করোনাকীর্তনের রাত
ঘুম ভেঙে যায়, ঘুম ভেঙে যায়, বার বার ঘুম ভেঙে যায় প্রহরে প্রহর।
কণ্ঠরোধ করে জেগে ওঠে শ্বাসযন্ত্র
পরিষ্কার নিঃশ্বাস বইছে কি নাকে?
নাকি ভাইরাস কিছু আছে তার সঙ্গে?
অচ্ছ্যুত মৃত্যুর সঙ্গে বাঁধলো বুঝিবা ওই লড়াই
কল্পনায় দেখে নেই মৃত্যুনীল এপার-ওপার
করোনা যদিবা নাই ছাড়ে তবে কি এমন হবে
ওই বিপদাপন্নকাল, স্বজনবিহীন অন্ধকার—
মনো-স্ক্রিনে ভেসে ওঠে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, স্পেন,
আর ইতালির সব হাসপাতালের ছবি
বরফ শাদায় ঢাকা মৃতের মিছিল
যেখানে ডাক্তার নার্স এক দিশাহীন শাদা ভালুক পোশাকে।
না, না এর মানে নেই কোনো।
দুশ্চিন্তার লাল-সুতো কেটে দেই যত পারি দ্রুত,
স্বপ্নের সাঁতার কাটি সমুদ্রের ডলফিন যেন
সকলের মতো চাই বাঁচতে আমিও
ভাবনায় মেখে নেই ফের ধনেপাতার সবুজ।
ওদিকে তাকালে খুব দূরে দেখা যায়
সুন্দরবনের ঘন-জঙ্গলে হিংস্র থাবা মেলে
রয়েল বেঙ্গল টাইগার বসে আছে ওঁৎ পেতে
ওদিকে কেনবা যাবো—
ঘরেই না হয় অন্তরীণ থাকি আরও কিছুকাল,
প্রিয়-পরিজন নিয়ে, শিল্পিত হারানো মুখচ্ছবি
সেইসব দিন-রাত রোমন্থন করে
কাটুক না হয় আরও কিছুটা সময়,
এখনো তো মেঘের মতো ছেঁড়া-ছেঁড়া
স্বপ্নগুলো দু’চোখের আপেল মনিতে তড়পায়
মায়া-রোদে ভেসে যায় দূর অচলায়তন ছুঁয়ে
বাতাসের গায়ে মাখোমাখো ভালোবাসা
কত প্রিয়জন বাকি, এখনো তাদের
মুখ ফুটে হয়নি তো বলা, ভালোবাসি।
একদা ঘৃণায় যারা তুলেছে সতত
শানিত বিষের ফণা, চন্দ্রচূড়ে-ঘষা
তাকেও তো বলতে চাই, ভালেবাসা নাও,
দিতে চাই, অফুরন্ত—নেবে কি, নেবে না, তুমি বলো।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হোক,
হোক না তা?
কলারপাতার মতো ঝিরিঝিরি সন্ধ্যা,
এখনো তো বেঁচে আছি মাড়িয়ে মৃত্যুর আলিঙ্গন
এখনো দেখছি চাঁদ দূরে চিত্রার্পিত
অপরাজিতার মতো নীলাকাশজুড়ে
কণ্ডোর পঞ্চাশতলা থেকে যেন কেউ ছুড়ে দিচ্ছে
অবিনাশী জ্যোৎস্নার চাবি
আমি তাকে আঁচলেই বাঁধি
মাটি ফুঁড়ে উঠে আসে যেন এক ছোট্ট গাঙ ফুল
ও আমার শৈশবের রাঙাজল কালিগঙ্গা-তীর।
ও মানুষ
ও মানুষ বাঁচবে তুমিও
বাঁচার ভেতরে এক আঁশটে আমুদে
গন্ধ আছে মাছেদের মতো,
নাভিমূলে তার বন্য অচেনা-কুসুম
হরিণ-কস্তুরী যেন বাতাসে বিধুর
অভিমানেও যখন বলি, মরে যাবো তোমার বিহনে,
তখন আরও চাই বাঁচতে ব্যাপকভাবে খুব
তোমাকে জড়িয়ে নিঃস্বলয়ে…
এখনো এই যে বেঁচে আছি,
বাঁচা ও মরার এই আতঙ্ক-আশ্লেষ বুকে নিয়ে
অভিনব তারও এক প্রাণকাড়া সুবাস রয়েছে।
রঙচটা জীবনও কিছু দেয় তাকে
চাইবার মতো করে যদি চাইতে তুমিও পারো,
জীবন সর্বদা হতে বলেছে নমিত
অহঙ্কারী গ্রীবাদেশ ডুবিয়ে অতলে
যুদ্ধবাজ, অগ্নিবাজ তারা কেউ হয়নি অমর
গর্হিত চরিত্র দোষে,উপরন্তু মৃতের মিছিলে
অনাবিল এ গ্রহকে করেছে মলিন
সময়ের চঞ্চলতা থেমে গেছে বিমর্ষ বৈঠকে
ও মানষ তুমি তো বাঁচবে কিন্তু আরও
লাশের মিছিলে যাবে শত শত প্রিয়মুখ যত।
জীবনের বরাভয়ে জানি ভুলে যাবো সব গ্লানি
প্রকৃতি ফিরিয়ে দেবে ফের বিশ্বাসের মনোভূমি।
পাখি হয়ে যাই
মানুষের খোলস ছেড়ে পাখি হয়ে যাই,
ডানা মেলে দেই গভীর কোনো অরণ্য-সবুজের খোঁজে।
করোনা-ক্লেশের এই নিঃশব্দের স্তব্ধতা ভেঙে
চলে যেতে ইচ্ছে করছে সমুদ্রের নীল জলের কাছে,
যেখানে নির্ভয়ে রঙিন মাছেরা খেলা করে সর্বক্ষণ।
লকডাউন, হোম কোয়ারেন্টাইন, আইলোসোলেশন
রবাহুত এই শব্দ ত্রয়ের মুক্তির জন্যে চাই খোলা আকাশ।
কোথায় মুক্তি,
কোথায় বা গতিতত্ত্বের আরতি?
