এক.
আত্মপ্রত্যয়ী ও স্থিতধি অধ্যবসায়ী লেখক আঞ্জুমান রোজী কানাডায় সুদূর প্রবাসে থেকেও বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষার প্রতি নির্ভেজাল প্রেম ও ত্যাগের মহিমায় সাহিত্যের জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন দীর্ঘকাল যাবৎ। কবিতা দিয়ে লেখালেখির শুরু হলেও কালের পরিক্রমায় কথাসাহিত্যেও বেশ বড় জায়গা দখল করতে যাচ্ছেন। কেবল লেখালেখিতেই সীমাবদ্ধ নন তিনি, তার গোপন ও প্রচারহীন সাহিত্যপ্রেম, সাহিত্যচর্চা, সাহিত্যপাঠ অনেক বড় ঘটনা। ব্যাখ্যাটা এমন যে, সুদূর কানাডায় থেকেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের লেখকদের সঙ্গে সেতুবন্ধ রচনা করে সুসম্পর্ক বজায় রেখে সাহিত্যের বিকাশ, প্রকাশ ও প্রচারের জন্য যথেষ্ট সময় ও মেধা খরচ করেন। সাহিত্যের জন্য এমন ভালোবাসা ও ত্যাগ আমাদের কাছে বিরল বলেই প্রতীয়মান হয়। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী রোজী আবৃত্তি সংগঠন ‘কণ্ঠশীলন’ ও বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটারভুক্ত নাট্যসংগঠন ‘নাট্যচক্র’-এর সদস্য ছিলেন। নিয়মিত পত্রপত্রিকায় লেখালেখি ছাড়াও কানাডায় বিভিন্ন সাহিত্যবিষয়ক কর্মকাণ্ডে সাংগঠনিক কাজে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করছেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা মোট সাতটি। তন্মধ্যে কবিতা চারটি, গদ্য একটি ও গল্পগ্রন্থ দুটি।
দুই.
সম্প্রতি প্রকাশিত হয়ে তার গল্পগ্রন্থ ‘সবুজ পাসপোর্ট ও অন্যান্য নিঃসঙ্গ গল্প’। ১০৪ পৃষ্ঠার গ্রন্থটিতে স্থান পেয়েছে মোট ১০টি গল্প। দশটি গল্পের মধ্যে প্রথম দুটি গল্প আকারে বড় হলেও ছোট গল্পের বৈশিষ্ট্যই আপাদমস্তক ধারণ করে আছে। ‘অন্য কোথাও অন্য কোনোখানে’ প্রথম গল্পটি ২৪ পৃষ্ঠা এবং ‘রোদেলা’ দ্বিতীয় গল্পটি ২০ পৃষ্ঠা স্থান দখল করেছে। গল্পগুলো নির্মিত হয়েছে দাম্পত্যজীবনের মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন, পরকীয়া প্রেম, প্রেমের ভুল বোঝাবুঝি, পারিবারিক কলহ ইত্যাদি বিষয়কে উপজীব্য করে। শিল্প-সাহিত্যে সময়ের ও মানুষের দর্পণ আর সেই দর্পণে প্রতিফলিত হয় শিল্পীর চারপাশের উপাদানের। শিল্পী সমাজের বাইরে কেউ নন এবং তিনি যা প্রত্যক্ষণ করেন, উপলব্ধি করেন এবং ধারণ করেন সেসব বিষয়ই কোনো না কোনোভাবে লেখায় প্রতিফলিত হয়। আলোচ্য গল্পগ্রন্থে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি, প্রবাসজীবনের কানাডার অভিজ্ঞতা এবং সেখানকার মানুষের জীবনের টানাপোড়েনের বাস্তবচিত্র অঙ্কন করেছেন। শুধু কানাডার জীবনের কথা বললে ভুল হবে, এই গ্রন্থে লেখকের প্রবাসজীবনের চালচিত্রের মানুষের মানসিক পরিবর্তন চাওয়া-পাওয়ার আবেগীয় ও বাস্তবতার মন্ত্রজালে আবদ্ধ করেছেন। এই গ্রন্থের গল্পগুলোর মধ্যে নারীর প্রতি অবহেলা, পারিবারিক নির্যাতন, সসিংহতা, ভালোবাসাহীন যান্ত্রিক জীবনের কথাই অঙ্কিত হয়েছে। প্রতিটি গল্পই নির্মিত হয়েছে সরল আনুভূমিক ধারায় এবং দুই বা তিনটি চরিত্রের মনোজগতের মিথস্ক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে এবং দু-একটি গল্পে রয়েছে অবৈধ মিলনের শৈল্পিক প্রক্ষেপণ ও চরিত্র স্খলনের তীব্র মনোযাতনার আত্মপীড়ন, নীরব কান্না।
তিন.
