[পর্ব-১৯]
আল মাহমুদের ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’ পড়ার পর আমার ভেতর বিপুল পরিবর্তন এসে গেলো। যেন দুরন্ত ঢেউয়ের ওপর আছড়ে পড়লো বিশাল সাম্পানের গলুই। আর অমনি সে ঢেউ ফণা নামিয়ে নিমিষেই স্রোতহীন-নিস্তরঙ্গ জলরাশিতে পরিণত হয়ে গেলো। কোনো উথাল-পাথাল করা স্বভাব নেই। শান্ত-ধীর তার গতি। আগের মতো তেমন দৌড়ঝাঁপ করি না। স্কুল থেকে ফিরেই দ্রুত খাওয়া-দাওয়া শেষ করি। এরপরই পুকুর পাড়ে বসি। প্রায় কিছুই করি না। ধ্যানমগ্ন থাকি। ক্লাসের বইয়ের মধ্যে ইংরেজি-গণিত ছাড়া বাদবাকি সব বই একসপ্তাহের মধ্যে পড়া শেষ। ওইসব তো আর পড়তে ইচ্ছা করে না। ‘যেভাবে বেড়ে উঠি‘তে আল মাহমুদ পাঠাগার থেকে বই ধার নিয়ে পড়ার কথা বলেছেন। কিন্তু আমাদের এখানে পাঠাগার কোথায়? চৌরাস্তা বাজারে তো কোনো পাঠাগার নেই। দিনে-দিনে আমার পাঠস্পৃহা যত বাড়ে, তত বইয়ের শূন্যতার জন্য হাহাকারও বাড়ে। কিন্তু এই অব্যক্ত হাহাকারের কথা কাউকে বোঝাতে পারি না। নিজেই তো বুঝি না—বিপুল এই বিশ্বসংসারে আমার আসলেই কিসের অভাব?
কাকার একটি ট্রাভেল ব্যাগ কাঠের আলমারির ওপর প্রায় পড়ে থাকে। ধুলো জমলে সপ্তাহে একদিন ঝাড়মোছ করি। একদিন সকালে ঘর ঝাড়মোছ শেষে যথারীতি ব্যাগটা হাতে নিলাম। বেশ ভারী। চেইনে কোনো তালা নেই। চাইলেই টান দিয়ে খুলে দেখতে পারি। কিন্তু এক ধরনের ভয় কাজ করে। কিছুক্ষণ ভাবার পরই চেইন টান দিলাম। আরে, এখানে তো কাপড়-চোপড় কিছুই নেই। আছে কয়েকটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। আর কিছু দৈনিক পত্রিকা। আছে সেবা প্রকাশনীর ‘রহস্য পত্রিকা’। সঙ্গে ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের কয়েকটি বই। রকিব হাসানের ‘তিন গোয়েন্দা’। আমাকে আর পায় কে। প্রথমে দৈনিক পত্রিকাগুলো হাতের নিলাম। একটি পত্রিকার ভেতরের দুটি পাতা বেশ অলঙ্করণ করা। তাতে কয়েকটি কবিতাও রয়েছে। সেখানে অন্যান্য কবির পাশে আছে আল মাহমুদের কবিতাও। আমার আনন্দ আর ধরে না। তার মানে দৈনিক পত্রিকার সঙ্গে সাহিত্য পাতাও থাকে। সেখানে গল্প-প্রবন্ধসহ অন্যান্য লেখার সঙ্গে কবিতাও প্রকাশিত হয়! গুপ্তধন পাওয়ার আনন্দে আত্মহারা।
সমাজের আর দশটি কিশোরের আচরণের সঙ্গে আমার আচরণ মেলে না। তারা যে স্বরে কথা বলে, আমি সেই ভঙ্গিতে পারি না। কেমন যেন দিনে দিনে শামুকের মতো নিজের ভেতর গুটিয়ে যাচ্ছি।