বাতাসের গতিবেগ উল্টো আমাকে নিয়ে আছড়ে ফেলেছে
দেড়শত বছরের আগের এক সন্ধ্যারাগে,
অন্টারিও লেক ছেড়ে ঝিলোম নদীর পাশে
যার বাঁকা স্রোত, আজো আঁধারে মলিন,
যেন খাপে ঢাকা বাঁকা তলোয়ার
অন্ধকার গিরিতটতলে এখনো দাঁড়িয়ে আছে দেবদারু,
আজো তার ‘অব্যক্ত ধ্বনির পুঞ্জ অন্ধকারে উঠেছে গুমরি’।
হে আমার প্রাণের দেবতা, আপনি এসে দেখুন,
কোথাও খোলা নেই পলায়নের কোনো গিরিপথ
তূষরাবৃত্ত এই তল্লাটেও নেই কোনো অভয়াশ্রম
আমপাড়া হাতে নিয়ে ফিরে যাবো কি শৈশবে?
সাপের মতো চিকন হালোটের ছায়াপথ ধরে…
সেখানেও মৃত ঘাস-ফড়িং আর সব অচেনা কুসুম
মমি হয়ে পড়ে আছে বিস্মৃতির পাতাজুড়ে…
কোথায় মুক্তি, এই যোজন যোজন পথ-হারানো পথে
কিছুতেই আর মনে পড়ে না প্রণয়ের সেই প্রথম ছোঁয়া,
যখন স্পর্শের প্রবল হাতছানিতে সে ডেকেছিলো কাছে;
বৃন্দাবনসহ যুমনার কালো জলে ডুবে গেছে সব
কদমতলায় পড়ে আছে ভাঙা বাঁশি, হারানো সুর
কাঙাল মন, ভিখিরি দীনহীন তবু আজো বেঁচে আছি,
বাঁচার পিপাসায়, প্রকৃতির প্রেমে অন্ধ স্বপ্নের বালিকা এক।
আই কান্ট ব্রিদ
হে, জর্জ ফ্লয়েড,
আমরাও জানি;
তুমি ছিলে নিরস্ত্র ও সত্য,
একা ও একাকী।
ফাঁসিতে নিহত প্রতিবাদী কবি বেঞ্জামিন ছিল সহোদর
মানবজাতির আদি আঁতুর ঘরেই ছিল প্রথম ঠিকানা,
আফ্রিকার ছায়াবৃত্ত ইতিহাসের সবুজ অরণ্যে,
জন্মেছিলে নিয়ে তুমি অপার সৌন্দর্য,
কালোর পেখমতোলা আদিত্য কিরণ।
শাদাদের দেশে ছিল ভিন্ন পরিচয়
কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান এক নাগরিক,
বর্ণবাদী তন্তুজালে তারা জন্ম মুহূর্ত থেকেই
তোমাকে রেখেছে বেঁধে,
দাসত্বচাবুকে উল্কি ফুটে আছে তার দিকে দিকে
আজো তাই আমন্ত্রণ করে আনে সেই নৃশংসতা
সেকথা কি ভুলে যাবে শ্বেতাঙ্গ সহসা?
