[পর্ব-৩৭]
ক’দিন পরই বার্ষিক পরীক্ষা। ধনু কাকা, খোকন, বেলাল, আনোয়ারদের কেউ এখন আর হাটবারেও চৌরাস্তাবাজারে আসে না। আমি ইচ্ছা-অনিচ্ছায়—দুই কারণেই যাই। ইচ্ছায় যাই—কারণ বাজারে না গেলে অস্থির লাগে। অনিচ্ছায় যাই—কারণ দোকানে বসতে হয় কিছুক্ষণ। না হলে বাবা একা মানুষ সব দিক সামলাতে হিমশিম খান।
ডিজেল-মোবিল-পেট্রোল সপ্তাহের অন্যান্য দিনের চেয়ে হাটবারে বেশি বিক্রি হয়। এদিন সংসারের বাজারসদাই কিনতে হয় বাবাকে। আবার ক্ষেতের সবজিও বিক্রি করতে হয়। বাবা যখন সবজি বিক্রি আর চাল-তেল-নুন মরিচ কেনায় ব্যস্ত, তখন আমাকে দোকানেই বসতে হয়। কখনো কখনো আমার সঙ্গে ইসমাইলও বসে।
তবে, যেদিন ইসমাইল দোকানে বসে, সেদিন আমি ক্যাশিয়ার। ইসমাইল কর্মী। অর্থাৎ তেল মাপা, ক্রেতার কনটেইনারে তেল ভরে দেওয়ার কাজ তাকেই করতে হয়। এছাড়া, কেউ সাইকেল ভাড়া নিতে এলে, ভাড়া দেওয়া, ফিরে এলে সাইকেল মোছামুছির কাজও তাকে করতে হয়। আমি কেবল হিসাব কষি, টাকা গুনি। আর ফাঁক পেলেই পড়ি রকিব হাসানের কিশোর গোয়েন্দা কাহিনী কিংবা কাজী আনোয়ার হোসেনের ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের কোনো বই। কখনো কখনো রোমেনা আফাজের ‘দস্যু বনহুর’। এসব বই আপন মনে পড়ি, হাসি, বিমর্ষ হই। কিন্তু অনুভূতির কথা কারও কাছে প্রকাশ করতে পারি না। তাই ভাবনাবিনিময়ের জন্য সমমনা কাউকে খুঁজি। সামনে বার্ষিক পরীক্ষা থাকায় কেউ তো বাজারে আসে না। উল্টো বড়দের কেউ আমার হাতে এসব বই দেখলে রেগে আগুন হয়ে যান। বলেন, ‘দোকানে বসে বসেও তো স্কুলের বই পড়তে পারিস। পরীক্ষার জন্য রেডি হতে পারিস।’
আর আমার বসে থাকা কিংবা এসব আউট বই পড়ার বিষয়টি ইসমাইল মেনে নিতে পারে না। সে প্রায় বলে, ‘আঁই সব কাজ করি। আর তুই শুধু বসে বসে হিসাব করিস। টাকা গুনিস। তোর কাজ কী?’ তার কথার জবাব দেই না আমি। বলি, ‘বাবা যাকে যা করতে বলেছেন, তার তা-ই করা উচিত। আমি আমার কাজ করছি, তুই তোর কাজ কর। হুদাই ঝগড়া করিস না।’
আমার কথায় ইসমাল ক্ষেপে যায়। চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে। ততক্ষণে বাবা এসে হাজির। ‘কী হইছে’—বাবার প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই ইসমাইল কান্নাকাটি শুরু করে—‘অ্যাঁ! সব কাজ আঁরে করতে অয়। ভাইসা খালি বসি বসি টাকা গোনে আর হিসাব করে। আঁই কিল্লাই সব কাজ কইত্তাম?’
