[কিস্তি-৪]
পরের দিন সকালে অতুলের বাড়িতে হাজির নূর আলম। চেহারায় চাপা একটা উত্তেজনা। মাধবীকে দেখে জিজ্ঞেস করে, অতুল কনে কাকি?
—ওমা এ কীডা! আমাগের ছোট হুজুর যে। নূর আলমকে দেখে খুশি ছড়িয়ে পড়ে মাধবীর চোখেমুখে।
—নন্দীরে নে বাড়িত্তে বেরোলো এট্টু আগে। নদীর দিকি গেচে বুদায়। দেকো খোঁজ করে।
নদীর পাড়ে যেখানে অতুলের থাকার সম্ভাবনা সেখানে নেই সে। সেই বুড়ো বটের তলে গিয়ে খোঁজ করেও পাওয়া গেলো না তাকে। আমগাছের নিচেও নেই। গেলো কোথায় সে? ভাবনায় পড়ে যায় নূর আলম। কোনো অঘটন ঘটলো না তো? অজানা আশঙ্কায় কেঁপে যায় তার বুক। মুখটা শুকিয়ে ওঠে বন্ধুর জন্য দুশ্চিন্তায়। নতুন উদ্যমে খুঁজতে শুরু করে। অবশেষে পুরনো মন্দীরে গিয়ে মেলে তার খোঁজ। মন্দীরে ঢোকার আগেই অতুলের গলা শুনতে পায় সে।
-নে এবার একটা খেজুরির পাতা খেয়ে দেখ কিরাম লাগে। ভালো করে চাবাবি, দেখসেনে মিষ্টি লেগবেনে। শোন্, আমরা আর রাস্তার দিকি আপাতত ক’দিন যাবো না। বকরা ঈদ বেরোই গিলি তারপর ওদিকি যাবো, বুইচিস?
নন্দীর মুখে পাতা গুঁজে দিতে দিতে তার সাথে কথা বলছে অতুল। নন্দীর সামনে আম, কাঁঠাল, কিছু কাঁচা ঘাস আর খেজুরের পাতা আলাদা করে রাখা। কোনটার কী স্বাদ সেটাই বর্ণনা করছে আর খাওয়াচ্ছে। যেন নিজে সেগুলোর প্রতিটির আলাদা করে স্বাদ নিয়েছে। পেছন ফিরে থাকায় নূর আলমকে দেখতে পায়নি সে। গলা মোটা করে জয়নালের বাচন ভঙ্গি নকল করে কথা বলে ওঠে নূর আলম, তুমার এই ইয়েডারে বেচপা না খুকা? ভালো ইয়ে, মানে দাম দুবানে।
চমকে উঠে মারমুখো ভঙ্গিতে পেছন ফেরে অতুল। নূর আলমকে দেখে চেহারার রাগ কর্পূরের মতো উড়ে যায়। সেখানে রাগের যায়গায় ঠেলে স্থান করে নেয় হাসি—কিরে তালবেলেম, তুই তো দেখি ওই শালা দালালের মতো করেই কতা বলা শিকে গিচিস!
এগিয়ে গিয়ে নন্দীর মুখের সামনে একটা খেজুরের পাতা ধরে নূর আলম। স্নেহের সঙ্গে তার গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়।
-নন্দীরে নিয়ে খুব চিন্তার মদ্যি আচিস মনে হচ্চে।
-তা তো থাকতিই হবে। ওই শালা দালাল বাবার সঙ্গে কতা কয়ে গেচে। বাবাও নন্দীকে বেচপে না বলে দেচে। তারপরেও পেছনে লেগে রইচে। তাই ওরে নিয়ে চোখির আড়ালে থাকার সিদ্ধান্ত নিচি। ঈদ চলে গিলি আবার সব ঠিক হয়ে যাবে।
নিশ্চিন্ত সমাধান নিজের মতো করেই বের করে নিয়েছে অতুল—তা আমি ইকেনে আচি তুই জানলি কী করে? প্রশ্ন করে অতুল।
—জয়নাল ব্যাপারী কইচে। হাসতে হাসতে জবাব দেয় নূর আলম। নূর আলমের মোটা দাগের রসিকতা অতুল ঠিকই ধরতে পারে। কিন্তু তার এই অকারণ উৎফুল্লতার কারণ বুঝতে পারে না। সন্দেহের সুরে জিজ্ঞেস করে, কী হইচে তোর? মিজাজ খুব ফুরফুরা মনে হচ্চে!
