আমার শ্রদ্ধেয় বড় চাচার একমাত্র পুত্র সিরাজুল ইসলাম। সিরাজ ভাই বলে ডাকতাম আমরা। প্রেসের ব্যবসায় তিনিও মনোযোগী ছিলেন না, ফলে ভাগে পাওয়া মেসিনারি সব বিক্রি করে গ্রামের বাড়িতেই ফিরে এসেছিলেন। মানিকগঞ্জের নতুন গড়ে ওঠা মহকুমা শহরে ব্যবসা বাণিজ্যের যেটুকু প্রচেষ্টা ছিলো তা খুব সফল হয়নি।
পরবর্তী সময়ে বোন ও তার বর, তামেজ উদ্দিনের চালাকি, প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে বৈষয়িক বিষের তিক্ততা, নিজের মায়ের বৈষম্যমূলক আচরণ, সর্বোপরি ভালোবাসার জীবন সঙ্গিনীকে হারিয়ে সিরাজ ভাই জগত ও জীবনের প্রতি চরম উদাসীনতায় আঁকড়ে ধরেছিলেন সন্ন্যাসব্রত।
সিরাজ ভাইয়ের স্ত্রী আমাদের সবার প্রিয় রাজন ভাবি ছিলেন শ্যামবর্ণ, বাঙালি লাবণ্যময়ী সুন্দরীর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। লম্বা একহারা গড়নের কমনীয় এক মাধুরিলতা। হৃদয়ের রাজেশ্বরী যেমন, তেমনি কথা-কাননেও সুরসিকা বটে। মাঘ মাসের ঠাণ্ডায় এক সময় গ্রামজীবন প্রায় জমে যেতো। মাটির আলসে ও নাড়ার আগুন ছিল একটু ভরসা।
এক সন্ধ্যায় ঠাণ্ডা কুলাতে না পেরে আমার মাকে এসে বলেছিলেন, ‘মেজো শাশুড়ি আম্মা, শোনেন, এই শীতে না এক সোয়ামিতে জার কুলায় না। দুই সোয়ামি দরকার, একদিকের ওমে গরম হলেও আরেক পাশ বরফ ঠাণ্ডায় জমে যায়। কী করি বলেন তো? মা হেসে বলেছিলেন, দেখ তো পাগলে কী কয়!
ভরা বর্ষাকালে বেলে জোৎস্নার অপূর্ব এক হিরণ্ময় রাত ছিল সেদিন। অনাস্বাদিতপূর্ব এক হালকা হলুদ পাখির পালকের মতো সেই রাতে আমাদের সবার হৃদয়জুড়ে বসে থাকা অসামান্য লাবণ্যময়ী ভাবি, ‘রাজন’ ফস করে চলে গেলেন সাত মাসের সন্তান গর্ভে নিয়ে।
আমার বড় কাকার একমাত্র পুত্র সিরাজ ভাই আমাদের সবার প্রিয়ভাজন ব্যক্তিত্ব। তার স্ত্রী রাজনও ততধিক প্রিয় আমাদের কাছে। আমার শৈশবে দেখা সবচেয়ে লাবণ্যময়ী নারী, অনেকটা সোফিয়া লরেনের মতো। রুনু, পল নামে দুই পুত্রের পরে একটি কন্যা সন্তানের আশায় তৃতীয় বার গর্ভবতী হয়েছিলেন তিনি।
বড় ছেলে রুনুর পরে দুই বছরের অন্য পুত্র ‘পল’এর তখনো মায়ের বুকের দুধেই চলে আহার। আজকাল ঢেঁকিতে ধান ভানার জন্যে ঝি-বৌ কাউকে পাওয়া যায় না এই বর্ষাকালে। গ্রাম থেকে মাইল তিনেক দূরে পাকিস্তানের বাজারের ধান ভাঙানোর নতুন কল বসেছে, রাখালকে পাঠিয়ে সেই কলে ধান ভাঙানোর কথা ছিল সেদিন। ভাবি তাই নিজেই মাচায় উঠে ধামায় ভরে ধান নামিয়ে কাজের মেয়েটির হাতে দিয়েছেন।
কিন্তু হঠাৎ করেই চঞ্চলমতি ভাবি লাফ দিয়ে নিচে নামতে গিয়েই হলো সেই ঘোর বিপত্তি, সাড়ে সর্বনাশের একশেষ। মাটিতে শুয়ে পড়লেন সঙ্গে সঙ্গে, শ্বাস-প্রশ্বাস আটকে যাচ্ছে, ঘেমে নেয়ে যাচ্ছেন ক্রমাগত। সিরাজ ভাই বাড়িতেই ছিলেন, মুহূর্তেই সবাই জড়ো হলো। গ্রাম্য ডাক্তার এলো, কবিরাজ, ঝাড়-ফুঁক চললো, কিন্তু মানিকগঞ্জ শহরে নিয়ে চিকিৎসার কথা কেউ ভাবেনি।