কী যে এক টগবগে তরুণ বয়স
মাত্র ছেচল্লিশ, যেন এক আকাশের ধ্রুবতারা
নিশ্চয় কন্যাটি সবে স্কুল শেষ করেছে তোমার
গৃহবন্দি করোনায় ঘরে থাকা ক্লান্ত,
প্রিয় সন্তানের হাতে খুদকুঁড়াসহ
অসামান্য এক ভালোবাসা
তুলে দেবে বলে গিয়েছিলে তুমি ওই গ্রোসারিশপে
হাতে নিয়ে মাত্র,
মাত্র বিশটি ডলার,
কে জানতো জাল নোটে লেখা ছিল এমন সমন।
খুব দুঃখ হচ্ছে আজ, তুমি তো জেনে গেলে না কিছু
কেবল তোমার জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের চল্লিশ
শহরেই সুনসান কারফিউ ভেঙে
ক্ষোভে ও বিক্ষোভে জনগণ নেমে এসেছে রাস্তায়
এই মহাদেশ জুড়ে বিরতিবিহীন প্রতিবাদে ভেসে যাচ্ছে বাদামি,
শাদা ও কালো-মানুষের কান্না,
আন্দোলনকারী যত স্বেচ্ছায় তোমার জন্যে আজ
বরণ করেছে কারা,
কোভিড ছাড়াও মৃত্যু ভয়কে করেছে তুচ্ছজ্ঞান।
নিজেকে অনিরাপদ ভেবে হোয়াইট হাউজের
চারপাশে আজ টেনে দিয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্পি পর্দা
ওয়াসিংটন ডিসিসহ পনেরটি অঙ্গরাজ্যে
সেনাবাহিনীর কাঁধে ঝুলিয়ে দিয়েছে সুসজ্জিত ভারী অস্ত্র
উন্নত বিশ্বের তিনি মোড়ল, তবুও
থরথর করে আজ কাঁপছে করোনাক্রান্ত জ্বরে, শ্বাসকষ্টে,
হাঁটু চেপে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছে তোমাকে যারা যারা
ওই যে শাদা চামড়ার বিশেষ পুলিশ
ড্যারেক চৌভিন, যার নাম উচ্চারণ করা পাপ
যার হাঁটুর তলা থেকে তবু তুমি বার বার বলেছিলে,
‘আই কান্ট ব্রিদ,
আই কান্ট ব্রিদ
আই এম অ্যাবাউট টু ডাই’
স্বপ্নময় আমেরিকা আজ
বিড়বিড় করে যাচ্ছে ঝিঁঝি পোকার মতন এক,
আই কান্ট ব্রিদ,
আই কান্ট ব্রিদ—
বিশ্ব যেন আজ এক উত্তাল অগ্নির তপোবন,
দহনে পুড়ছে জন-দাবানল তৃণ
শোষণ-ভূষণ আর বর্ণবৈষম্যের আদিমতা….
মুহূর্তেই যেন ঝরে যাচ্ছে হলুদপাতার মতো।
প্রতিবাদী ঢেউ এক ছুটেছে সমুদ্র সঙ্গমের লক্ষ্যভেদে
একই পঙ্ক্তিতে এসে দাঁড়িয়েছে সাম্যের পৃথিবী,
আফ্রিকার মরুভূমি সাহারা থেকেও
দীর্ঘশ্বাস এক ছুটে এসেছে তোমাকে মনে করে,
তোমার উচ্চতা যেন এটলাস পর্বতের শৃঙ্গ,
এতটাই শক্তিধর, তুমি—
তোমার জন্যই বুন্দেসলিগার মঞ্চে থেকে আজ
জ্যাডন স্যাঞ্চো ও আশরাফ হাকিমিও
‘জাস্টিস ফর জর্জ ফ্লয়েড’
লিখিত টি-শার্ট পরে খেলতে নেমেছে মাঠে
মাঠ থেকে মাঠে মাঠে
খেলা নয় যেন প্রতিবাদের অনন্য এক ঝড়—
পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন প্রান্তে বসে তোমারই নামে
কবিতা লিখছে কবি,
সঙ্গীতের সুরে সুরকার নাম গায় তোমারই।
বিস্মৃতির ছেঁড়াপাতা থেকে উঠে আসে এক নাম
মার্টিন লুথার কিং, মানবতার ওই বাতিঘর
গুপ্তহত্যা দেখে তার, বিক্ষুব্ধ, বিপন্ন বিশ্ববাসী কেঁদেছিল
যে দুঃখে, বিক্ষোভে আর বেদনা-লাভায়
বাহান্ন বছর পরে আজ
তোমারই জন্যে, শুধু তোমারই জন্যে
একই রকম এক আকাশ বিষাদে নেমে এলো
নিচে, আরও নিচে, জল-মাটির বিপন্ন ঘর-দোরে
তবু যদি সাম্য ফিরে আসে একবার,
বৈষম্যের এই ঘোলাজল ও কাদায়
বহুবর্ণ মানুষের এ কী লাল রক্তের আভায়?