগুলো বাড়িতেই রেখে গেছিলাম। নানির পুরনো সাদা নরম কাপড় দিয়ে হাতে বানানো পুতুল সেসব। মাথায় তাদের কালো সুতোর চুল, মেয়ে পুতুল। রঙ-বেরঙের শাড়ি পরিয়ে পাশাপাশি শুইয়ে রাখতাম তাদের।
এরকম ৬/৭টি পুতুল ছিল আমার। আমাদের বাড়ির রাখাল লালচানের বৌ, তাকে চাচি ডাকতাম। তারও পুতুল খেলার মতো বয়স। আমার চেয়ে সামান্য একটু বড় হবে হয়তো বা। সেই আগ্রহ ভরে অনেকগুলো পুতুল বানিয়ে দিয়েছিল আমাকে। তাকে দিয়ে পুতুল বানাতে গিয়ে, তার পাশে বসে থাকতাম। কেমন করে পুতুল বানায়, দেখতাম। মিয়াবাড়ির মেয়ে, তদুপরি সরাসরি মনিবকন্যা, এভাবে তার পাশে আমি বসে আছি, এজন্যে যেমন পুলকিত বোধ করতো, তেমনি আমাকে সে স্নেহও করতো, বুঝতে পারতাম। কেমন করে যেন তার সঙ্গেও আমার এক ধরনের বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল, হতে পারে তা অসম। এখনো তার জন্যে বুকের এক কোণায় জমে আছে শৈশব চাকের মধু ও মমতা।
মাকে কাছে না পাওয়ার দীর্ঘদিনের বিরহ যেন অনেকটাই দূর হলো এই জল-বসন্তের কল্যাণে।
তাকে অনুরোধ করলেই আমাকে সে বানিয়ে দিতো মেয়ে পুতুল, এভাবে বেশ কটি পুতুল জন্ম নিয়েছে আমার ঘরে। আমার সবগুলো মেয়ে পুতুল, সংসার বড় করতে ছেলে পুতুল লাগবে। কী করি? এরমধ্যে আলেয়ার ঘটকালিতে আরেক চাচাতো বোন বৈরানীর ছেলে-পুতুলের সঙ্গে ধুমধাম করে আমার মেয়ে পুতুলের বিয়ে দিলাম। বিয়েশাদি শেষ, কন্যা বিদায় করেছি, মনটাও খারাপ, এরমধ্যে এলো জ্বর। বেশ জ্বর সঙ্গে পেটে দুটো ফোস্কা মতন দেখা দিলো। মাকে দেখালাম।
সর্বনাশ! পক্স মনে হচ্ছে তো। জামা খোলো তো?
খুললাম, পিঠেও আছে বেশ কটি ফোসকার মতো। যা বোঝার মা বুঝে গেলেন, আমাদের দক্ষিণের ঘরে আমার জন্যে আলাদা বিছানা পাতা হলো নতুন একটা মশারিযোগে। এরপর মা বললেন, যাও শুয়ে পড়ো। মশারির বাইরে বেরুবে না মোটে, কেমন? দুদিনের মধ্যেই শরীরে দুর্দান্ত রকমের জলবসন্ত দেখা দিল। পেলব ত্বক ফুঁড়ে জল-রসদ নিয়ে মাথা উঁচু করে আছে অসংখ্য ফোস্কা। আগুনে পুড়লে যেমন হয়।
সেসব ক্ষতচিহ্ন এখনো আছে কপালে ও কপোলে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ডান কপালে ফুলে ফেঁপে ওঠা সেই ফোসকাগুলোতে সারাক্ষণ হাত চলে যেতো, তর্জনি দিয়ে ঘষে ঘষে সেসব ফুটিয়ে জল বের করে দিয়ে খুব মজা পেতাম। যদিও মায়ের বারণ ছিল। যে মুহূর্তে মা সাগু-বার্লি কিছু আনতে যেতো, সেই সময়ে মায়ের নিষেধ অমান্য করেই এ কাজে আনন্দ পেতাম।
