[পর্ব-৬ ॥ ও বাবু সেলাম বারে বার]
এক.
পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর, শুভম, পবিত্রতর শুদ্ধ মুহূর্তের জলছবি হলো মাতৃজরায়ন থেকে একজন নিষ্পাপ শিশুর পৃথিবীতে প্রথমভূমিষ্টকালীন দৃশ্য। স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে অন্য সৃষ্টিশীল মায়ের যেন স্বর্ণমুহূর্তের এক অনাবিল সাক্ষাৎকার।
কাজেই প্রতিটি শিশুর জন্ম-মুহূর্ত হলো এক অপার বিস্ময়। জ্যোতির্ময় এক সুন্দরে শোভিত চিরন্তন আকাঙ্ক্ষার সোপানে উত্তরণে মায়ের গলায় জয়মাল্য গ্রহণের কাল।
অনন্য সাহসী আমার মা রহিমা হাফিজের বুকেও নিশ্চয় নেচেছিল হলুদ খঞ্জনা, পালতোলা বাতাসে সৃষ্টি-সুখের উল্লাস।
শিশুর জন্মমুহূর্তের এই সময়টুকুর শুরু থেক শেষের মধ্যে লুকিয়ে থাকে মানব সভ্যতার ইতিহাস, যা অলৌকিক এক রহস্যময়অনুধাবনে পৃথিবীকে ঋদ্ধ করেন প্রত্যেক মা। আমাকে জন্মদানের মুহূর্তে প্রসববেদনার কষ্টও নাকি মা সেদিন পেয়েছিলেন খুবই সামান্য।
একজন নারী হয়ে, দুই-দু’বার সন্তান জন্মদানে প্রসব বেদনার বিপুল গৌরব ও অভিজ্ঞতার পরেও মায়ের কথা আমাকে বিশ্বাস করতে হয়েছে। সেই গল্পটিই বলছি শুরুতে।
দেখতে বেশ বড়সড় গোছের শিশু হয়ে জন্মেছিলাম, মাপার যন্ত্র নিশ্চয় ছিল না দাইমার কাছে। বাঁশের নেইলে নাড়ি কাটার পরে নিশ্চয় বলতে পারতেন, আট পাউন্ডের বেশি ওজন ছিল শিশুটির।
পেটা শরীর, কাঁধ পর্যন্ত ছড়ানো চুল, ঘাড় ধরে তখনি বসানো গেছে। পেটের মধ্যে টোল পড়া ছিল, আঁতুড় ঘরে বড় আম্মা আমাকে দেখে বলেছিলেন, বোয়াল মাছের শাদা পেটের মতো নাদুস-নুদুস, এই মেয়ে ভাগ্যবতী হবে। এসব কথা মা-ই বলেছেন আমাকে।
বড় সন্তানেরা অধিকাংশ সময়ে মায়ের বন্ধু হিসেবে উত্তম, সে ছেলেই হোক অথবা মেয়ে। কী এক আত্যন্তিক বন্ধনে যেন সব সন্তানের চেয়ে এগিয়ে থাকে এই প্রথমেরা। মায়ের নানা অজানা কথা জানেও তারা। মা -ই শেয়ার করেন সেসব তাদের সঙ্গে।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, প্রথম সন্তানের সঙ্গে মায়ের বয়সের ব্যবধানও থাকে সবচেয়ে কম। হতে পারে এটিও বন্ধুত্বের অন্যতম একটি কারণ। সংসারের প্রথাগত লিঙ্গীয় বৈষম্য সত্ত্বেও শেষাবধি কন্যা সন্তানেরাই দিনশেষে বাবা-মায়ের কূলহারা সময়ের বন্ধু। আমৃত্যু সুবর্ণসুতোয় সেলাই করে রাখে তারা স্মৃতিময় সোনালি অতীত। ব্যতিক্রম যে নেই, তা নয়। তবে তা ব্যতিক্রমের উদাহরণ হিসেবেই উল্লেখযোগ্য বৈকি।
দুই.
আমাদের প্রথম মায়ের গর্ভজাত বড় দুই বোনের একজনকে ডাকতাম বড়’পা, দ্বিতীয়জনের নামসহ ডাকতাম হাওয়া’পা। বড়’পা মূলত আমাকে কোলে কাঁখে করে মানুষ করেছেন ছোট থেকে। বোতলে দুধ খাওয়ানো, পায়ে দুলিয়ে ঘুম পাড়ানো থেকে শুরু করে আমার আড়াই বছর বয়সের পর থেকে গোসল করানোর দায়িত্বটিও মাঝেমধ্যে তারই ছিল। বাকি সময়ে নানির হাতে।
সীমারের বর্ণনায় মায়ের কণ্ঠ যখন আবেগে ভিজে আসতো, অন্য সবাই তখন হু হু করে কাঁদতো। আশুরার আগের দিন অর্থাৎ নয় দিনে ‘বিষাদ সিন্ধু’ পাঠ শেষ করতেন মা।
বড়’পা আমাকে নাচ শিখিয়েছিলেন খুব যত্ন করে। কবি জসীম উদ্দীন রচিত জনপ্রিয় এই সঙ্গীতের সঙ্গে আমার বয়েসী অধিকাংশ শিশুই তখন নৃত্যের মুদ্রায় সালামে আনত হয়েছে বৈকি।
ও বাবু সেলাম বারে বার,
আমার নাম গয়া বাইদ্যা বাবু,
বাড়ি পদ্মা পার।মোরা পঙ্খি মারি পঙ্খি ধরি মোরা
পঙ্খি বেইচা খাই—
মোদের সুখের সীমা নাই
‘ও বাবু সেলাম বারে বার’ গানটির সঙ্গে মুদ্রা মেলাতে বড়’পা কত যে সময় ব্যয় করেছেন আমার পেছনে, সেসব বলে শেষ করা যাবে না। তিনি নিজেও চমৎকার গাইতে পারতেন।
প্রতি বছর শীতকালের দিকে আমাদের গ্রামে স্কুলের মাঠে যাত্রা ও নাটক মঞ্চস্থ হতো। নাটকের পাত্র-পাত্রী অধিকাংশই ছিল আমাদের বাড়ির ছেলেরা। ছেলেরাই মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করতো। আমার ছোট ভাই সেলিমও পরবর্তী সময়ে মেয়ে সেজে অভিনয় করেছে এইসব নাটকে। বাকি চরিত্রের অভিনয়ে জমাদ্দার পাড়ার আগ্রহীরা এসে যোগ দিতো। নাটকের শুরুতেই শিশুদের একটা নৃত্য থাকতো, সেই নাচের জন্যে আমাকে রেডি করতেন বড়’পা।