ইসমাইলের অভিযোগ শুনে আমি তো ভয়ে জড়োসড়ো। আল্লাহ জানে—বাবা কী করে বসেন। ইসমাইলের গালে ঠাস করে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেন কি না, কে জানে! কিন্তু না। বাবা হাসতে হাসতে বসলেন গদিতে। আমাকে বললেন, ‘যা সিদ্দিক ডাক্তারের দোকানে চা’র কথা কই আয়।’ নির্দেশ পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে চায়ের কথা বলতে বের হয়ে যাই। ফিরে এসে দেখি, ইসমাইল তখনো কেঁদেই চলেছে। তার অভিযোগ একটাই। সে সব কাজ করে আর আমি বসে থাকি। কোনো কাজ করি না। তার কান্নাকাটি শুনে দোকানে তখন অনেক লোকের ভিড়। যেন সার্কাস দেখতে এসেছে সবাই। কারও চোখে কৌতূহলের হাসি, কারও ভ্রূ নেচে উঠছে অপার বিস্ময়ে। কেউ কেউ ফিসফাস করছে—‘আহারে! ছোট পোলাটারে খালি খাটায় মারে, আর বড়টা বেক্কেল। কেবল বসি বসি মাতবরি করে!’
এসব ফিসফাস বাবার কান এড়ায় না। বাবা বলেন, ‘তোমরা যারা আমার বড় পোলারে দোষ দিচ্ছ আর ছোট পোলার জন্য দুঃখ করছো, সবাই চুপচাপ দাঁড়াও। আমি একটা গল্প কমু। সবাই মনোযোগ দিয়ে শুইনো। তাইলে বুঝবা, বড় পোলা কী কাজ করে, আর ছোটজনই বা কী করে।’
উৎসুক জনতার চেয়ে ততোধিক উৎকর্ণ হয়ে আমিও শুনি। বাবা বলেন, ‘কোনো এক শহরে একটি বহুতল ভবনের বাইরের দেয়ালে রঙের কাজ হচ্ছে। তো, জানালার কার্নিশের ওপর একটি কাঠ দিয়ে সেই কাঠের দুই মাথায় দুজন বসেছে। একজনের না, রহিম। আরেক জন করিম। রহিম রঙের বালতি ধরে বসে আছে। করিম সেই বালতি থেকে ব্রাশে রঙ মেখে দেয়াল রঙ করছে। করিমের হঠাৎ খেয়াল হলো, আসলে সে একাই কাজ করছে। রহিম কেবল বসে আছে। আর বসে বসে মাঝেমাঝে হুকুম করে যাচ্ছে। বসে থাকা রহিমের হুকুম আর করিম মানতে রাজি নয়। তাই সে ক্ষেপে ওঠে—এত ক্যাট-ক্যাট করিস ক্যান? কাজ তো আমি করি। তু্ই তো শুধু বসি থাকিস। এবার রহিম বলে, আমি কোনো কাজ করি না? তাহলে চলে যাই? তুই একলাই সব কাজ কর দেখি! যেই কথা সেই কাজ। রহিম আস্তে কাঠ থেকে পা তুলে সরে গেলো ছাদের দিকে। অমনি কাঠের অন্যপ্রান্তে থাকা করিম ধপাস করে নিচে পড়ে গেলো।’ বাবা গল্পটা এই পর্যন্ত বলে একবার সবার মুখের ওপর চোখ বুলিয়ে নিলেন।
সংসারে যাকে বসে বসে বুদ্ধি দেখা যায়, পরিকল্পনা করতে দেখা যায়, আসলে সে বসে থাকে না, যে ভারসাম্য রক্ষা করে। আর যে কায়িক শ্রম দেয়, সেও মহৎ কাজ করে। কিন্তু তার কাজের ফল ভোগ করতে হলে বসে থাকা ব্যক্তির বসে থাকাকে গুরুত্ব দিতে হবে।
বাবার গল্প বলার একফাঁকে সিদ্দিক ডাক্তারের দোকান থেকে তার জন্য চা, আমাদের দুই ভাইয়ের জন্য দুই কাপ মিক্সার এসে হাজির। বাবা চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলেন, ‘এই গল্প শুনি আম্নেরা কে কী বুইঝলেন? কন তো?’ সত্যি বলতে কী, আমি নিজেও গল্পের উদ্দেশ্য ও নীতিকথা কী, তা বুঝিনি। একটানে মিক্সারটুকু খেয়ে কাপটা পাশে রেখে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। এই পৌষের হাড়কাঁপানো শীতে এতক্ষণ ঠকঠক করে কাঁপলেও এখন আমার কপাল বেয়ে চিকন ঘাম বের হওয়া শুরু হয়েছে। মনে মনে প্রমাদ গুনছি—ছোট ভাইকে ঠকিয়ে গাধার মতো খাটিয়ে নিচ্ছি, নিজে ক্যাশে বসে বাবুগিরি করছি। বিষয়টি ঠিক করছি না বেঠিক?