‘অন্য কোথাও অন্য কোনোখানে’ দীর্ঘ গল্পের প্রথম প্যারাতেই একটি যান্ত্রিক জীবনের করুণ আর্তনাদের মতো ঝংকার দিয়ে ওঠে। শুরুটাও অসম্ভব নাটকীয়তায়—‘মিতুল এই দশ বছরের কানাডা-জীবনে তা আঁচ করতে পারেনি। কখন যে সকাল গড়িয়ে দুপুর; দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা; আবার সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতের আঁধার নেমে আসে; মিতুল বিন্দুমাত্র অনুভব করতে পারে না।’ মিতুল ও জামানের দাম্পত্যজীবন থেকে গল্পের বুনন শুরু হলেও এই দম্পতির মধ্যেই গাঁট বেঁধে থাকেনি। গল্পের ভাঁজে ভাঁজে প্রবাসজীবনের বাস্তব চিত্রসহ বাঙালি জীবনের বিভিন্ন দিক চিত্রিত হয়েছে। ফুটে ওঠে বাঙালির চিরচেনা সংস্কার, কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা এবং পরচর্চার প্রপঞ্চ।
পার্কেই হৃদি নামে আরেক স্বামীর ভালোবাসা বঞ্চিত ও অবহেলার শিকার নারীর সঙ্গে। শুরু হয় দুজনের মধ্যে হার্দিক যোগাযোগ। স্বামীর অবহেলার কারণেই প্রথম স্বামীকে তালাক দিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করে প্রেম করে এবং এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশে এসে মিতুলের সঙ্গে পরিচয় হয়।
স্বর্গভূমি কানাডার মোহে মিতুল ও জামানও সেখানে পাড়ি জমায়। প্রবাসজীবন শুরু হওয়ার পরেই তারা বুঝতে পারে বাংলাদেশের মতো জীবন এখানে এত সহজ নয়। শরীরের রক্তকে পানি করে, ঘাম ঝরিয়ে বাঁচতে হয় এখানে। এখানে মানুষকে বোঝার সময় নেই, ভালোবাসা আর আবেগের সুধাময় হাঁড়ি শূন্যতায় খাঁ খাঁ করে। ক্যারিয়ার আর বেঁচে থাকার চিন্তায় মন ও মননের সুকুমার বৃত্তিগুলো বৃন্তচ্যুত পাতার মতো শুকিয়ে ঝরে। সংগীতপ্রেমী, মুক্তমনা ও স্বাধীনচেতা মিতুল একটি কফিশপে কাজ করে দুটি মেয়েসহ সংসার সামলিয়ে জামানের ক্যারিয়ারের পথ প্রশস্ত করে দিলেও জামান নিজের ক্যারিয়ারের জন্য এতটাই মোহাচ্ছন্ন থাকে যেন নিজের পরিবারের দিকে ফিরে তাকানোরও সময় নেই। মিতুলের জীবনের সাধ-আহ্লাদের কথা না হয় বাদই দেওয়া যাক, কিন্তু তাই বলে কি মেয়ে দুটির জন্য সামান্য সময় দেওয়া যায় না? অ্যাসাইনমেন্টের পর অ্যাসাইনেমেন্ট নিয়ে মগ্ন হয়ে নাক ডুবিয়ে থাকার জন্যই মিতুল একদিন উপলব্ধি করতে থাকে তার ভেতরের অসহ্য নিঃসঙ্গতা। ঝিমিয়ে পড়া মিতুল নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি পেতে মাঝে মাঝে পার্কে গিয়ে একাকী সময় কাটায়। পার্কেই হৃদি নামে আরেক স্বামীর ভালোবাসা বঞ্চিত ও অবহেলার শিকার নারীর সঙ্গে। শুরু হয় দুজনের মধ্যে হার্দিক যোগাযোগ। স্বামীর অবহেলার কারণেই প্রথম স্বামীকে তালাক দিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করে প্রেম করে এবং এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশে এসে মিতুলের সঙ্গে পরিচয় হয়।