হাওয়া’পাও নাচতেন খুব ভালো, কিন্তু পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পরে তাকে আর নাচতে দেওয়া হতো না প্রকাশ্য মঞ্চে। কাজেই সবচেয়ে ছোট বলে ২/৩ বার আমাকে দিয়ে নাটকের সেই সূচনা নৃত্য করানো হয়েছে। আমাদের আঞ্চলিক বিবাহ-গীত ও বিচ্ছেদের গানেও খুব পারদর্শী ছিল আমাদের এই দুই বোনই। আমার বড়’পার কাছেই আমারও গানের হাতেখড়ি।
উদাত্ত পদ্মা ও মনোহর শাখানদী কালিগঙ্গায় বেষ্টিত আমাদের গ্রামটি ছিলো ভাটি অঞ্চলের তালিকায়। সমতল ভূমির অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের চেয়ে নদ-নদীর তীরবর্তী জনপদের মানুষের মধ্যে বৈরাগ্য ও চিরন্তন এক উদাসীনতা যেন মরমে লুকিয়ে থাকে নিজের অজান্তেই।
প্রতি বছর নদীর ভাঙনে বাড়িঘর হারা মানুষের হাহাকারে আকাশও নেমে আসে ভারাক্রান্ত জমিনের কাছাকাছি যেন। মানুষ অধিক হারে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে পীর-মুর্শিদের কৃপায়। এজন্যে বুঝি বা মুর্শিদী ও বিচ্ছ্দের গান খুব জনপ্রিয় ছিল আমাদের এই ভাটি অঞ্চলের মানুষের মন ও মননে। আমাদের ছোট্ট গ্রামের পরিসরেই ৩টা পীর ফকিরের দরগা বা মাজার শরীফ ছিল।
আগেই উল্লেখ করেছি, আমাদের বাড়ির পূর্বদিকের শরিকবাড়ির পরেই ছিল এক খাজা বাবার দরগা। তার উরস মোবারকের সময় ব্যতিরেকেও সেখানে মুর্শিদী, কবিগান, জারাসারি গান হতো নিয়মিত। অন্যদিকে ধর্মীয় সংস্কৃতি উজ্জীবনে গড়পাড়া ইমাম বাড়ির বিশেষ ভূমিকা ছিল। এই বাড়িটি ছিল আমাদের বাড়ি থেকে মাইলখানেক দূরে।
ঐতিহ্যবাহী আশুরা পালিত হতো অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে। বহু প্রাচীন এই পীরবাড়ির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আমার আব্বা ও বড় চাচার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। বিশেষ করে বর্ষার সময় নৌকা ভাড়া করে বছরে একবার এই ইমাম বাড়িতে আব্বা-মা আমাদের নিয়ে আসতেন। সারাদিন থেকে খেয়ে-দেয়ে সন্ধ্যার দিকে ঝিরিঝিরি বাতাসে পাল তোলা নৌকায় আবার ফিরে যেতাম বাড়িতে।
আমি খুব ছোট ছিলাম। তবু মনে আছে সেই স্মৃতি ধূসর সন্ধ্যার কথা। পীরবাড়ি থেকে ফেরার পথে নৌকার গুলুইর কাছাকাছি খোলা আকাশতলে বসে আব্বা আপন মনে হুক্কা টানছেন। কাজল কালো নিশ্চল জলের ওপরে ঘনিয়ে আসা সন্ধ্যা বাতাসের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার। নৌকা ছুটে চলেছে ভাটির টানে। জলে ভেসে বেড়ানোর সেই মুহূর্তে প্রকৃতির অপরূপ রূপে দেখে কী যে আন্দোলিত হতেন আব্বা, আজও সে দিনের সেই প্রদীপ্ত বাবার মুখখানি মনে পড়ে।
উরস মোবারকের নানা পার্বণে ওই বাড়িতেও ভাটিয়ালি-মুর্শিদি গানের আসর হতো প্রতি বৃহস্পতিবারে।
ফরিদপুর, রাজবাড়ি, গোয়ালন্দের মতো বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে এই বাড়ির হাজারো মুরিদান। মহররমের পহেলা তারিখ থেকে এরা মাছ মাংস খেতো না। লাল সালুর পোশাকে আপাদমস্তক ঢেকে শোক পালন করতো। রোজা রাখতো এদের অনেকেই।
আশুরার দিনে দূর-দুরান্ত থেকে পায়ে হেঁটে মাতম করতে করতে হাতে ঢাল তলোয়ার হাতে নিয়ে হাজারো মুরিদান এই ইমামবাড়িতে এসে জড়ো হতো। পীরবাড়ির আদর্শ প্রাণপণ ধারণ করে বুক চাপড়ে মহররমের কাসিদা গান গাওয়ার একটা রেওয়াজ আমাদের এলাকায়ও ছিল।
হিজরি মাসের প্রথম মাস—মহররম। এই মাসের পহেলা তারিখ থেকে সন্ধ্যায় আমাদের বাড়ির বারান্দায় বসে সুরেলা কণ্ঠে মা ‘বিষাদ সিন্ধু’ পাঠ করতেন। আমাদের বাড়ির বৌ-ঝি, ছেলে-মেয়ে ছাড়াও আশেপাশের পাড়া থেকে অনেকেই এসে গোল হয়ে বসে মায়ের পাঠ শুনতো।
সীমারের বর্ণনায় মায়ের কণ্ঠ যখন আবেগে ভিজে আসতো, অন্য সবাই তখন হু হু করে কাঁদতো। আশুরার আগের দিন অর্থাৎ নয় দিনে ‘বিষাদ সিন্ধু’ পাঠ শেষ করতেন মা।
তিন.
