অনুবাদ: ফারহানা রহমান
[পর্ব-৫]
[ড. মায়া অ্যাঞ্জেল্যু—আমেরিকান কবি। তার জন্ম ১৯২৮ সালের ৪ এপ্রিল। মিসোরি রাজ্যের সেন্ট লুইস শহরে। ছিলেন একাধারে, কণ্ঠশিল্পী, অভিনেত্রী, নাট্যকার, শিক্ষক ও একজন জীবনীকার। তার পুরো নাম মার্গারেট অ্যানি জনসন।
১৯৯৩ সালে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি তার নিজের লেখা কবিতা ‘পালস অব মর্নিং’ আবৃত্তি করেন। এজন্য পরে গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডও পান। ইতোপূর্বে ১৯৬১ সালে একমাত্র কবি রবার্ট ফ্রস্টই প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ‘দ্য গিফট আউটরাইট’ কবিতাটি আবৃত্তি করার সম্মাননায় ভূষিত হয়েছিলেন।
১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা নিজের অভিষেক অনুষ্ঠানে মায়া এঞ্জেলোর কবিতা পাঠ করে তাকে সম্মান দেখান। কর্মজীবনে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। সমগ্র পৃথিবীর ৭০টিরও বেশি ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি সম্মাননা পান। প্রায় ৫০টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিলিট বা ডক্টর উপাধি পান।
১৯৬৯ সালে তার প্রথম আত্মজীবনী ‘আই নো হোয়াই দ্য কেজড বার্ড সিংস’ বইটি প্রকাশিত হলে বিশ্বব্যাপী তিনি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। বইটি পরবর্তী দুবছর ধরে নিউ ইয়র্ক টাইমস এর বেস্ট সেলার তালিকায় সর্বোচ্চ স্থান দখল করে ছিল। ২০১৪ সালের ২৮ মে সকালে অ্যাঞ্জেল্যু চিরনিদ্রায় চলে যান। চিন্তাসূত্রের জন্য এই মহান লেখকের আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ড ‘আই নো হোয়াই দ্য কেজড বার্ড সিংস’-এর বাংলা অনুবাদ করেছেন কথাশিল্পী-কবি-অনুবাদক ফারহানা রহমান। নাম দিয়েছেন, ‘আমি জানি খাঁচার পাখিরা কেন গান গায়’। আজ প্রকাশিত হলো পঞ্চম পর্ব]
কোনো নোংরামি-বেহায়াগিরি বরদাশত করা হবে না। আমাদের জন্য দাদির কাছ থেকে ছিল এই দুটি চিরন্তন বাণী। আর এগুলো থেকে আমাদের জীবন কখনো নিস্তার পায়নি।
ভয়াবহ শীতের মধ্যেও প্রতিরাতে বিছানায় যাওয়ার আগে আমরা মুখ, গলা, হাত-পা ধুতে বাধ্য হতাম। তিনি মুখে কৃত্রিম হাসি নিয়ে বলতেন, ‘পবিত্র মানুষদের অশুচি অবস্থায় নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, যতদূর সম্ভব ধুয়ে ফেলো তাহলেই ধোয়া হবে।’
