পাবনা প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়ার পর আবির মাত্র পাঁচদিন ক্লাস করতে পারলো। এরপরই ক্যাম্পাস বন্ধ। মেজাজ বিগড়ে গেলো ওর। তবু আশা ১৫ দিন পরেই ক্যাম্পাস খুলে দেবে। ক্যাম্পাস জীবনের পাঁচদিনে অনেক নতুন বন্ধু জুটেছে তার। ওর জন্মই যেন হয়েছে এদের সঙ্গে দেখা হওয়ার জন্য। বাড়ি ফেরার আগে বিদায় নিতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে সে। বাড়ি ফিরে কিছুই ভালো লাগে না আর।
ছেলেকে কাছে পেয়ে খুব খুশি আবিরের মা। বড় বোন আভা পড়ে থার্ড ইয়ারে। দুজনের ঝগড়া লেগেই থাকে। আভা কথা বলে কম। বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে আসার সময় আভার মনে হচ্ছিল দেশে একটা যুদ্ধ লেগেছে। শরীয়তপুর লকডাউন করে দেওয়া হয়েছে। এখন যেকোনো সময় যেকোনো শহর লকডাউন হতে পারে। মনে হচ্ছে—১৯৭১ সাল। মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরে আভার জন্ম। কিন্তু মায়ের কাছে শুনেছে যুদ্ধদিনের অনেক গল্প। পড়েছে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক লেখাও।
আবির বাইরে থেকে এসে বিছানায় বসে নখ কামড়ায়। আভা ধমকের সুরে বললো, তুই বাইরে যাবি আবার এসে এভাবে হাত মুখ না ধুয়ে বসে থাকবি।
বন্ধুবান্ধব ছেড়ে আসা নিয়ে আভা বিচলিত নয়, দেশের পরিস্থিতি নিয়েই ভাবছে সে। সবাই বলে আভার কোনো আবেগ নেই। বাসায় এসেই ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলো। কোনো আন্টি এলেও দরজা খোলে না। এতে সবাই আভাকে বেয়াদব ধরনের মেয়ে বলেই জানে। মাও আভাকে বলে, এত বেশি বেশি করো না। —ভাইরাসটা কিন্তু ইনফেকটেড লোকের আশপাশে বাতাসের মধ্যেও ছড়াতে পারে আম্মু। সেখানে কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া ঠিক হবে না।
মা চলে যেতেই পেছন ফিরে দেখে আবির এসে ব্যাগ ঘাটাঘাটি করছে—কী খুঁজছিস?
—তোর কাছে টাকা হবে?
—না।
—থাকলেও তো দিবি না।
আবির ভাবতে লাগলো বন্ধের মধ্যে ওর মাসের হাতখরচটাও আর পাচ্ছে না। সিগারেট খাওয়ার টাকা নেই। এছাড়া হাতে টাকা না থাকলে কেমন যেন লাগে। সিগারেট খায় বলে আবিরকে তার মাও টাকা দেয় না সহজে। দিলেও খুব হিসেব করে দেয়। মায়ের এক কথা সিগারেটের জন্য টাকা দেওয়া যাবে না।
ছেলে সিগারেট খেলেও ধার্মিক। মেয়ে একবার নামাজ-রোজা কোনো কিছুতেই নেই। কথাই বলা যায় না আজকাল।
আবির বাইরে থেকে এসে বিছানায় বসে নখ কামড়ায়। আভা ধমকের সুরে বললো, তুই বাইরে যাবি আবার এসে এভাবে হাত মুখ না ধুয়ে বসে থাকবি।
—হইছে চুপ থাক ঘ্যান-ঘ্যান করিস না এত। রাখে আল্লাহ মারে কে? তুই তো আবার এই সব কিছু বুঝিস না।