দূর অতীতে প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়া অন্য কোনো হাই স্কুল ছিল না বলে, পঞ্চম শ্রেণী পাস দিয়ে আমাদের ‘মিয়া বাড়ির’ মেয়েরা বিয়ের জন্যে অপেক্ষা করতো। অপেক্ষাতুর এই সময়ে উল বুনানো, সুই সুতোর ভরাট সেলাইয়ে টেবিল ক্লথ বানানো, বিছানার চাদর সেলাই শেখা, ফুল-পাখির ছবি আঁকা সুদৃশ্য রুমাল সেলাই, কুশিকাটার লেইজ, ব্লাউজ বানানো শেখানো হতো।
হাওয়া’পা তার খুব ছোট বেলায় আশে পাশের পাড়া প্রতিবেশীর বাড়ির গাছের আমতলায় যেতো আম কুড়ানোর জন্যে। আমকুড়ানো ছিল তার অন্যতম শখের একটি কাজ। মা তাকে বারণ করেও ফেরাতে পারতেন না।
গজ কাপড় কেটে মেশিনে ব্লাউজ, ফ্রক, পেটিকোট বানাতে শেখা ছিল তাদের শিক্ষানবিশকালের কাজ। আমার মায়ের খুব বই পড়ার নেশা ছিল। দুপুরে খাবার পরে তার পালঙ্কে শুয়ে উপন্যাসের পাতায় চোখ না রাখলে তার বিশ্রাম বা ঘুম হতো না।
কাজেই বাড়িতে সেই সব বই ছিল অনেক। আব্বাও মায়ের ফরমাইস মতো ঢাকা থেকে নিয়ে আসতেন নানা ধরনের উপন্যাস ও নাটকের বই। আমার বোনেরাও মায়ের দেখাদেখি আগ্রহ ভরে পড়েছেন সেইসব নভেল ও নাটকের বইপত্র।
ক্লাসের বাইরের বই যখনই আমি নানির পাশে শুয়ে গোপনে পড়ার চেষ্টা করেছি, কেন জানি, নানি ঠিক তা বুঝতে পারতেন। বলতেন, আসল থুয়ে এত নফল পড়ো ক্যান? আসল পড়ো, আসল পড়ো, আগে মানুষের মতো মানুষ হও।
‘জাতের মেয়ে কালো ভালো/ নদীর পানি ঘোলাও ভালো।’—এই জাতীয় লেখা কালো অথবা শাদা এক টুকরো কাপড়ে লিখে নানা বর্ণের সুতোয় ভরাট সেলাই করতো তারা। ফেরিওয়ালাদের কাছে থেকেও এমন বিভিন্ন কবিতার মতো লেখাসহ অঙ্কিত কাপড় কিনতে পাওয়া যেতো। সেলাইয়ের জন্যে ডিএমসি সুতো, জরি ও পুঁতিও পাওয়া যেতো ওদের কাছেই। বাড়িতে বিয়ের উপযুক্ত মেয়ে থাকলে অধিকাংশ মধ্যবিত্ত পরিবারে সেলাইয়ের এই চর্চা অপরিহার্য ছিল সেই সব দিনে।
অবসর সময়ে বসে সমবয়সীদের সঙ্গে গল্প করতে করতে কাপড়ের ডিজাইনগুলো সেলাই শেষ করতো তারা। পরে ধুয়ে কড়া রোদে শুকিয়ে ইস্ত্রি করে বাঁধাই করতে পাঠাতো। বাঁধানোর পরে তাকে বলা হতো পিকচার। টিনের ঘরের দেয়ালেও যত্ন করে সেসব ঝুলিয়ে রাখা হতো।
মেয়ের জন্যে কোনো ভালো বিয়ের প্রস্তাব এলে বরপক্ষকে কনের মুখ দেখানোর পরে সেলাই জানার নমুনা হিসেবে চাক্ষুষ প্রমাণ হিসেবে দেখানো হতো সেসব।
সৌন্দর্যের পাশাপাশি মেয়েদের গুণবতী করে গড়ে তোলার একটা প্রচেষ্টাও ছিল এই সময়ের প্রায় সব মায়েরই। রান্নাবান্নার মধ্যে পোলাও, মাংস রোস্ট, রেজালা ছাড়াও শেখানো হতো আরও কিছু। বিশেষভাবে দুধ লাউয়ের জন্যে খুব চিকন করে লাউকাটা, চোস্ত আলুভাজির জন্যে আলু ও বেরেস্তার তৈরির জন্য মিহি করে পেঁয়াজ কাটতে পারাও মেয়েদের বিশেষ যোগ্যতা বলে বিবেচিত হতো।
নতুন বরের ‘সাককোর খানা’-এর জন্য বিভিন্ন প্রকার সবজির তেলেভাজা পদ তৈরির যোগ্যতা অর্জন করাও রন্ধনশিল্পের বিশেষ যোগ্যতা বলে বিবেচিত হতো আমাদের বাড়ির মেয়েদের।
চার.