সেই সময়ে মায়ের মুখে শুনেছিলাম ফকির লালনেরও নাকি এই বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। আমার এক পালকভাই ছিল, তাকে সবাই নজিরভাই বলে ডাকতাম। জলবসন্ত যখন প্রথমদিকে এলো দেশে, তখন তার মুখসহ সমস্ত শরীর ফস্কা পড়ে ফেটে গিয়েছিলে। সুতোহীন শরীরে কলারপাতায় শুয়ে রাখা হতো, দিনের পর দিন। ইমান দেওয়ানের ঝাঁড়-ফুঁক আর কবিরাজি চিকিৎসায় সে বেঁচে উঠেছিল বটে, কিন্ত তার মুখে এত গভীর ক্ষতচিহ্ন রয়ে গেছিল যে, কাউকে বলতে হতো না যে, তার একদা বসন্ত হয়েছিল।
মেয়েদের জলবসন্তে মায়েরা খুব চিন্তিত হয়ে পড়তো। বসন্তের বেশি দাগ পড়লে, সেই মেয়েকে বিয়ে দেওয়া কঠিন হয়ে পড়তে পারে। এজন্যে চুলকাতে বা ফোস্কা ভাঙতে নিষেধ করতেন। সেরে ওঠার পরে তো ডাবের জলে মুখ ধোওয়া, কাঁচা হলুদের সঙ্গে মশুরি ডালের প্যাগ তো চলতেই থাকতো বেশ কিছুদিন।
এই অসুস্থতা সূত্রে মাকে খুব কাছে পেলাম, হাতের স্পর্শে পেলাম সর্বক্ষণ। মশারির ভেতরে মায়ের হাতের নিমপাতার বাতাস খেলা করছিল আমার সঙ্গে। তার সেবা-যত্নে কখনো কখনো মৌসুমি সমুদ্রের পেটের মতো মশারি যেমন ফুলে ওঠে জীবনানন্দ দাশের হাওয়ার রাত কবিতায়, মায়ের পরম যত্নে, তার স্নেহশীল করতলের ছোঁয়া পেয়ে আমিও তরল আনন্দের উদ্গীরণে ফুলে ফুলে উঠছিলাম সেরকম।
দক্ষিণ ভিটার ঘরজুড়ে আমার রুগ্ণ বিছানা ছুঁয়ে অসংখ্য গোলাপ ফুটে উঠেছিল সেই নক্ষত্রভরা রাতে। অসম্ভব ভালো লাগার আনন্দে ভিজে যাচ্ছিল আমার অতীত বিরহকাতর রাত্রিদিনের হিসাব। মাকে কাছে না পাওয়ার দীর্ঘদিনের বিরহ যেন অনেকটাই দূর হলো এই জল-বসন্তের কল্যাণে।
দুই.
এই যাত্রায় তাই অনেকদিন বাড়িতে থাকা হলো আমার। মাত্র একটু সুস্থ হয়ে উঠেছি, এমন সময়ে হঠাৎ জাবরা থেকে আমাকে নিতে এসেছে লকেট ভাই। আজকেই ভৈরববাজার যেতে হবে। ননী মামা বাড়িতে অপেক্ষা করছেন আমার জন্যে। যেহেতু পরীক্ষাও আসন্ন, কাজেই না যাওয়ার ছল-ছুঁতো ধোপে খুব বেশি টিকবে না।
কিন্তু, কী করি, কী করবো, ভাবছি কেবলি। কিছুতেই ভৈরবে যেতে আর ইচ্ছে করছে না। বাড়িতে থাকার আকুতি ডালপালা মেলে আমাকে আড়াল করতে চাইছে।অধিকন্তু অপরিপক্ব বয়সে এমন প্রেমের প্রস্তাব ভৈরবের প্রতি আমার মনকে খানিকটা বিষিয়ে তুলেছে বৈকি। নীলুকেও আর আপন মনে হচ্ছে না। নানা কিছু চিন্তা করেই দক্ষিণভিটার ঘরে খিল এঁটে দিলাম প্রথম। তারপর মাটিতে ঘষে ঘষে পাজামা দুটো ময়লা করে নিলাম। না যাওয়ার জন্যে মাকে আর কী অজুহাত দেওয়া যেতে পারে—সেই চিন্তা করছি ঘরে খিল তোলা অবস্থায়।
এমন সময় দরোজায় খটখট শব্দ। মায়ের গম্ভীর গলার নির্দেশ।
দরোজা খোলো।
খোলো দরোজা।
ভয়ে ভীত বেড়াল ছানার মতো আস্তে দরোজা খুলে দিলাম।
মা ঘরে ঢুকে আমার বিছানার পাশে বসলেন। তারপর বললেন, এখনো রেডি হওনি, যেতে হবে তো! ভয়ে ভয়ে একটু ইতস্তত, কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললাম, কিভাবে যাব! আমার দুটো পাজামাই ভীষণ ময়লা, কী পরে যাব? এত ময়লা পাজামা পরে কি বাইরে যাওয়া যায়?
