[পর্ব-৪২]
সকালের নাস্তা শেষে হিরোদের বাড়ি থেকে বের হবো—এমন সময় সে বললো, ‘ভাইয়া দুপুরে খেয়ে-দেয়ে বিকালে যান। আমি ছন্দ ভালো করে বুঝিনি। আমাকে ছন্দ ও ছড়া লেখার নিয়মগুলো বুঝিয়ে দিয়ে যাবেন। দুপুর পর্যন্ত থাকলে বুঝে ফেলবো।’ কী আর করা! একে তো মেধাবী, এরওপর বন্ধু-দিদাদের মামাতো ভাই। এর মানে তো আমারও মামাতো ভাই। আবার আমার ছন্দশাস্ত্রের ছাত্র। ছাত্রের অনুরোধ উপেক্ষা করার মতো এত হৃদয়হীন হতে পারিনি। তাই রয়ে গেলাম।
রয়ে তো গেলাম, কিন্তু দুপুর পর্যন্ত একটানা কি ছন্দশাস্ত্র বোঝাবো হিরোকে? ওর যত আগ্রহ শেখার, আমার শেখানোর ততটা নয়। আমার আগ্রহ বরং তাদের পুকুরপাড়ের বিশাল বিশাল বৃক্ষরাজি দেখা। একেকটা কড়ই গাছ কত মোটা! এত মোটা ও চারিদিকে ডালপালা ছড়িয়ে পড়া কড়ই গাছ এর আগে দেখিনি। সেই কড়ই কাছে আবার বাসা বেঁধেছে নানা রকমের পাখি।
বাড়ির সামনের ক্ষেতে টমেটো, মরিচ, ক্ষিরা সারিসারি। তারই একপাশে বেগুনি ফুল ফুটে আছে শিমের লতায় লতায়। এই শিমফুলের আকর্ষণে প্রায় বিমোহিত হয়ে যাই। মনে পড়ে আরও ছোটবেলার কথা। শিমফুলের শোভা দেখতে দেখতে ইসমাইলকে নিয়ে ঢুকে পড়তাম, ঝোপের ভেতর। ঝোপের ভেতরে ঢুকে পড়লেই রাজ্যের বিস্ময় অপেক্ষা করতো। ঘুঘুর বাসা। ঘুঘুর ছানা। ঘুঘুর ডিম। দুই ভাই সেই ঘুঘু ধরে এনে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে বানানো খাঁচায় ভরতাম। দিনভর পাখিগুলো ডানা ঝাপটাতো। আমরা এটা-সেটা খেতে দিতাম। পাখিগুলো খেতো না। রাতে ঘরের চালের সঙ্গে খাঁচাগুলো ঝুলিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। সকালে ঘুম ভাঙতেই প্রথমে খাঁচার দিকে তাকাতাম। প্রায় দেখা যেতো পাখিগুলো আর জীবিত নেই। বেড়ালের থাবায় প্রাণ গেছে তাদের।
হিরো আমার কথা কতটুকু বুঝলো, টের পাওয়া গেলো না। তবে, শেখার প্রতি তার যে তীব্র আগ্রহ, তা পরিষ্কার বোঝা গেলো।
হিরোদের শিমের ঝোপের দিকে এগোতে এগোতে ভাবি, এখানেও ঘুঘু পাখি পাওয়া যাবে তো! কিন্তু ঝোপের কাছে গিয়ে দেখি, পাখি নেই। তবে অসংখ্য বেগুনি ফুল ফুটে আছে। হিরোকে বলি, ‘দেখো। শিমফুলগুলো কী সুন্দর!’ আমার কথায় বিস্ময়ভরা চোখে তাকায় সে। বিড়ালপায়ে এগিয়ে আসে ঝোপের কাছে। দুজনেই ক্ষেতের আল ধরে হাঁটি। আর শিমফুলে আলতো করে হাত বোলাই। আমাদের হাতের ছোঁয়ায় ফুলের রেণুগুলো ঝরে যায়। হাতেও লাগে। হঠাৎ একজন বয়স্ক মানুষের ডাকে আমাদের ঘোর কাটে। তিনি প্রায় চিৎকার করে বলেন, ‘ওই বাচ্চারা! তোমরা ফুলের রেণু নষ্ট করছ কেন?’ প্রশ্ন করতে করতে আমাদের কাছে চলে আসেন। থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি। কী বলবো, বুঝতে পারি না। আমতা আমতা করতে থাকি। আমার অবস্থা বেগতিক দেখে দেবদূত হয়ে দাঁড়ায় হিরো। বলে, ‘আমরা রেণু নষ্ট করছি না তো। কেবল ফুলগুলোর ওপর হাত বোলাই।’ লোকটি এবার গলার স্বর রেশম কোমল-নরম করে বলেন, ‘শোনো বাবারা, এই ফুলের ওপর এভাবে হাত বোলালে রেণুগুলো তোমাদের হাতে লেগে ঝরে যাবে। তখন আর পরাগায়ণ হবে না। পরাগায়ণ না হলে এই ফুলগুলো থেকে আর শিমও হবে না। বুঝতে পেরেছ?’ পরাগায়ণ কী, এর কাজ কী, পাঠ্যবইয়ের কল্যাণে এই বিষয়ে দুজনেই মোটামুটি জানি। তাই লোকটির কথায় প্রায় লজ্জিত হয়ে বলি, ‘জি। বুঝেছি। আর হাত বোলাবো না।’ আমাদের উত্তরে লোকটি সন্তুষ্ট হলেন কি না, বোঝা গেলো না, তবে তিনি হন-হন করে চলে গেলেন দক্ষিণের দিকে। যেদিক দিকে শীতের হিমেল হাওয়া ঝিরঝির করে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। আর বাঘের থাবা মেলে ধরছে আমাদের চোখে-মুখে-কানে। কানের কাছে হাত দিয়ে দেখি, কান যেন ঠাণ্ডার ছুরিতে কেটে যাবে।
ক্ষেতের আল ধরে হেঁটে হেঁটে কাছারিতে ঢুকি। ফের খাতা কলম নিয়ে বসি। আমি স্বরবৃত্তের চরণ, পর্ব, মাত্রার সূত্র খাতায় লিখি আর জোরে-জোরে উচ্চারণ করি, ‘প্রতি চরণে চার পর্ব। প্রতিপর্বে চার মাত্র। শেষ পর্ব অপূর্ণ।’ মাত্রাগণনার সূত্র বলি, ‘বদ্ধাক্ষর একমাত্রা, মুক্তাক্ষরও একমাত্রা।’ হিরো বলে, ‘বদ্ধাক্ষর কী? মুক্তাক্ষর কী?’ জবাবে বলি, ‘‘যে অক্ষরের সঙ্গে স্বরধ্বনি যুক্ত থাকে, যে অক্ষর টেনে পড়া যায়, তাকে মুক্তাক্ষর বলে। যেমন, ‘মাতা’। এখানে দুটি মুক্তাক্ষর। ‘মা’ একটি; আর ‘তা’ আরেকটি। আবার যে অক্ষর উচ্চারণ করার সময় স্বর আটকে যায়, তাকে বদ্ধাক্ষর বলে। বদ্ধাক্ষর দুটি বর্ণের সমন্বয়ে গঠিত হয়। যেমন, ‘সব’। এখানে ‘সব’-এর উচ্চারণ কিন্তু ‘মাতা’র মতো প্রবহমান নয়। তাই এই অক্ষরকে বদ্ধাক্ষর বলে।’’ এবার হিরো বলে, ‘তার মানে অ, আ, ক, খ, গ এগুলো অক্ষর নয়?’ বলি, ‘না। এগুলো বলো বর্ণ। এগুলোর সঙ্গে স্বরধ্বনি বা ব্যাঞ্জনধ্বনি যুক্ত হয়ে অক্ষর তৈরি করে।’ ভাবলাম, হিরো এবার থামবে। কিন্তু না। সে থামার পাত্র নয়। তার প্রশ্নের স্রোত যেন বহুযুগ ধরে কোনো এক আদিম পাহাড়ে আটকে থাকা ঝরনা। হঠাৎ বাঁধ কেটে যাওয়ায় উছলে পড়ছে, লাফিয়ে ছুটছে। সেই বাঁধভাঙা প্রশ্নেরই একটি এবার ছুড়লো, ‘চরণ কী, পর্ব কী?’