আমাদের বোন ও চাচাতো বোনদের অনেকেই বিয়ের পরে স্বামীগৃহে গিয়ে পড়াশোনা করেছে। সরকারি স্কুলের শিক্ষকতা পেশায় যোগ দিয়েছিল সেজো চাচা আফসার উদ্দিন আহমেদের দুই কন্যা রেনু আপা ও চায়না আপা। আমার বড় দুই বোন এসএসসি পর্যন্ত পড়েছেন কিন্তু চাকরি করেননি কেউ। আমাদের মেজো আপা মানে হাওয়া আপার ছিল পাড়া বেড়ানোর খেতাব।
উপরন্তু প্রকৃতির সন্তান হিসেবে কিছুটা চঞ্চল স্বভাবের হাওয়া’পা সাজুগুজো করতে খুব পছন্দ করতো। মেজো’পা যখন ফাইভ পাস দিয়ে স্কুল শেষ করেছে, আমি তার অনেক পরে যেতে শুরু করেছি সেই একই স্কুলে।
এই সময়ে হাওয়া’পা বিকেলের তরি-তরকারি পুনঃগরমের কাজে মাকে সাহায্য করতো। বিকেলের চা বানাতো। তখন দেখতাম, যখন চুলার পাড়ে বসে হাওয়া’পা ফুঁকনি দিয়ে চুলার আগুনে ফুঁ দিচ্ছে, তখনো তার চোখের কাজল, অধরোষ্ঠের তিলের কালি, ঠোঁটের লিপিস্টিক—এতটুকুন মলিন হতো না। সারাজীবনই মেজো’পা এই রকম পরিপাটি হয়ে থাকতে ভালোবাসতো। বড় লাল টিপ পরতো। বড়’পাকে দীর্ঘদিন লাল টিপ পরতে দেখেছি, তবে তা ছিল সহজ ও নিরাভরণ।
হাওয়া’পা তার খুব ছোট বেলায় আশে পাশের পাড়া প্রতিবেশীর বাড়ির গাছের আমতলায় যেতো আম কুড়ানোর জন্যে। আমকুড়ানো ছিল তার অন্যতম শখের একটি কাজ। মা তাকে বারণ করেও ফেরাতে পারতেন না।
তখন আমাদের বাড়িতে আম গাছ প্রায় ছিলই না। আমের দিনে আব্বা আশে পাশের বাড়ি থেকে আস্ত দুটো-তিনটা গাছ কিনে দিতেন আম খাওয়ার জন্যে। আম পাকা পর্যন্ত সেই গাছের মালিকানা থাকতো আমাদের। এভাবেও আম গাছ বেচাকেনা হতো সেসব দিনে।
আমাদের তিন বাড়ি পরেই পুব দিকে ছিলো হাওয়া আপার সই বাড়ি। সইয়ের নাম শান্ত। কেন জানি আমি তাকে শান্ত খালা ডাকতাম। ওই বাড়িতেই পীর-মুর্শিদ খাজা বাবার এক কবর ছিল। প্রতিবছর ১৫ বৈশাখ তার উরস মোবারক পালন করা হতো খুব জাঁকজমকের সঙ্গে। সইয়ের বাবা ইজারবক্স ছিল ওই মাজারের খাদেম। হাওয়া আপা ওই বাড়িতেও আম কুড়াতে যেতেন খুব ভোরে। এজন্যে ইজারবক্স আব্বাকে কাছে পেয়ে একদিন অভিযোগের সুরে বলেছিলেন, মাইজা মিয়া সাব, আপনার মাইজা ম্যায়া হাওয়া আন্দার থাকতে আমার গাছের আম গুইলা খুইট্যা নিয়া যায়। এত সাহুস ম্যায়াডার, ডরায় না, জিনে-বুতেও তো ধরতে পারে।
তবে আব্বা যখন ‘ও রেজা, কোথায় গেলি রে’ বলে ডাক দিতেন, সঙ্গে সঙ্গে এসে আমাদের বারান্দায় হাজির হতেন আব্বার সামনে।
-তাই নাকি ইজার বক্স? ঠিক আছে আমার হাওয়া মায়েরে বলে দেবো, তোমার আম গাছতলায় আর আসবে না।
হাওয়া আপাকে কিছু বলেছিলেন কিনা, সে গল্প মনে নেই, তবে এই আপার জন্যে আমাদের দক্ষিণমুখো বাড়ির পুকুরের পাড়েই আব্বার ৫ বিঘার যে একটা জমি ছিল, এই ঘটনার পরেই হঠাৎ সেই জমিতে মাটি তুলে উঁচু করে বিভিন্ন ফলের গাছ লাগিয়ে আব্বা ফলের বাগান করে দিয়েছিলেন আমাদের জন্যে। যেন অন্য কারও বাড়ির আঙিনায় আমাদের যেতে না হয়, কোনো ফলের জন্যে, আব্বাকেও যেন না শুনতে হয় কোনো না-হক কথা।
আম, জাম, জামরুল, লিচু, খেজুর, নারিকেল, পেয়ারা, আমড়া, দারুচিনি, এলাচ, কমলার গাছও ঢাকা থেকে এনে লাগিয়েছিলেন আব্বা তার মেজো কন্যার আম কুড়ানোর এই সখের কথা জেনে। এমনি সন্তানবৎসল বাবা ছিলেন তিনি।
বড়’পার কথা বলতেন, আমার বোকাসোকা, সাদাসিধে মেয়ে মায়া। ওর কোনো চাহিদা নেই। আমি যা বলি, তাতেই বলে আচ্ছা। এমন শান্ত মেয়ে হয় না কি?
পাঁচ.
আমাদের মায়ের সংসারে রান্নার জায়গা ছিল দুটো, রান্না ঘরের ভেতরে দুটো মাটির চুলা বাকি অর্ধেকটা জায়গা জুড়ে সারাবছরের জ্বালানি সংরক্ষণের জন্যে খড়িজাবার মাচা। ঘরসংলগ্ন সমুখ উঠানে মাটির চুলা আরও চারটি। কামলা-জামলার জন্যে অধিক রান্নাবাড়া, ধানসেদ্ধ, চিড়া ও মুড়ি ভাঁজার কাজে ব্যবহৃত হতো বাইরের চুলাগুলো। খেজুরের কাঁচা রস জ্বাল দিয়ে ঘন করা, কখনো সখনো পাটালি গুড় বানানোর জন্যে এই বাইরের চুলা ব্যবহার করতো রাঁধুনীরা।