আমরা কুয়োর কাছে গিয়ে বরফের মতো ঠাণ্ডা জল দিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে নিতাম। একইরকম ঠাণ্ডা শক্ত ভেসলিন পায়ে মালিশ করতাম। তারপর পা টিপে টিপে বাসায় ঢুকতাম। পায়ের আঙুল থেকে ধুলো মুছে স্কুলের হোমওয়ার্ক করতে বসতাম। তারপর ভুট্টার রুটির পর ননীসহ দুধ খেয়ে প্রার্থনার পর বিছানায় চলে যেতাম। প্রতিদিন সবকিছু এভাবেই পর্যায়ক্রমে চলতো। আমরা ঘুমিয়ে যাওয়ার পর প্রচণ্ড শীতের মধ্যে কম্বল টেনে নিয়ে আমাদের পা যথেষ্ট পরিষ্কার হয়েছে কি না, তা দেখার ব্যাপারে দাদি বিখ্যাত ছিলেন। তার কাছে যদি পাগুলো যথেষ্ট পরিষ্কার মনে না হতো, তাহলেই তিনি সুইচ অন করে দিতেন (জরুরি প্রয়োজনের জন্য তিনি একটি সুইচ বেডরুমের দরজার পেছনে রাখতেন)। এরপর জ্বালাময়ী ভাষণ দিতে দিতে অপরাধীদের ঘুম ভাঙাতেন।
রাতের বেলা কুয়োর চারপাশটা অন্ধকার আর পিচ্ছিল হয়ে থাকতো। ছেলেরা আমাদের বলতো যে, জল সাপের কাছে ভীষণ প্রিয় জিনিস। তাই কেউ যদি রাতে একা একা ওখানে দাঁড়িয়ে থাকে বা কুয়ো থেকে জল উঠিয়ে হাত-পা ধোয়, তখন ডোড়াসাপ আর র্যা টলস্নেক, পাফএডার (আফ্রিকার বিষধর সাপ), ও বিশাল অজগর সাপ সে কথা জেনে যায়। ওই সময় হয়তো তারা কুয়োর ভেতর জল খাওয়ার জন্য ঝুঁকে ছিল। আর যখনই কেউ মুখ ধোয়ার জন্য চোখেমুখে সাবান মাখবে ঠিক, তখনই সাপগুলো এসে হাজির হবে। মোমা আমাদের সান্ত্বনা দিয়ে বোঝাতো যে, এসব সত্যি না। আর ধর্মের পরেই হচ্ছে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার স্থান। অপরিচ্ছন্নতা মানুষের জীবনে দুর্ভোগ আর দারিদ্র্য বয়ে আনে।
নোংরা ছোট বাচ্চাগুলো স্টোরের আশেপাশে থেকে এমনভাবে অর্ডার করতো, যেন একটি বিড়াল তার নয়টা লেজ দিয়ে বাড়ি মারছে।
ঈশ্বর বেহায়া বাচ্চাদের খুবই অপছন্দ করেন। তারা পরিবার, বাবা-মা আর সমাজের জন্য লজ্জা ও ধ্বংস বয়ে আনে। বড়দের মিস্টার, মিসেস, মিস, আনটি, কাসিন, আংকেল, বুহবাহ, আপু, ভাইয়া ও আরও এরকম হাজারটা খেতাবে ডাকা হোতো। আর এসবই নির্ভর করতো পরিবারগুলোর ভদ্রতা, শিক্ষাদীক্ষা আর অবস্থানের ওপর।
আমি যাদের চিনতাম, তারা সবাই এই প্রথাগত আইন মেনে চলতো। শুধু গরিব অল্পশিক্ষিত শ্বেতাঙ্গ বাচ্চাগুলো ছাড়া। স্কুলের পেছনের দিকে মোমার খামারের জমিতে এমন কিছু গরিব অল্পশিক্ষিত শ্বেতাঙ্গ পরিবার থাকতো। মাঝেমাঝে তারা দল বেঁধে স্টোরে আসতো। তারা তখন সম্পূর্ণ রুমটিতে গিজগিজ করতো। আর তখন রুমের হাওয়াই বদলে যেতো এমনকী অতি পরিচিত গন্ধ পর্যন্ত। তাদের বাচ্চাগুলো হামাগুড়ি দিতে দিতে তাকের ভেতর ও আলু-পেঁয়াজের ঝুড়ির ভেতর ঢুকে পড়তো। সিগারবক্স