প্রথম লেখালেখির শুরুর কথা বলতে গিয়ে অনেকেই বলেন, হুট করেই একদিন কিছু না ভেবে কবিতা লিখে ফেললাম। গল্প বা উপন্যাস লেখা শুরু করলাম। তবে কেউ এখন পর্যন্ত বলেননি, কিছু না ভেবেই একদিন প্রবন্ধ লিখতে বসে গেলাম। এর কারণ হয়তো পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া প্রবন্ধ শুরু করা যায় না। বলছি না যে, কবিতা, গল্প লিখতে গেলে পূর্বপ্রস্তুতির প্রয়োজন নেই। আছে। তবে পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া সাহিত্যের শাখায় পদচারণা শুরু করা গেলেও প্রবন্ধে তা সম্ভব নয়। এজন্য প্রাবন্ধিককে পড়ে, শুনে, বুঝেই লিখতে হয়।
পূর্বপ্রস্তুতির বিকল্প পথ তার কাছে খোলা নেই। তাকে মনে, মননে বৈদগ্ধ অর্জন করতেই হয়। তাই হয়তো দশকে দশকে কবি, গল্পকারের যে মিছিল দেখা যায়, প্রাবন্ধিকদের ক্ষেত্রে তেমনটা দেখা যায় না। খুব একটা দেখা যায় না, অমুক দশকের প্রবন্ধ সংকলন। অথচ প্রতি দশকেই দশকনির্ভর একাধিক কবিতা, এমনকী গল্পের সংকলনও দেখা যায়। এক্ষেত্রে আরেকটি প্রশ্ন উঠতে পারে, পরিশ্রম করে ‘পথের পাঁচালি’-র আলোচনা করার চেয়ে নতুন একটি উপন্যাস লেখাই উত্তম। কারণ যিনি ‘পথের পাঁচালি’ সৃষ্টি করবেন, তিনি প্রথম শ্রেণীর প্রতিভা এবং যিনি এর আলোচনা, গঠন কৌশল নিয়ে প্রবন্ধ লিখবেন, তিনি দ্বিতীয় শ্রেণীর প্রতিভা হিসেবে বিবেচিত হবেন। তাই কে চায় দ্বিতীয় শ্রেণীর প্রতিভার ধারক হতে। ব্যাপারটি আদতে তা নয়। ছোট্ট একটি উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটি খোলাসা করা যাক। বুদ্ধদেব বসু যদি গল্প, উপন্যাস লেখার পাশাপাশি জীবনানন্দের কবিতার পক্ষে কলম না ধরতেন, তা হলে হয়তো জীবনানন্দ দাশ তার স্বকালে আরও কিছুদিন অনাদরের ধুলোয় ঢাকা পড়েই থাকতেন।
কাজী মহম্মদ আশরাফ কবিতার বিষয় এবং কবির সমসাময়িক ঘটনাবলির ওপর জোর দিয়েছেন। মোহাম্মদ নূরুল হক সেখানে কবিতার বিষয়ের চেয়ে কবিতার প্রকরণ, শৈলীর ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
এজন্যেই মননশীল প্রবন্ধের প্রয়োজন। এ কারণেই প্রাবন্ধিক সিসিফাসের মতো পাথর ঠেলে যান, সাহিত্যের লুকানো সৌন্দর্য তুলে আনেন। রেখে যান পাঠকের জন্য। সাহিত্যের রস গ্রহণ একান্তই ব্যক্তিগত অভিরুচির ওপর নির্ভর করে। প্রাবন্ধিক এই অভিরুচি তৈরিতে সহায়তা করে। যা বড় কঠিন কর্ম। এই কঠিন কর্মের জন্যেই দশকে দশকে ঝাঁক বেঁধে প্রাবন্ধিক আসেন না সাহিত্যপাড়ায়। তবে একেবারেই যে আসেন না, তা নয়। সংখ্যায় কম হলেও তারা বাংলাসাহিত্যের প্রবন্ধের ভুবনকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন সবসময়। কেউ কেউ সৃজনশীল সাহিত্য অর্থাৎ গল্প, কবিতার পাশাপাশি মননশীল প্রবন্ধও রচনা করছেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তাদের