স্কুল থেকে ফিরে আগের মতো আর আড্ডা দিতে যাই না। কাছারি ঘরে বসে সেবাপ্রকাশনীর বইগুলো সব পড়ে শেষ করি। ‘রহস্য পত্রিকা’র শেষের দিকে একটি বিজ্ঞাপন দেখতে পাই। তাতে গ্রাহক চাঁদার কথা উল্লেখ আছে। আরও আছে কিশোরদের জন্য আলাদা একটি পত্রিকার প্রচ্ছদের ছবি। নামও ‘কিশোর পত্রিকা’। আছে মূল্য ও বার্ষিক চাঁদার হারও। পত্রিকার নিয়মিত মূল্য সম্ভবত ৫টাকা। আর ডাকমাশুলসহ বার্ষিক চাঁদা ৪৫ টাকা।
তখন দাদা লন্ডন ছিলেন। বাড়িতে মাসে একটি করে চিঠি আসতো তার। কাকার নামে। ডাকপিওন এসে দিয়ে যেতেন। একদিন ডাকপিওনকে বললাম, আমি মানি অর্ডার করতে চাই। আপনি আমাকে একটি ফরম এনে দেবেন? তিনি বলেন, ‘না।তোকে পোস্ট অফিসে যেতে হবে।’ পরদিন ছিল বৃহস্পতিবার। আক্তার মিয়ার হাটের হাটবার। বাজার আনতে হবে। তাই দুই ভাই গেলাম। সঙ্গে নিলাম দশ জোড়া নারিকেল। জোড়া ৬/৭ টাকা করে বিক্রি করলাম। ৬০ বা ৬৫ টাকার নারিকেল বিক্রি করে তেল-লবণ-পেঁয়াজ-রসুন কিনলাম। নিজের সঙ্গে কিছু টাকা ছিল। সবমিলিয়ে আরও ৫০ টাকার মতো হলো। গেলাম পোস্ট অফিসে। পোস্ট অফিসের ভেতরে যিনি বসে আছেন, তাকে দেখেই চমকে উঠলাম। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে করতে পারলাম না কে এই পোস্ট মাস্টার! কিন্তু সালাম দিতেই তিনি বললেন, ‘আরে আয় আয় ভাইগনা। বাজারে আইছস? এতক্ষণ সোহেলও ছিল। বাজার নিয়ে বাড়ি চলে গেছে। আরেকটু আগে এলে তো তোদের দেখা হইতো।’
সোহেলের নাম বলার পর মনে পড়ে গেলো, আরে পোস্ট মাস্টার তো আমাদের খালু। সোহেলের বাবা। ভেতরে ঢুকে দাঁড়িয়ে আছি। তিনি মনোযোগ দিয়ে একটি বাসি পত্রিকা পড়ছিলেন। আমাদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন, ‘কী হইছে বোস। কিছু খাইবি?’ বলি, ‘না। একটা জ-জ-জরুরি কাজে আইছি। তা-তা-তা-তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যামু।’
কাজ কী জানতে চাইলেই তার দিকে ৪৫ টাকাসহ ঠিকানা দিয়ে বলি, ‘মা-মা-মানি অর্ডার করমু।’তিনি মনোযোগ দিয়ে ঠিকানা দেখলেন। বললেন, ‘কোন বই কিনবি, সেটা এককর্নারে লিখে দে। না হলে তারা টাকা পাবে ঠিকই, কিন্তু তোর বই পাঠাবে না।’ আমি বিস্তারিত খুলে বলি। তখন তিনি আগের ফরমটি ছিঁড়ে ফেলে নতুন করে একটি ফরম নিজেই পূরণ করে দেন। বলেন, ‘স্বাক্ষর দে’। তার কথামতো স্বাক্ষর দিয়ে চলে আসি। একমাস না যেতেই নিয়মিত ‘কিশোর পত্রিকা’ আমার নামে আসতে থাকে। ডাকপিওনসহ বাজারের অনেকেই আমার দিকে অবাক চোকে তাকিয়ে থাকে। কী ব্যাপার! এত্তটুকুন পোলার কাছে মোটা খামে কী আসে এত?