ছাত্র যখন জটিল প্রশ্ন করে, শিক্ষককে তখন কিছুটা সিরিয়াস মুড নিতেই হয়। আমিও নিতে বাধ্য হলাম। মুখ গম্ভীর করে বলি, ‘মনোযোগ দিয়ে শোনো। আর খাতায়ও লিখে দিচ্ছি। এক দিনে কিন্তু সব আয়ত্ত করতে পারবে না। জানো তো, ছন্দশাস্ত্র হলো দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিন শাস্ত্র?’ হিরো আমার কথা কতটুকু বুঝলো, টের পাওয়া গেলো না। তবে, শেখার প্রতি তার যে তীব্র আগ্রহ, তা পরিষ্কার বোঝা গেলো। সে বলে, ‘আপনি শিখিয়ে দিন। আমি দিনরাত প্র্যাকটিস করে মুখস্ত করবো।’
এসব ভাবনা আমার মানসচক্ষে মস্ত বড় একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন দাঁড় করিয়ে দেয়। আমি সেই চিহ্ন সরিয়ে না হিরো, না তার মায়ের চোখের দিকে তাকাতে পারি।
এবার যেন তাকে জব্দ করার মোক্ষম সুযোগ পেলাম। বলি, ‘‘ছন্দশাস্ত্র মুখস্ত করার বিষয় না বোকা। আত্মস্থ করার বিষয়। আত্মস্থ করো। ধ্যান করো। তাহলে পারবে। না হলে সকালে মুখস্ত করবে, বিকালে ভুলে যাবে। বুঝেছ? ছন্দশাস্ত্র হলো, ‘যতই পড়িবে, ততই শিখিবে; যতই শিখিবে, ততই ভুলিবে’।’’ কথাটা কার কাছে শুনেছিলাম, তার নাম মনে নেই। কিন্তু কথাগুলো মনে আছে। এবার যেন হিরো মুখ শুকিয়ে গেলো। গলা শুকিয়ে এলো। মুখ গোমরা করে চুপ করে বসে আছে। তার এই করুণ চেহারা দেখে নিজেকে দিগ্বিজয়ী বখতিয়ার খিলজি মনে হলো। এবার খুব ভাব নিয়ে বললাম, ‘শোনো তাহলে, একটি পূর্ণ বাক্যকে চরণ বলে। আর চরণের অন্তর্ভুক্ত সমমাত্রার বাক্যাংশ যা পাঠের সময় যেটুকুতে সামান্য বিরাম নিতে হয়, তাকে পর্ব বলে।’ এরপরই উদাহরণ হিসেবে কবি জসীম উদ্দীনের ‘রাখাল ছেলে’ পদ্যের দুই লাইন লিখলাম খাতায়:
রাখাল ছেলে/রাখাল ছেলে/ বারেক ফিরে/ চাও
বাঁকা গাঁয়ের/ পথটি বেয়ে/ কোথায় চলে/ যাও?