বাড়িতেই দু’দিন ধরে চললো ডাক্তার কবিরাজের মিলিত চিকিৎসা। তৃতীয়দিনে কেবলি অস্থিরতা আর ঘাম, দুপুরের দিকে দম বন্ধ হয়ে গেলো ভাবির। ডাকলেও আর প্রজাপতি চক্ষুদ্বয় তার খোলে না।
সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে তিন দিনের মাথায় তৃতীয় সন্তান পেটে নিয়ে চলে গেলেন সেই অনন্তলোকে, যার ঠিকানা আজো খুব রহস্যজালে গুপ্ত।
সেই বছরটাতে ভীষণ বন্যায় ডুবে গিয়েছিল শস্যক্ষেত, মাঠ, ঘাট, স্কুল কলেজের শ্রেণীকক্ষ। অগত্যা আমাদের বাড়ির উঁচু বৈঠকখানা ঘরে চলছিল স্কুলের কার্যক্রম। আমি তখন তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী। ক্লাসের মাঝপথে ঘণ্টা পিটিয়ে আমাদের ছুটি ঘোষণা করা হলো। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির ভেতর থেকে সোরগোলময় ভীষণ এক মৃত্যু কান্না ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে। আমি দৌড়ে গিয়ে ভাবির মৃত মুখ দেখতে অগুনতি মানুষের জটলা ভেদ করে ছুটে চলেছি আগুনের হলকার মতো।
এ যেন অনন্ত কালের এক পথ। কিছুতেই তা ফুরোচ্ছে না আর। আহা, এইটুকু বুঝতে পারছি যে, অনন্তের ফুল হয়ে ভাবি হারিয়ে গেলেন খুব অসময়ে। ভাবির শোকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো অত্যন্ত শোকাকূল সিরাজ ভাই পড়ে আছে তার পাশেই। ক্ষণে ক্ষণে ফিট হচ্ছে, উপরন্তু ছোট্ট দুটি পুত্র সন্তানের দুশ্চিন্তা তাকে অন্য এক সংগ্রামমুখর জীবনের দীক্ষায় ভারী করে তুলেছিল সম্ভবত।
রাজন ভাবির বাবার বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে দু/তিন মাইলের দূরত্বে অবস্থিত ডাউটিয়া গ্রামে। তার মা, ভাই, বোন আত্মীয়-স্বজন এক এক করে আসছেন নৌকা করে। আমাদের বাড়ির ঘাটে পা রাখা মাত্রই শূন্যতায় কালিঝুলি মেখে কান্নার অস্থির একদৈত্য যেন আকাশ থেকে গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে। স্মৃতিময় বিলাপের ধ্বনিবিহ্বল আগ্নেয়গিরি থেকে ক্রমাগত ঝরে পড়ছে গলিত লাভা। ভাবির দুবছরের শিশু পুত্র পল কোল থেকে কোলে অদল বদল হচ্ছে শুধু, কিছুই বুঝতে পারছে না যে, ইতোমধ্যে কী সর্বনাশ হয়ে গেছে তাদের। রুনু একটু বুঝতে পারে, কাজেই তাকে দূরে দূরে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখছে সিরাজ ভাইয়ের ছোট বোন টগর আপা।
সিরাজ ভাইয়ের জ্ঞান একটু ফিরলেই, ওহ, রাজন এ কী করলা তুমি? বলেই আবার জ্ঞান হারাচ্ছেন। বন্যায় পানিতে সারা গ্রাম ডুবে আছে। গোরস্থানে পানি, স্কুল ঘরের টুঁই ছোঁয়া পানি। অধিকাংশ বর্গাচাষি, ভূমিহীন, নিরন্ন মানুষের ঘরবাড়ি জলের তলদেশে প্রায় নিমজ্জিত।
একটু অবস্থাপন্ন যেসব বাড়ি সে রকম কয়েকটি বাড়ি শুধু জেগে আছে তখন। আমাদের তিন চাচা ও আব্বার সম্মিলিত অন্দরবাড়ির দেউড়ি থেকে শুরু হয়েছে দক্ষিণমুখো বহির্বাটির প্রাঙ্গণ।