বর্ষাকাল ছাড়া অধিকাংশ সময়ে রান্না হতো বাইরের চুলায়। এই বাইরের জায়গাটিকে বলতাম রান্ধনপাড়। রান্ধনপাড়ে বসে শীতকালের ভাপাপিঠে, মুরগীর পাতলা ঝোল দিয়ে মাটির খোলা থেকে মায়ের হাতে তুলে দেওয়া গরম গরম চিতই পিঠা খাবার আনন্দই আলাদা।
রসনাবিলাসী খাবারের এইসব স্মৃতি আজও খুব অমলিন স্মৃতির উপকরণ। কোনো কোনো দিনের ঘনিয়ে আসা সন্ধ্যার রাগে-অনুরাগে চুলার পারে বসে চা খেতে খেতে স্মৃতি-উষ্ণতার আড্ডাও ছিল অতুলনীয়। নানি-মা, মায়া আপা, হাওয়া আপা ছাড়া আমরা খুদেরাও থাকতাম বেশিরভাগ সময়ে।
সিরাজভাই ও ভাবি এসেও যোগ দিতেন সেই আড্ডায়। ছোট চাচার ছেলে রেজাভাই উঁকি দিয়েই চলে যেতে চাইতেন, খুব জোর দিয়ে না বললে খেতে চাইতেন না কিছু।
তবে আব্বা যখন ‘ও রেজা, কোথায় গেলি রে’ বলে ডাক দিতেন, সঙ্গে সঙ্গে এসে আমাদের বারান্দায় হাজির হতেন আব্বার সামনে। জলজ্যান্ত সেই রেজা ভাইও স্ট্রোক করে হঠাৎ চলে গেলেন সবাইকে কাঁদিয়ে। আমার চেয়ে বছর চারেকের বড় ছিলেন রেজা ভাই। আমার আব্বার নামের কলেজের গঠনপর্ব থেকেই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। কন্যা ছিল না বলে তার দুঃখছিলো মনে। কিন্তু গ্রামে থেকেই চারটি ছেলেকে অনার্স এমএ পাস করালেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
বড় ছেলে আজিম আমাদের কলেজেই ইংরেজির শিক্ষক, অসীম বাংলার শিক্ষক হিসেবে কর্মরত রয়েছে।
ফিরে যাই আবার সেই ধুসর অতীতে।
আব্বা বাড়িতে থাকলে বিকেলের চায়ের আড্ডা বেশির ভাগ সময় আমাদের বারান্দায় পাতা দীর্ঘবেঞ্চ ও চেয়ারে বসেই হতো।
সঙ্গে মুড়ি, পাঁক দেওয়া খই, সিদ্ধ অথবা আলুপোড়া নিয়মিত থাকতো, কখনো কখনো ঢাকা থেকে আব্বার আনা বিস্কুট অথবা বড়’পার হাতের চানাচুর দিয়ে মাখানো মুড়িও আব্বার খুব পছন্দ ছিল।
আব্বাহীন বাড়িতে আমার মা-ই দু’জনের ভূমিকায় একক ছিলেন। কোনো কোনো দিন স্কুল থেকে ফেরার পরে মা তখন আমাদের নাস্তা দিতেন ঘন দুধ দিয়ে পোড়া আলু, নয়তো দুধ-লাউয়ের ক্ষীর, অগত্যা গুড়ে পাক দেওয়া খই-মুড়ি।
সকালের নাস্তা হিসেবে গম অথবা যবের ছাতুও মাঝেমধ্যে খেতাম আমরা বিশেষভাবে ফাল্গুন চৈত্রমাসের দিকে। এখনো মনে আছে, অনেকদিন পর্যন্ত শক্ত খাবারও চুষে চুষে খাবার অভ্যেস ছিল আমার।
শস্য তোলা, কিংবা ধান ও পাট ক্ষেতের আগাছা নিড়ানির সময়ে বাড়িতে বাড়তি রোজের অনেক কামলারা দুপুরে খেতো। ১০ কেজির মতো চালের ভাত রান্না করা হতো প্রত্যেক বেলায়।
মা হয়তো আমাদের ভাই-বোনদের গুড় ও দুধ দিয়ে ছাতু মাখিয়ে খেতে দিয়ে চলে গেছেন অন্য কাজের তদারকি করতে। বড়’পা, হাওয়া আপা, এক এক করে সবাই খাওয়া শেষ করে উঠে যেতো। আমিই কেবল সেই ছাতুর একটা দলা মুখে পুরে চুষতে চুষতে ঘুমিয়ে পড়তাম পিঁড়িতে বসেই। বাকি ছাতুসহ ছাতুর প্লেট শুকিয়ে মড়মড়া হয়ে যেতো, বেড়াল এসে মুখ দিতো কখনো সখনো। হয়তো কোনো কাজে পুনরায় ঘরে ঢুকেছেন মা, আমাকে ঘুম-জড়ানো ওেই অবস্থায় দেখে ডেকে তুলে হাত-মুখ ধুয়ে দিতেন।
যখন আরও একটু বড় হয়েছি, ক্লাস টু থ্রিতে, তখনো উঠানের খেলাধুলার মধ্যে থেকে হঠাৎ উঠে এসে মায়ের বড় ঘরে ঢুকে বিশাল গামলা থেকে একটুখানি ভাত মুখে দিয়ে চুষতে চুষতে বেরিয়ে পুনরায় খেলায় যুক্ত হতাম।
ধারণা করি, আমার ছোট ভাই সেলিমের জন্মের মুহূর্ত থেকে সেই যে আমি মায়ের বুক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিলাম, তাই দীর্ঘকাল মায়ের বুকের দুধের নেশা আমার বোধ হয় কাটেনি।
মাকে অস্তিত্বের গূঢ় অনুভবে উপলব্ধি করতেই এমনটি করেছি হয়তো বা। নয়তো কী? মনো-বিশেষজ্ঞেরা ভালো ব্যাখ্যা নিশ্চয় দিতে পারতেন।
ছয়.