গিটারের মতো তারা সারাক্ষণ তাদের তীক্ষ্ণ গলায় শব্দ করেই যেতো। আমাদের স্টোরের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা তারা দখলে নিয়ে নিতো। আমার কক্ষনোই সেই সাহস হতো না। মোমা সবসময় বলতো যে সাদা লোকজনের সঙ্গে যত কম কথা বলবে, ততই মঙ্গল (এমনকী এইসব অল্প শিক্ষিত গরিব সাদা মানুষদের সঙ্গেও)। আমি আর বেইলি সেই অস্বস্তিকর পরিবেশে গম্ভীর হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতাম। আর কখনো যদি খেলতে খেলতে কোনো একটা ছোট্ট ভূতের মতো বাচ্চা আমাদের কাছে চলে আসতো, তাহলে আমি তাকে চিমটি মারতাম। এটা করতাম মূলত কিছুটা হতাশা থেকে। এছাড়া ওগুলোকে আসলে কখনো রক্তমাংসের মানুষই মনে করতাম না।
স্টোরের ভেতর তারা আমার আংকেলের নামের প্রথম অংশ ধরে ডেকে কিছু একটা করার জন্য আদেশ করতো। আমি লজ্জায় কাঁদতে কাঁদতে দেখলাম আংকেল দৌড়ে গিয়ে তাদের দেওয়া আদেশ পালন করছেন। এমনকী দাদিও তাদের আদেশ মেনে চলতেন, যদিও তাকে ক্রীতদাসীর মতো মনে হতো না। তিনি জানতেন যে, তারা এসবই অর্ডার করবে।
দাদি তাদের উদ্দেশে বলেন, এখানে চিনি আছে মিস পোর্টার! আর এখানে বেকিং পাউডার। গতমাসে তো আপনি এগুলো কিনতে ভুলে গিয়েছিলেন। আপনার হয়তো এসব লাগবে।
মোমা সবসময় বড়দের সঙ্গেই কথা বলতেন। কিন্তু মাঝেমাঝে, ওহ! মাঝেমঝে এমন ভয়ানক ঘটনাও ঘটতো যে, কিছু নোংরা, ঘৃণ্য উন্নাসিক মেয়েরা কথা বলে উঠতো—না, অ্যানি।
মোমাকে বলতো? ভাবা যায়? যিনি এই সব জমিজমার মালিক, যেখানে তারা আশ্রিত। এরা সেইসব মানুষ, যারা যা কিছু শিখেছিল তারচেয়ে বেশি ভুলে গেছে। এই পৃথিবীতে সত্যি যদি কোনো ন্যায়বিচার থাকতো, ঈশ্বর তখনই তাদের বোবা বানিয়ে দিতেন!
তারা দাদির উদ্দেশে বলতো, না, আমাদের শুধু বাড়তি কিছু সোডি ক্রাকারস আর আরও কিছুটা বেশি ম্যাকারল দিয়ে দাও।
এটাই একমাত্র সান্ত্বনা ছিল যে, ওরা কখনো দাদির মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার সাহস দেখাতো না। আমি আসলে কখনো তাদের সে অবস্থায় ধরতে পারিনি। তাদের কোনো শিক্ষাই ছিল না। এমনকী একজন কুলিমজুরের মতোও তাদের কোনো ভদ্রতাবোধ ছিল না। তারা কী করে একজন বয়স্ক মানুষের দিকে তাকাবে? এতে এটাই বোঝা যেতো যে, তারা যা বলছে, সেসব কথা আসলে বলার আগেই ফিরিয়ে নিচ্ছে। নোংরা ছোট বাচ্চাগুলো স্টোরের আশেপাশে থেকে এমনভাবে অর্ডার করতো, যেন একটি বিড়াল তার নয়টা লেজ দিয়ে বাড়ি মারছে।