একদিন বিবাহবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে হৃদির বাসায় পরিচয় হয় শাহেদের। কবিতা ও সংগীতপ্রেমী, মুক্তমনা, যৌবন ও বুদ্ধিদীপ্ত শাহেদের দৃষ্টি পড়ে শ্যামাঙ্গিনী অপূর্ব সুন্দরী মিতুলের দিকে। এই দৃষ্টি বড় প্রখর, বড় তীব্র। হৃদি অনুভব করে শাহেদের কামুক দৃষ্টি শুভ নয় এবং মিতুলকে জানিয়ে দেয় শাহেদের চোখ পড়েছে তোমার দিকে। মিতুল শাহেদকে পাত্তা না দিলেও নানা কৌশলের ফাঁদে মিতুল আটকে যায়। দুজনের অগ্রসর চিন্তা, কবিতার প্রতি অমোঘ ভালোবাসা এবং শাহেদের মিষ্টি কথার রসায়নে হেরে যায় মিতুল এবং শাহেদের নৈকট্য লাভ করে। শুধু নৈকট্যই নয়; বরং বলা যায় হেরে যাওয়ার চূড়ান্ত বিপর্যয়ও ঘটে মিতুলের। একদিন লং ড্রাইভে গিয়ে এক হোটেলের কক্ষে নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করে মিতুল। এই গল্পের ক্লাইমেক্স বলতে মূলত শাহেদের কাছে মিতুলের শরীরকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করা। কিন্তু লেখক এই যৌনতার বর্ণনা করেছেন অত্যন্ত শৈল্পিকভাবে, ‘এই দ্বিপ্রহরে অগাধ আকাশ হতে অঝোরে ঝরছে সোনালী সুরধারা, উদার পৃথিবী কাঁপছে, দুলে দুলে ফুলে ফুলে উঠছে পুলকিত মিতুলের তনু। শাহেদ এখন বন্দি মিতুলের বাহুবন্ধনে। রুদ্রবীণা বেজে উঠলো সপ্তম সুরে, সাগরসংগীতে মিতুল ডুবে গেল ক্ষীণ তটিনীর মতো, ত্রিভুবন ব্যাপ্ত হলো তাল-লয়ের সরসমন্বয়ে, নেই কোনো নিবৃত্তি নেই কোনো বিরাম। কম্পিত মিতুল-শাহেদ স্তম্ভিত সময়ের পাটাতনে। সুর লহরী লয়ে শাহেদ জেগে ওঠে আর মিতুল স্রোতস্বিনীর মতো স্তব্ধ হয়ে পড়ে থাকে। সকল কোলাহল থামলো বটে; কিন্তু মিতুলের নীরব বুকে আচমকা দাউদাউ করে জ্বলে উঠল অক্ষয় অনল।’
আকাশের স্ত্রী কবির বই উপহার দেয়, উপহার দেয় রজনীগন্ধা। এখানেই গল্পটি শেষ হতে পারত, কিন্তু লেখক তা করেননি। তিনি রিকশাচালক শাহাতদকেও সপরিবারে হাসপাতালে উপস্থিত করালেন এবং তার সন্তানদের লেখাপড়ার দায়িত্ব নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন।
মিতুল হয়তো শাহেদের অবাঞ্ছিত পীড়াপিড়িতে, কিংবা মুক্তমনের শাহেদের প্রেমে পড়ে আকণ্ঠ ডুবে হয়তো অসাবধানতায় নিজেকে মেলে দিয়েছে কিন্তু পরক্ষণই সে দারুণভাবে মর্মাহত হয় এবং রন্ধ্রে রন্ধ্রে বয়ে যেতে থাকে ক্লেদাক্ত যন্ত্রণার প্রবাহ। এ-কারণেই ফিরতি পথে শাহেদের সঙ্গে কোনো কথা বলেনি কিংবা কথা বলার মতো মানসিক অবস্থাও তার ছিল না। তুমুল ঝড়ে লণ্ডভণ্ড মিতুল দিশেহারা। লেখকের ভাষায়, ‘রাতে বাঁধভাঙা ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়লো জামানের বুকে। চিৎকার করে কান্না শুরু করে দিলো। জামান কোনো কিছু না বুঝে; মিতুলের এহেন আচরণে ভয় পেয়ে যায়। সজোরে মিতুলকে বুকের মাঝে চেপে ধরে। কী হয়েছে মিতুলের? মিতুল শুধু চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে বলছে, আমাকে অন্য কোথাও নিয়ে যাও, অন্য কোনোখানে।’
