দোকানে ডিজেল-মবিল-পেট্রোল শেষ হয়ে এসেছে। মোকামে যেতে হবে। মোকাম মানে সোনাপুর। সোনাপুর কলেজ গেটের দক্ষিণ পাশে একটা সাইকেল গ্যারেজে ৫ টাকার বিনিময়ে সাইকেল রেখে ২ টাকা ভাড়া দিয়ে টেম্পুতে চড়ে যেতে হবে মাইজদী। তেল তো কিনবো সোনাপুর পেট্রোলপাম্প থেকে। তাহলে মাইজদী কেন? কোথায় যেন পড়েছি, সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের একটি ব্যাকরণ আছে। নাম ‘ভাষা প্রকাশ ও বাঙ্গালা ব্যাকরণ’। এই ব্যাকরণখানা আমার চাই-ই চাই। দাম যা-ই হোক।
রাতেই বাবার কাছ থেকে ডিজেল-মবিল-পেট্রোল কেনার টাকা নিয়ে রেখেছি। শুক্রবার ভোর হতে না হতেই সাইকেল নিয়ে সোনাপুরের উদ্দেশে যাত্রা। সাইকেলের ক্যারিয়ারের দুই পাশে রশি দিয়ে বাঁধা দুটি প্লাস্টিকের কনটেইনার। এগুলোয় আনবো পেট্রোল-মবিল। আর ডিজেলের কিনবো আস্ত ড্রাম। প্রতিবার ড্রাম খালি হলে বাসের ছাদে তুলে পাঠিয়ে দেই। পেট্রোল পাম্পের ছেলেগুলো বাস থেকে নিয়ে নেয়। আর কন্ডাক্টর চৌরাস্তা বাজারে বাস এলেই সেগুলো নামিয়ে দেয়।
ক্লাস সিক্সের একজন ছাত্র আর কী বই বা কিনতে পারে!—এমন প্রশ্ন সাধারণ মানুষ করবেই, তাতে তাদের দোষ দেওয়া যায় না।
সোনাপুর পেট্রোলপাম্প থেকে ডিজেল-মোবিল-পেট্রোল কিনে টাকা-পয়সা বুঝিয়ে দিলাম। তবে ডিজেল ও মোবিল দুই লিটার করে কম কিনলাম। উদ্দেশ্য ওই টাকা দিয়ে বই কিনবো। পকেটে তখন প্রায় ৩০০ টাকা। সাইকেল সোনাপুর রিকশা গ্যারেজে রেখে টেম্পোতে চেপে বসলাম। মাইজদী পৌঁছেই জামে মসজিদ মোড়ে নেমে সোজা ঢুকে গেলাম শাহজাহান বুক স্টোরে। পাবলিক হেল্থের দক্ষিণপাশে লাইব্রেরি। মাইজদীর সবচেয়ে বড় লাইব্রেরি। উল্টোদিকেও একটি লাইব্রেরি আছে। কিন্তু সেখানে পাঠ্যবই বেশি, উপন্যাস-গল্প-কবিতার বা প্রবন্ধের তেমন নেই। তাই আমার আগ্রহ শাহাজাহান বুক স্টোরের দিকেই।
লাইব্রেরিতে ঢুকতেই ক্যাশ কাউন্টারে দাঁড়ানো মধ্যবয়সী লোকটি সোজা আমার দিকে তাকালেন—‘খোকা কী চায়?’ কোনো উত্তর না দিয়ে বইয়ের প্রতিটি তাকে খুঁজতে থাকি সুনীতিকুমারের ‘ভাষাপ্রকাশ ও বাঙ্গালা ব্যাকরণ’ বইখানা। বিশাল লাইব্রেরির উত্তর-দক্ষিণের দুই দেয়ালজুড়েই বইয়ের তাক। ঘামে আমার জামা ভিজে গেছে। ফ্যানের হাওয়া লাগতেই কেমন যেন ফুরফুরে অনুভূতি জাগলো। কিন্তু মধ্যবয়সী লোকটি আমাকে একমিনিটও শান্তিতে দাঁড়াতে দিচ্ছেন না। ক্রমাগত প্রশ্ন করেই যাচ্ছেন—‘কী বই খুঁজছো? ছোটদের বই ওই তাকে পাবে না। আমাকে বলো, আমি দিচ্ছি। কমিক্স? কার্টুনের না গল্পের বই? লেখকের নাম কী? বইয়ের নাম কী?’