এরপর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের পালা। আমি খাতায় লিখে লিখে তাকে বোঝাচ্ছি, সে চোখ গোল গোল করে সবিস্ময়ে তা আত্মস্থ করার চেষ্টা করছে। আমি বলছি,
রা=১, খাল=১, ছে=১, লে=১/রা=১, খাল=১, ছে=১, লে=১/ বা=১, রেক=১, ফি=১, রে=১/ চা=১, ও=১//=(৪+৪+৪+২)
বাঁ=১, কা=১, গাঁ=১, য়ের=১/ পথ=১, টি=১, বে=১, য়ে=১/ কো=১, থায়=১, চ=১, লে=১/ যা=১, ও=১?//=(৪+৪+৪+২)
অর্থাৎ এখানে অবলিগ (/) দিয়ে পর্ব বিভাজন করলাম। এরপর প্রতিটি অক্ষরের পাশে= চিহ্ন দিয়ে এর সামনে ১ লিখে মাত্র সংখ্যা বোঝালাম। এখন প্রত্যেক অবলিগ চিহ্নের আগে প্রথম তিন পর্বে ৪ মাত্রা করে এবং শেষ পর্বে ২ মাত্রা করে আছে। এছাড়া দুই চরণের শেষে ‘চাও’ শব্দের সঙ্গে ‘যাও’ শব্দের ধ্বনিগত মিলও আছে। হিরো এই মিল দেখে বলে, ‘এই তো ছন্দ।’ বলি, ‘না। এটা ছন্দ নয়। ছন্দের সঙ্গে এই মিলের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা হলো অন্ত্যমিল। এর অন্য এক নামও আছে। তাকে বলে অনুপ্রাস। অন্ত্যমিল-অনুপ্রাস পরে শিখবে। আপাতত চরণ-পর্ব-মাত্রা শিখে নাও। দেখো ওপরের উদাহরণে কী আছে? প্রতি চরণে ৪+৪+৪+২ এভাবে হিসাব পাচ্ছ তো?
হিরো অনেকক্ষণ ধরে খাতায় মনোযোগ দিয়ে দেখে। এরপর আঙুলের কড়ে হিসাব করে। এরপর কাজী নজরুলের ‘সংকল্প’, শামসুর রাহমানের ‘পণ্ডশ্রম’ আল মাহমুদের ‘না ঘুমানোর দল’-এর চরণ-পর্ব-মাত্রা বিশ্লেষণ করে আমাকে দেখালো।
আমরা যখন পদ্য-ছড়া নিয়ে গভীর আলোচনায় মগ্ন, তখন হিরোর মা এসে আমাদের পেছনে দাঁড়ালেন। খুব নরম গলায় বললেন, এসব অনেক ওপরের ক্লাসে পড়ানো হয়। তোমরা এই ছোট্ট বয়সে এগুলো শিখে কী করবে? তোমাদের তো লেখাপড়া নষ্ট হয়ে যাবে বাবা! এসো দুপুরের খাবারের সময় হয়েছে। খেতে এসো। হিরোর মায়ের কথায় আমি যেন কিছুটা উদ্যম হারিয়ে ফেললাম। আমার ভেতরে অপরাধবোধও কাজ করতে শুরু করে দিয়েছে। তবে কি হিরোকে বিপথে নিয়ে যাচ্ছি? নিজে দুর্বল ছাত্র হওয়ায়, একজন মেধাবী ছাত্রের ক্যারিয়ার ধ্বংস করার হাতিয়ার তুলে দিচ্ছি সচেতনভাবেই তার হাতে? আমি দ্বিধাগ্রস্ত। মাথার ভেতর ন্যায়-অন্যায়, ক্যারিয়ার-ভবিষ্যৎ, শিল্পচর্চা, কবি হওয়া, বড় অফিসার হওয়া, ডাক্তার হওয়া, ইঞ্জিনিয়ার হওয়া—এমন হাজারো ‘হওয়া’র যৌক্তিক-অযৌক্তিক বিষয় কিলবিল করছে। মনে হচ্ছে কপালের দুই পাশের শিরা দুটি ছিঁড়ে যাবে। লজ্জায় পালাতে পারলেই বাঁচি। হিরো আমার মুখের দিকে তাকায়, আমি তাকাই মাটির দিকে। ইচ্ছে হচ্ছে নিজের হাত নিজেই কেটে ফেলি। অথবা নিজের চুল ছিঁড়ে ফেলি। আবার নিজেকে প্রশ্ন করি, ‘কী হয়েছে? আমি এমন ভাবছি কেন? আমাকে কি অপমান করা হয়েছে? নাকি কেউ বকেছেন? মামি তো তার সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের চিন্তাই করবেন। তার সন্তান কবিতাচর্চার নামে গোল্লায় যাবে, এটা তো হতে পারে না। না কি পারে?’ এসব ভাবনা আমার মানসচক্ষে মস্ত বড় একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন দাঁড় করিয়ে দেয়। আমি সেই চিহ্ন সরিয়ে না হিরো, না তার মায়ের চোখের দিকে তাকাতে পারি।
চলবে…