দেউড়ি বেড়ার শেষ যেখানে, সেখানে যে বহু পুরোনো একটা বেল গাছ আছে, সেই ছায়াচ্ছন্ন বেলতলায় ভাবিকে কবর দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা আব্বা সিরাজ ভাইকে জানালে, তিনিও সম্মতি দিলেন।
পার্থিব জীবনের অর্থবিত্ত অর্জনের যথেষ্ট সুযোগ সেখানে থাকা সত্ত্বেও সেই সুযোগ কখনো গ্রহণ করেনি। সাম্যবাদী পরিবারের চিন্তাকে উত্তরাধিকার হিসেবে বহন করে সৎ ও নিরাভরণ জীবনই যেন বেছে নিয়েছে নিজের জীবনে।
আব্বা যথাসময়ে ভাবির সেই কবরের তদারকি করছেন, আর কিছুজ্ক্ষণ পর পর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলছেন। এত কঠিন চোয়ালে আব্বাকে কখনো দেখিনি। চোখে জল নেই, কিন্তু অগ্নিগোলক ফেটে ধোঁয়া উড়ছে তার চতুর্দিকে। সিরাজ ভাই তখনো পড়ে আছে ভাবির লাশের পাশে। কেউ তাকে সরাতে পারছে না। সিরাজ ভাইয়ের সবচেয়ে ছোট বোন টগর আপা বিয়ে হয়েছে বহু বছর, তখনো সন্তানাদি হয়নি।
সদ্য মাতৃহারা শিশু পলকে নিজের সন্তান হিসেবে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিলে সবাই মোটামুটি মেনে নিলো। কিন্তু সিরাজ ভাই নির্বাক, নিশ্চুপ। টগর আপা আপাতত, ঢাকায় না গিয়ে একমাত্র ভাইয়ের কাছে থেকেই ভাইপো দু’জনকেই দেখাশোনা করলেন বেশ কিছুদিন।
ভাবির মৃত্যুর ১৮ মাস পরে সন্তান দু’জনকে মানুষ করার ব্রত নিয়ে হঠাৎ করেই একদিন বিয়ে করে বাড়ি ফিরলেন সিরাজ ভাই একাকী। কিন্তু সিরাজ ভাইয়ের হাতে মেহেদির রঙ দেখে আমার মায়ের সন্দেহ হলো। পরে জিজ্ঞেস করে মা জানতে পারলেন। কৃষ্ণদিয়া গ্রামের অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে সে। একই গ্রামে ভাই তার বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে গেছিলেন, তাদের পাশের বাড়ির মেয়েটি, তারও বিয়ে ভেঙে গেছে বছর খানেক আগে।
কাজেই সবকিছু মিলিয়ে রুনু-পলের কথা ভেবে রাজি হয়ে গেলাম। এই ঘটনার সপ্তাহ খানেক পরে খুব অনাড়ম্বরভাবে ভাবিকে নিয়ে এলেন বাড়িতে। এর পরেই পলকে নিয়ে টগর আপা ঢাকায় স্বামীগৃহে ফিরে গেলেন। রুনু তখন থেকে নতুন মায়ের কাছে মানুষ হতে থাকলো।
দ্বিতীয় বারের এই বৈবাহিক সম্পর্ক সিরাজ ভাইয়ের জীবনের কিছু প্রয়োজন মিটলেও পুষ্টিগুণ ছিল না তাতে। দিনে দিনে রাজন ভাবির অভাব যেন আরও তীক্ষ্মভাবে অনুভবে এলো তার, ফলে রক্তহীন এক দুর্মর উদাসীনতা পেরে ফেললো তাকে। জীবনের বাস্তবতা মেনে কিছু ব্যবসা বাণিজ্যের কথা ভাবলেও কিছুতেই সফলতা এলো না আর।
মনোহীন সংসারে কিছুতেই মন বসাতে পারলো না সিরাজ ভাই, ভাবির জন্যে অন্তহীন এক বিরহ বোধের তীব্র হাহাকারে। রাজন ভাবি খুবই অবস্থাপন্ন পরিবারের আদুরে কন্যা ছিলেন। তার বাবা রশীদ খান ছিলেন ডাউটিয়া গ্রামের প্রতাপশালী ব্যক্তি। টানা ৪৫ বছর একই এলাকার চেয়ারম্যান ছিলেন। তার বাড়ির উল্টো দিকেই চাচাতো ভাই এদল মুন্সীর বাড়ি। জৌলুসহীন প্রকৃতির মতো শান্ত শ্রী। তিনি নিজেও অত্যন্ত সাধুসন্ত, সজ্জন প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। আশে পাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেকেই তাকে পীর হিসেবে মান্য করেছে এবং তার বায়েত হয়েছে। আমাদের সিরাজ ভাই শেষদিকে দিনের বেশির ভাগ সময় এই সাধুর সান্নিধ্যে সময় কাটাতেন।