লোকটির প্রশ্নে আমি খুব বিরক্ত। আমি ছোটদের বই-ই কিনতে এসেছি, তিনি বুঝলেন কী করে? আমি কি বড়দের বই কিনতে পারি না? সব ছোট বাচ্চাই কি কমিকস-কার্টুন দেখে কিংবা পড়ে? ছোটদের বই-ই পড়ে? এসব প্রশ্ন মগজে তখন তুফান তুলছে। আমিও ক্ষেপে উঠছি ভেতরে ভেতরে। কিন্তু এই দূর দেশে, অচেনা মুল্লুকে উত্তেজিত হওয়া চলবে না। এখানে আমি একা। কেউ চেনে না। ক্লাস সিক্সের একজন ছাত্র আর কী বই বা কিনতে পারে!—এমন প্রশ্ন সাধারণ মানুষ করবেই, তাতে তাদের দোষ দেওয়া যায় না।
বলেই ফেললাম, ‘আমার বয়স কম। সেই হিসেবে শিক্ষাগত যোগ্যতাও কম। শিক্ষাগত যোগ্যতা কম হওয়ার বড় সুবিধা হলো, বড়-বড় ডিগ্রিধারীদের ভেতরটা সহজেই চেনা যায়।’ আমার কথা শুনে তিনি জিহ্বায় কামড় বসালেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘যাও তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
লোকটির বিরতিহীন প্রশ্নের উত্তর দেওয়া দরকার। এমন কোনো বইয়ের কথা বলতে হবে, যে বইয়ের নামই শোনেননি তিনি। লেখকের নামও না। হঠাৎই মাথায় দুষ্টুবুদ্ধি খেলে গেলো। সোজা কাউন্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম—‘কাকু, নূরুল আসাদের লেখা ‘তোরাব আলীর চরে’ বইটি আছে? এবার লোকটি ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন আমার দিকে—‘এই নামে কোনো লেখকের নাম তো শুনিনি। এটা কিসের বই? গল্পের না উপন্যাস?’ এবার আমার মুখে বিজয়ের হাসি—‘না কাকু। কবিতার।’ একদিকে তার সঙ্গে কথোপকথন চালিয়ে যাচ্ছি, অন্যদিকে খুঁজে চলেছি ‘ভাষাপ্রকাশ ও বাঙ্গালা ব্যাকরণ’। হঠাৎই বিদ্যুচ্চমক খেলে গেলো আমার চোখে। ঠিক লোকটির পেছনের তাকেই রয়েছে কাঙ্ক্ষিত বইটি। সেদিকেই আঙুল তুলে বললাম, ‘কাকু, ওই বইটি দেন।’ ইতোমধ্যে আরও চার-পাঁচ জন ঢুকেছেন লাইব্রেরিতে। তাদের দুই-একজন দোকান মালিকের বন্ধুস্থানীয়। তাদের মধ্যকার কথাবার্তা শুনে জানা গেলো, যার সঙ্গে এতক্ষণ কথা বলছিলাম, তিনিই মালিক, নাম শাহজাহান মিয়া।
‘ভাষাপ্রকাশ ও বাঙ্গালা ব্যাকরণ’ চাওয়ায় একসঙ্গে তিন-চারজন আমার দিকে যেন সবিস্ময়ে তাকালেন। একজন ব্যঙ্গ করেই বললেন, ‘এই বই তো প্রফেসররা পড়েন। তুই কোন ক্লাসে পড়ছ?’ বিদ্রূপ গায়ে না মেখেই হেসেই জবাব দিলাম, ‘ক্লাস সিক্সে। ব্যাকরণ সংগ্রহ করা-পড়া আমার শখ।’ এবার বিদ্রূপকারী ঠোঁট উল্টে বললেন, ‘ওরে বাব্বা! ক্লাস সিক্সের ছাত্র পড়বে সুনীতির ব্যাকরণ। কোন কলি কাল আইলো রে বাবা!’ তার বিদ্রূপে দমে না গিয়ে শাহজাহান মিয়ার দিকে তাকাই, ‘কাকু, বইটা আমার কাছে বিক্রি করবেন? দাম কত?’ শাহজাহান মিয়া বইটি হাতে নিতে নিতে বললেন, ‘এত কঠিন বই তুমি বুঝবে? বইয়ের দাম তো অনেক। গায়ের রেট ৬০ টাকা। তুমি দেবে ১২০ টাকা।’ বলি, ‘কেন? কমিশন বাদ গেলে তো অন্তত ৫০ টাকা হতে পারে!’ আমার যুক্তিতে তিনি মৃদু হেসে বললেন, ‘বাপু, এটা আমাদের দেশের বই না। ইন্ডিয়ান। গায়ের রেটের দ্বিগুণ দামে বিক্রি করতে হয়। তুমি নেবে? নিলে ১২০টাকা দাও।’ বই কিনে বের হতে যাবো, এমন সময় একজন টিপ্পনি কাটলেন, ‘হয়তো কোনো স্যারের জন্য কিনছে, কিন্তু বলছে তার শখ। আজকালকার ছেলেরা এত মিথ্যা বলতে পারে!’ কথাটা শুনে আমার মাথায় যেন রক্ত চেপে গেলো। ঘুরে দাঁড়ালাম। চোয়াল শক্ত করে তার মুখোমুখি হলাম—‘শোনেন কাকু, আমি মিথ্যা বলি না। যা সত্য তা-ই বলি। আমি ছোট বলে আপনি আমাকে নিয়ে যা ইচ্ছা, তা বলতে পারেন না।’
এবার লোকটি ক্ষেপে গেলেন। তার কণ্ঠে তীব্র উত্তেজনা—‘বেয়াদব! কার লগে তর্ক করছ, জানোস? এমএ পাস করেছি তোর জন্মের আগে। মাত্র তো ক্লাস সিক্সে পড়ছ। উঠে এসেছিস চর থেকে। পরনে লুঙ্গি, ঘামে জামা ভেজা দেখেই তো বুঝতে পারছি। আমাকে জ্ঞান দিস?’
লোকটি যতটা গর্জে উঠলেন, ততটা ক্ষোভ আমারও জন্মালো। শাহজাহান মিয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘কাকু আমি ছোট। শিক্ষাগত যোগ্যতাও কম। বয়স হিসেবে আমি ক্লাস নাইনে থাকার কথা। তিন বছর হাফেজি পড়তে গিয়ে পিছিয়ে গেছি। নইলে এখন ক্লাস নাইনে পড়তাম…।’ উত্তেজিত লোকটি আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে তীব্র বিদ্রূপের বাণ ছুড়ে দিলেন, ‘আরে হাফেজ সাব! আগে কইবেন না? হাফেজরা তো মিথ্যা বলে না। হাহাহাহা।’ তার অট্টহাসিতে আমি বিরক্ত হয়েছি যতটা, তারও বেশি বিরক্ত হয়েছেন শাহজাহান মিয়া। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি যাও। ওকে আমি দেখছি।’ তার নরম কণ্ঠে ভরসা পেয়ে নিচুর গলায় বলেই ফেললাম, ‘আমার বয়স কম। সেই হিসেবে শিক্ষাগত যোগ্যতাও কম। শিক্ষাগত যোগ্যতা কম হওয়ার বড় সুবিধা হলো, বড়-বড় ডিগ্রিধারীদের ভেতরটা সহজেই চেনা যায়।’ আমার কথা শুনে তিনি জিহ্বায় কামড় বসালেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘যাও তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
আমার হাতে অনেক সময় আছে, না দেরি হয়ে যাচ্ছে; সেই তথ্য তার জানার কথা নয়। হয়তো তিনি আমাকে তার বন্ধুর রোষানল থেকে বাঁচানোর জন্য এমন মন্তব্যের আশ্রয় নিয়েছেন। বই কিনে যতটা আনন্দ পেয়েছি, উচ্চশিক্ষিত মধ্যবয়সী লোকটির আচরণে ততটাই কষ্ট পেয়েছি। ততক্ষণে জুমার আজান পড়ে গেছে। আমিও সোনাপুরগামী টেম্পুতে চড়ে বসেছি। সোনাপুর এসে পেট্রোল পাম্প থেকে ডিজেল-মোবিল-পেট্রোলের ড্রাম-কনটেইনার আক্তার মিয়ার হাটগামী বাসে তুলে দিয়ে সাইকেলে পথ ধরলাম।
পূর্বমাথায় সুপারিগাছ ছাড়াও জামরুল-আমগাছ-নারিকেল গাছও রয়েছে কয়েকটি। এমন জড়াজড়ি করে আছে গাছগুলো, যেমন নিবিড় দেয়াল তৈরি করে রেখেছে।