সংখ্যাই বেশি। বর্তমানে যারা প্রবন্ধ সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করার জন্য নিরন্তর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, তাদের মধ্যে দুজন হলেন, কাজী মহম্মদ আশরাফ ও মোহাম্মদ নূরুল হক। দুজনেই প্রবন্ধ ছাড়াও সাহিত্যের অন্যান্য শাখাতেও সক্রিয়। কাজী মহম্মদ আশরাফ গল্পকার ও মোহাম্মদ নূরুল হক কবি হিসেবে সমাধিক পরিচিত। তবে সংখ্যার প্রাচুর্যে দুজনেরই প্রবন্ধের সংখ্যা কম নয়।
কাজী মহম্মদ আশরাফ বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধ রচনা করেছেন। বাংলা ব্যাকরণ, কবি ও কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক, কাব্য নাট্য, গল্প প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। মোহাম্মদ নূরুল হকের প্রবন্ধের ক্ষেত্রও বেশ বিস্তৃত। তার আলোচনাতে উঠে এসেছে কবি-কবিতা, গল্প, উপন্যাস, আঞ্চলিক গান, ব্লগার হত্যা প্রভৃতি বিষয়গুলো। দুজনের প্রবন্ধেই বেশ কিছু সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য দেখা যায়। সংক্ষেপে এখানে কিছু তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
কাজী মহম্মদ আশরাফ ‘বাংলা ব্যাকরণে পরাশ্রম’ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন বাংলা ব্যাকরণ পূর্বে সংস্কৃতঘেঁষা হলেও বর্তমানে তা ইংরেজি ছাঁচে ফেলে লেখা হয়েছে। আদতে যার কোনোটিই ঠিক নয়। বাংলা ব্যাকরণ বাংলা ভাষার নিয়ম অনুসারেই হওয়া উচিত। ড. হুমায়ুন আজাদ বাংলা ব্যাকরণ রচনার কথা বললেও কোটি টাকা বরাদ্দের কথা শুনে বাংলা অ্যাকাডেমি সে প্রকল্প থেকে সরে আসে। পরবর্তী সময়, বাংলা অ্যাকাডেমি ‘প্রমিত বাংলা ব্যাকরণ’ প্রণয়ন করলেও তা পুরোই ইংরেজিনির্ভর হয়ে উঠেছে। ফলে তৈরি হয়েছে বিশৃঙ্খলা। প্রসঙ্গত এখানে বলে নেই, দশম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা ‘পদ’ পড়লেও, একাদশ শ্রেণীতে উঠে তাদের সেটাকে পড়তে হচ্ছে ব্যাকরণিক শব্দশ্রেণী। দশম শ্রেণীর অব্যয় পদকে তারা আর একাদশ শ্রেণীতে খুঁজে পাচ্ছে না। সর্বোপরি, প্রাবন্ধিক প্রমিত বাংলা বলে আমরা যাকে জানছি, মানছি, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। আর এ জন্য প্রশ্নের আঙুল তুলেছেন বাংলা অ্যাকাডেমির দিকেই। বাংলা বানানে অরজকতার জন্যও মোহাম্মদ নূরুল হক বেশ কিছু কারণের মধ্যে প্রধানত বাংলা অ্যাকাডেমির ভূমিকাকেই দায়ী করেছেন ‘বাংলা বানানে বিশৃঙ্খলার জন্য দায়ী কে’ প্রবন্ধে। তিনি লিখেছেন, ‘বানান ভুলের জন্য বড় দায়ী বাংলা অ্যাকাডেমি। এই স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানটি প্রমিত বানানরীতির যে নিয়ম তৈরি করেছে, সেখানেই রয়ে গেছে আসল গলদ। একই শব্দের দ্বৈতরীতি যেমন রেখেছে, তেমনি রেখেছে বেশকিছু বানান ও সমাসবদ্ধ শব্দগঠনের ক্ষেত্রে অস্পষ্টতাও। বানান ও শব্দগঠন-সংক্রান্ত এই জটিলতার সুযোগ নিয়ে গণমাধ্যম ছাড়াও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বানান বিষয়ে স্বৈরাচারী আচরণ করে আসছে।’