-বিরাট! কী হইচে কতি পারবি? রহস্য করে কথা বলে নূর আলম।
বেশ খানিকটা সময় চুপ করে থেকে কারণ অনুমানের চেষ্টা করে অতুল। কারণটি ধরতে না পেরে দুই হাত মাথার ওপরে তুলে বলে, স্যারেন্ডার, এবার তুই বল।
-কওয়া যাবে না। আমার সাতে চ, দেকাচ্চি। তখনো রহস্য করে চলে নূর আলম। পাহাড়ে চড়ার সময় ফসকে যাওয়া লাইফ লাইনটা যেনো হাতের মুঠোয় পেয়ে গেছে অতুল।
-জামা! নতুন জামা! বিশ্বজয়ের উত্তেজনা নিয়ে নূর আলমকে ধরে শূন্যে তুলে ফেলে অতুল। দু’পাক ঘুরিয়ে দুম করে মাটিতে নামিয়ে দেয়। ঈষৎ লজ্জায় সদ্য রঙচড়া খেজুরের মতো লাল হয়ে ওঠে নূর আলমের গাল দুটো। কী যে ছেলে মানুষী করে অতুল! মাটিয়ে নামিয়ে দেওয়ার পর স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টায় নন্দীর সামনে রাখা ঘাসগুলো মুঠিতে তুলে নিয়ে হাঁটা শুরু করে নূর আলম।
-নে দেরি করিসনে, তাতাড়ি চল। নন্দীকেও তো দেকাতি হবে নাকি! নন্দীকে নিয়ে নূর আলমের পেছনে হাঁটতে হাঁটতে অতুল জিজ্ঞেস করে, ককন এনচে জামা? কালার কিরাম? গায় ফিট করেচে? জামা সংক্রান্ত নানান প্রশ্নের ডালি সাজিয়ে বকবক করতে করতে চলে অতুল। ইচ্ছে হলে দুয়েকটা টুকটাক উত্তর দেয় নূর আলম, ইচ্ছে না হলে ভাবের সাথে তার দিকে তাকিয়ে ফিচলে হাসি দেয়। এক সময় নন্দীসহ আট পায়ের কাফেলাটি নূর আলমদের বাড়ির উঠনে গিয়ে থামে।
শব্দ শুনে মনে হয় খুব তাড়া আছে তার। সেটারই কিয়দংশ কানে যায় সুকবাসীর। আপন মনে বলে, ছেলেপিলেগের নিয়ে আর পাল্লাম না।
ছেলে বাড়ি এলে তাকে একটু ভালোমন্দ খাওয়ানোর জন্য মায়ের মন উদগ্রীব হয়ে থাকে। অভাবের সংসারে আর কিছু না থাকলেও দুয়েকটা হাঁস-মুরগী ঠিকই থাকে। আজ সকালে বাড়ির একটা মদ্দা হাঁস জবাই করে দিয়ে তাই কাজে বেরিয়েছে নুরুজ্জামান। নারকেল কুরে দুধ বানিয়ে তা দিয়ে বেশ কষিয়ে ঝাল ঝাল করে রান্না করেছে সুকবাসী। আশপাশের দুচারটে বাড়িতে এবাড়ির বাতাসে ভেসে বেড়ানো সুবাস ঠিকই পৌঁছে গেছে বলে অনুমান করে সে। সবসময় খারাপ খাই এমন ভাবার কিছু নাই। মাঝে মাঝে ভালোমন্দও রান্না হয় এবাড়িতে, সেটা বাতাস শুঁকেই বুঝুক সবাই। প্রতিবেশীদের প্রতি সুকবাসীর এই মনোভাবের পিছনে যথেষ্ট শক্তিশালী কারণ রয়েছে। গরিব দেখে কখনো ভালো খাবার খেতে পায় না, সেই কটাক্ষের জবাব সে এখন মনে মনে এভাবে দেয়।
দুপুরবেলা লোকটা বাড়ি আসবে বলে জানিয়ে গেছে। অনেকদিন পর আজ বাপ-বেটা একসাথে বসে ভাত খাবে বলে আশা প্রকাশ করেছে। বাপ-বেটা এক সাথে বসে ভাত খাচ্ছে। হাত পাখায় বাতাস করছে সে। ঝাল অথবা গরমের কারণে তাদের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিয়েছে। খেতে খেতে দুজনে মাদ্রাসা সংক্রান্ত নানান গল্প করছে আর অন্য হাতের চেটো দিয়ে ঘাম মুছে নিচ্ছে। কল্পনার চোখে দেখা দৃশ্যটা সুকবাসীর মনে আনন্দের একটা ফল্গুধারা বইয়ে দেয়। দারুন উৎসাহে টগবগে ফুটতে থাকা সুখানুভূতির কল্যাণে সকাল সকাল তার রান্নাবান্না শেষ হয়ে যায়। কেবল সময় মতো ভাতটা চড়িয়ে দিলেই হবে। মাংস রান্না শেষ করে ঘরের ভিতরে রেখে কেবল বাইরে বেরিয়েছে সুকবাসী। এমন সময় অতুল আর নন্দীকে নিয়ে বাড়ি ঢোকে নূর আলম। অতুলকে দেখে খুশি হয়ে ওঠে সুকবাসী। বলে, ‘অতুলকে নিয়ে আইচিস খুব ভালো হইচে। আজ দুকোরে চাইড্ডে খেয়ে যাবা বাপ। তুমার আর তুমার ছাগলের দাওয়াত। তুমার ছাগলে হাঁসের গোশতো খায় তো? হাঁস রাদ্দিচি, না খেয়ে যেনো যাবা না। বলে মুখে হাসি ধরে রেখে উঠোনের কোনায় চুলার দিকে এগিয়ে যায় সুকবাসী। ‘ঠিকাচে কাকি’ বলে তাকে পাশ কাটিয়ে নূর আলমের পিছু পিছু ঘরে ঢোকে অতুল।