আমার তখন প্রায় দশ বছর বয়স, সে সময় সেই জঘন্য বাচ্চাগুলো দাদির সঙ্গে আমার জীবনের সবচেয়ে কষ্টকর ও বিভ্রান্তিকর অভিজ্ঞতাটি ঘটাতে বাধ্য করেছিল।
চোখের জলে ভেসে যেতে যেতে আমার কাছে সামনের উঠোনটিতে দেখা সবকিছু ঝাপসা আর অপ্রকৃত মনে হতে লাগলো।
গ্রীষ্মের এক সকালে আমি স্টোরের উঠোনের সামনে পড়ে থাকা শুকনোপাতা, সুগন্ধী পুদিনা চুইংগামের মোড়ক, ভ্যানিলা সসেজের লেবেলগুলো ঝাড়ু দিচ্ছিলাম। হলুদ-লাল ময়লাগুলো অর্ধচাঁদের মতো ডিজাইন করে একপাশে জড় করে রাখছিলাম, যেন সেগুলোকে মুখোশের মতো দেখতে লাগে। আমি ঝাড়ুটাকে স্টোরের পেছনে রেখে বাড়ির পেছন দিক দিয়ে ঘুরে সামনের বারান্দায় এলাম। ওখানে দাদিকে তার অনেক কুঁচি দেওয়া তার সাদা বিশাল ফ্রকটা পরা অবস্থায় খুঁজে পেলাম। অ্যাপ্রোনটা এতই মাড় দেওয়া ছিল যে, ওটা দাদিকে একা একাই দাঁড়িয়ে রাখতে পারতো। দাদি উঠোনটার প্রশংসা করছিলেন, আর আমিও তাতে যোগ দিয়েছিলাম। এটিকে সত্যি সত্যি বড় চিরুনি দিয়ে আঁচড়ানো একটি সোজা লাল চুলওয়ালা একটি মাথার মতো দেখতে লাগছিল। মোমা মুখে কিছু বললো না কিন্তু আমি জানতাম যে তার এটা খুব পছন্দ হয়েছে। তিনি স্কুলের প্রিন্সিপ্যালের বাড়ির দিকে অর্থাৎ মিস্টার ম্যাকএলরয়ের দিকে তাকাচ্ছিলেন। তিনি খুব আশা করছিলেন যেন সারাদিনের ব্যবসার কার্যক্রমের ফলে এটি মুছে যাওয়ার আগেই যেন অন্তত সমাজের গুরুত্বপূর্ণ কেউ একজন এই ডিজাইনটা দেখুক। তারপর তিনি স্কুলের ওপর দিয়ে উঁচুতে তাকালেন। আমিও তার দৃষ্টি অনুসরণ করলাম। আমরা দুজনই ওইসময় দেখতে পেলাম যে ফাজিল সাদা বাচ্চাগুলোর একটি দল পাহাড়ের ওপর থেকে সারি বেঁধে স্কুলের পাশ দিয়ে এদিকেই আসছে।
আমি মোমার দিকে তাকালাম, তিনি কী করেন সেটা বোঝার জন্য। তিনি কোমর নিচু করে মাটিতে বসে খুব ভালো কাজ করেছিলেন। কিন্তু তার কোমরের ওপরের অংশ দেখে মনে হচ্ছিল যে, তিনি যেন একটি ওক গাছকে রাস্তা থেকে টেনে আনতে চাচ্ছেন। তারপর তিনি বিলাপ করে করে দোয়াদুরুদ পড়তে লাগলেন। হয়তো তিনি কাঁদছিলেন না, তবে গলার স্বর এতই নিচু আর উদ্ভট ছিল যে, তিনি বরং কাঁদতে পারলেই ভালো করতেন। তিনি আমার দিকে আর একবারও তাকালেন না। বদমাইশ বাচ্চাগুলো যখন প্রায় স্টোরের কাছাকাছি চলে এসেছে, তখন শুধু তিনি এতটুকুই বলতে পারলেন যে, বোন আমার, যাও তুমি বাড়ির ভেতরে ঢুকে যাও।