মা আমার হাতের পাজামা দুটো দেখলেন, কণ্ঠ আরও গম্ভীর করে বললেন, বসো এখানে। চোখের ইশারায় তার মুখোমুখি বসার নির্দেশ দিয়ে নিজেই আবার দরোজায় খিল তুলে দিলেন। আমি বসলাম কাঁচুমাচু এক ভঙ্গিতে। শোন মেয়ে, তুমি যদি না যেতে চাও, যাবে না। কিন্তু আগামীকাল থেকে শেফালির মাকে কাজে আসতে না করে দেবো। ভোরসকালে উঠে চুলার ছাই ফেলা থেকে শুরু করে গোয়ালের গোবর ফেলা, ধান সেদ্ধ, পাট শুকানো, রান্নাবাড়ার সব কাজ তোমাকে করতে হবে।
কিন্তু শব্দের তালে বার বার মনের অতলপার থেকে ভেসে আসছে আরও ছোট ক্লাসে পড়া কাজী নজরুল ইসলামের ‘ভোর হলো’কবিতাটির কথাগুলো। বিড়বিড় করে আপন মনে আমি আওড়াচ্ছি সেই কবিতাটিকে।
ভেবো দেখো তুমি কী করবে?
মায়ের কথাগুলো, প্রত্যেকটা শিলানুড়ি পাথরের মতো আমার মনের গায়ে এসে আঘাত করছিল, রক্তাক্ত হচ্ছিল মায়ের প্রতি আমার এ যাবতকালের যত ভালোবাসা। মাকে একজন চূড়ান্ত নিষ্ঠুর মানুষ মনে হলো।
হঠাৎ করে ভীষণ জিদ চেপে গেলো। মায়ের কথার একটি জবাব না দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে হন হন করে বাড়ির ঘাট পর্যন্ত এসে, সোজা জাবরা যাওয়ার জন্যে ঘাটে বাঁধা ভাড়া করা একমাল্লাইয়ের নৌকার ভেতরে উঠে বসলাম। একবারও পেছন ফিরে তাকালাম না। বুঝতে পারছি মা আমার পেছন-পেছন ঘাট পর্যন্ত আসছেন। খাবার কথাও বললেন, মৃদু কণ্ঠে।
কার খাবার আর কে খাবে!
মায়ের কথা যেন আমার কানে না পৌঁছায়, সেজন্যে পেছনের গুলুইয়ের মাথায় গিয়ে বসে রইলাম। চোখের ভেতরে জল কাঁপছে, কিন্তু পড়তে দিচ্ছি না, কেবলি মনে হচ্ছে, মা এত নিষ্ঠুর হতে পারে সন্তানের প্রতি?
মা কি আমাকে ভালোবাসেন না তাহলে?