গত রাতে একটু দেরি করে বাড়িতে ফেরে নুরুজ্জামান। পাশের গ্রাম শালাইপুর পার হয়ে তালসারির হাট। সেখানে গিয়েছিল ছেলের জন্য জামা কিনতে। সুন্দর দেখে একটা জামা কিনেছে সে। সেদিন সন্ধ্যায় ছেলের কথাগুলো শোনার পর থেকে মনোজগতে একটা বিরাট আলোড়ন শুরু হয় তার। মুখ ফুটে ওইটুকুই তো বলেছে ছেলেটি! মায়ের কথার পিঠে কথা বলে বেয়াদবিও করেনি। ছেলেটি তার অন্যদের মতো না। বাবা-মায়ের কষ্ট বোঝে। কষ্ট হলেও নিজের প্রয়োজনীয় কিছুই মুখ ফুটে বলে না। এবার তার মুখে জামার কথা শুনে মনের ভিতরটা খোঁচাতে থাকে নুরুজ্জামানের। উপার্জনের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাই প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও নিজের জন্য লুঙ্গি কেনার বাজেট দিয়ে ছেলের জন্য জামা কিনবে বলেই সিদ্ধান্ত নেয় সে। এ নিয়ে সুকবাসীর সাথেও পরামর্শ করে। সুকবাসী অবশ্য তার জন্য শাড়ি না কেনার ব্যাপারে চাপ দেয়। কিন্তু নুরুজ্জামান নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। লুঙ্গি কেনার বাজেটের সঙ্গে আরও কিছু টাকা মিলিয়ে ছেলের জন্য জামা কিনে ফেলে সে। জামাটি কেনার পর একটু স্বস্তি পায় সে।
এ কথা আগে থেকে নূর আলমকে জানানো হয়নি। নতুন জামা দেখে তার প্রতিক্রিয়া কী হয়, তা জানতে বাবা-মা দুজনেই উদগ্রীব ছিল। নিজেদের অতীব প্রয়োজনের জিনিসটিও কুরবানী দিয়ে সন্তানের আনন্দ কেনার মধ্যেই হয়তো বাবা-মায়ের প্রকৃত সুখ লুকিয়ে থাকে। সেই সুখ তারা চুটিয়ে উপভোগ করে যখন জামা দেখে নূর আলমের মুখটি ডাঙায় তোলা কই মাছের মতো খাবি খেতে থাকে। আনন্দের আতিসয্যে নাকি অন্য কারণে বাক হারা হয়ে পড়ে নূর আলম তা সে নিজেও বলতে পারে না। গলার কাছে কী যেন একটা ডেলা পাকিয়ে উঠে বাকরুদ্ধ করে দেয় তার। দু’চোখের কোন ভিজে ওঠে। একই অবস্থা নুরুজ্জামান-সুকবাসীরও। পরস্পরকে লুকিয়ে তারা নিজ নিজ চোখের কোন মুছে নেয়। সম্পদের প্রাচুর্য যে সুখ দিতে পারে না, সামান্য একটা বস্তুই তার চেয়ে অনেক বেশি সুখি করতে পারে মানুষকে। নুরুজ্জামানের ভাঙ্গা চালের ঘরে আজ রাতে সামান্য একটি জামার কল্যাণে যে সুখের প্লাবন বয়ে চলেছে সেটি যেনো তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
নতুন জামাটি ভাঁজে ভাঁজে ভাঁজ দিয়ে চকচকে পলিপেপারের মধ্যে ঢুকিয়ে টিনের তোরঙ্গে তুলে রেখেছে নূর আলম। অতুলকে দেখানোর তর সইছে না রাত থেকেই। সকাল হতে না হতে তাই ছুটে গেছে তার খোঁজে। অতুলকে সামনে দাঁড় করিয়ে রহস্য করে বাক্সের ডালা খোলে নূর আলম। গুপ্তধন দেখানোর মতো করে জামাটি বের করে। অতুলের মতোই বুঝি সমান আগ্রহ নন্দীরও। গলার ভিতর থেকে ‘হুউমমম’ জাতীয় একটা শব্দ বের করে উৎসুক চোখে তাকিয়ে থাকে নূর আলমের দিকে। যেনো বলতে চায়, দেখাও দেখি কী ম্যাজিক দেখাবে!