আমি মোমার কাছে আকুতি জানাতে চেয়েছিলাম, মোমা ওদের জন্য অপেক্ষা না করে আমার সঙ্গে ভেতরে চলো প্লিজ। যদি তারা স্টোরে আসে, তাহলে তুমি বরং বেডরুমে ঢুকে যেও। আমি ওদের জন্য অপেক্ষা করবো। যখন তুমি আমার সঙ্গে থাকো তখনই শুধু ওরা আমাকে ভয় দেখায়। কিন্তু আমি একা থাকলে ওদের দেখে নেবো। কিন্তু হায়! আমার গলা দিয়ে একটি শব্দও বের হলো না। আর আমি দৌড়ে ভেতরে গিয়ে দরজার পর্দার পেছনে লুকালাম।
সামনের বারান্দায় ঢোকার আগেই তাদের বিকৃত শব্দের হা হা হো হো করে হেসে ফেটে পড়ার আওয়াজ শুনতে পেলাম। তারা যেন চুলার মধ্যে পাইন গাছের গুঁড়ি দিলে যেভাবে ফটফট শব্দ করে ফাটে সেভাবে বিকৃত শব্দে ফেটে পড়ছে। আমার মনে হয় আমি সারাজীবন ধরে মনের মধ্যে যে একটা বিকৃত ভয় (প্যারানইয়া) নিয়ে কাটিয়ে দিলাম, সেটার অন্যতম কারণ হচ্ছে সেই দিনটি। যেদিন পর্দার পেছন থেকে অপেক্ষা করে করে কাটিয়েছিলাম শীতল-গাঢ় ধীর মুহূর্তগুলো। তারা শেষ পর্যন্ত মাটির ওপর পাথরে পরিণত হওয়া মোমার সামনে এসে দাঁড়ালো। তারা প্রথমে খুব গাম্ভীর্যের ভান করতে লাগলো। তারপর একজন এগিয়ে এসে নিজের ডান হাতটি বাম হাতের ওপর ভাঁজ করে মুড়িয়ে নিয়ে মুখটা উঁচুতে তুলে গুনগুন করে গান গাইতে লাগলো। আমি বুঝতে পারলাম যে, সে আমার দাদিকে ভেঙাচ্ছে। আরেকজন এসে বললো, আরে না হ্যালেন! তুমি তো ওর মতো করে দাঁড়াতেই পারছো না। এটা এরকম হবে। তারপর সে তার হাত ভাঁজ করে তার বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে উদ্ভট একটা গাড়ির মতো রংঢং করতে লাগলো। যেন সে অ্যানি হ্যান্ডারসন হয়ে গেছে। আরেকজন এসে হে হে করে হাসা শুরু করে দিলো—আরে, আরে কিছুই হচ্ছে না, তুমি পারবে না বুঝলে। তোমার মুখটা ঠিক এমন করে গোল হয়ে খোলে না। এটা এমন হবে। বলে সে কুকুরের মতো মুখভঙ্গি করলো।
দরজার পেছনে রাখা রাইফেলের কথা আমার মনে পড়ে গেলো। যদিও জানতাম যে, আমি এতই ছোট যে, এটা কখনোই সোজা করে ধরতে পর্যন্ত পারবো না। আর ৪১০, আমাদের সুড অব সটগান (বন্দুক) যেন সব সময় গুলি ভরা থাকে। আর সেটা প্রতি নববর্ষ শুরুর আগের রাতে চালানো হয়। সেটা এখন ট্রাংকে বন্দি হয়ে আছে আর আংকেল উইলির চেইনের মধ্যে সেটার চাবি ঝুলে আছে। দরজার ছোট্ট ফুটো দিয়ে আমি দেখতে পেলাম মোমার কান্নার মতো গুনগুন শব্দের সঙ্গে তার হাতগুলো কাঁপছে। আর অ্যাপ্রোনের ওপর দিয়েই সেটা দেখা যাচ্ছে। তার হাঁটুগুলো এমনভাবে মাটির সঙ্গে আঁটকে আছে যেন, সেটা আর কখনোই নিজে থেকে ভাঁজ হবে না।