কাকার আনা বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার ভেতর থেকে নিয়ে সাহিত্যপাতা পড়ি। গোগ্রাসে গিলি বিভিন্ন সাপ্তাহিক পত্রিকার ফিচার, গোয়েন্দা-থ্রিলার কাহিনী। এসব পড়ে পড়ে ততদিনে আমার মনের মধ্যে অন্যভুবন তৈরি হয়ে গেছে। সমাজের আর দশটি কিশোরের আচরণের সঙ্গে আমার আচরণ মেলে না। তারা যে স্বরে কথা বলে, আমি সেই ভঙ্গিতে পারি না। কেমন যেন দিনে দিনে শামুকের মতো নিজের ভেতর গুটিয়ে যাচ্ছি।
এরই মধ্যে সাহিত্যপাতা পড়ার আজব এক সন্ধান পেয়ে গেলাম। চৌরাস্তা বাজারে তখন ধনু কাকাদের মুদি কাম কাপড়ের দোকান। সেখানে তাকের ওপর নতুন-পুরনো দৈনিক পত্রিকার বান্ডিল। খুচরা পণ্য বিক্রির সময় এই কাগজের টুকরো দিয়ে মুড়িয়ে দেন খায়ের কাকা। খায়ের কাকা হলেন ধনু কাকার পঞ্চম ভাই। তারা মোট ছয় ভাই। ধনু কাকা সবার ছোট। তার বড় এই খায়ের কাকা। তো তিনি আমাকে বেশ প্রশ্রয় দিতেন। আমিও সেই সুযোগ নিয়ে পুরনো পত্রিকাগুলো ঘাঁটতে থাকতাম। মাঝে মাঝে পেয়ে যেতাম অসম্ভব সুন্দর অলঙ্করযুক্ত সাহিত্যপাতা। তখন দৈনিক পত্রিকা বলতে ইত্তেফাক, মিল্লাত, সংবাদ ও ইনকিলাবের পুরনো সংখ্যা পাওয়া যেতো। আমাদের তল্লাটে কেউ পত্রিকা পড়ার মতো ছিলেন না। ব্যতিক্রম কাকা, কাকার বন্ধু খালেকুজ্জামান চৌধুরী। কাকা আবার বছরের নয় মাসই থাকতেন চট্টগ্রাম। তিন-সাড়ে তিন মাস পর-পর আসতেন। বাড়িতে থাকতেন হয়তো তিন-চার দিন। আবার চলে যেতেন। আসার সময় যথারীতি নিয়ে আসতেন নতুন নতুন বই-ম্যাগাজিন।
একবার তো ‘দস্যু বনহুর’ পড়ে এমন হয়েছে, বড় হয়ে বনহুর হবো। আবার বনহুরের ওপর মাঝেমাঝে মেজাজ খারাপ হতো। মতো নূরীর প্রতি তার টান কম। কখনো কখনো নিজেকে ‘মাসুদ রানা’ ভাবতেও ভালো লাগতো। তবে, সব ঢাকা পড়ে যেতো ম্যাকগাইভারের প্র্যাকটিক্যাল কাণ্ডকারখানার কাছে।
কাকা যতদিন বাড়িতে থাকতেন, ততদিন আউট বই পড়া একদম বন্ধ। স্কুল থেকে ফিরেই খাওয়া-দাওয়া। সন্ধ্যার আগে আগে মাঠ থেকে গরু নিয়ে আসা। এরপর কচুপাতা দিয়ে হারিকেনের চিমনি পরিষ্কার করা। এসব আমিই করতাম। হারিকেনের চিমনি সাধারণত অন্যরা পরিষ্কার করতেন শুকনো ন্যাকড়া জাতীয় কিছু দিয়ে। কিন্তু আমি ন্যাকড়া দিয়ে যতই ঘষাঘষি করতাম, সম্পূর্ণ পরিষ্কার হতোই না। স্থানে স্থানে আগের রাতের কালি লেগে থাকতো।
হঠাৎ একদিন ন্যাকড়া না পেয়ে কাছারির পেছন থেকে কচুপাতা ছিঁড়ে আনি। দেখি, সেই কচুপাতা ম্যাজিকের মতো কাজ করে। ঝকঝকে পরিষ্কার হয়ে যায় চিমনি। হারিকেনের চিমনি পরিষ্কার করে সলতে থেকে আগের রাতের পোড়া অংশ পরিষ্কার করি। এরপর হারিকেন জ্বালিয়ে পড়তে বসি।
আর কাকা চট্টগ্রাম চলে গেলে আমি মুক্তস্বাধীন। বিহঙ্গ। বুধবার এলেই রাত সাড়ে আটটায় হাজির হই চৌরাস্তাবাজারে। কামাল ডাক্তারের দোকানে। সাদাকালো টিভিতে ম্যাকগাইভার দেখি। ওই সিরিজটি কেবল দেখতামই না, অনেকেই ম্যাকগাইভারের বিভিন্ন কারিগরি কর্মকাণ্ড বেশ রপ্তও করে নিতাম। এই যেমন, ঘরে না থেকেও ঘরে থাকার প্রমাণ দেওয়ার জন্য দরজার ছিটকিনিতে সুতা বেঁধে বাইরে থেকে বন্ধ করে দেওয়া। আবার নাটক দেখে বা আড্ডা দিয়ে ফিরে এসে সুতা ধরে টান দিয়েই দরজা খুলে ঘরে ঢুকে যাওয়া। এতে বন্ধ দরজা দেখে সবাই ধরেই নিতেন আমরা ঘরের ভেতরেই আছি।