ফাল্গুন-চৈত্র মাসে যেসব শস্য কৃষকেরা ঘরে তুলতো, তাকে বলা হতো রবিশস্য। এই সময়ে ধান হতো না। কিন্তু বাকি সব শস্যই আমাদের ক্ষেতে চাষ হতো।
চিনা-কাউন, তিল-তিসি-মুগ-মসুরি-খেসারী-মাসকলই, মৌরী, কালোজিরা সরিষা, লাল-আলু, গোল-আলু, চিনে বাদামসহ সবই ফলতো আমাদের জমিতে। এমনকী বাঁশতলার ছায়াঘেরা জমিতে হলুদের চাষ হতো। পৌষ মাসের শেষ দিকে হলুদের গাছে কলাবতীর মতো ফুল হতো।
সেই ফুলে যে শিশির জমে থাকতো সৌন্দর্য চর্চায় তাই মুখে মাখতাম আমরা বড় বোনদের দেখাদেখি। এই সময়ে ধান ছাড়া নানা জাতীয় শস্যে ভাঁড়ার পূর্ণ হয়ে উঠতো।
কাজেই বছর শেষের চৈত্রমাসে অধিকাংশ গৃহস্থ বাড়িতে খাবারের চালে টান পড়তো। পরবর্তী আউশ, আমন ধান গোলায় না ওঠা পর্যন্ত। চালের সঙ্গে চিনার চাল মিলিয়ে ভাত রান্না হতো। কখনো চালের মতো চিকন করে কেটে মিষ্টি আলু ফুটন্ত ভাতের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে রান্না হতো আলু-ভাত।
সেই সময়ে মিস্টি আলুর প্রচুর ফলন হতো আমাদের ক্ষেতে। পাঁচ কেজির এক পাল্লার দাম ছিল চার আনার মতো। আলুতোলার পরে কিছুদিন ঘরের মাচার তলে ছড়িয়ে রাখতেন মা। তখন সেই আলু খেতে খুব মিষ্টি হতো। পোড়া বা সেদ্ধ যাই হোক না কেন! আবার আটার ময়ানের সঙ্গে সেদ্ধ আলুর কাঁই মিশিয়ে রুটি তৈরি করা হতো। আব্বা খুব পছন্দ করতেন এই আলুর রুটি। তো, নাস্তা হিসেবে সেদ্ধ আলু খেতো রাখালেরাও। আমাদের প্রিয় ছিল পোড়া আলু। পোড়া আলুর গন্ধে এখনো উন্মাতাল হয়ে ওঠে অতীতচারী রসনাবিলাস।
শস্য তোলা, কিংবা ধান ও পাট ক্ষেতের আগাছা নিড়ানির সময়ে বাড়িতে বাড়তি রোজের অনেক কামলারা দুপুরে খেতো। ১০ কেজির মতো চালের ভাত রান্না করা হতো প্রত্যেক বেলায়। তখন সাশ্রয় কল্পে মা ভাতের চালের সঙ্গে চিনার চাল অথবা আলুর মিশেল দিতেন। সকালে গমের জাউ অথবা খিচুড়ি রান্না করে তাদের নাস্তা দেওয়া হতো।
মায়ের খোলা রান্নার জায়গার পাশে একটা বড় হাউজ ছিলো রান্নার পানি তুলে রাখার জন্যে। আলাদা একটি কালো মাটির চারে পানি জমিয়ে রাখা হতো বাথরুমের কাজে ব্যবহারের জন্যে। সাধারণত কুয়া থেকে তুলে রাখালেরা সকালের দিকে ভরে রাখতো, সেখান থেকে পানি নিয়ে ব্যবহার করা হতো প্রয়োজন মতো।
আমি তখন বেশ ছোট, মায়ের কোল ছেড়ে মাটির কোলে হাঁটি, দৌড়াই মনের আনন্দে। গুড গুড করে পা ফেলে হাঁটি আর সবিস্ময়ে দেখি পৃথিবীর প্রতিটি নতুনকে।
এরপর তিন দিন তিন রাত্রির জ্বরে কুপোকাত। পাখির শোক বাষ্প হয়ে উড়ে গেলো জ্বরের ১০৪ ডিগ্রি তাপে। সর্বক্ষণ নানি আমার পাশে ছিলেন, সাগু বার্লির পথ্য চলতে থাকে নিয়মিত। মাঝে মধ্যে টগর আপা এসে আমাকে ঠাকুরমার ঝুলি থেকে গল্প বলেন নানা পদের।
সব শিশুদের মতো আমারও ছিল পানির প্রতি খুব ঝোঁক। মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে কখন যে চারের পানি ছুঁতে গিয়ে পানির মধ্যেপড়ে গেছি উপুড় হয়ে, মুখ মাথা পানির নিচে পা দুটো ওপরে খাড়া হয়ে আছে, মা তা টেরও পাননি। হঠাৎ আমাকে আশেপাশে দেখতে না পেয়ে মা, রান্না ফেলে উঠে দাঁড়াতেই ডান দিকে তাকিয়ে দেখেন চারের পানির মধ্যে পড়ে আছি আমি। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার দিয়ে কোলে তুলে নিয়ে, ঝাঁকিয়ে পেটের পানি বের করে ফেলেন দ্রুত। খুঁজে পেতে আর সামান্য দেরি হলেই পগার পার হতে হতো সেদিনই।
সাত.
আমাদের বাড়ির উত্তর দিকে বড়দের জন্যে ছিল টিনের চার চালায় ঘেরা মজবুত চারটি মোটা কাঠের খামে দাঁড়ানো, কাঠের পাটাতনে তৈরি পায়খানা।
আর আমাদের মতো ছোটদের জন্যে ছিল কাঠের তিনটি টুকরো দিয়ে টেম্প্রোরারি একটি পায়খানার জায়গা। মূল পায়খানায় যাওয়ার আগেই হাতের বাম দিকে আমাদের বাড়ির শেষ সীমানাঘেঁষে সেটি পেতে রাখা হতো—যত দিন না শিশুদের বড় পায়খানা ব্যবহারের উপযুক্ত বয়স হতো।
ডানদিকে ছিল বইড়া বাঁশের বড় একটা ঝাঁড়। গা ছম ছম করা সেই বাঁশের ঝাঁড়টি কঞ্চিতে এতই আকীর্ণ ছিল যে, চাইলেও তার কাছে যাওয়া যেতো না। উপরন্তু প্রত্যেক দিন সকালে রাঁধুনি টুলির মা এসে চুলা থেকে ছাই তুলে ফেলে দিতো সেখানে। এই করে একটা ছাইয়ের ঢিপি তৈরি হয়েছিল। পেছন বাড়ির এই অংশটিকে বলা হতো কাঞ্চিকোণা। সন্ধ্যার পরে সাধারণত এই কাঞ্চিকোণায় কেউ আসতো না।
‘কাঞ্চিকোণা’ এই শব্দটি নানি ও মায়ের মুখে শোনা আমার খুব প্রিয় শব্দের একটি। আমরাও বলতাম কাঞ্চিকোণা। এই শব্দটি প্রায় হারিয়ে গেছে, কোথাও কারও মুখে শুনি না আর।
আমাদের এই বড় প্রসাধন ঘরের টিনের চাল ও খামের ঊরু-সন্ধিতে দোয়েল পাখি-দম্পতির একটা বাসা ছিল। আমরা বলতাম দইনাচা পাখি। ক’দিন পর পর সেখানে দোয়েল পাখি ডিম পেরে ছানা ফুটাতো। ওই ছানার প্রতি ছিল আমার দুর্বার লোভ, আকাশে ওড়া ওই সুদূরের পাখি, একদম আমার হাতের নাগালে। ভাবা যায়! এ যেন স্বপ্নে দেখা সময়।
সুদূরকে এভাবেই নিজের হাতের নাগালে পেতে প্রবল ইচ্ছে হতো আমার। ফলে উপর্যুক্ত বয়সের আগেই আমি বড়দের পায়খানা ব্যবহার করতে শুরু করি, পাখির ডিম ও ছানাগুলো দেখার লোভে।
আমি তার নীলাভ ডিমের ওপর খয়েরি রঙের স্পটগুলো প্রথম দেখি, বিপুল বিস্ময়ে বিমোহিত হই, হাতের তালুতে নিয়ে ছুঁয়ে দেখি। ঘোরলাগা চোখে দোয়েল পাখির তুলতুলে ছানা দুটোকে হাতের স্পর্শে ভালোবাসা জানাই। খুব আপন মনে হয় ওদের, যেন বা আমার সমগোত্রীয় কেউ!