মোমা গেয়েই চলেছিলেন। আগের চেয়ে উচ্চস্বরে অথবা কোমলভাবে নয়। আর খুব ধীরে বা দ্রুতও নয়। মেয়েগুলোর নোংরা সূতির জামা থেকে শুরু করে তাদের হাত-পা-মুখ-দেহ সবই আরও নোংরা হয়ে উঠলো। আর তাতে তারা একেকজন একেকটি চিড়িয়ায় পরিণত হলো। তাদের উসকোখুসকো চিটচিটে ফ্যাকাসে চুলগুলো মাথার সঙ্গে ঝুলতে লাগলো। এ সবকিছু নিয়ে শেষপর্যন্ত তাদের বিকট লাগতে লাগলো। ভালো করে তাদের চেহারা দেখার জন্য আমি হাঁটু গেঁড়ে বসলাম। আমি চিরকাল তাদের চেহারাগুলো মনে রেখেছিলাম। সেদিন যে জামাটির ওপর আমার চোখের জল পড়েছিল। তা অবিশ্বাস্যভাবে গাঢ় রঙের দাগ হয়ে রয়ে গেলো। চোখের জলে ভেসে যেতে যেতে আমার কাছে সামনের উঠোনটিতে দেখা সবকিছু ঝাপসা আর অপ্রকৃত মনে হতে লাগলো।
আমি ঠিক কতক্ষণ এসব অপকর্মের মধ্যে নিজেকে না জড়িয়ে বাইরে থাকতে পারতাম? আমি কী ধরনের ব্যবহার করলে মোমা খুশি হতেন?
সেদিন পৃথিবীটা এমনই একটি দীর্ঘশ্বাস নিয়েছিল, যেন সে আর কখনো তার নিজ আবর্তে ঘুরবে কি না, সে ব্যাপারে সে নিজেই সন্দিহান হয়েছিল। নোংরা মেয়েগুলো মোমাকে নানাভাবে ভেঙাতে লাগলো আর আরও বেশি করে উত্যক্ত করে লাগলো। একজন চোখ টেড়া করে মুখের মধ্যে দুই আঙুল ঢুকিয়ে টানটান করে ভেঙাতে ভেঙাতে বললো, এদিকে তাকাও অ্যানি। দাদি গুনগুন করেই যেতে লাগলেন। আর তার অ্যাপ্রোনটা থরথর করে কাঁপতে লাগলো। আমি তাদের চোখেমুখে এক মুঠো কালো গোলমরিচের গুঁড়ো ছিটিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। তাদের উপর ক্ষার (এসিড) ছুড়ে দিতে চেয়েছিলাম। চিৎকার করে বলতে চেয়েছিলাম, তোমরা সব নোংরা মানুষ। চিৎকার করে বলতে চেয়েছিলাম তোমরা সব বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ ফকিন্নির দল। কিন্তু আমি জানতাম যে, আমি শুধু একজন পর্দার পেছনের বন্দি কয়েদি বই তো কিছু নই। বাইরের অভিনেতারা যেমন শুধু তাদের রোলে অভিনয়টুকুই করে যায়, ঠিক তেমনই একজন।
তাদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত ছোট একটা মেয়ে পুতুল নাচের মতো করে ভঙ্গি করে লাচতে শুরু করলো। আর এই নাচ দেখে তার অন্যসব ভাঁড় বন্ধু হাহাহিহি করতে শুরু করে দিলো। কিন্তু এদের মধ্যে সবচেয়ে লম্বা মেয়েটা যে আসলে এরইমধ্যে একজন মহিলা হয়ে উঠেছে, সে খুব দ্রুত কিছু একটা বললো, যা আমি শুনতে পাইনি। তারা সবাই বারান্দা ছেড়ে পেছনের দিকে চলে যেতে লাগলো। তখনো তারা মোমার দিকে ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছিল। মুহূর্তের জন্য আমার কেন যেন এমন মনে হতে লাগলো যে মোমা, ইতিমধ্যে একটি পাথরে পরিণত হয়ে গিয়েছিলেন। তার দিকেই হয়তো বদমাইশ বাচ্চাগুলো পাথর ছুড়ে মারবে। কিন্তু সবচেয়ে বড় ধেড়ে মেয়েটা উল্টো দিকে ঘুরে