ধারণা করি, উল্টোদিকে অবস্থিত রাজন ভাবিদের বাড়ির আকর্ষণেই হয়তো তিনি যেতেন এদোল মুন্সীর বাড়িতে। রাতের বেলা সেখানে গান হতো, জিগির হতো, খোদার রসনাই খুঁজে ফিরতো ভক্তেরা।
বিরহকাতর সিরাজ ভাই হয়তো রাজনভাবির শৈশব, কৈশোরে বেড়ে ওঠার সময়কে নিবিড়ভাবে তার মনশ্চক্ষে অনুভব করতে চাইতেন, ওই বাড়িটি ঘিরে। কে জানে? আমৃত্যু সেই সাধুসঙ্গলাভে অমৃত খুঁজে বেড়িয়েছেন তিনি। সাধুসঙ্গে সময় কাটিয়ে, তবে ফিরতেন বাড়িতে।
এ নিয়ে নতুন ভাবীর সঙ্গে মতদ্বৈততা ছিল বিস্তর, কিন্তু তার কোনো অভিযোগ কানেই তোলেননি সিরাজ ভাই কোনোদিন। এই নতুন ভাবির গর্ভেও দুই পুত্রসন্তান মঞ্জু, আজাদ ও বহু কাঙ্ক্ষিত এক কন্যা সন্তান সোমার জন্মও পিতাকে গৃহমুখী করতে পারেনি।
এক অর্থে পিতার মনোহীন ফসল হিসেবে গোলায় উঠেছে তারা। সংসারে সিরাজ ভাইয়ের মন ফেরানোর জন্যে, এ নিয়ে আব্বাও সিরাজ ভাইয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছেন একাধিকবার, কথা বলেছেন বিভিন্ন সময়ে কিন্তু লাভ হয়নি।
রাজন ভাবীর দুই পুত্র মাহবুব ইসলাম রুনু ও আমিরুল ইসলাম পল—দু’জন সন্তান এখন কত্ত বড় হয়েছে, ভালো আছে, মানুষের জন্যে ভালো কাজ করছে। শুধু মাকে তারা দেখাতে পারলো না কিছু। এই যা দুঃখ তাদের মনে। এই বেদনা বুকে ধারণ করে মানুষের মঙ্গল ও কল্যাণে তাদের সাধ্যমতো কাজ করছে তারা দু’ভাই।
তবে বড় পুত্র মাহবুব ইসলাম রুনুর মধ্যে পিতার উদাসীনতার উপস্থিতি বেশ বুঝতে পারি। বাংলাদেশের ব্যবসায়ী সংগঠনে এফবিসিসিআই—এ দীর্ঘদিন ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করছে সে। সালমান এফ রহমান থেকে শীর্ষ স্থানীয় ব্যবসীদের সঙ্গে ঘণিষ্ঠ যোগাযোগ ও বন্ধুত্ব। পার্থিব জীবনের অর্থবিত্ত অর্জনের যথেষ্ট সুযোগ সেখানে থাকা সত্ত্বেও সেই সুযোগ কখনো গ্রহণ করেনি। সাম্যবাদী পরিবারের চিন্তাকে উত্তরাধিকার হিসেবে বহন করে সৎ ও নিরাভরণ জীবনই যেন বেছে নিয়েছে নিজের জীবনে।
সংসারে সন্ন্যাসী পিতা হিসেবে সিরাজভাই তাদের উত্থান যেমন দেখেছেন কিছুটা, তেমনি সন্তানের যথাযথ সেবা যত্ন পেয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় ও নিয়েছেন যথার্থ সময়ে।
মধ্যপথে সরোবরে ফুটে থাকা মা ফুলটি হারিয়ে গেলো অসময়ে।
রুনু পলের মুখের দিকে তাকালে আজো মনে পড়ে যায় প্রথমেই রাজনভাবির অনিন্দ্য সেই ছায়াময় কায়া। পরিশেষে মনে হয় রবীন্দ্রনাথের ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতাটির সেই বিখ্যাত দুটি চরণ,
মা বলিতে প্রাণ, করে আনচান
চোখে আসে জল ভরে।চলবে…