বোনের ওপর চোটপাট দেখালেও হাত মুখ ধুয়ে আসল আবির। আভা অদৃষ্টের কাছে সব ছেড়ে দিয়ে উদাসীন হতে নারাজ। ও তার ভাইকে নিয়ে যতটা চিন্তিত, তার চেয়ে বেশি চিন্তা করছে মা-বাবাকে নিয়ে।
ওদের বাবার একটা ব্যাগের দোকান আছে। ভাইরাসের প্রকোপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দোকান বন্ধ করে দিয়েছে সে। বাসাতেই থাকে সারাক্ষণ। আভা বুঝতে পারছে ভাইরাসটা এই বাসায় এলে আসবে আবিরের হাত ধরে।
আবির আর ঘরে আটকে রাখা যাচ্ছে না। দুদিন অবশ্য কোথাও যায়নি। ওর বন্ধুবান্ধবেরা আসা-যাওয়া করছে রোজই। খুব ভোর হলে আবির স্টেশনে যেত হাঁটতে।
আভা দুদিন ধরেই খেয়াল করলো বাবার অবস্থা খুব খারাপ দিকে যাচ্ছে। হালকা জ্বরও এসেছে। গ্রামে এইসময় জ্বর এলেও কাউকে বলা যাবে না। আভারও অনেক জ্বর।
মা এসে আভাকে বলছেন, নামাজ পড়। এইসময়ে আল্লাহকে ডাকা ছাড়া কোনো উপায় নেই।
তাই ঘরেই থাকলো। তাছাড়া বাবা বোনের অসুস্থতায় তার মনে ভয়ের সঙ্গে অনুতাপ বোধও এসেছে। একটা ভয়, অনিশ্চয়তা মনকে ঘিরে রেখেছে।
মায়ের সঙ্গে কোনো কিছুতে তর্কে যাওয়ার মানে হয় না। হঠাৎ উৎসব বাসায় এলো। সে অবশ্য দরজায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে। আবিরের এক বছরের বড় উৎসব। আবির বলে, বাসায় আর ভালো লাগে না।
—কেন? পড়বি। এটা তো পড়ার জন্য ভালো সুযোগ।
—উৎসব ভাই আমার পড়ার ধৈর্য নেই।
—বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিপারেশন তো তুই নিস নাই। আমার থেকে দেখে টিকে গেছিস। তুই কি আর বুঝবি।
আবির এসএসসি, এইচএসসিতে খুব একটা ভালো পয়েন্ট পায়নি। ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরমও তুলতে পারেনি। আবিরকে টেকাতে পাবনা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবিরের সামনে বসে পরীক্ষা দিয়েছিল উৎসব। আবিরের চেষ্টায় কমতি ছিল না।
—তোর বন্ধুদের সঙ্গে দেখা কম করা ভালো। একজনের অবস্থা খুব খারাপ।
কিছুদিন পর আবিরের বাবার জ্বর বেড়ে গেলো। পরীক্ষা করাতে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। মা আভা আর তার বাবা দুজনকে একসঙ্গে ঠিকমতো যত্ন নিতে পারছে না। এর মধ্যে বাজারেও যেতে হয়। ভয়ে কাউকে জ্বরের কথা বলছে না। গ্রামের মানুষের ভাবখানাই এমন জ্বর হলেই যেন তাদের পিটিয়ে মেরে ফেলবে। পরীক্ষা করতে যাওয়ারও খুব সুবিধা নেই।
বাবার পাশের রুমেই আবির থাকে। তাই ঘরে বসে সিগারেট খেতে পারে না। গন্ধ পাবে। ছাদে যাওয়ার সময় বাবার রুমের জানালা দিয়ে দেখা যায়। এতে বাবার সন্দেহ হতে পারে। তাই ছাদে যেতে পারছে না। অসুস্থ অবস্থায় সে বাবাকে কোনো চাপ দিতে চায় না আর। তাই ঘরেই থাকলো। তাছাড়া বাবা বোনের অসুস্থতায় তার মনে ভয়ের সঙ্গে অনুতাপ বোধও এসেছে। একটা ভয়, অনিশ্চয়তা মনকে ঘিরে রেখেছে।