চার.
‘রোদেলা’ গল্পটি দীর্ঘ। প্রবাসী রোদেলার জীবনের ভার্চুয়াল প্রেমের আখ্যান নিয়ে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি রচিত। গল্পে ছায়া পড়েছে রোদেলার ব্যক্তিসত্তার স্বাধীনচেতনার, আত্মনির্ভরশীলতার ও কবিতাপ্রেমের। অন্যদিকে পারিবারিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতার ছায়াও প্রতিভাত হয়েছে বড় ভাই, মা ও ভাবির চরিত্র চিত্রণের মাধ্যমে।
গল্পটি নির্মাণ কৌশলে লেখক আশ্রয় নিয়েছেন এক রিকশা ভ্রমণের। গল্পের নায়িকা নিউ ইউর্ক থেকে তার ভার্চুয়াল অর্থাৎ ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচিত এক কবির সঙ্গে দেখা করার জন্য ঢাকায় এসেছে। রোদেলা কবিতাপ্রেমী—কবিতার ভালোবাসায় তার আত্মকথনে প্রচ্ছন্নভাবে প্রকাশ পায় কবির প্রতি দুর্বলতা। ভালোবাসতে চায় কোনো অচেনা ও অদেখা কবিকে। আর এই কবির সঙ্গে দেখা করার জন্যই সুদূর আমেরিকা থেকে দেখা করার উড়ে আসে। কবির প্রতি দুর্বলতা থাকলেও এর আগেও প্রতারিত হওয়ার আভাস মিলে গল্পে। লেখকের ভাষায়, ‘কবিতা পড়তে পড়তে কবিদের বিড়ম্বনায় বেশ কয়েকবার পড়েছেও রোদেলা। কারণ, কবির কবিতায় কিবাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। কবিকে যখন দেখা হয় তখন কবিতা বোঝা যায় না। কবিতা হয়ে যায় অন্তঃসারশূন্য এক পরিখা, তাতে শুধু তলিয়ে যাওয়া হয়; কবিকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। কবি এবং কবিতার মাঝে বিস্তর পার্থক্য দেখে রোদেলা বিস্ময় প্রকাশ করে! কবি কেমন হবে বা হওয়া উচিত; রোদেলা তা বলতে পারবে না। তবে কবিতার মতো যে কবি নয়; তা বেশ বুঝতে পারে।’
রোদেলা কি এমন কোনো কবির সন্ধান করে যার নেই জাগতিক কোনো মোহ নেই। কবিকে কি রোদেলা মানবের অধিক অতি মানব বা অন্য কিছু কল্পনা করে কবির প্রেমে পড়ে! হয়তো এমনই তার অনুভূতিতে সৃষ্টি হয় মহাপ্রাণের মহত্তম প্রেমের কোনো অবিনাশী সূত্র। অন্যথায় কেন তার কল্পজগতে বাসা বাঁধে, ‘কবিতার কবিকে দেখা হয় এক সাধারণ মানুষরূপে। যার ভেতরে আছে নিদ্রা ক্ষুধা সহবাস; আর আছে লোভ লালসা ঘৃণা পরশ্রীকাতরতা দাম্ভিকতা, আরো আছে আত্মপ্রচারণা, পদ-পদবি, পাওয়ার হুঙ্কার। এ সবের ঊর্ধ্বের আছে কোন কবি? যাকে শুধু কবিতার আদলেই ভাবা যায়, ভালোবাসা যায় কবিতার দেবতা রূপে!’