তখন থেকেই পাখি পুষতে ইচ্ছে জাগলো আমার মনে। পাখিকে নিজের করে পেতে ইচ্ছে করে। ছানাদুটো ওড়া শিখবে শিখবে, এমন সময়ে একটা ছানা নিয়ে পুষতে শুরু করি। পাখি মায়ের জন্যে একটা শাবক রেখে অন্যটি নিয়ে আসি নিজের জন্যে। কিন্তু কোথায় রাখবো?
খাঁচার ধারণা নেই। মাকে কিছু বলতেও পারছি না। নিজের বুদ্ধি প্রয়োগ করে আমি আর সেলিম তখন আমাদের দক্ষিণ ভিটার ঘরের মাটির ডোয়া খুঁড়ে লম্বা একটা গর্ত করেছি, ওর মধ্যে খড়-বিচালি দিয়ে নরম একটা বিছানা করে পাখিটিকে রাতে ঘুমাতে দেই সেখানে। সকালে বের করে চাল খাওয়াই। ছোট্ট হলুদ চঞ্চু দুটো ফাঁক করে ৩/৪টা চালের দানা ওর পেটে চালান দিয়ে দেই। এরপর পানি দেই, যেন গলায় আটকে না থাকে খাবার। এইভাবে তিন দিনের মাথায় সকালে উঠে পাখিটি বের করতে গিয়ে দেখি, শূন্য ঘর, পাখি নেই সেখানে।
আমি আর সেলিম দু’জনেই হায় হায় করছি। মা এসে বললেন, তোমাদের পোষা পাখিটি বেড়াল নয়তো শেয়ালে খেয়েছে।
এ কথা শুনেই আমি কান্না শুরু করেছি। টগর আপা আমাকে নিয়ে তাদের ঘরে গিয়ে এটা সেটা বলে কান্না থামালেন। বড় চাচার সবচেয়ে ছোট মেয়ের নাম টগর। ছোটরা আমরা তাকে টগর আপা বলে ডাকতাম।
কিছুক্ষণ টগর আপার সঙ্গে কাটিয়ে ফিরে এসে বড় পায়খানায় গেছি, প্রাকৃতিকের বড় কাজটি সারতে। বড়রা যেখানে বসে কাজটি সারতো, তা ছিল বড়দের মাপে ফাঁকা করে কাটা। তুলনামূলক আমার ছোট্ট দুটো পা দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে বেশিক্ষণ যে বসে থাকা দুরূহ হবে, তা কে আর জানতো।
যথারীতি ওই ফাঁক গলিয়ে আমার ছোট্ট শরীর নিয়ে আমি নিচে পড়ে গেছি। গলা পর্যন্ত ডুবে গেছে স-মলে। সম্ভবত চিৎকার দিয়েছিলাম, আমার কিছু মনে নেই। নানি দৌড়ে গিয়ে আমাকে তুলে এনেছিলেন, কিভাবে সেটিও মনে নেই। তবে নানি যে অনেকগরম পানি, ঠাণ্ডা পানি, সাবান পানি দিয়ে আমাকে ধুয়ে সাফ-সুতরো করে তুলেছিলেন। সেই দৃশ্য মনে আছে যে, এক সময় আমি ভয়ে ও শীত-ঠাণ্ডায় থরথর করে কাঁপছিলাম। মা অদূরে দাঁড়িয়ে কাঁদছে, আর নানি আমাকে ৫৭০ সাবান মাখাচ্ছেন কেবলি। এরপর তিন দিন তিন রাত্রির জ্বরে কুপোকাত। পাখির শোক বাষ্প হয়ে উড়ে গেলো জ্বরের ১০৪ ডিগ্রি তাপে। সর্বক্ষণ নানি আমার পাশে ছিলেন, সাগু বার্লির পথ্য চলতে থাকে নিয়মিত। মাঝে মধ্যে টগর আপা এসে আমাকে ঠাকুরমার ঝুলি থেকে গল্প বলেন নানা পদের।
আট.