বাংলা অ্যাকাডেমি ছাড়াও তিনি আরও কিছু যৌক্তিক কারণ নির্দেশ করেছেন, তবে মূল দায়িত্বটি দিয়ে রেখেছেন বাংলা একাডেমির ঘাড়েই।
কাজী মহম্মদ আশরাফ ও মোহাম্মদ নূরুল হক কবি ও কবিতা নিয়ে বেশ কিছু প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তবে মহম্মদ আশরাফ অগ্রজ কবিদের কবিতা নিয়ে আলোচনা করলেও মোহাম্মদ নূরুল হক অগ্রজের পাশাপাশি সমসাময়িক কবিদের কবিতা নিয়েও আলোচনা করেছেন। বলতে গেলে সমসাময়িক কবিদের কবিতার দিকে তার পক্ষপাতিত্ব বেশি পরিলক্ষিত হয়। কাজী মহম্মদ আশরাফ কবিতার বিষয় এবং কবির সমসাময়িক ঘটনাবলির ওপর জোর দিয়েছেন। মোহাম্মদ নূরুল হক সেখানে কবিতার বিষয়ের চেয়ে কবিতার প্রকরণ, শৈলীর ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
বিষ্ণু দের কবিতা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন কাজী মহম্মদ আশরাফ। বিষ্ণু দের প্রায় প্রতিটি কাব্য ধরে ধরে আলোচনা করেছেন। আলোচনা করে বিষ্ণু দের সমসামিয়ক ঘটনাগুলো। যেমন তিনি বিষ্ণু দের ‘ব্লাডপ্রেসর’ কবিতার আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘পঞ্চাশ পেরুনো কবিদের প্রায় সবাই তখন নিজ নিজ অবস্থানে বেশ সঙ্গত এবং সংহতরূপেই প্রতিষ্ঠিত। এর মধ্যে কাছের অনেক লেখক মারা গেছেন। প্রথমে গেলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারপরে জীবনানন্দ দাশ মারা গেছেন। প্রবল শক্তিশালী মানিক বন্দ্যোপাধ্যয়ও চলে গেছেন। সুধীন্দ্রনাথ থেমে গেছেন।
অনেকের সঙ্গেই সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেছে। অনেকে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের আগ্রহ দেখাচ্ছেন। হচ্ছেও কারও সাথে। এই বয়সে বিষ্ণু দে অনুভব করেন একজন মৌলিক কবি হিসাবে নিজের বোধ ও অনুভবের, স্বপ্নের ও সম্ভাবনার কিছু কবিতা জগতে রেখে যাবেন। বাইরে থেকে পাওয়া, বক্তব্যধর্মী কথা অনেক শুনিয়েছেন, শুনিয়ে যাচ্ছেন আরও অনেক কবি। কিন্তু এবরই মধ্যে কবির মধ্যে এসেছে মৃত্যুচিন্তা। শরীরে বাসা বেঁধেছে স্থায়ী ব্যাধি যা তিনি ‘ব্লাডপ্রেসর’ কবিতায় অনুভব করেই উল্লেখ করেছেন।’