রোদেলা একদিন সারা দিন ঘুরে বেড়ায় রিকশায়, রিকশাচালককে নিয়ে একসঙ্গে খায়, ঢাকা শহরকে চিনে নতুন করে, চিনে বুড়িগঙ্গাকে। রিকশাচালক শাহাদতের সঙ্গে গড়ে উঠে সখ্য। বড় ভাই, মা ও ভাবি সবাই মিলে হুজুর টাইপের একজনের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার জন্য মরিয়া যার সঙ্গে মতাদর্শগত দিক থেকে রয়েছে বৈপরীত্য। কিন্তু ভার্চুয়াল জগতের আকাশ নামের কবি রোদেলার হৃদয় জুড়ে বসে আছে। পরিবারের সঙ্গে তার বিপর্যয় ঘটে চরম পর্যায়ে এবং এক ঝড়ো রাতে রোদেলা ছাদের উপর গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং তাকে খুঁজে পায় পরের দিন।
গল্পটি শেষ হয় নাটকীয়ভাবে। রোদেলার অসুস্থতার খবর পেয়ে সেই আকাশ নামের কবি যার কবিতা ও কথার টানে সুদূর আমেরিকা থেকে দেখা করার জন্য এসেছিল সেই কবি হাসপাতালে রোদেলাকে দেখতে আসে সপরিবারে। রোদেলা বিস্মিত হয় আকাশের স্ত্রী ও কন্যাকে দেখে। আকাশ কোনো দিন বলেনি যে সে বিবাহিত। আকাশের স্ত্রী কবির বই উপহার দেয়, উপহার দেয় রজনীগন্ধা। এখানেই গল্পটি শেষ হতে পারত, কিন্তু লেখক তা করেননি। তিনি রিকশাচালক শাহাতদকেও সপরিবারে হাসপাতালে উপস্থিত করালেন এবং তার সন্তানদের লেখাপড়ার দায়িত্ব নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন।
পাঁচ.
দশটি গল্প নিয়েই এই ক্ষুদ্র পরিসরে আলোচনা করা সম্ভব নয় বিধায় অতি সংক্ষেপে অন্যগুলোর সারকথা তুলে ধরছি। মূর্ত মরণ-মায়া গল্পটিতে অবিশ্বাসের অন্তরালে পারিবারিক সহিংসতা ও পুরুষের পৈশাচিক নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েছে স্ত্রী। এই গল্পেও স্ত্রীর প্রতি স্বামীর ঔদাসীন্য, সংসারের প্রতি দায়িত্বহীনতা এবং অহেতুক অবিশ্বাসের পরিণতিতে স্ত্রীকে হত্যা করে স্বামী। কানাডার প্রবাসজীবনের কর্মব্যস্ততা, যান্ত্রিকতা, কাছে থেকেও দূরে থাকার মতো ঘটনার ব্যঞ্জনা রয়েছে। সমুদ্র সৈকতে একাকী ঘুরে বেড়ানোর সময় তৃতীয় ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হওয়া এবং সেই তৃতীয় ব্যক্তির উপযাজকতা আলপনার জীবনে নেমে আসে অন্তহীন স্তব্ধতা ও গাঢ় অন্ধকার। গল্পটির শেষটিতে লেখক দীর্ঘশ্বাসের রেশ রেখে যান, ‘পরের দিন প্রকৃতির নিয়মে ভোর হলো ঠিকই, তবে পৃথিবীটা আজ অন্যরকম। চারদিক এখন শান্ত, নিথর ও নিস্তব্ধ। গম্ভীর করুণ বন্দনায় কেঁপে ওঠে স্তম্ভিত আকাশ। স্তব্ধ পৃথিবী অকান্ত সুরে নিগূঢ় নির্মম মন্ত্রের শেষ শ্লোক বাজায় একাকী উৎসাহে […]।’