তখন হাটবারের বাইরে আরেক দিন—এই বুধবারেই বাজারে যেতাম ছোটরা। তাও ম্যাকগাইভার দেখার জন্যই। অন্যদিন থাকতাম বাড়িতে। রুটিনমাফিক পড়ার টেবিলে বসি বটে, কিন্তু ক্লাসের বই উল্টেও দেখি না। সারাক্ষণ ডুবে থাকি আউট বইয়ে। একবার তো ‘দস্যু বনহুর’ পড়ে এমন হয়েছে, বড় হয়ে বনহুর হবো। আবার বনহুরের ওপর মাঝেমাঝে মেজাজ খারাপ হতো। মতো নূরীর প্রতি তার টান কম। কখনো কখনো নিজেকে ‘মাসুদ রানা’ ভাবতেও ভালো লাগতো। তবে, সব ঢাকা পড়ে যেতো ম্যাকগাইভারের প্র্যাকটিক্যাল কাণ্ডকারখানার কাছে। কিন্তু প্রতিদিন তো আর ম্যাকগাইভার দেখা সম্ভব ছিল না। তাই আবারও সেই আউট বইয়ে আশ্রয় নিতাম।
আউট বই পড়তে পড়তে সেদিন এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেলো। একটি বিনোদন ম্যাগাজিনে পেয়ে গেলাম এক আজব ফিচার। বিষয় সুচিত্রা সেনের অভিনয় ও জীবন-যাপন। ইতোমধ্যেই মরিয়ম-আজাদদের কাছে বইয়ের (সিনেমার) কাহিনী ও নায়ক-নায়িকাদের নাম শুনে শুনে এই জগৎ সম্পর্কে অনেকটা ধারণা পেয়ে গেছি। সঙ্গে বিভিন্ন ম্যাগাজিনে নায়ক-নায়িকার ইন্টারভিউ, তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত ফিচার পড়ে পড়ে সেই ধারণা আরও কিছুটা পোক্ত হয়েছে। কিন্তু নিজে এখনো কোনো বই (সিনেমা) দেখার সুযোগ পাইনি। এই ম্যাগাজিনে সুচিত্রা সেন সম্পর্কে এক অদ্ভুত তথ্য দিলেন লেখক। তার লেখার সারমর্ম অনেকটা এমন—সুচিত্রা সেন পূর্ববঙ্গের (বাংলাদেশের) মেয়ে। গেছেন পশ্চিমবঙ্গে। করছেন অভিনয়। কিন্তু ভালো করে উচ্চারণ করতে পারেন না। তবে তিনি ছিলেন যেমন অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্না, তেমনি প্রত্যুৎপন্নমতিত্বেও অদ্বিতীয়া। অল্পদিনেই সংলাপ উচ্চারণের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠলেন এই মহানায়িকা। কিভাবে?
তারা ‘ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরির’ খেলা শুরু করেছে। আর তাতে কখনো কখনো রোদের আলো ঝিলিক দিয়ে যাচ্ছে রাসেলের চোখেমুখে। কখনো মেঘের ছায়া এসে ঢেকে দিচ্ছে সেই বিস্ফারিত দুটি চোখ।
খুবই সাধারণ কিন্তু ব্যতিক্রম তার সাধনা। সুচিত্রা সেন অন্যদের মতো স্বাভাবিক গতিতে সংলাপ উচ্চারণ করেন না আর। স্বাভাবিকের চেয়ে একটু ধীরে উচ্চারণ করেন। একইসঙ্গে হালকা চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলেন। তাতে তার উচ্চারণের দুর্বলতাটুকু যেমনি ঢাকা পড়ে গেলো, তেমনি নতুন একটি শৈলীরও জন্ম হলো। শিল্পবোদ্ধারা তার কথা বলার এই ভঙ্গিকে গ্রহণ করলেন প্রায় বিনা প্রশ্নে, বিনা তর্কে। হয়তো অনেকে ধরেই নিয়েছেন, সুচিত্রা সেন আজন্মই এভাবে কথা বলেন!