অন্যদিকে মোহাম্মদ নূরুল হক কবিতার আলোচনা করতে প্রকরণালোচনাকেই উদ্দিষ্ট করেছেন। ‘শামীম রেজার কবিতা: বিষয় ও প্রকরণ’ প্রবন্ধ থেকে কিছুটা অংশ উদ্ধৃত করা যাক। তিনি লিখেছেন, ‘ইতিহাসের সঙ্গে মিথ এবং বাস্তবতার সঙ্গে রূপকথা-উপককথার যোগসূত্র স্থাপন করতে গিয়ে যতটা কল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন, ততটা অভিজ্ঞা থেকেও আহরণ করেছেন। একইসঙ্গে গ্রামীণ পটভূমি-শহুরে চিত্রের সম্পর্ক স্থাপন করে দেখিয়েছেন, স্থানিকসীমারেখা ও সংস্কৃত্বি মানবজীবনে বিশেষ প্রভাব ফেলে। ছন্দ-অন্ত্যমিল ও অনুপ্রাসের ক্ষেত্রে অক্ষরবৃত্তের চাল বজায় রেখে টানাগদ্যে প্রবহমান রেখেছেন প্রায় কবিতা। অন্ত্যমিল বর্জন করেছেন, নিরূপিত ছন্দকে গ্রাহ্য করেননি। একইসঙ্গে অন্ত্যমিল ও অনুপ্রাসও তার কাছে ন্যূনতম গুরুত্ব পায়নি।’
ব্যাপারটি আরেকটু খোলাসা করে বলি। দুজনেই সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা নিয়ে আলোচনা করেছেন। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসে পঞ্চপাণ্ডবের একজন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছেন। যদিও শব্দের দুর্বোধ্যতার কারণে পাঠকের কাছে তিনি সমাদৃত হননি। অবশ্য সুধীন্দ্রনাথ দত্তও জনপ্রিয় কবি হতে চাননি। এড়িয়ে গেছেন ‘জনতার জঘন্য মিতালী।’
দুজনের গদ্যভাষা কিছু মৌল লক্ষণ এখানে পাওয়া যায়। কাজী মহম্মদ আশরাফ গদ্যভাষা অনেকটা মুখের ভাষা কাছাকাছি। গীতল। নদীর ঢেউয়ের মতো বয়ে যায়। চলিত শব্দের প্রয়োগ বেশি। কিন্তু মোহাম্মদ নূরুল হকের গদ্যে তৎসম অনায়াসে এসে পড়ে। যুক্তবর্ণ ব্যবহারের দিকে তার পক্ষপাতিত্ব রয়েছে। তিনি শব্দে শব্দে সৌধ নির্মাণ করেন। শব্দের শৃঙ্খলার মধ্যে গেঁথে দেন নিজস্ব ছন্দ।
দুজনের প্রবন্ধেই অবশ্যম্ভাবীভাবে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের দুর্বোধ্য কাব্যভাষার কথা উঠে এসেছে। কাজী মহম্মদ আশরাফ লিখেছেন, ‘তার(সুধীন্দ্রনাথ দত্ত) রচনারীতি নিয়ে পাঠকের অভিযোগ রয়েছে দুর্বোধ্যতার। কিন্তু বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, তা দুর্বোধ্য নয় দুরূহমাত্র। একবার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সুধীন্দ্রনাথকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তিনি এমন অপরিচিত এবং আভিধানিক শব্দ ব্যবহার করেন কেন। উত্তরে নাকি সুধীন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে পার্থক্য সৃষ্টি করার জন্য তিনি এটা করেন।’
অন্যদিকে নূরুল হক লিখেছেন, ‘তার (সুধীন্দ্রনাথ দত্ত) কবিতায় আবেগের চেয়ে প্রজ্ঞা, কল্পনার চেয়ে অভিজ্ঞতা এবং ভাবালুতার চেয়ে বুদ্ধিবৃত্তির পরিচয় বহুল পরিমাণে বিধৃত। ফলে তার কবিতা সহজবোধ্য হয়ে ওঠেনি।’