আমার ভাবনায় ছেদ পড়ে। কারও কাছ থেকে কোনো জবাব না পেয়ে বাবা বলেন, ‘বুঝলেন না তো? শারীরিক পরিশ্রমই আসল পরিশ্রম না। মানসিক পরিশ্রমই আসল। দেখেন না, মাটি কাটার একজন লেবার সারা মাস কাজ করে পায় সাত-আট শত টাকা? আর একজন মাস্টার পান সাত-আট হাজার টাকা। ইঞ্জিনিয়াররা তো অর্ধলক্ষ টাকাও পান। মাটি কাটার লেবারের কাজ কী—তা তো আম্নেরা সবাই জানেন। কত পরিশ্রম। মাথার ঘাম পায়ে গড়ায়। কিন্তু ইঞ্জিয়াররা কী করেন, আম্নেরা দেখেছেন? দেখেন নাই। তারা এসি রুমে বসি বসি ইজি চেয়ারে দোল খান। আর চোখ বন্ধ করি ভাবেন। হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি আইলে নোট করে রাখেন। শারীরিক শ্রম দেখা যায়, মানসিক শ্রম দেখা যায় না। আম্নেরা তো সব্বাই আমার ছোট ছেলের পরিশ্রমটা দেখলেন, বড়জনেরটা চোখেই পড়লো না। ছোটজন কী করে? তেল মাপে, সাইকেল মোছে। তারপর কালিঝুলিমাখা হাত নিয়ে বসে থাকে টুলে। আর বড়জন? সে ক্যাশে বসে থাকে। টাকা গোনে। হিসাব করে। বড় কাজ কোনটা? বড় কাজ বড়জনেরটা। ছোটজন কত টাকার তেল বেছে, কত টাকা নগদ বেছে, কতটাকা বাকি যায়, সব হিসাবই বড়জনকে করতে হয়। আবার কারে বাকি মাল দেওয়া যাবে, কারে দেওয়া যাবে না, এসব দেখতে হয় বড় জনকেই। বুঝতে হয়। এরপর বাড়িতে যাওয়ার আগে সব হিসাব জাররা-জাররা করে আমাকে বুঝাইতে হয় তার। বুইঝতে পারছেন—যে পরিশ্রম কেবল দেখা যায়, সে পরিশ্রম বড় নয়, বড় পরিশ্রম হলো মগজের পরিশ্রম। সংসারে যাকে বসে বসে বুদ্ধি দেখা যায়, পরিকল্পনা করতে দেখা যায়, আসলে সে বসে থাকে না, যে ভারসাম্য রক্ষা করে। আর যে কায়িক শ্রম দেয়, সেও মহৎ কাজ করে। কিন্তু তার কাজের ফল ভোগ করতে হলে বসে থাকা ব্যক্তির বসে থাকাকে গুরুত্ব দিতে হবে।’
বাবা তার দীর্ঘ বুদ্ধিবৃত্তিক কথা বলে আবারও থামলেন। ততক্ষণে তার চা খাওয়া শেষ। এবার মুখে পান পুরবেন। হামিমপুরী জর্দা, শুকনো সুপারি দিয়ে মুখে পুরে নিলেন পান। এরপর তর্জনির মাথা চুনের কৌটায় চুবিয়ে দাঁতের মাঝখানে চেপে ধরে চুনটুকু জিহ্বায় মেখে নিলেন। একটুখানি দম নিয়ে বলেন, ‘বুইঝতে পারছেন তো সবাই? আমার দুই পোলাই কাজ করে। একজনেরটা দেখা যায়, আরেকজনেরটা দেখা যায় না। কিন্তু দুজনের কাজই সমান গুরুত্বের। যে যেটা পারবে, তাকে সেই দায়িত্বই দিয়েছি। আম্নেরা মিছামিছি পোলাপাইনরে উল্টাপাল্টা কইয়া ভুল বুঝাইয়েন না।’