ওই ফিচার টানা বেশ কয়েকদিন পড়লাম। পড়তে পড়তে হঠাৎই আমার মাথায় বুদ্ধি খেলে গেলো—যেমন আমরা ম্যাকগাইভার দেখে দেখে, নানা রকম কুটবুদ্ধি মাথায় খেলে তেমনই। সুচিত্রা সেন যদি চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলে উচ্চারণের দুর্বলা দূর করতে পারেন, আমি কেন পারবো না? যদি দ্রুত ও ঘন কথা না বলি, খুব ধীরে কথা বলি, তাহলে কি তোতলামি থাকবে? বিষয়টি নিয়ে সারারাত ভাবি। কিন্তু কী করা যায়? মা-বাবা-ভাই—কারও সঙ্গেই এই ব্যাপারে পরীক্ষা করা যাবে না। করতে গেলেই তারা সবাই বিদ্রূপ করতে পারেন। এরচেয়ে নির্ভরযোগ্য—পাশের বাড়ির রাসেল। বাতেন মাঝির ছেলে।
পরদিন স্কুলে যাওয়ার সময় হলে রাসেল এসে হাজির। সে পড়তো ক্লাস ফোরে। ইসমাইলের ক্লাসমেট। কিন্তু চলতো-ফিরতো আমার সঙ্গে। কেবল আমার সঙ্গে চলতো-ফিরতোই না, ততদিনে সার্বক্ষণিক সহচরই হয়ে গেছে। সেদিন এসে শুরু করে হাঁকডাক—‘ভাইজ্জি চলেন। স্কুলের সময় হইছে।’
এখানে বলে রাখি, গ্রামের ছোটরা বড়দের সাধারণত ভাইছা বা ভাইয়া ডাকতো। কিন্তু রাসেল আমাকে সম্বোধন করতো ‘ভাইজ্জি’। এই সম্বোধন নোয়াখালীর গ্রামাঞ্চলের নয়, সন্দ্বীপের। আমাদের প্রতিবেশীদের মধ্যে বেশ কয়েকটি পরিবার ছিল সন্দ্বীপ থেকে আসা। একটি পরিবার কাকার বাড়িতেও তখন ছিল। তারা বছর পাঁচেক আগে নদীভাঙনে সর্বস্বান্ত হয়ে সন্দ্বীপ থেকে চরলক্ষ্মী আসে। কাকা সব শুনে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দেন।
সেদিন কী কারণে যেন ইসমাইল স্কুলে যায়নি। রাসেল আর আমি স্কুলের পথ ধরলাম। তবে, রাস্তা বাদ দিয়ে ধানক্ষেতের আল ধরে। রাসেল তো হতবাক। ঘটনা কী? রাস্তা ছেড়ে আল ধরে কেন? বলে—‘কী হইলো আইজ? রাস্তা বাদ দিয়ে আইল দিয়া কিল্লাই?’ আমিও এই প্রশ্নের অপেক্ষায়ই ছিলাম। বলি—‘তোর লগে জরুরি আলাপ আছে।’ কথাটা এমন ধীর লয়ে বলি যে, তোতলামির লেশমাত্র থাকে না তাতে। অনেকটা এভাবে—‘তো-র-ল-গে…জ-রু-রি…আ-লা-প…আ-ছে।’ আমার তোতলামিমুক্ত স্বাভাবিক-ধীর উচ্চারণভঙ্গিতে সে হতবাক। যেন বিস্ময়চিহ্নের মতো তার পথ আগলে দাঁড়িয়েছে রাস্তার পাশের বিশাল বটগাছটি। তার আর পা চলে না। সে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। তার তাকানো দেখে আমার মনে হতে থাকে—বাতাস থমকে গেছে। সূর্যের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে শরৎশেষের মেঘমালা। তারা ‘ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরির’ খেলা শুরু করেছে। আর কখনো রোদের আলো ঝিলিক দিয়ে যাচ্ছে, কখনো মেঘের ছায়া এসে ঢেকে দিচ্ছে রাসেলের বিস্ফারিত দুটি চোখ।
চলবে…
জীবনের যতিচিহ্নগুলো-১৮॥ মোহাম্মদ নূরুল হক