আমি চৌরাস্তাবাজারে পৌঁছার অনেক আগেই বাস পৌঁছে গেছে। আমি সন্ধ্যার পরপরই বাজারে পৌঁছলাম। কিন্তু দোকানে গেলাম না। একবার উঁকি মেরে দেখলাম, ড্রাম-কনটেইনার ঢুকেছে কি না। দেখি ঠিক আছে। কন্ডাক্টর নামিয়ে দিয়ে গেছে। মোবিল-পেট্রোলের টাকা যে মেরেছি, তার হিসাব দিতে না পারলে খবর আছে! বলতে হবে, মোকামে তেল কম ছিল। তাই দুই লিটার করে কম দিয়েছে। কৈফিয়ত দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই বেঁচে যাওয়া টাকাও ফেরত দিতে হবে। তাই আজ আর দোকানে ঢোকা যাবে না। ওই টাকার ব্যবস্থা আগে করতে হবে। দ্রুত কাছারিতে ঢুকে ব্যাকরণখানা ড্রয়ারে রেখে তালা দিলাম। এরপর ঢুকলাম সুপারি বাগানে।
বিশাল সুপারি বাগানে তিনশ’র মতো গাছ। সব গাছেই সুপারি পেকেছে। পণ (৮০ টি সুপারিতে ১ পণ) ২০/২২ টাকায় বিক্রি করা যাবে। আমাকে প্রায় দশ পন সুপারি নামাতে হবে। গাছ থেকে সুপারি নামানোর একটি সুন্দর পদ্ধতি আছে আমার। একবারই উঠবো গাছে, নামবো একবারই। কিন্তু প্রত্যেক গাছ থেকেই সুপারি নামাবো। এই পদ্ধতি অনেকের কাছে জটিল মনে হতে পারে। কিন্তু আসলে জটিল নয়, সহজ। সুপারি গাছে মাথায় উঠলে গাছ সহজে নুয়ে পড়ে। তখন নিজের শরীরকে যেদিকে দোলাই, গাছও সেদিকে দোলে। একগাছ থেকে সুপারির কাঁদি ছিঁড়ে নিচের দিকে ছেড়ে দিয়ে অন্যগাছেই চড়ে বসি। এভাবে পশ্চিম মাথা থেকে পূর্বমাথায় পৌঁছে যাই। সুপারিগাছের চিরল চিরল পাতা যেন আমার সঙ্গে মিতালি খেলে। একগাছ থেকে অন্যগাছে যখন চড়তে যাই, অমনি আগের গাছের চিরল-চিরল পাতারা পিঠের ওপর স্নেহের পরশ বুলিয়ে দেয়। বলে, ওরে কাছে আয়। তোকে নিবিড় করে ধরে রাখি। কিন্তু আমি তো দুরন্ত-দস্যি। কোনো একটি গাছে স্থির হতে পারি না। তাদের স্নেহের পরশ টের পাই ঠিকই, কিন্তু সেই বাঁধনে ধরা পড়ি না। তাই অনেকটা বাঁদরের মতোই লাফিয়ে লাফিয়ে একগাছ থেকে অন্যগাছে পৌঁছে যাই, আর কাঁদি কাঁদি সুপারি ছিঁড়ে মাটির দিকে চালান করে দেই। পূর্বমাথায় এসে প্রায় ক্লান্ত হয়ে পড়ি। হিসাব কষে দেখি ২৫টি গাছ থেকে সুপারি নামিয়েছি। রাত আটটার দিকে বাজারে তুলতে হবে। আবুল হোসেন কিংবা রাসেলকে দরকার। এই দুটাকে কোথায় পাবো? ভাবতে ভাবতে গাছ থেকে নেমে আসি।
আবার ঢুকি কাছারিতে। দুটি চটের বস্তা নিয়ে ফিরে আসি বাগানে। সুপারিগুলো বস্তায় পুরতে পুরতে বাগানের পূর্বমাথায় পৌঁছে যাই। পূর্বমাথায় সুপারিগাছ ছাড়াও জামরুল-আমগাছ-নারিকেল গাছও রয়েছে কয়েকটি। এমন জড়াজড়ি করে আছে গাছগুলো, যেমন নিবিড় দেয়াল তৈরি করে রেখেছে। বস্তা দুটি টেনে টেনে সেই বৃক্ষপ্রাচীরের কাছে নিতেই ভূত দেখার মতো আঁৎকে উঠি। বস্তা দুটি রেখেই বাগানের ভেতর দিয়ে পশ্চিম দিকে দেই ভোঁ-দৌড়। পেছন থেকে বাবার কণ্ঠ ভেসে আসে—‘আগেই সন্দেহ করেছিলাম। আজ বাছাধন কেন দোকানে গেলো না!’
চলবে…
জীবনের যতিচিহ্নগুলো-৩৪॥ মোহাম্মদ নূরুল হক