যখনই ভাবছি, সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসার কথা, নিজের মনেই তখন নিজেকে প্রশ্ন করছি, ঝরঝর করে দুচোখের জল আমাদের খালের পানিতে যেন জোয়ার তুলে দিচ্ছে।
ঘাটের দিকে পেছন দিয়ে বসেছি, যেন আমার চোখ-মুখ, কান্না কেউ দেখতে না পায়। অনন্ত আকাশই আজ আমার মা। ঐ ঘাটে দাঁড়ানো বেগম রহিমা হাফিজ কেউ নয় আমার। অনন্ত জলধারা আমার বাবা, আমি একা, ভীষণভাবে একা—এইবাড়ি-ঘর কেউ আমার আপন নয়।
এই মুহূর্ত থেকে আমি যেন এক অন্য আমি।
আমার খাতাপত্র, পোশাক পরিচ্ছেদের বাক্সখানা কে যেন নৌকায় তুলে দিলো। লকেট ভাই পায়ের কাদা ধুয়ে নৌকাং উঠে পাটাতনে বসলেন। নৌকা ছেড়ে দিলো। গড়পাড়া গ্রামের বিষণ্ন ঘাট, খেলার সঙ্গী আলেয়া, শেফালি, টুলি সবই পড়ে রইলো পেছনে।
খাল পেরিয়ে নৌকা যখন কালিগঙ্গার মাঝ দরিয়ায় ঢেউয়ের মধ্যে এসে পড়লো, তখনো আমি গুলুই আঁকড়ে ধরে বসে আছি। লকেট ভাই দুবার ডেকে নায়ের ছইয়ের ভেতরে গিয়ে বসতে বললেন।
আজ আমি ভীষণ নাছোড়। কারও কথা শুনতে প্রস্তুত নই।
অসীম জলরাশির মধ্যে নিজেকে বিলীন করে দিতে বদ্ধপরিকর। মনে মনে খুব প্রার্থনা করছি, আমাদের নৌকাটি ডুবে যাক, আমি মরে যাই যেন। আমার মা যেন বুঝতে পারে আমার প্রতি, আমার ভালোবাসার প্রতি তিনি অন্যায় আচরণ করেছেন। আমি তো শুধু তাকে ভালোবেসে তার কাছে আর ক’টা দিন থাকতে চেয়েছি। এই চাওয়া কি খুব অন্যায়?
লকেট ভাইয়ের মুখে সব শুনে ননী মামা খুব স্নেহের স্বরে কাছে ডাকলেন। নিজের পাশে বসিয়ে ভাত খেতে বাধ্য করলেন একপ্রকার। মামি সেদিন গরম মশলাযোগে কষিয়ে শুকনা ঝোলের বাইম মাছ রেঁধেছেন। ছোট চিংড়ি দিয়ে করলা ভাজি, কচি কাঁচা লাউপাতার হাতে-ডলা ভর্তা।
তার সঙ্গে দিয়েছিলেন কুচি করে কাটা রসুন, পেঁয়াজ, টালা শুকনা মরিচ আর শর্ষে তেলের ঝাল মিশ্রণ এবং বিলম্ব দিয়ে অসাধারণ টক-ডাল রেঁধেছিলেন সেদিন তিনি। আমার মন যদিও খুব বিষণ্ন তবু খেতে বেশ ভালো লাগছিল। দীর্ঘক্ষণ কিছু খাইনি, সেটিও একটি কারণ।
ননী মামা লকেট ভাইসহ আবার সেই ভৈরবের পথ আমাকে ভীষণভাবে উদাসীন করে দিল। ট্রেনের আকর্ষণীয় শব্দনাচ আজ আর ভাল্লাগছে না। কিন্তু শব্দের তালে বার বার মনের অতলপার থেকে ভেসে আসছে আরও ছোট ক্লাসে পড়া কাজী নজরুল ইসলামের ‘ভোর হলো’কবিতাটির কথাগুলো। বিড়বিড় করে আপন মনে আমি আওড়াচ্ছি সেই কবিতাটিকে।
ভোর হলো দোর খোল
খুকুমনি ওঠে রে,
ঐ ডাকে জুঁই-শাখে
ফুল-খুকি ছোট রে।খুলি হাল তুলি পাল
ঐ তরি চলল,
এইবার এইবার
খুকু চোখ খুলল।
আমি কি তোমার খুকু মা?
অন্যমনস্ক হয়ে ভাবছি, আমার মা কি আমার মতোই কষ্ট পাচ্ছে, না কি আমিই কেবল মাকে ভুলতে পারছি না!
চলবে…
বালিকার চরৈবেতি-১৩॥ দিলারা হাফিজ