নূর আলম জামাটি বের করলে খাবার মনে করে সেদিকে এগিয়ে যায় নন্দী। পলিতিনের প্যাকেটে নাক লাগিয়ে শুকতে থাকে। মনে মনে তাহলে জামাটাকে নতুন কিছিমের একটা খাবার ভাবছিল সে! ছাগলটিকে সামান্য ঠেলে সরিয়ে দিয়ে জামাটি হাতে নেয় অতুল। পলিথিন থেকে জামা বের করে ভাঁজ ছাড়ানোর জন্য একটি ঝাড়া মারে। ঠিক সেই সময় অসাবধানে নূর আলমের হাতে লেগে সদ্য রান্না করা হাঁসের মাংসের কড়াইয়ের ঢাকনি পড়ে যায়। ওদিকে জামাটি ঝাড়া দেওয়ার সাথে সাথে হাত থেকে ফস্কে যায় অতুলের। গিয়ে পড়ে একেবারে ধোঁয়া ওঠা ঝোল ভর্তি কড়াইয়ে। যেন সাজানো মঞ্চে এমনটাই হওয়ার কথা ছিল।
ছোঁ মেরে কড়াই থেকে জামাটি উদ্ধার করে নূর আলম। তারপর পরস্পরের দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে। চোখের পলক পড়ে না দুজনের কারোরই। কী হতে কী হলো ভাবার শক্তি বা ঘটনার গভীরতা কেউই উপলব্ধির পর্যায়ে আর নেই যেন। দুজনেরই সময় থমকে গেছে। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া তাদের আর যেন কিছু করার নেই। ঘটনার আকস্মিকতা তাদের দুজনকেই বিমূঢ় করে দিয়েছে।
থমকে যাওয়া সময়ের তালা ভেঙ্গে যায় নন্দীর ‘হুউমমমম’ জাতীয় একটা শব্দে। দুজনেই একসঙ্গে চমক ভেঙ্গে জেগে ওঠে। কী করবে বুঝতে না পেরে একবার লালচে ঝোলের দাগ লাগা নতুন জামাটির দিকে তাকায় আরেকবার তাকায় পরস্পরের দিকে। দুজনের কারও চাহনিতে ভাষার আদান প্রদান নেই। বোবা মানুষের মতো তাদের চোখও বোবা হয়ে গেছে। সেখানে ভাষার কোনো চিহ্ন নেই। নতুন জামার গা বেয়ে লালচে ঝোলের ফোঁটা গুলো ঝরে পড়ছে নূর আলমের লাল রঙের জুতার ছইয়ে। সেখান থেকে গড়িয়ে মেঝে ছোঁয়ার নিখুঁত প্রচেষ্টায় স্লো মোশানে ধেয়ে চলেছে।
ভাতের হাড়ি চুলায় চাপিয়ে চোঙ্গায় ফুঁ দিয়ে সোজা হয়ে বসে সুকবাসী। ধোঁয়া লাগা ঝাপসা চোখে নন্দীর লেজের ডগাটি দ্রুত বেগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে দেখে সে—এই আবার কনে যাচ্চিস তুরা? তাতাড়ি বাড়ি আসিস কিন্তুক। ভয়তাড়িত ‘ম্যাভ্যাএ্যএ্য’ জাতীয় একটা শব্দ বেরিয়ে আসে নন্দীর মুখ দিয়ে। শব্দ শুনে মনে হয় খুব তাড়া আছে তার। সেটারই কিয়দংশ কানে যায় সুকবাসীর। আপন মনে বলে, ছেলেপিলেগের নিয়ে আর পাল্লাম না।
চলছে…
জামা-৩॥ ইবনুল কাইয়ুম