এখানে কাজী মহম্মদ আশরাফ সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাব্যের দুর্বোধ্যতার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দুটো উদ্ধৃতির সাহায্য নিয়েছেন। মোহাম্মদ নূরুল হক সেখানে গাণিতিক যুক্তির দ্বারস্থ হয়েছেন। তবে কেউ যেন বিষয়টিকে এমনভাবে না নেয়, কাজী মহম্মদ আশরাফ যুক্তিকে এড়িয়ে চলেন। আদতে তা সম্ভবও নয়। কারণ প্রবন্ধ নির্মিত হয় যুক্তি এবং কল্পনার মিথস্ক্রিয়ায়। আর মোহাম্মদ নূরুল হকও তার প্রবন্ধে পূবোর্জ অনেক প্রাবন্ধিকের কোটেশন ব্যবহার করেন। এখানে শুধু তাদের প্রধান প্রবণতা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
দুজনের গদ্যভাষা কিছু মৌল লক্ষণ এখানে পাওয়া যায়। কাজী মহম্মদ আশরাফ গদ্যভাষা অনেকটা মুখের ভাষা কাছাকাছি। গীতল। নদীর ঢেউয়ের মতো বয়ে যায়। চলিত শব্দের প্রয়োগ বেশি। কিন্তু মোহাম্মদ নূরুল হকের গদ্যে তৎসম অনায়াসে এসে পড়ে। যুক্তবর্ণ ব্যবহারের দিকে তার পক্ষপাতিত্ব রয়েছে। তিনি শব্দে শব্দে সৌধ নির্মাণ করেন। শব্দের শৃঙ্খলার মধ্যে গেঁথে দেন নিজস্ব ছন্দ।
ছোটগল্পের আলোচনায় মোহাম্মদ নূরুল হক বেছে নিয়েছেন অগ্রজদের গল্পের ভুবন। রবীন্দ্রনাথ, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু, শওকত ওসমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ, সমরেশ বসু, আবদুল মান্নান সৈয়দ, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, কায়েস আহমেদ, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, নাজিব ওয়াদুদের গল্প হয়েছে তার প্রবন্ধের বিষয়। সেখানে কাজী মহম্মদ আশরাফ তার সমসামিয়ক লেখকদের গল্পের ভুবনে উঁকি দিয়েছেন। সাবরিনা আনাম, আশরাফ জুয়েল, পিন্টু রহমান, আনিফ রুবেদ, সুমন মজুমদার, সোলায়মান সুমনের গল্প নিয়ে আলোচনা করেছেন।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও শামসুর রাহমান যথাক্রমে ঔপন্যাসিক ও কবি হলেও কাজী মহম্মদ আশরাফ এই দুই সাহিত্যিকের অপেক্ষাকৃত কম আলোচিত প্রাবন্ধিক পরিচয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। ‘প্রবন্ধ সাহিত্যে শরৎ চন্দ্র প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘তাঁর রচনার পরিমাণ অনেক। তবে প্রবন্ধগ্রন্থের সংখ্যা মাত্র তিনটি। ‘নারীর মূল্য’ (১৯২৪), ‘তরুণর বিদ্রোহ’ (১৯৩০) ও ‘স্বদেশ ও সাহিত্য’ (১৯৩২)। তারও অনেক প্রবন্ধ-নিবন্ধ, ভ্রমণকাহিনী, স্মৃতিকথা, সমালোচনা, রাজনৈতিক প্রবন্ধ, ভাষণ-অভিভাষণ, শোকপ্রস্তাব, মানপত্র, পুস্তক সমালোচনা ও চিঠিপত্র বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, গ্রন্থভুক্ত হয়নি। নারীর মূল্যের মতো ‘মূল্য’ সিরিজে অনেকগুলো প্রবন্ধ লেখার ইচ্ছা ছিল, বেঁচে থাকলে হয়তো লিখতেন। তবে শরতের প্রবন্ধসাহিত্য অনালোচিত ও অবহেলিত রয়ে গেছে।’