টগর আপা খুব স্নেহ করতেন আমাকে। মাথা ভর্তি চুল ছিল আমার, কিন্তু আঁচড়াতে চাইতাম না। টগর আপা ধরে ধরে চুলবেঁধে কলা বেণী করে দিতেন।
সদ্য বিয়ে হয়েছে তার, সামেজ দুলা ভাইয়ের সঙ্গে। সামেজ দুলা ভাইয়ের বাড়ি আমাদের পাশের তেরশ্রী গ্রামে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও জাতীয় জীবনের বিভিন্ন পর্বে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী এই গ্রামের বিশেষ অবদান।
ভয়ে আমি আঁতকে উঠেছি এই ভেবে যে, ওখানে তো ঘা আছে, টগর আপা যে সাবান মাখছে এতে তো জ্বালা করবে, ঘায়ের জায়গায় ধরবে না বুঝি? ভাবছি, কিন্তু মুখে কিছুই বলছি না, কিন্তু সবিস্ময়ে তাকিয়ে আছি সেদিকটায়।
সামেজ দুলাভাই ঢাকায় চাকরি করেন, মাসে মাসে শ্বশুর বাড়িতে আসেন, তখনো আপাকে তুলে নেননি। বিয়ের পর থেকে নানারকম সুগন্ধী প্রসাধনী ব্যবহার করেন টগর আপা। দুলাভাই এলে তো কথাই নেই। এখনো মনে পড়ে তিব্বত স্নো মাখতে খুব ভালোবাসতেন। টগর আপার কাছে গেলেই এই গন্ধটি আমার ছোট্ট প্রাণেও খুব সাড়া পড়ে যেতো।
খুব আকুল আকুল ভাব জাগতো মনে। সুদূর ওই শৈশবে টগর আপার তিব্বত স্নো ও আব্বার গায়ের গন্ধ আমাকে না পাওয়ার বিষণ্নতায় ভাসাতো-ডুবাতো।
এই গন্ধের জন্যেই কি না, জানি না, আমি টগর আপার খুব গা-ঘেঁষে থাকতাম। যাকে বলে নেওটা। টগর আপাও কেন জানি বাড়ির বাইরে যখনই কোথাও যেতো, আমাকে সঙ্গে নিতো।
আমাদের বাড়ির মেয়েদের পায়ে হেঁটে দূর কালিগঙ্গা নদীর জলে গোসল করা নিষেধ ছিল। বহির্বাড়ির পুকুর, নয়তো পাশের বাড়ির হাওয়া আপার সই শান্ত খালাদের বাড়ির পুকুরে যেতে হতো।
বাড়ির বউয়েরা অর্থাৎ আমাদের মা বা চাচিরা কুয়ার পানিতে গোসল করতেন যার যার আলাদা গোসলখানায়। তারা কখনো বাইরের পুকুরেও যেতেন না।
টগর আপা আমাকে সঙ্গে নিয়ে গোসলে যান মাঝে-মধ্যেই। সেদিন আমাকে নিয়ে গেলেন শান্ত খালাদের পুকুরে। এই পুকুরটাতে গোসলের নামে মেয়েদের আড্ডা হতো বেশির ভাগ সময়জুড়ে। বড়’পা, হাওয়া আপাও আসতো। নিজের সইয়ের বাড়ি বলে সবচেয়ে বেশি আসতো হাওয়া আপা।
জলডুমুর আর বাঁশঝাড়ে ঘেরা অসাধারণ ছায়াময় এই উতল পুকুরটি ছিলো আমার শৈশবের সবুজ রঙে আঁকা শান্তশ্রীময় একটি জলছবি।
তার পাশে ছিল মোটাতাজা পর পর সাজানো কতগুলো গাব গাছ। বাকিটা ঘন বাঁশঝাড়ে আকীর্ণ, যেন কালি মেঘে আকাশঢাকা। যেখানে ভূতের ভয় অতিক্রম করে জড়সড়ো ছেলেবেলা সতত কৌতূহলী ছিল।
চৈত্রমাসের দুপুরে এরকম ছায়াময় গাছপালাদের সঙ্গে আমপাক্কি খেলতাম।
এই খেলার একটি নিয়ম ছিল এ রকম যে, আমি যে গাছটাতে উঠতাম, সেখানে উঠে আমাকে যদি অন্য কেউ ছুঁয়ে দেয়, তাহলে আমি মরা হয়ে যেতাম। কিন্তু এই ফাঁকে আমার দলের কেউ নিচে নেমে আমের কাঠি ছুঁয়ে দিতে পারে, তাহলে, যে আমাকে ছুঁতে গাছ উঠেছে, সে মরে যাবে। এই ছিল নিয়ম। ঘুরে ঘুরে চলতো দীর্ঘক্ষণ।
এইসব গাছ উঠে অন্য সময়ে হলুদ রঙের পাকা গাব খুঁজে বেড়াতাম। কার আগে কে কতটা খুঁজে পায়, সেই নিয়ে প্রতিযোগিতা চলতো গাছে উঠে।
এছাড়া আমাদের ফলের বাগানে কলাগাছের চিপায় চিপায় ঘর বানিয়ে সংসার সংসার খেলা করতাম। এই খেলার আমারপছন্দের খেলার সঙ্গী ছিল হাতেম ফেরাজির মেয়ে মহেলা। আমাদের রাখাল আজাহারের চাচাতো বোনের মেয়ে ছিল মহেলা। কোনোদিন স্কুলে যায়নি। ওদের বাড়ি ছিল আধামাইল দূরের এক পাড়ায়। কিন্তু প্রায়ই নানির বাড়িতে এসে থাকতো বলে, সেও আমার আপৎকালীন সঙ্গী ছিল।
তো, শান্ত খালাদের পুকুরে গোসল করতে যেতো আমার বোনেরাও। গরমের দিনে এই পুকুরের পানি খুব ঠাণ্ডা থাকতো। ধারণা করি, ফাল্গুন চৈত্র মাসে এজন্যে আমাদের রৌদ্রদগ্ধ পুকুরের গরম পানি ছেড়ে বড়’পা, হাওয়া আপা অর্থাৎ আমাদের বাড়িরসেয়ানা মেয়েরা এই পুকুরে আসতো গোসল সারতে।
শান্ত খালাদের পুকুরটা খুব গভীর এবং পিছলে ছিল। অল্প পানিতে আমি বসে একটু একটু করে গা ভেজাচ্ছি মাত্র। টগর আপা হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে শাড়ি পেটিকোটের ভেতরে হাত দিয়ে সাবান মাখছেন তার নিম্নাঙ্গে। হঠাৎ আমার চোখ পড়েছে সেদিকে। প্রথম দেখা এই দৃশ্যে আমি হত-বিহবল। সিমোন দ্য বোভোয়ারও পড়িনি, এমন দৃশ্য আগে কখনো দেখিওনি।
ভয়ে আমি আঁতকে উঠেছি এই ভেবে যে, ওখানে তো ঘা আছে, টগর আপা যে সাবান মাখছে এতে তো জ্বালা করবে, ঘায়ের জায়গায় ধরবে না বুঝি? ভাবছি, কিন্তু মুখে কিছুই বলছি না, কিন্তু সবিস্ময়ে তাকিয়ে আছি সেদিকটায়।
মেয়েরা যে তাদের যৌনাঙ্গকে ক্ষতস্থান মনে করে, আমি নিজেই তার প্রমান পেয়েছি ওই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বয়সেই। এই সময় টগর আপা হাত বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে, বললেন, আয় আয় তোরে পরিষ্কার পানি থেকে ডুব দিয়ে দেই। নির্ভয়ে তার হাতে সপে দিলাম নিজেকে একটি জলডুবের আশায়।
চলবে..
বালিকার চরৈবেতি-৫॥ দিলারা হাফিজ