এবার ভিড়ের ভেতর থেকে কথা বলে ওঠেন কাকার একান্ত সহচর ছোটন কাকা। বলেন, ‘আরে ভাই, আমরা তো মনে কইচ্ছি আম্নের বড় পোলা সাবগিরি করে। আর ছোটটারে ভূতের বেগার খাটায় খালি। অন বুইঝতাম পারছি আসলে আম্নের ইনসাফ আছে।’ ছোটন কাকার কথা শেষ না হতেই কে একজন বলে ওঠেন—‘ভাই ভূতের কথা কইয়েন না। আইজ অমাবস্যা। রাসেল গো দরজার বটগাছে ভূত আছে। চলেন, বেশি রাইত নামার আগে আগে বাড়িত চলি যাই।’ ছোটন কাকা শুনে বলেন, ‘আরে ধুর! ভূত-টুত বলে কিচ্ছু নাই মিয়া। কত আইলাম-গেলাম কোনোদিন তো ভূত দেইখলাম না। হুদাই ডরান খালি।’ ভূত নিয়ে যখন কথা বলছিলেন ছোটন কাকারা, তখন রাসেল এসে আমার পাশে দাঁড়ায়। কানে কানে বলে, ‘ভাইজ্জি চলেন, আইজ ছোটন কাকারে মজা দেখামু।’ বলি, ‘ক্যামনে?’ রাসেল বলে, ‘ছোটন কাকা আর মোয়া-জিলাপি কিনছেন। বাড়ি যাইবেন তো বটগাছের তলা দিয়ে। আমরা দুজন আগেভাগে বটগাছের ডালে বসি থাকুম। যখনই ছোটন কাকা বটগাছের নিচে যাবেন, অমনি আমরা ভূতের মতো…।’ মাঝপথেই রাসেলকে থামিয়ে বলি, ‘তার সঙ্গে যদি আর কেউ থাকে?’ রাসেল কথা কেড়ে নিয়ে বলে, ‘থাইকলে থাইকবো। সব্বাই ভীতুর ডিম। সব্বাইরে চিনি। খালি ভূতের গলা শুইনলেই অইলো।’
রাসেল আমার হাত চেপে ধরে ফিসফিস বরে বলে, ‘কী বুজুর্গ হুজুর রে বাবা!’ এরপরই কাছারির দিকে পা বাড়ায় সে, পেছন পেছনে আমরা দুই ভাই।
যেই কথা, সেই কাজ। ইসমাইলকে বলি, বাড়ি গিয়ে কাছারিতে তিন জনের খাবার নিয়ে আসতে। সে চলে যায় বাড়ির দিকে। আমি রাসেলকে সঙ্গে নিয়ে বটগাছে উঠে বসি। কেউ টচলাইটের আলো ফেললেও আমাদের চিনতে পারবে না। এত মোটা ও বিশাল এই বটগাছ যে, ওপরের কোটরে বসে থাকলে দিনের বেলাও আমাদের দেখা যায় না, এখন রাতেই বেলা তো দেখা যাওয়া বা চেনার প্রশ্নই ওঠে না।
রাত প্রায় বারোটা। গ্রামেগঞ্জে অন্যদিন রাত আটটা মানেই গভীর রাত। কিন্তু হাটবারে রাত বারোটা তেমন কোনো গভীর রাত নয়। এই সময়ে হাট ভাঙতে থাকে। হাটুরেরা বাড়ির পথ ধরেন। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। উত্তর দিকে তাকিয়ে দেখি কে একজন আসছেন। কাছাকাছি আসতেই আমরা নাকি সুরে ভয় দেখানোর প্রস্তুতি নেই, এমন সময় দেখি, ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে বিড়িতে আগুন ধরালেন রাসেলের বাবা। আমরা দুজনে এবার নিজ নিজ বুকে থুতু দিয়ে ভয় তাড়াই। রাসেলের বাবা বাড়িতে ঢুকে গেলে ছোটন কাকার জন্য অপেক্ষা করি। আমাদের অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়ে আসে। ছোটন কাকা একা। হাতে টর্চ লাইট। কণ্ঠে গান—‘আমায় এত রাতে কেনে ডাক দিলি প্রাণ কোকিলারে…।’ বটগাছের নিচে আসতেই আমাদের সম্মিলিত নাকি সুর—‘তুঁই কেঁরেঁ। তোঁর হাতের মোঁয়াঁ-জিঁলাঁপিঁ দিঁয়াঁ যাঁ। নঁইঁলেঁ তোঁর মুঁণ্ডুঁ চিঁবিঁয়েঁ…।’ নাকি সুর শেষ হয় না। তার আগেই ছোটন কাকা বাজারের থলিটা রাস্তায় ফেলে ভয়ার্ত স্বরে চিৎকার দেন—‘ওরে বাবারে ভূত-ভূত-ভূত!’ বাড়ির পথ ভুলে উল্টো বাজারের দিকে দে ছুট।
আর আমরাও দ্রুত বটগাছ থেকে নেমে মোয়া-জিলাপির থলে নিয়ে একদৌড়ে কাছারিতে। কিছুক্ষণ পর বটগাছের নিচে জনাত্রিশেক লোকের ভিড় জমে যায়। বটগাছটি কাছারি ঘর থেকে দুই শ গজের মাথায়। তাই সবার কথাই আমরা স্পষ্ট শুনতে পাই। শোর চিৎকারে বের হয়ে আসি। আস্তে আস্তে তিনজনই হাজির হই বটতলায়। দেখি, ছোটন কাকার হাত-পা ঠক ঠক করে কাঁপছে। এতটাই ভয় পেয়েছেন যে, পরিষ্কার করে কিছু বলতেও পারছেন না। তবু কাঁপা কাঁপা গলায় যা বলছেন, তা শুনতে গিয়ে মনে হচ্ছে, কোনো উত্তাল নদীর মাঝখানে ডুবে যাওয়া নৌকা থেকে বেঁচে ফেরা কোনো যাত্রীর আর্তি ভেসে আসছে। তবু লোকজন তার কথা শুনছে মনোযোগ দিয়ে। তিনি বলছেন, ‘আমি এখানে এসেছি মাত্র। হঠাৎ দৈত্যের মতো বিশাল দুটি ভূত আঁর সামনে দাঁড়ালো। ভূতগুলোর পা এই বটগাছের মতো মোটা আর বিশাল। আর মাথা ওই আকাশে। আর ভূতগুলো একসঙ্গে বললো, মোয়া দে, জিলাপি দে। আঁই সব ফালাই থুই জানটা হাতে লই বাজারের দিকে দৌড় দিলাম। ভাইরে লোকে যে কয়, এই বটগাছে ভূত আছে, কথা কিন্তুক মিছা না। আইজ নিজে ভূত না দেইখলে বিশ্বাস করতাম না।’
ছোটন কাকার কথা শেষ। জনাত্রিশেকের লোকের ভিড় ঠেলে একজন মৌলবি এগিয়ে আসেন। বলেন, ‘এখনই ভূত তাড়াতে এই বটগাছ বন্ধ করতে হবে। আপনারা সবাই যার যার চাদর খুলুন। প্রত্যেকের চাদরে গিঁট দিয়ে গোল কুণ্ডুলি বানান।’ মৌলবির নির্দেশে হাড়কাঁপানো শীতের রাতেও চাদর খুলে গিঁট দিয়ে চারদিকে পেঁছিয়ে কুণ্ডুলি বানিয়ে সেই কুণ্ডুলির মাঝখানে সবাই দাঁড়ায়। মৌলবি অনেকক্ষণ ধরে দোয়া পড়তে থাকেন। অন্ধকারে তার মুখ দেখি না। হঠাৎ রাসেল তার হাতের টর্চ লাইটের সুইচ অন করতেই দেখি, মৌলবি আমাদের দিকে শ্যন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। গর্জে ওঠেন তিনি—‘এই ছোট ছোট বাচ্চাদের এখানে কী? যা বাড়ি ঘরে যাহ! নইলে বিপদ। বিপদ। বিপদ।’ রাসেল আমার হাত চেপে ধরে ফিসফিস করে বলে, ‘কী বুজুর্গ হুজুর রে বাবা!’ এরপরই কাছারির দিকে পা বাড়ায় সে, পেছন পেছন আমরা দুই ভাই।
চলবে…
জীবনের যতিচিহ্নগুলো-৩৬ ॥ মোহাম্মদ নূরুল হক