তিনি শরৎ চন্দ্রের তিনটি প্রবন্ধগ্রন্থ নিয়েই আলোচনা করেছেন। শরৎচন্দ্র নারীদের ছদ্মনাম গ্রহণ করার ভুল ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য ড. হুমায়ুন আজাদের সমালোচনাও করেছেন তিনি। শামসুর রাহমানের সাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধ নিয়েও তিনি বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। পিকাসোর শিল্প- প্রেম, মান্নান সৈয়দের কাব্য নাটক হয়েছে তার প্রবন্ধের বিষয়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তার দ্বিতীয় স্ত্রী রমার চোখে কেমন ছিলেন, এই নিয়ে কাজী মহম্মদ আশরাফ লিখেছেন ‘রমার বিভূতিভূষণ’। সামিনা লুৎফা নিত্রার ‘খনা’ নাটক নিয়ে আলোচনা করেছেন ‘বচনে খনার বচন’ প্রবন্ধে। তবে এটি নিছক নাটকের সমালোচনা নয়, প্রাবন্ধিক তার রচনা নৈপূণ্যে এটিকে পূর্ণাঙ্গ প্রবন্ধ করেই তুলেছেন। এছাড়া ‘সাহিত্য সম্পাদকের দায়’, ‘সাহিত্যে যৌনতা’, ‘সাহিত্যের স্বায়ত্তশাসন’, ‘মৃত্যুর সৃজনশীলতা ও মতবাদ’, ‘বাংলা মনুষ্যেতর ছোটগল্পে মানবিক বোধ’ প্রভৃতি প্রবন্ধ লিখে কাজী মহম্মদ আশরাফ তার প্রবন্ধের দিগন্তকে বিস্তৃত করেছেন।
কাজী মহম্মদ আশরাফ ও মোহাম্মদ নূরুল হক এই সময়ের প্রতিনিধি। হাজার বছরের বাংলাসাহিত্যের ঐতিহ্যকে তুলে ধরার পাশাপাশি বর্তমান সাহিত্যেরও পৃষ্ঠপোষক তারা। তাদের শৈল্পিক মন এবং পরিশ্রম দিয়ে প্রবন্ধ সাহিত্যের অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছেন। ফলে স্বভাবতই তাদের প্রতি আমাদের প্রতীতি জন্মায়।
মোহাম্মদ নূরুল হক অগ্রজ, সমসাময়িক কবিদের বিষয়, প্রকরণ নিয়ে বিশ্লেষণ মূলক প্রবন্ধ ছাড়াও লিখেছেন, ‘ব্লগার-লেখক-প্রকাশক খুন: একটি অশনি সংকেত’, ‘কেন ছন্দ অনিবার্য’, ‘কবিতার সংকট’, ‘জাতীয় সংগীত বিতর্ক: মুখোশ যখন খসে পড়ে’, ‘কবিতার সৃজনক্রিয়া’, ‘কবির ঋণগ্রহণপ্রবণতা ও নতুন কবিতার সৃষ্টি’, ‘বাক-স্বাধীনতার প্রয়োগ-অপপ্রয়োগ’, ‘বৃত্তাবদ্ধের স্বার্থচিন্তা ও মতাদর্শের দ্বন্দ্ব’ প্রভৃতি প্রবন্ধ। প্রবন্ধের শিরোনামেই মোহাম্মদ নূরুল হকের বিচরণশীল মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি শুধু সাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেন না, সমাজের বিভিন্ন সমস্যাও তার লেখায় উঠেছে আসে। ‘ব্লগার-লেখক-প্রকাশক খুন: একটি অশনি সংকেত’, ‘জাতীয় সংগীত বিতর্ক: মুখোশ যখন খসে পড়ে’ প্রভৃতি তেমনই প্রবন্ধ। এখানে তিনি সমাজের মনস্তত্ত উদঘাটনের চেষ্টা করেছেন। আমরা জানি ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে বেশ কিছু ব্লগার, মুক্তমনা লেখক, প্রকাশক আততায়ীদের হাতে নিহত হয়েছেন। তারও প্রায় এক দশক আগে আততায়ীদের হাতে আহত হোন প্রথাবিরোধী লেখক ড. হুমায়ুন আজাদ। এইসব হামলা, হত্যাকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে মোহাম্মদ নূরুল হক ‘ব্লগার-লেখক-প্রকাশক খুন: একটি অশনি সংকেত’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘কেন ব্লগার- লেখক- প্রকাশক খুন হচ্ছেন, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের একটু পেছনে তাকাতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের সময়, বিজয় যখন দ্বারপ্রান্তে ঠিক তখনই, পাকিস্তানি হানাদারদের এ দেশীয় দোসররা দেশের সেরা শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের ধরে ধরে নিয়ে হত্যা করেছেন। দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু ওই পাকিস্তানি দোসররা রয়ে গেছেন। তারা নানা কৌশলে ও কারণে-অকারণে সুযোগ পেলেই মুক্তমনা-সমাজচিন্তকদের হত্যা করবেন, এটাই স্বাভাবিক। তাদের সেই স্বাভাবিক স্বভাবের কারণেই বলা যায়—ব্লগার লেখকদের খুন করে তারা দেখেছেন, তাতেও সমস্যার সমাধান হয়তো হচ্ছে না। ব্লগার লেখকের মৃত্যুর পর, তাদের আদর্শ মুছে যাচ্ছে না। পরন্তু তাদের আদর্শে নতুন করে উজ্জীবিত হচ্ছে অনেকে। আর এই উজ্জীবনে সহযোগিতা করছেন প্রকাশকেরা, বই ছাপিয়ে। তাই এবার হয়তো সে কারণেই প্রকাশকদের ওপরই খুনিদের খড়্গ নেমে এলো।’
বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত নিয়ে নানা সময় নানা বিতর্ক তৈরি হয়েছে। সেটা কখনো ব্যক্তিগত ভাবে, কখনো রাষ্ট্রীয় ভাবে। ‘জাতীয় সংগীত বিতর্ক: মুখোশ যখন খসে পড়ে’ প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক তারই বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি তুলে ধরেছেন, কিভাবে রবীন্দ্রনাথের এই দেশাত্মবোধক গান আমাদের প্রাণের সংগীত হয়ে উঠেছে, জাতীয় সংগীত হয়ে উঠেছে। এবং এই জাতীয় সংগীত কিভাবে রাষ্ট্রনায়কদের কোপানলে পতিত হয়েছে, তাও তুলে ধরেছেন তিনি। একটি দেশের জাতীয় সংগীতের সঙ্গে দেশের অনেক কিছুই জড়িত থাকে। তাই যারা জাতীয় সংগীতকে হাল্কাভাবে নেন, বিভিন্ন সমস্যার মাঝে থেকে জাতীয় সংগীত বিতর্ককে গুরুত্বহীন মনে করেন, প্রাবন্ধিক অত্যন্ত রূঢ়ভাষায় তাদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘তাদের আচরণ-বক্তব্য-ভূমিকা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, তারা একেকজন আইয়ুব-মোশতাক-জিয়া-মুজাহিদ-নিজামীরই উত্তরসূরি।’
কাজী মহম্মদ আশরাফ ও মোহাম্মদ নূরুল হক এই সময়ের প্রতিনিধি। হাজার বছরের বাংলাসাহিত্যের ঐতিহ্যকে তুলে ধরার পাশাপাশি বর্তমান সাহিত্যেরও পৃষ্ঠপোষক তারা। তাদের শৈল্পিক মন এবং পরিশ্রম দিয়ে প্রবন্ধ সাহিত্যের অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছেন। ফলে স্বভাবতই তাদের প্রতি আমাদের প্রতীতি জন্মায়। তারা সেই প্রতীতি রক্ষা করবেন, তাদের মেধা ও মনন দিয়ে সাহিত্যের লুকায়িত স্বর্ণমৃগকে পাঠকের সামনে তুলে ধরবেন, পাঠক হিসেবে এই চাওয়া তাদের কাছে রইলো।