পারিবারিক জীবনে মনস্তাত্ত্বিক সংকট থাকলেও পরিবারের বন্ধনের প্রতিও মমত্ববোধ, মানবিকতা এবং সামাজিক মূল্যবোধের রসদ রয়েছে প্রতিটি গল্পে।
ভিন্ন স্বাদের গল্প ‘নীল বিড়ম্বনা’ প্রবাস জীবনের অন্য রকম একটি ছবি চিত্রিত হয়েছে। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র রাকা নির্ঝঞ্ঝাট পরিবারে সাদাসিধে জীবন যাপনে অভ্যস্ত। কিন্তু তাকে টার্গেট করে বাংলাদেশে এক কণ্ঠশিল্পী যিনি বাংলাদেশ বেতারে গান করতেন। সখ্য গড়ে তোলে বিভিন্ন কৌশলে। এভাবে সম্পর্ক গড়ে তোলার পেছনে কোনো কারণ ছিল কি না তা শিল্পের কারণে লেখক উন্মোচন করেননি। রাকাকে এক প্রকার ফাঁদে ফেলে কথিত কণ্ঠশিল্পী যিনি কানাডায় সেলিব্রিটি তাকে নিয়ে একদিন বের হন। গাড়ি ড্রাইভ করছে স্বামী, জোর করেই স্বামীর পাশের সীটে বসতে দেওয়া হয় রাকাকে। মাঝ পথে একটি জরুরি কিছু কেনার কথা বলে কণ্ঠশিল্পী মিসেস শরীফ গাড়ি থেকে নেমে গেলে মি. শরীফ রাকার গায়ে হাত দেয়। রাকা তীব্র প্রতিবাদ করে গাড়ি দরজা খুলে নেমে দৌড়ে বাঁচে। পরে পুলিশের সহায়তায় বাসায় ফিরে আসে।
‘অবিমিশ্র কান্না’ ও ‘নিঃসঙ্গ সবুজ পাসপোর্ট’ গল্প দুটিতে মাতৃভূমির প্রতি মমতা এবং বিদেশের প্রতি মোহ ভাঙার সুর ঝংকৃত হয়েছে। ‘অবিমিশ্র কান্না’ গল্পে অবৈধভাবে কানাডায় প্রবেশের পর জীবন কতটা দুর্বিষহ হতে পারে নিখুঁত ছবি অঙ্কিত হয়েছে। এমন অবৈধ্য অভিবাসীদের বিড়ম্বনা, কষ্ট, ক্লেদ আর তীব্র যন্ত্রণায় গল্পের মূল চরিত্র আলমের মুখে শুনতে পাওয়া যায়… “আলমের চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে, মাথা উঁচু করে যদি দেশ থেকে বের হতে না পারে তবে চোরের মতো কেন? কেন এভাবে অন্য দেশে এসে লুকিয়ে পালিয়ে থেকে নিজ দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে? এখানে অর্ধাহারে অনাহারে পালিয়ে লুকিয়ে থাকার চেয়ে নিজ দেশের আলোবাতাস খেয়ে মাথা উঁচু করে চলাটা কি শান্তির ছিল না?”