গেলো। তারপর সে নিচের দিকে ঝুঁকে মেঝেতে তার হাতদুটো সোজা করে রাখলো। সে কিছুই তুলে নিলো না। বরং সে দুহাতের ওপর সম্পূর্ণ দেহের ভর দিয়ে হাত দিয়েই হাঁটতে লাগলো। তার নোংরা উদোম এবং লম্বা পাগুলো সোজা আকাশের দিকে তোলা ছিল। তার পুরো ফ্রকটি কাঁধের কাছে ঝুলে রইলো। আর শরীরে কোনো অন্তর্বাস ছিল না। তার উলঙ্গ পা’দুটিকে ভি-এর মতো করে ওপরের দিকে বের করে দিতেই তার গোপনাঙ্গের চকচকে লোমগুলো বাদামি ত্রিভুজের আকার ধারণ করলো।
সেই প্রাণহীন সকালটার শূন্যতার ভেতর সেই মেয়েটি মাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্য ওইভাবে ঝুলে থেকেছিল। তারপরই সে দুলে উঠে-লাফিয়ে আগের মতো পায়ের ওপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করলো। এতেই ভীষণ খুশি হয়ে অন্য মেয়েরা পেছন থেকে নিজেরা হাততালি দিয়ে তাতে সম্ভাষণ করতে লাগলো। একে অন্যের হাতের সঙ্গে তালি দিতে লাগলো।
মোমা তার গানটি বদলিয়ে অন্য একটি গান গাইতে লাগলেন। তিনি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার একটি স্তবক গুনগুন করতে লাগলেন, স্বর্গের রুটি, স্বর্গের রুটি আমি যতক্ষণ পর্যন্ত না, নিষেধ করছি আমাকে খাবার দিতে থেকো। আমি খেয়াল করলাম, আমিও দাদির সঙ্গে প্রার্থনায় বসেছি।
আমি নিজেকে প্রশ্ন করতে লাগলাম, মোমা আসলে কতক্ষণ সেই অত্যাচার সহ্য করতে পারতেন? আর কত ধরনের অসম্মান তারা মোমাকে করতে পারতো? আমি ঠিক কতক্ষণ এসব অপকর্মের মধ্যে নিজেকে না জড়িয়ে বাইরে থাকতে পারতাম? আমি কী ধরনের ব্যবহার করলে মোমা খুশি হতেন?
এরপর তারা তাদের শহরের পথে হেঁটে চলে গেলো। শেষবারের মতো তারা মোমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকালো:
—বিদায় অ্যানি।
—বিদায় অ্যানি।
—বিদায় অ্যানি।
মোমা ফিরে তাকালেন না। তার হাতগুলোকেও ভাঁজ করলেন না। কিন্তু তিনি গান গাওয়া থামিয়ে দিয়ে বলতে লাগলেন:
—বিদায় মিস হ্যানেল।
—বিদায় মিস রুথ।
—বিদায় মিস এলিওস।
আমি কান্নায় ফেটে পড়লাম! জুলাই মাসের চার তারিখের বাজি ফাটার মতো ফেটে পড়লাম। মোমা কী করে পারলেন তাদের মিস বলে সম্বোধন করতে? এটি সত্যি জঘন্য নোংরা একটা ব্যাপার। যখন নিকৃষ্ট প্রাণীগুলো পাহাড় বেয়ে আসছিল, তখন কেন মোমা শীতল মনোরম স্টোরের ভেতর ঢুকে গেলেন না? তিনি আসলে কী প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন? এছাড়া ওরা যখন এতই নোংরা, অসভ্য-বর্বর ও ঘৃণ্য, তাহলে তিনি কেন ওদের এভাবে মিস মিস বলে সম্মান দেখালেন?