‘নিঃসঙ্গ সবুজ পাসপোর্ট’ দেশ প্রেম এবং হিন্দু-মুসলমান পাত্রপাত্রীর গোপন ও গভীর প্রেমের আলপনা আঁকা হয়েছে। এ প্রেমের দহন আছে কিন্তু নিষ্কৃতি নেই। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এই প্রেমের দহন চলবে। এই গল্পটি অবশ্যই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নির্মিত এবং পাত্র দেশ ছেড়ে কোথাও যাবে না এমন অঙ্গীকার রয়েছে।
‘নদীর বুকে জাদুবাস্তব এক সন্ধ্যায়’ গল্পটিতে যদিও প্রেমের নানা রকম দ্যোতনা রয়েছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই দ্যোতনায় যখন রাহীর শরীরের প্রতি প্রীতমের লালসার আচরণ প্রকাশ করে তখন রাহী নিজেকে সংযত করে এবং প্রীতমকে ত্যাগ করে। সমাজবাস্তবতার প্রেক্ষাপটে বর্তমান সময়ের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ভার্চুয়াল প্রেম এবং বিভিন্ন প্রলোভনে মেয়েদের ভোগ করে কলার খোসার মতো ফেলে দিয়ে ছেলেদের পালিয়ে যাওয়া মতো ঘটনা এখানেও ঘটতে পারত। কিন্তু লেখক সে কাজটি না করে এক প্রায় হেরে যাওয়া, প্রায় প্রতারিত হওয়ার ঘটনা থেকে নিজেকে ফিরিয়ে এনে ঋজু করে দাঁড় করিয়েছেন। মেয়েদেরও যে হেরে না গিয়ে ঋজু হয়ে দাঁড়াবার শক্তি আছে, তারাও যে প্রতিবাদ করতে পারে, তারাও যে নিজেকে রক্ষা করতে পারে শেষ গল্পটিতে লেখক তারই স্বাক্ষর রেখেছেন।
ছয়.
‘সবুজ পাসপোর্ট ও অন্যান্য নিঃসঙ্গ গল্প’ বইটিতে যেসব গল্প স্থান পেয়েছে তা গল্পের চরিত্রগুলোর একার নয়, ব্যক্তিক নয় বরং বলা যায় সমস্টিক রূপের নিপুণ হাতে গড়া নিখুঁত ছবি। গ্রন্থকার নিজে কবিতা লিখেন, কবিতা ও কবিদের প্রতি মমত্ব বোধ থাকাটাই স্বাভাবিক এবং কবিতার প্রতি মমত্ববোধ এবং গল্পের কাব্যসঞ্জাত ভাব ও আবেশ কয়েকটি গল্পে সহজাত হিসেবে নির্মিত হয়েছে। জীবন সহজ কোনো কবিতার খাতা নয়, জীবন হলো সংগ্রামের ইতিবৃত্ত, আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার নিরন্তর লড়াইয়ের মাঠ এবং মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখার পাঠ। এই পাঠ উন্নত বিশে^র জীবনযাপন থেকে হারে হারে টের পাওয়া যায়।
আঞ্জুমান রোজীর আলোচ্য গ্রন্থের গল্পগুলোর প্রতিটিতে রয়েছে অন্তর্দর্শন। মানুষ হিসেবে বাঁচার জন্য চিন্তার স্বাধীনতা, চিন্তার বিকাশ, কুসংস্কার থেকে মুক্ত থেকে শিরদাঁড়া ঋজু রেখে আত্মপ্রত্যয় ও আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচার মন্ত্রজাল রয়েছে। পারিবারিক জীবনে মনস্তাত্ত্বিক সংকট থাকলেও পরিবারের বন্ধনের প্রতিও মমত্ববোধ, মানবিকতা এবং সামাজিক মূল্যবোধের রসদ রয়েছে প্রতিটি গল্পে।
রোজীর গল্পের ভাষা ঝরঝরে এবং একটানা অবসাদহীন দীর্ঘ সময় পড়া যায়। বাক্য গঠনের ব্যাপারে সতর্ক এবং প্রায় নির্ভুল বানানে বইটি মুদ্রিত হয়েছে। কম্পিউটারে বদলের কারণে এই বইটিতে মাঝে মাঝে শব্দ জড়িয়ে গেছে বলে মনে হয়েছে। পরবর্তী সংস্করণ হলে এই জড়িয়ে যাওয়া শব্দগুলোর সংশোধন করা হবে বলে আশা করতে পারি।