তারপর তিনি আবারও গুনগুন করে, ‘গ্লোরি, গ্লোরি, হ্যালালুয়াহ, যখন আমি আমার বোঝাটি নামিয়ে রাখি’ গাইতে গাইতে ধীরে ধীরে স্টোরের ভেতরে প্রবেশ করলেন।
তিনি ওখানেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আরেকটি পুরো গান গাইলেন। এরপর দরজার পর্দা সরিয়ে ভেতরে তাকালেন। আমি তখনো উন্মাদের মতো কেঁদেই চলেছি। তিনি আমার দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে রইলেন। তিনি দাঁড়িয়ে থেকে চোখ নামিয়ে ততক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন, যতক্ষণ না আমি চোখ তুলে তার দিকে তাকালাম। আমার কাছে তার মুখটিকে ধূসর চাঁদের মতো লেগেছিল। তাকে অপূর্ব লাগছিল। সেখানে কিছু তো একটা অবশ্যই ঘটেছিল কিন্তু আমি তখন সেটা ঠিক মতো বুঝতে পারিনি। তবে আমি এতটুকু অনুভব করতে পেড়েছিলাম, তিনি খুব খুশি হয়েছেন। এরপর তিনি ঝুঁকে নিচু হয়ে আমার পাশে বসলেন। এমনভাবে আমাকে স্পর্শ করলেন, যেভাবে চার্চের মাদাররা হতদরিদ্র- অসুস্থ মানুষকে স্পর্শ করে। আর এভাবেই আমি আস্তে আস্তে শান্ত হলাম।
দাদি বললেন, যাও বোন! মুখ ধুয়ে এসো! তিনি ক্যান্ডি কাউন্টারের পেছন দিয়ে একটি আধ্যাত্মিক গান গাইতে গাইতে হেঁটে গেলেন—‘গ্লোরি, গ্লোরি হ্যালিলুয়াহ, যখন আমি আমার বোঝাকে নামিয়ে রাখি।’
কুয়ো থেকে পানি নিয়ে আমি আমার মুখে ছিটালাম। আর সারা সপ্তাহের ব্যবহৃত রুমালটিকে নাক ঝাড়ার জন্য ব্যবহার করলাম। কী পরিস্থিতি হয়েছিল, সেটা বড় কথা নয়, আমি জেনে গেলাম যে মোমাই জিতেছেন।
সামনের উঠোনে আমি ঝাড়ুটাকে আবার নিয়ে আসলাম। ঝাড়ু দিয়ে সেই নোংরা পায়ের ছাপগুলো সহজেই মুছে ফেললাম। অনেক সময় নিয়ে আমি নতুন করে ডিজাইন তৈরি করলাম। আর পরিষ্কার পাত্রের পাশে ঝাড়ুটিকে দাঁড় করিয়ে রাখলাম। স্টোরের ভেতরে এসে আমি মোমাকে হাত ধরে বাইরে নিয়ে এলাম। আমার নতুন তৈরি করা ডিজাইনের প্যাটার্নটা মোমাকে দেখালাম।
এটি ছিল একটি বিশাল হৃদয় আর যার ভেতর ফুটে ছিল অনেক অনেক ছোট্ট ছোট্ট হৃদয়! আর সবচেয়ে ছোট্ট হৃদয়ের একটি তীর আবরণের বেড়াজালের রহস্য ভেদ করে ভেতর থেকে বাইরের দিকে উঁকি দিচ্ছে এমন করেই ডিজাইনটি তৈরি করেছিলাম। মোমা বললেন, বোন আমার! এটি আশ্চর্য সুন্দর হয়েছে। তারপর তিনি আবারও গুনগুন করে, ‘গ্লোরি, গ্লোরি, হ্যালালুয়াহ, যখন আমি আমার বোঝাটি নামিয়ে রাখি’ গাইতে গাইতে ধীরে ধীরে স্টোরের ভেতরে প্রবেশ করলেন।
চলবে…
আমি জানি খাঁচার পাখিরা কেন গান গায়-৪॥ মায়া অ্যাঞ্জেল্যু